প্রধান বিচারপতিকে প্রচণ্ড চাপে বাধ্য করা হয়েছে: অ্যাডভোকেট জয়নুল

প্রধান বিচারপতিকে ‘প্রচণ্ড চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে’ ছুটিতে যেতে বাধ্য করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Oct 2017, 08:43 AM
Updated : 3 Oct 2017, 05:00 PM

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধন বাতিলের রায় নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সমালোচনার মধ্যে থাকা বিচারপতি এস কে সিনহা ছুটিতে যাওয়ার পর মঙ্গলবার সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির ‘জরুরি সভা’ শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে এই দাবি করেন তিনি।

জয়নুল বলেন, “আমরা মনে করি, আমাদের আইনজীবী সমিতি মনে করে, তার (প্রধান বিচারপতির) ওপরে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে, তিনি যাতে এক মাসের জন্য ছুটিতে চলে যান।

“আপনারা জানেন, জাতি জানে, সারা পৃথিবীর মানুষ জানে, একটি জাজমেন্টের পরে তাকে একটি রাজনৈতিক দল, সরকার বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করছিল। আমরা মনে করি, সেই চাপের অংশ হিসেবে গতকাল তাকে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে।

“তিনি ছুটিতে যাননি এবং তাকে বাধ্য করা হয়েছে।”

প্রধান বিচারপতির ছুটিতে যাওয়া এবং উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে রাষ্ট্রপতির সাক্ষাত চাইতে পারে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা। সভাপতি জয়নুল আবেদীন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান, সম্পাদক মাহবুব উদ্দিন খোকন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব।

এদিকে আইনজীবী সমিতির এই অভিযোগ নাকচ করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ষোড়শ সংশোধনের রায়ের সঙ্গে প্রধান বিচারপতির ছুটিতে যাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, প্রধান বিচারপতির ছুটি নিয়ে প্রশ্ন তুলে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা করছেন বিএনপি সমর্থকরা।

বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফেরাতে আনা হয়েছিল সংবিধানের ওই সংশোধন। তা বাতিল করে জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ফিরিয়ে আনে আদালত।

গত অগাস্টে ষোড়শ সংশোধনের বাতিলের রায় হওয়ার পর তাতে সংসদ, সরকার ও বঙ্গবন্ধুকে খাটো করা হয়েছে বলে অভিযোগ তোলেন আওয়ামী লীগ নেতারা।

সুপ্রিম কোর্টের অবকাশ শেষে প্রধান বিচারপতিকে অপসারণের দাবি আন্দোলনে নামার হুমকিও ছিল আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীদের। তবে খোলার দিন থেকেই এক মাসের ছুটিতে গেলেন প্রধান বিচারপতি।

প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা

এই সময়ে জ্যেষ্ঠ বিচারক মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা  প্রধান বিচারপতির কার্যভার পেয়েছেন। সে অনুযায়ী মঙ্গলবার সকালে বিচারপতি ওয়াহহাব মিঞার নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়।

জয়নুল আবেদীন বলেন, “প্রধান বিচারপতি কী কারণে এক মাসের ছুটি নিয়েছেন, তা জানার অধিকার আইনজীবী সমিতির আছে। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে অবশ্যই সাক্ষাৎ করতে হবে।

“এই বিচারাঙ্গনে কী ঘটেছে, প্রকৃত ঘটনা জাতি জানতে চায়। মানুষ যদি জানতে না পারে, তাহলে ভবিষ্যতে কোনো বিচারপতি কোনো বিচারক সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারবে না।”

এখানে ‘সরকারের হস্তক্ষেপ’ ঘটেছে দাবি করে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, অবকাশ শেষে সুপ্রিম কোর্টের রীতি অনুযায়ী আইনজীবীরা যেন ‘গেট টুগেদারে’ আসেন, সে বিষয়ে আগেই চিঠি দিয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। কিন্তু তিনি নিজেই ছুটিতে গেছেন বলা হচ্ছে।

“ইতিহাস বলে, কখনও কোনো প্রধান বিচারপতি দাওয়াত করে এভাবে ছুটি নিয়ে চলে যান নাই। আমাদের সেটা জানার দরকার আছে।”

জয়নুল আবেদীন বলেন, “কী কারণে, কী চাপে, কী জন্য তিনি ছুটি নিয়েছেন এবং সকালে এই প্রাঙ্গণে এসেও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সঙ্গে কোনো কথা না বলে কেন তিনি সুপ্রিম কোর্ট ত্যাগ করেছেন- সেটা আমাদের সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির জানার অধিকার আছে।”

এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি ফজলুল করিমের উদাহরণ টানেন সমিতির সভাপতি।

“তিনিও এইভাবে দাওয়াত করে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি হাঁটতে পারছিলেন না, তিনি স্ট্রেচারে করে এসে আইনজীবীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। আর এখন এমন কী ঘটনা ঘটেছে যে কারণে আজকে এই প্রধান বিচারপতি উপস্থিত থাকতে না পেরে ছুটি নিয়ে চলে গেলেন?”

প্রধান বিচারপতি ছুটিতে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে মঙ্গলবার জরুরি সভায় বসে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটি।

সংবাদ সম্মেলনে সমিতির সম্পাদক মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, হঠাৎ করে মাননীয় প্রধান বিচারপতি ছুটি নেওয়ায় দেশব্যাপী একটা আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে।

“তার পরিপ্রেক্ষিতে আজকে আইনজীবী সমিতির কার্যকরী কমিটির জরুরি সভা হয়। সেই সভায় অনেকগুলো সিদ্ধান্ত হয়েছে। আমরা মনে করি, রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বিচার বিভাগে একটি নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হচ্ছে।”

সভাপতি জয়নুল আবেদীন বলেন, আইনজীবী সমিতির ১৪ সদস্যের মধ্যে ১৩ জনই সকালের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এবং সেখানে ঐকমত্যের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনের আগে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ মিছিল করেন বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা। তারা স্লোগানে বলেন, প্রধান বিচারপতিকে ছুটিতে যেতে ‘বাধ্য করা হয়েছে’।

সকালে সংবাদ সম্মেলনের পর বিকালে কয়েকজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর সঙ্গে বৈঠক করেন সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন।

সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে বিক্ষোভে বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা

সাবেক স্পিকার মুহম্মদ জমিরউদ্দিন সরকার, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি খাদেমুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী, সমিতির সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মইনুল হোসেন, সাবেক আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদ, গিয়াস উদ্দিন আহমেদ এই বৈঠকে ছিলেন।

আওয়ামী লীগ আমলের সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান, গণফোরাম নেতা সুব্রত চৌধুরীও এই বৈঠকে ছিলেন।

বিকালের বৈঠকের পর জয়নুল আবেদীন সাংবাদিকদের বলেন, “সকালে আমাদের একটি কার্যকরি সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে সিনিয়র আইনজীবীদের নিয়ে আমরা একটি সভা করব। তারই আলোকে বিকালে আমরা একটি সভা করেছি।

“এটি নিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারি কি না, তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। আমরা তার সাক্ষাৎ চাইব।”

তিনি বলেন, “আলোচনায় উপস্থিত প্রত্যেকেই বলেছেন, প্রধান বিচারপতির আকস্মিক ছুটিতে যাওয়ার বিষয়টি সকলকে মর্মাহত করেছে এবং এটি বিচার ব্যবস্থার জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক। এটা এমনকি সরকারের জন্যও মঙ্গলজনক নয়।”

এই বিষয়টি নিয়ে আইনজীবী সমিতি দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে কাজ করতে চায় জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের একটি বৃহত্তর ঐক্য দরকার। আমরা আগামীকাল আবার বসব।”