মিয়ানমারের প্রস্তাবে ‘কৌশল’ দেখছে বাংলাদেশ

মিয়ানমার সরকার ১৯৯২ সালের প্রত্যাবাসন চুক্তির আওতায় রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার যে প্রস্তাব দিয়েছে, তাকে ‘আন্তর্জাতিক চাপ প্রশমিত করার কৌশল’ হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Oct 2017, 09:08 AM
Updated : 13 Oct 2017, 01:32 PM

পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করে তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ অব্যাহত না থাকলে মিয়ানমার মূল সমস্যার সমাধানে উদ্যোগী নাও হতে পারে।

মঙ্গলবার ঢাকায় ‘রোহিঙ্গা সঙ্কট: বাংলাদেশ কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ ও পর্যালোচনা’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় এ কথা বলেন তিনি।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “রোহিঙ্গাদের আংশিক ফিরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব মিয়ানমারের উপর আন্তর্জাতিক চাপ প্রশমিত করার কৌশল হতে পারে। মিয়ানমার নিজস্ব যাচাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যোগ্য প্রত্যাবাসন প্রত্যাশীদের সংখ্যা সীমিত করার এবং নানা অজুহাতে কফি আনান কমিশনের সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নে বিলম্বিত করতে পারে।”

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমালোচনার মুখে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি গত মাসে পার্লামেন্টে দেওয়া ভাষণে বলেন, ১৯৯২ সালে করা প্রত্যাবাসন চুক্তির আওতায় ‘যাচাইয়ের মাধ্যমে’ বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রাখাইনের মুসলমানদের ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত রয়েছে তার দেশ।

সু চির দপ্তরের মন্ত্রী কিয়া তিন্ত সোয়ে চলতি মাসের শুরুতে ঢাকা সফরে এসে বাংলাদেশের মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকেও একই প্রস্তাব তুলে ধরেন।  

রাখাইনে কয়েকশ বছর ধরে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বসবাসের ইতিহাস থাকলেও  ১৯৮২ সালে আইন করে তাদের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতাই রোহিঙ্গাদের বর্ণনা করে আসছেন ‘বাঙালি সন্ত্রাসী’ ও ‘অবৈধ অভিবাসী’ হিসেবে।

সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের মুখে পালিয়ে আসা চার লাখের মত রোহিঙ্গা গত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে আছে। আর গত ২৫ অগাস্ট রাখাইনে নতুন করে দমন অভিযান শুরুর পর আরও পাঁচ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে।

বেশ কিছুদিন কূটনৈতিক আলোচনার পর ১৯৯২ সালে মিয়ানমারের সামরিক সরকার শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি  প্রত্যাবাসন চুক্তি করে, যেখানে রোহিঙ্গাদের ‘মিয়ানমার সমাজের সদস্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

ওই চুক্তির আওতায় মিয়ানমার সে সময় দুই লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৯ জন রোহিঙ্গাকে দেশে ফিরিয়ে নেয়। চুক্তি নির্ধারিত যাচাই প্রক্রিয়ায় আরও ২৪১৫ জন শরণার্থীকে সে সময় মিয়ানমার থেকে আসা বলে চিহ্নিত করা হলেও মিয়ানমার তাদের আর ফিরিয়ে নেয়নি।  

সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের ডেকে এক ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, যে প্রেক্ষাপটে ১৯৯২ সালের চুক্তির নীতিমালা ও যাচাইয়ের প্রক্রিয়াগুলো ঠিক করা হয়েছিল, বর্তমান পরিস্থিতি তার তুলনায় অনেকটাই আলাদা। সুতরাং ওই চুক্তি অনুসারে এবার রোহিঙ্গাদের পরিচয় শনাক্ত করার প্রস্তাব বাস্তবসম্মত নয়।

এ কারণে মিয়ানমারের মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার জন্য একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তির প্রস্তাব করে তার খসড়া হস্তান্তর করা হয়। সে বিষয়ে মিয়ানমারের জবাব এখনও বাংলাদেশ পায়নি।

মঙ্গলবার বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) মিলায়তনে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে গোলটেবিলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিলিতভাবে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে, যাতে সু চির এনএলডি সরকার রাখাইনে স্থিতিশীলতা সৃষ্টি ও জীবন যাপনের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে ইতিবাচক নীতি বাস্তবায়নের চেষ্টা করে এবং সামরিক বাহিনী নেতিবাচক কর্মকাণ্ড থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়।

“এবং তারা যেন বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে বাধ্য হয়, বাংলাদেশ সে লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।”

মাহমুদ আলী বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের দুটি দিক রয়েছে। প্রথমত, মিয়ানমারে মূল সমস্যার সমাধান এবং দ্বিতীয়ত বাংলাদেশ থেকে তাদের ফিরিয়ে নেওয়া। 

তিনি বলেন, প্রথম ক্ষেত্রে মূল সমস্যার সমাধান মিয়ানমারকেই করতে হবে। রোহিঙ্গাদের নাগরকিত্বসহ অন্যান্য অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বৈষম্যমূলক নীতির অবসান ঘটিয়ে তাদের স্বাভাবিক জীবন যাপনরে সুযোগ করে দিতে হবে। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের অপপ্রচার, ধর্মীয় বিদ্বেষ, উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে; ধর্মীয় ও জাতিগত সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনার জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে।

“আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় চাপ প্রয়োগ না করলে মিয়ানমার মূল সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হবে বলে মনে হয় না। নাগরিকত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত কমিশনের সুপারিশমালার পূর্ণ ও দ্রুত বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও তৎপর হতে হবে।”

সঙ্কটের দ্বিতীয় অংশে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়াকে ‘জটিল ও দীর্ঘমেয়াদী’ হিসেবে বর্ণনা করেন মাহমুদ আলী।

তিনি বলেন, “এ ব্যাপারেও মিয়ানমারকে মূল ভূমিকা পালন করতে হবে। সেখানে স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনের উপযোগী পরবিশে সৃষ্টি করতে হবে। নিরাপত্তা, সুরক্ষা ও জীবিকার নিশ্চয়তা না পেলে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যূত রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে আগ্রহী হবে না। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মিয়ানমারের উপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখতে হবে।”

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা এখন কেবল মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয় নেই। এটি এখন আঞ্চলিক সমস্যায় রূপ পেয়েছে।

“তাছাড়া এটি বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের দ্বিপক্ষীয় সমস্যা নয়। এ সমস্যার পেছনে বাংলাদেশের কোনো ভূমিকা নেই। সমস্যার সৃষ্টি ও কেন্দ্রবিন্দু মিয়ানমারে, সমাধানও সেখানে নিহিত।”

আন্তর্জাতিক মহলের নজরদারি ও সহযোগিতা ছাড়া মিয়ানমারকে দীর্ঘমেয়াদে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আগ্রহী রাখা ‘কঠিন হবে’ মন্তব্য করে মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ উপায়ে, বহুপক্ষীয়, আঞ্চলিক, দ্বিপক্ষীয় কূটনীতির মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধানের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে। এর এ কূটনৈতিক তৎপরতায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও সমর্থন রয়েছে।

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে কোন প্রস্তাব পাস না হলেও অন্যান্য শক্তির সহায়তা রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে আশাবাদী হতে চেয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।

গোলটেবিলের সমাপনী বক্তব্যে তিনি বলেন, “এই সংঘাতে মিয়ানমারকে ভরসা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও ইউরোপিয়ান কাউন্সিল। কিন্তু তারা এখন যে মুখী আছে, সেটা আমাদের পাশেই। সিকিউরিটি কাউন্সিলে প্রস্তাব আশা করি আসবে। এই তিনটি পক্ষের সহায়তায় আমরা সমাধান আনতে পারব।”

প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দ্রুততর সময়ে শুরুর পরামর্শ দিয়ে সাবেক বিএনপি নেতা ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মোবিন চৌধুরী বলেন, “প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হলে বাংলাদেশকে তাদের রেখে দিতে হতে পারে। আর সেটাই মিয়ানমারের মূল পরিকল্পনা। সরকার যে পদক্ষেপই নিক, সেটা যেন জাতিসংঘের গ্যারান্টি নিয়েই করে।”

কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালায় ‘সব কিছু’ না থাকলেও এটাকে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ‘ভালো মতো’ কাজে লাগানো যেতে পারে বলে মত দেন তিনি।

রোহিঙ্গাদের একটি অংশ কেন সরকারি উদ্যোগে নিবন্ধন করাতে চাইছেন না, সেই প্রসঙ্গে রামরুর চেয়ারপার্সন অধ্যাপক তাসনীম সিদ্দিকী বলেন, “রোহিঙ্গারা রোহিঙ্গা হিসাবে স্বীকৃতি চায়। এর সঙ্গে পুরাতন রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে প্রচার আছে রোহিঙ্গারা স্বীকৃতি না পেলে দেশে ফেরত যেতে পারবে না। সেজন্য তারা নিবন্ধন করাতে চাচ্ছেন না।”

এই প্রচারণার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানো এবং স্থানীয় এনজিওগুলোকে নিবন্ধন ও ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করার পরামর্শ দেন তিনি।

বিআইআইএসএস-এর গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান মুন্সি ফয়েজ আহমেদের সভাপতিত্বে গোলটেবিল বৈঠকে অন্যদের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সি এম শফি সামি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক সাহাব এনাম খান, সাবেক রাষ্ট্রদূত চৌধুরী খলিকুজ্জামান, পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক, রামরুর পরিচালক অধ্যাপক সি আর আবরার বক্তব্য দেন।