প্রধান বিচারপতির ছুটির ‘চিঠি’ সাংবাদিকদের দেখালেন আইনমন্ত্রী

প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার ছুটিতে যাওয়া নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার প্রেক্ষাপটে এক মাসের ছুটি চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো তার আবেদনটি সংবাদমাধ্যমের জন্য প্রকাশ করে দিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Oct 2017, 09:19 AM
Updated : 4 Oct 2017, 12:15 PM

বুধবার সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে আনিসুল হক রাষ্ট্রপতিকে লেখা প্রধান বিচারপতির ওই চিঠিটি প্রথমে পড়ে শোনান।

পরে টেলিভিশনের ক্যামেরার সামনে ওই চিঠি তিনি তুলে ধরেন এবং গণমাধ্যমকর্মীদের চিঠির ছবি তোলার অনুমতি দেন।

পরে আইন সচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হকের হাত থেকে সাংবাদিকরা প্রধান বিচারপতির ছুটির আবেদনের ছবি তুলে নেন।

প্রধান বিচারপতির স্বাক্ষরে রাষ্ট্রপতি বরাবরে লেখা ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে এর আগে তিনি দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন এবং গত বেশ কিছুদিন ধরেও বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন। বিশ্রামের জন্য ৩ অক্টোবর থেকে ১ নভেম্বর পর্যন্ত ৩০ দিন তিনি ছুটি কাটাতে চান।

ছুটি চেয়ে রাষ্ট্রপতিকে লেখা প্রধান বিচারপতির আবেদনের ছবি

 

গত অগাস্টে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর থেকেই ক্ষমতাসীনদের সমালোচনার মুখে রয়েছেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা।

সুপ্রিম কোর্টের অবকাশ শেষে মঙ্গলবার আদালত খুললে প্রধান বিচারপতির অপসারণের দাবিতে আন্দোলনের হুমকিও দিয়ে রেখেছিলেন আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরা।

কিন্তু তার আগেই সোমবার বিচারপতি সিনহার ছুটিতে যাওয়ার খবর আসে। সরকারের এক প্রজ্ঞাপণে বলা হয়, রাষ্ট্রপতি তার এক মাসের ছুটি মঞ্জুর করেছেন এবং এই সময়ে জ্যেষ্ঠ বিচারক মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞাকে প্রধান বিচারপতির কার্যভার দেওয়া হয়েছে।

সে অনুযায়ী মঙ্গলবার সকালে বিচারপতি ওয়াহহাব মিঞার নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়। অন্যদিকে বিএনপিপন্থিদের নেতৃত্বে থাকা সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ‘জরুরি সভা’ করে সরকারের বিরুদ্ধে চাপ প্রয়োগের অভিযোগ আনে।

আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন এক ব্রিফিংয়ে বলেন, “আপনারা জানেন, জাতি জানে, সারা পৃথিবীর মানুষ জানে, একটি জাজমেন্টের পরে তাকে একটি রাজনৈতিক দল, সরকার বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করছিল। আমরা মনে করি, সেই চাপের অংশ হিসেবে গতকাল তাকে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। তিনি ছুটিতে যাননি এবং তাকে বাধ্য করা হয়েছে।”

এর প্রতিক্রিয়ায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক মঙ্গলবারই বলেন, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের সঙ্গে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার ছুটিতে যাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই

“পূর্ণাঙ্গ রায়ের পরে পর্যবেক্ষণ দেওয়া বা সমালোচনা করা আমাদের অধিকার। আমরা সংক্ষুব্ধ পার্টি হিসেবে এই রায়ের বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেব, জাতীয় সংসদে সেটা প্রস্তাব আকারে পাস হয়েছে। সেখানে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছিল, সেটা পাস হয়েছে।

“সেই কারণে আমরা আইনি পদক্ষেপ নিশ্চয়ই নেব, তার সাথে মাননীয় প্রধান বিচারপতির অসুস্থতার কোনো নেক্সাস নাই। এর সাথে যদি কেউ কানেক্ট করতে চায় তো আমি মনে করব তাদের একটা দুরভিসন্ধি আছে।”

ছুটি শেষেই বিচারপতি সিনহা কর্মস্থলে ফিরবেন- এমন আশা প্রকাশ করে সেজন্য দোয়া করার কথাও বলেন আনিসুল হক।

আইন সচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হকের হাত থেকে প্রধান বিচারপতির আবেদনের ছবি নিচ্ছেন সাংবাদিকরা; পাশে আইনমন্ত্রী

‘প্রধান বিচারপতি বাসায়’

বুধবার প্রধান বিচারপতির চিঠি দেখানোর পর সাংবাদিকদের প্রশ্নে আনিসুল বলেন, তিনি যতদূর জানেন, প্রধান বিচারপতি তার বাসাতেই আছেন এবং তিনি অসুস্থ।

“আমি জেনেছি, গতকাল উনাকে ডাক্তার দেখতে গিয়েছিল। আজকেও ডাক্তার দেখতে যাওয়ার কথা আছে।”

অসুস্থতার জন্য ছুটি নিয়েও বিচারপতি সিনহা কেন হাসপাতালে ভর্তি হননি- এমন প্রশ্নে আইনমন্ত্রী বলেন, “হাসপাতালে কেন ভর্তি হননি, দ্যাট ইজ হিজ প্রবলেম। উনি কেন হাসপাতালে যান নাই তার কারণ তো আমি আপনাকে বলতে পারব না, এটা উনার বলার বিষয়।

“আমি শিগগিরই উনাকে দেখতে যাব, আমি ডাক্তারের ক্লিয়ারেন্সের জন্য অপেক্ষা করছি। ডাক্তারের সাথে আমার কথাবার্তা হচ্ছে, তাকে দেখতে যাওয়ার মত যখন অবস্থা হবে নিশ্চয়ই আমি তাকে দেখতে যাব।”

অসুস্থতা কখনও ‘স্বাভাবিক হয় না’ মন্তব্য করে আনিসুল বলেন, “উনি বলেছেন, ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত ছিলেন। আপনারা জানেন, আমিও জানি, ক্যান্সার থেকে সুস্থ হতে অনেক দিন লাগে এবং উনিও বলেছেন যে সেই ক্যান্সার থেকে উনার নানাবিধ জটিলতা হয়েছে।

“এখন তো আমি দেখছি যে উনি অসুস্থ হয়ে আমাকে বিপদে ফেলেছেন,” হাসতে হাসতে বলেন আইনমন্ত্রী।

প্রধান বিচারপতির ছুটি নিয়ে বিএনপি যে প্রশ্ন তুলেছে, সে বিষয়ে আইনমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া জানতে চান এক সাংবাদিক।

জবাবে তিনি বলেন, “এটা অত্যন্ত দুঃখের। পৃথিবীর সব জায়গায় অসুস্থতা মানুষের একটা ব্যক্তিগত ব্যাপার এবং এই ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে কথোপকথন নিয়ে প্রাইভেসিকে উৎসাহিত করা হয়, সেটাই হচ্ছে নিয়ম। এর পরেও তারা (বিএনপি) যখন এই বক্তব্য রেখেছেন, আমি বলতে চাই, তিনি অসুস্থ, এ নিয়ে রাজনীতির কিছু নাই।

আইনমন্ত্রী বলেন, সংবিধানে বলা আছে প্রধান বিচারপতি কর্মে অসমর্থ হলে আপিল বিভাগের প্রবীণতম বিচারপতিই হবেন অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি। এক্ষেত্রে নিয়মের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি।

“একজন অসুস্থ হয়েছেন, আসুন আমরা সকলে মিলে বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সুস্থতার জন্য দোয়া করি। এটাই আমাদের করা উচিৎ, এরকম একটা ইস্যু নিয়ে রাজনীতি করা নয়।… আমি বিএনপি নেতৃবৃন্দকে বলব, আসেন দোয়া করি উনি যেন সুস্থ হয়ে যান, দিস ইজ হোয়াট উই অল ওয়ান্ট।”

প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (ফাইল ছবি)

‘শূন্যতা সৃষ্টি হয়নি’

প্রধান বিচারপতি এক মাসের ছুটিতে যাওয়ার পর জ্যেষ্ঠ বিচারপতিকে সেই দায়িত্ব দেওয়ায় বিচারালয়ে কোনো শূন্যতা সৃষ্টি হয়নি বলে মন্তব্য করেন আইনমন্ত্রী।

“শূন্যতা হবে যদি সুপ্রিম কোর্টের বিচার ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায়, সেটা তো হয়নি। সুপ্রিম কোর্টে একজন অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব গ্রহণ করার পরে … দ্য হাই কোর্ট ডিভিশন অ্যান্ড দ্যা অ্যাপিলেট ডিভিশন আর ফাংশনিং প্রোপারলি,… দেয়ার ইজ নো ভ্যাকুয়াম।”

আইনমন্ত্রী জানান, ছুটি চেয়ে প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন পাঠানোর পর সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার অফিস থেকেও বিষয়টি তুলে ধরে সরকারকে অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি নিয়োগের কথা বলা হয়।

বর্তমান অস্থায়ী প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ মামলায় ‘আসামির পক্ষে রায় দেওয়ার নজির আছে’- একজন সাংবাদিকের এমন মন্তব্যের পর আইনমন্ত্রী বলেন, “যিনি প্রবীণতম বিচারপতি সংবিধান অনুযায়ী তাকেই অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি করতে হবে। যদি তিনি বিতর্কিতও থাকেন, সংবিধানে কিন্তু লেখা নাই তাকে করা যাবে না।”

আগাম মন্তব্যে ‘সাবধানী’

এক মাস ছুটি শেষে প্রধান বিচারপতি পদত্যাগ করতে পারেন কি না এবং ছুটি আরও বাড়ানোর আবেদন করতে পারেন কি না- এসব বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি আইনমন্ত্রী।

ছুটি শেষে প্রধান বিচারপতি পদত্যাগপত্র দিলে তখন সরকার তা কীভাবে সামাল দেবে- এ প্রশ্নে আনিসুল বলেন, “উনি এখনও পদত্যাগপত্র দেন নাই, এই স্পেকুলেশনের মধ্যে আমি যেতে চাই না। আমি আশা করি উনার অসুস্থতা এ রকম হবে না যে উনি পদত্যাগপত্র দেবেন। আমি আশা করি উনি সুস্থ হয়ে উঠবেন।”

প্রধান বিচারপতি ছুটি বাড়াতে পারেন কি না- এই প্রশ্নে আইনমন্ত্রী বলেন, “আমি কোনো ব্যাপারেই স্পেকুলেট করতে রাজি না।”

বিচারপতি সিনহা ছুটি নিয়ে ইতোমধ্যে বিদেশে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন বলে যে গুঞ্জন চলছে, সে বিষয়ে মন্ত্রীর বক্তব্য চান একজন সাংবাদিক। জবাবে আনিসুল বলেন, তিনি কিছু জানেন না।

এস কে সিনহা গৃহবন্দি- এমন অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করলে আইনমন্ত্রী জোর গলায় বলেন, “নিশ্চই না।”

প্রধান বিচারপতি ছুটি নিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন, নাকি ছুটি চেয়ে আগে আবেদন করেছেন- এ প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, “আমি তো মনে করি মাননীয় প্রধান বিচারপতি অত্যন্ত ভালো একটা কাজ করেছেন। তার কারণ হচ্ছে তিনি যদি নিজে নিজে ছুটি ওখান থেকে নিয়ে নিতেন, তখন আপনারা আমাদেরকে বলতেন আমরা জোর করেছি।

“তিনি তার ছুটি নিয়েছেন এবং যেটা নিয়ম… যখন রাষ্ট্রের একটা অঙ্গের প্রধান এ রকম একটা পরিস্থিতিতে যাচ্ছেন সেক্ষেত্রে তিনি যে পদক্ষেপ নিয়েছেন তার জন্য আমি তাকে ধন্যবাদ জানাই।”