অপহরণ নয়, ফরহাদ মজহার স্বেচ্ছায় গেছেন: আইজিপি

পুলিশ মহা পরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক বলেছেন, তদন্তে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে তাদের মনে হয়েছে, ফরহাদ মজহার স্বেচ্ছায় খুলনা গিয়েছিলেন, অপহরণের কোনো ঘটনা সেখানে ঘটেনি।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 July 2017, 10:17 AM
Updated : 13 July 2017, 07:40 PM

বৃহস্পতিবার ঢাকায় পুলিশ সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে তদন্তের এই অগ্রগতির তথ্য তুলে ধরেন তিনি।    

আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে ফরহাদ মজহার তার অন্তর্ধানের বিষয়ে যা বলেছেন, তার সত্যতা নিয়ে আগেই সন্দেহ প্রকাশ করেছিল পুলিশ। বরং ফরহাদ মজহারের ‘ভক্ত’ হিসেবে পরিচয়দানকারী অর্চনা রানির বক্তব্যের সঙ্গে তদন্তে মিল পাওয়ার কথা জানানো হয়েছিল পুলিশের পক্ষ থেকে।

কেন ফরহাদ মজহারের বক্তব্য নিয়ে সন্দেহ, সেই কারণগুলো তুলে ধরে আইজিপি শহীদুল হক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “এ পর্যন্ত তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে আমরা যতটুকু পেয়েছি, উনি অপহৃত হননি, উনি স্বেচ্ছায় গেছেন।”

ফরহাদ মজহার গত ৩ জুলাই ভোরে ঢাকার শ্যামলীর রিং রোডের বাসা থেকে বেরিয়ে ‘অপহৃত’ হন বলে তার স্ত্রী ফরিদা আখতারের অভিযোগ। পুলিশ মোবাইল ফোন ট্র্যাক করে অনুসন্ধান শুরুর পর সেই রাতেই যশোরে হানিফ এন্টারপ্রাইজের একটি বাসে ফরহাদ মজহারকে পাওয়া যায়।

পরদিন গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ফরহাদ মজহার বলেছিলেন, ভোরে ওষুধ কেনার জন্য তিনি বাসা থেকে বের হলে কয়েকজন একটি মাইক্রোবাসে করে তাকে তুলে নিয়ে যায়।

আর ফরিদা আখতারের অভিযোগের ভিত্তিতে আদাবর থানায় নথিভুক্ত মামলায় বলা হয়, ফরহাদ মজহার তার ফোন থেকে স্ত্রীকে পাঁচবার কল করে বলেন, অপহরণকারীরা ৩৫ লাখ টাকা চেয়েছে।

ফরহাদ মজহার অন্তর্ধান নিয়ে সব মহলে আলোচনার মধ্যে গত ১০ জুলাই ঢাকার আদালতে অর্চনা রানি নামে ওই নারীকে নিয়ে আসে পুলিশ।

নিজেকে ফরহাদ মজহারের শিষ্য দাবি করে এই নারী জবানবন্দিতে বলেন, সেদিন ফরহাদ মজহার তার জন্য অর্থ জোগাড় করতেই বেরিয়েছিলেন এবং টাকাও পাঠিয়েছিলেন।

আইজিপি বলেন, “ফরহাদ মজহার সেদিন স্ত্রীর সাথে দশবার এবং আরেকটি মোবাইলে (অর্চনা রানি) ছয়বার কথা বলেছেন। তার কাছ থেকে ওই মোবাইলে একটি এসএমএসও এসেছে।”

পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক (ফাইল ছবি)

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, দ্বিতীয় নম্বরটির সূত্র ধরে তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে, ওই ফোনের মালিক ঢাকার ভাটারায় আছেন। পরে মোবাইল ট্র্যাক করতে গিয়ে দেখেন, ফোনের মালিক চট্টগ্রামে চলে গেছেন।

“পরে জানতে পারি,  তিনি একজন নারী। তিনি ফরহাদ মজহারের পূর্ব পরিচিত। তাদের মধ্যে ওইদিন (অন্তর্ধানের দিন) কথোপকথন হয়। পরে আমরা তার জবানবন্দি রেকর্ড করাই।”

আইজিপি বলেন, ৩ জুলাই সকালে ফরিদা আখতার যখন থানায় লোক পাঠিয়ে অভিযোগ জানান, ফরহাদ মজহারের অবস্থান তখন ছিল আরিচা ঘাটের পরে। মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের ওই তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ তখন আরিচার পর থেকে সব মাইক্রোবাসে তল্লাশি শুরু করে। কিন্তু কোনো মাইক্রোবাসে তাকে পাওয়া যায়নি।

সেদিন বিকাল ৪টা থেকে ৬টা পর্যন্ত খুলনা নিউ মার্কেট এলাকায় ফরহাদ মজহারের চলাফেরার সিসিটিভি ভিডিও পাওয়ার বিষয়টিও সংবাদ সম্মেলনে জানান শহীদুল হক।

তিনি বলেন, ওই নারীকে ফরহাদ মজহার রকেটের মাধ্যমে দুই দফায় মোট ১৫ হাজার টাকা পাঠান। আর স্ত্রীর সঙ্গে তার কথোপকথনের রেকর্ডও পুলিশের হাতে আছে।

“তাই আমাদের কাছে এ পর্যন্ত প্রতীয়মান হচ্ছে, উনি অপহৃত হননি, উনি স্বেচ্ছায় গেছেন। আমার মনে হচ্ছে, উনি বাসে করে খুলনায় গিয়েছিলেন, কারণ আমরা মাইক্রোবাস তল্লাশি করেছি।”

ফরহাদ মজহার কেন অপহরণের ঘটনা সাজাবেন- উত্তরে শহীদুল হক বলেন, “ফরহাদ মজহার উনার স্ত্রীকে বারবার বলেছেন, টাকা পেলে ছেড়ে দিবে, টাকা সংগ্রহ কর।

“ঘটনার পূর্বে তার আচরণ আর ঘটনার পরে তার আচরণ দেখলেই বোঝা যায়। ঘটনার পূর্বের ওই নারীর সঙ্গে কথোপকথনে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা আর ঘটনার পর উনাকে ভালোবাসে সরকার বিরোধীরা।”

“ফরহাদ মজহারের ঘটনার পরের আচরণগুলো এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যে ধরনের বক্তব্য দিয়েছে, এতে ধারণা হয় সরকারকে বিব্রত করা বা বিপাকে ফেলা আর কিছু টাকা হাতিয়ে নেওয়া। এছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্য পাই না।”

ফরহাদ মজহারের অন্তর্ধান নিয়ে নানা ধরনের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় শহীদুল হক বলেন, “সরকারকে জড়িয়ে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জড়িয়ে, প্রতিবেশী দেশ ও প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা সংস্থাকে জড়িয়ে অনেকে কথাবার্তা বলেছে। যেগুলোর আমাদের জানা মতে কোনো ভিত্তি নাই। আমরা মনে করি দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য।”

নানা বক্তব্যে মানুষের মনে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে বলে বিষয়টি স্পষ্ট করতে এই সংবাদ সম্মেলন বরে দাবি করেন তিনি।

“কিন্তু আমরা পুলিশ কাজ করি বস্তুগত তথ্যের ভিত্তিতে। তদন্তে তথ্য-উপাত্ত না পাওয়া পর্যন্ত আমরা সুনির্দিষ্ট কিছু বলে থাকি না। এজন্য আমরা সময় নিয়েছি। তদন্ত করতে গিয়ে একটা পর্যায়ে এসেছি। এখন আমরা মনে করছি এই জিনিসটা জনগণকে বলা উচিত।”

ফরহাদ মজহারকে আদালতে নেওয়ার বিষয়ে পুলিশ প্রধান বলেন, “অনেক গুণীজন, আইনজীবী তারা প্রশ্ন তুলছেন- ফরহাদ মজহারকে আইনজীবীদের সাথে পরামর্শ করার সুযোগ না দিয়ে আদালতে নেওয়া হয়েছে।

“আমি সেই আইনজীবীদের সাথে দ্বিমত পোষণ করে বলতে চাই, ফরহাদ মজহার তো মামলার আসামি না। তিনি মামলার ভিকটিম। তার পক্ষে রাষ্ট্র আছে, পুলিশ আছে। রাষ্ট্র যার পক্ষে থাকে, সেখানে উকিল নেওয়ার বিধান নেই। অন্য উকিল নিতে হলে আদালতের অনুমতি নিতে হয়।”

 

আদালতে অর্চনা রানির দেওয়া বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশের পর থেকে ব্যাপক আলোচনা চলছে। এ নিয়ে ফরহাদ মজহারের সমালোচনা যেমন হচ্ছে, তেমনি নাটক সাজানো হচ্ছে বলেও দাবি করছেন ডানপন্থি এই অধিকারকর্মীর সমর্থকরা।

নিজেকে বাউলভক্ত ফরহাদ মজহারের ‘ভক্ত’ ও ‘সেবাদাসী’ দাবি করে তাকে ‘গুরুবাবা’ সম্বোধন করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন অর্চনা।

জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ২০০৬-০৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে ফরহাদ মজহারের এনজিও উবিনীগে যোগ দেন তিনি। ফরহাদ মজহারের কাছে ‘ফকির ও বৈষ্ণব আদর্শে’ দীক্ষা নেওয়ার পর তার ‘সেবাদাসী’ হন।

ঈশ্বরদীতে থাকার সময়ে ফরহাদ মজহারের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে দাবি করে ওই নারী বলেন, ২০০৯ সালে সেই সম্পর্ক ফরিদা আখতার জেনে ফেলায় উবিনীগের চাকরি হারাতে হয় তাকে। তবে ফরহাদ মজহার তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন ও টাকা দিয়ে সহায়তা করতেন।

ওই নারী জবানবন্দিতে বলেন, একাধিকবার শারীরিক সম্পর্ক হওয়ার পর প্রায় দুই বছর আগে তিনি ‘অন্তঃস্বত্বা হলে ফরহাদ মজহারের টাকায়’ মালিবাগের একটি ক্লিনিকে গর্ভপাত করান। আবার ‘গর্ভবতী’ হলে গত এপ্রিল মাসে তিনি ফরহাদ মজহারের কাছে টাকা চেয়েছিলেন।

“০৩/০৭/২০১৭ ইং তারিখ সকাল ৬টা ২০ মিনিটে গুরুবাবা ফোন করে আমাকে জানান, তোমার টাকা সংগ্রহের জন্য বাহির হয়েছি। চিন্তা করো না। ০৩/০৭/১৭ ইং তারিখ সকাল ১১টায় আমি গুরুবাবাকে মোবাইল ফোনে জিজ্ঞাসা করি, আপনি অপহৃত হয়েছেন কি না? তিনি আমাকে বলেন, কোনও সমস্যা নাই। আমি ভালো আছি।

“এরপর সন্ধ্যা ৭টার দিকে গুরুবাবা আমাকে মোবাইল করে একটি অ্যাকাউন্ট নম্বর চান। তখন আমি তাকে অ্যাকাউন্ট নম্বর পাঠাই। তিনি আমাকে দুটি নম্বর থেকে ১৫ হাজার টাকা পাঠান। আমার কাছে জিজ্ঞাসা করেন, টাকা পেয়েছি কিনা? আমি বাসায় এসে মোবাইল ফোন চেক করে টাকা পাওয়ার কথা জানাই।”

নীল চেকের লুঙ্গি ও সাদা পাঞ্জাবি পরা ফরহাদ মজহার ঢাকায় পুলিশ হেফাজতে, এই পোশাকেই তাকে যশোরে দেখার কথা জানান বাসে তার সহযাত্রী শাহরিয়ার পলক

জবানবন্দিতে অর্চনা বলেছেন, ৪ জুলাই চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার গিয়েছিলেন তিনি। ৯ জুলাই ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ তাকে ঢাকা নিয়ে আসে। পরে বাসা থেকে মোবাইল ফোন ও একটি ডায়েরি নিয়ে যায়।

কিন্তু আদালতে জবানবন্দি দেওয়ার পর থেকে অর্চনা নিরুদ্দেশ। কোনো ঠিকানায় তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। রাঙ্গুনিয়া থেকে নিয়ে এলেও এখন পুলিশ কর্মকর্তারাও তার কোনো খবর জানেন না বলে দাবি করেছেন।

৭০ বছর বয়সী ফরহাদ মজহার গত ৪ জুলাই আদালতে জবানবন্দি দেওয়ার পর থেকে বারডেম হাসপাতালে রয়েছেন। তার স্ত্রী ফরিদাও রয়েছেন স্বামীর সঙ্গে।

অর্চনা রানিসহ পুলিশের নানা বক্তব্যের বিষয়ে কথা বলতে চাইলে ফরিদা আখতার বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা নিয়ে আমরা কোনো কথা বলব না।”