নাটকীয়ভাবে যশোরে মিলল ফরহাদ মজহারের হদিস

ঢাকা থেকে নিখোঁজ হওয়ার ১৮ ঘণ্টা পর মধ্যরাতে যশোরে একটি বাস থেকে ফরহাদ মজহারকে নাটকীয়ভাবে উদ্ধারের কথা জানিয়েছে র‌্যাব।

লিটন হায়দারসুবীর রায় ওবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 July 2017, 04:34 PM
Updated : 5 July 2017, 03:03 PM

সোমবার সকালে ফরহাদ মজহারের পরিবার অপহরণের অভিযোগ করার পর মোবাইল ফোন ট্র্যাক করে খুলনা অঞ্চলে অবস্থান শনাক্তের কথা জানিয়ে ওই অঞ্চলে অভিযান চালাচ্ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

এই অভিযানের মধ্যে রাত সাড়ে ১১টার দিকে যশোরের নওয়াপাড়ায় ঢাকাগামী একটি বাসে তাকে পাওয়ার কথা জানান র‌্যাব-৬ এর অধিনায়ক খন্দকার রফিকুল ইসলাম।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নওয়াপাড়ায় পাওয়ার পর ফরহাদ মজহারকে প্রথম অভয়নগর থানায় নেওয়া হয়। সেখান থেকে তাকে খুলনায় আনা হয়েছে। রাত দেড়টার দিকে তাকে ঢাকার পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

উদ্ধারের তিন ঘণ্টা আগে ফরহাদ মজহারকে খুলনায় নিজের রেস্তোরাঁয় দেখার দাবি করেছিলেন ‘নিউ গ্রীল হাউস’র মালিক আব্দুল মান্নান।

খুলনার নিউ মার্কেটের সামনে এই রেস্তোরাঁটি। মান্নানের কাছে খবর পাওয়ার পর র‌্যাব জোর অনুসন্ধান শুরুর কথা জানায়।

র‌্যাব কর্মকর্তা রফিকুল বলেন, “ফরহাদ মজহার খুলনার শিববাড়ী মোড় থেকে রাত সোয়া ৯টায় হানিফ পরিবহনের একটি বাসে ঢাকা রওনা হয়েছিলেন।” 

শাহরিয়ার পলক নামে একজন নিজেও ওই বাসে ছিলেন দাবি করে তার ফেইসবুক পাতায় লিখেছেন, “খুলনা থেকে আসছি হানিফের বাসে করে! নোয়াপাড়ায় হঠাৎ করে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখা হল! সুপারভাইজার কোনো কথার উত্তর দিলো না। প্রায় ৪০ মিনিট পর ৩টি র‍্যাবের গাড়ি এসে তল্লাশি করলো, আর বাসের পেছনের সিট থেকে উদ্ধার হলো - নিখোঁজ কবি ফরহাদ মজহার.....।”

‘নিউ গ্রীল হাউস’র মালিক মান্নান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, রাত ৮টার দিকে তার রেস্তোরাঁয় ভাত খেয়েছিলেন ফরহাদ মজহার। 

“আমার হোটেলে ভাত, ডাল ও সবজি খেয়ে রাত ৮টার দিকে বের হয়ে যান তিনি। তার পরনে লুঙ্গি ও মাথায় সাদা কাপড় ছিল। তাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল।”

ফরহাদ মজহারকেই দেখেছেন, তা নিশ্চিত হলেন কীভাবে- এই প্রশ্নে মান্নান বলেন, “প্রথমে আমি তাকে চিনতে পারিনি, পরে টিভিতে তার ছবি দেখে চিনতে পারি। তখন আমি বিষয়টি র‌্যাবকে জানাই।”

খুলনার এই রেস্তোরাঁয় ফরহাদ মজহারকে দেখা গেছে বলে দাবি করেছেন এর মালিক আব্দুল মান্নান

র‌্যাব-৬ এর অধিনায়ক রফিকুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রেস্টুরেন্ট মালিক আব্দুল মান্নান রাত ১০টার দিকে বিষয়টি আমাদের জানায়। তখন তার খোঁজে অভিযান চালাই।”

রাতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ফরহাদ মজহারকে সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থায়ই পেয়েছেন তারা।

খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি দিদার আহম্মেদ বলেন, “একজন সুস্থ মানুষ যেভাবে জার্নি করে, সেভাবেই তিনি ছিলেন। তার সঙ্গে একটি ব্যাগ ছিল, গেঞ্জি ছিল। কিছু টাকাও ছিল। এমনকি মোবাইল চার্জার নিতেও ভোলেননি তিনি।”

কিন্তু র‌্যাব অপহরণেরে কোনো ইঙ্গিত পায়নি জানিয়ে তিনি বলেন, “একজন সুস্থ মানুষ যেভাবে জার্নি করে সেভাবেই উনাকে আমরা পেয়েছি। এতে করে অপহরণের বিষয়টি প্রমাণ হয় না। মনে হয় না এটা অপহরণ।”

ডানপন্থি অধিকারকর্মী হিসেবে পরিচিত কবি-প্রাবন্ধিক ফরহাদ মজহার সোমবার ভোরে ঢাকার শ্যামলীর রিং রোডে তার বাসা থেকে বের হওয়ার পরপরই অপহৃত হন বলে তার স্বজনরা পুলিশকে জানান।

তার সন্ধান মেলার পর স্ত্রী ফরিদা আখতার আদাবরের বাসায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “উনি যতক্ষণ না বাসায় আমাদের কাছে পৌঁছাচ্ছেন, ততক্ষণ উৎকণ্ঠা কাটছে না। তবে উনার সঙ্গে র‌্যাবের মোবাইল ফোনে আমার ‘অল্প একটু’ কথা হয়েছে। উনি বাসায় এসে পৌঁছালে উৎকণ্ঠা পুরোপুরি দূর হবে।”

তার দুই ঘণ্টা আগে রাত ১০টায় ওই বাসায় সাংবাদিকদের সামনে এসে স্বামীর খোঁজ না পেয়ে নিজের উৎকণ্ঠার কথা জানিয়েছিলেন ফরিদা। ফরহাদ মজহারকে উদ্ধারে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আহ্বানও জানিয়েছিলেন তিনি।

উদ্ধার পাওয়ায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, মানবাধিকারকর্মী, সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়সহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ফরিদা বলেন, “আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সচেষ্ট হলে সবকিছুই সম্ভব।”

ভোর থেকে নিখোঁজ

সোমবার রিং রোডের ভোর ৫টায় বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকে ফরহাদ মজহার নিখোঁজ বলে তার স্বজনরা আদাবর থানায় গিয়ে অভিযোগ জানালে পুলিশ অনুসন্ধানে নামে।

ফরিদা আখতার সাংবাদিকদের বলেন, ফরহাদ মজহার ভোরে লেখালেখি করেন। সাধারণত বের হন না। এদিন ভোরেও কম্পিউটারের সামনে স্বামীকে দেখেছিলেন তিনি। কিছুক্ষণ পর দেখতে না পেয়ে খোঁজাখুঁজির মধ্যে একটি ফোন পান। তাতে ফরহাদ মজহার বলেন, তাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে, মেরে ফেলবে।

এরপর উদ্বিগ্ন হয়ে বিষয়টি পুলিশে জানায় পরিবার। তখন পুলিশ কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা রিং রোডের হক গার্ডেনের চার তলায় ফরহাদ মজহারের বাসায় যায়।

আদাবর থানার এসআই মহসিন আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ফরহাদ মজহার সকাল ৫টা ৫ মিনিটে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন বলে সিসিটিভি ভিডিও দেখে তারা নিশ্চিত হয়েছেন।”

ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাকে উদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছি। তবে বিষয়টি এখনও বেশ রহস্যজনক।”

আদাবর থানা থেকে তিনশ গজ দূরে ফরহাদ মজহারের বাসা। ওই বাড়ির দারোয়ান মো. আলি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তিনি ভোরে বাসা থেকে বের হয়ে হেঁটে ছোট ফটক দিয়ে বেরিয়ে সড়কে উঠতে দেখেছেন ফরহাদ মজহারকে।

তাকে কেউ উঠিয়ে নিয়ে গেছে, এমন কোনো দৃশ্য তার চোখে পড়েনি বলে জানান তিনি।

পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, শ্যামলী রিং রোড হক গ্যারেজের মোড় থেকে শ্যামলীর দিকে যেতে একটি হাসপাতাল রয়েছে। এই হাসপাতালের সামনে ওই সময় একটি মাইক্রোবাস ছিল। পরে সেটি আর দেখা যায়নি। সেই মাইক্রোবাসের সূত্র ধরে তাদের কাজ চলছে।

ওই হাসপাতালের সামনে পুলিশের একটি তল্লাশি চৌকিও রয়েছে।

বিকালে খুলনা এলাকায় ফরহাদ মজহারের মোবাইল ফোনের অবস্থান শনাক্ত করার কথা জানানো হয় পুলিশের পক্ষ থেকে।

খুলনার র‌্যাব কর্মকর্তা রফিকুল রাত পৌনে ৯টার দিকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিকাল সাড়ে ৫টা থেকে নগরীর সোনাডাঙ্গার ইব্রাহিম মিয়া সড়কের দুই পাশ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ওই এলাকার প্রতিটি বাড়িতে তল্লাশি চলছে।”

খুলনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বয়রা এলাকায়ও অভিযান চালানো হয়েছে, তবে সেখানেও তাকে পাওয়া যায়নি।

কারা ফরহাদ মজহারকে ধরে নিয়ে গেছে, সে বিষয়ে কোনো তথ্য পরিবারের সদস্যদের কাছে পাওয়া যায়নি। তবে একদিন আগে ভারতে মুসলিম হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে একটি কর্মসূচিতে তার যোগ দেওয়ার কথা বলেন তারা।

বিএনপি জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করে, সরকারের কোনো সংস্থাই ফরহাদ মজহারকে অপহরণ করেছে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনও ফরহাদ মজহারকে দ্রুত উদ্ধারে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়।

কবি-প্রাবন্ধিক ফরহাদ মজহার ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শাহবাগে গড়ে ওঠা গণজাগরণ আন্দোলনের সমালোচনামূলক বিভিন্ন বক্তব্যের জন্য আলোচিত।

শাহবাগের ওই আন্দোলনের বিরোধিতাকারী হেফাজতে ইসলামের পক্ষে বিভিন্ন সভা সমাবেশে বক্তব্য দিতেও দেখা যায় তাকে।

জাসদের প্রতিষ্ঠাতা তাত্ত্বিক সিরাজুল আলম খান দাদাভাইয়ের মামাত ভাই ফরহাদ মজহার নিজেকে মার্কসিস্ট হিসেবে পরিচয় দেন। তবে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সম্পৃক্ততা নিয়ে বাম দলগুলোর সমালোচনা রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের হরতালের মধ্যে সংবাদকর্মীদের ওপর হামলার প্রেক্ষাপট হিসেবে একুশে টেলিভিশনের ‘টকশো’তে বিভিন্ন গণমাধ্যমকে ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যায়িত করে গণমাধ্যমের ওপর হামলাকে ‘সঠিক’ বলে মন্তব্য করেছিলেন ৭০ বছর বয়সী ফরহাদ মজহার।

ওই সময় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে এক সভায় আরও কঠোর আন্দোলনে যাওয়ারও আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্মেসিতে পড়ার পর যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে অর্থনীতিতে ডিগ্রি নেন ফরহাদ মজহার। দেশে ফিরে তিনি উবিনীগ নামে একটি এনজিও গড়ে নয়াকৃষি আন্দোলন শুরু করেন।

চিন্তা নামে একটি পত্রিকার সম্পাদক দীর্ঘকেশী ফরহাদ মজহার সব সময় লুঙ্গি পরে থাকেন, যা নিয়েও রয়েছে আলোচনা।

ফোনে মুক্তিপণের আলোচনা

ফরহাদ মজহার অন্তর্ধাণের পর ফোন থেকে মুক্তিপণের কথা বলেছিলেন তা স্ত্রী ফরিদা আখতারকে।

নিখোঁজ হওয়ার আধা ঘণ্টার মধ্যে প্রথম ফোন পাওয়ার কিছু সময় পর দ্বিতীয় ফোন কল পান ফরিদা, তাতে মুক্তির জন্য মুক্তিপণের কথা স্বামী বলেছিলেন বলে ফরিদা জানান।

পরিবারের এক সদস্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিকাল পর্যন্ত ফরহাদ মজহারের ফোন থেকে ফরিদা আখতারের কাছে পাঁচবার ফোন এসেছিল।”

সর্বশেষ ফোনালাপে ১৫-২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ নিয়ে কথা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা টাকার বিষয়ে চিন্তা করছি না। সুস্থভাবে তার ফিরে আসাটাই মূল লক্ষ্য।”

ফরহাদ মজহারের অপহরণের বিষয়ে কথা বলছেন তার বন্ধু-স্বজনরা

অপহরণকারীরা প্রথমে ৩৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ চেয়েছিল বলে ওই স্বজন জানান।

পুলিশের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, সর্বশেষ রাত ৮টার দিকে ফরিদা আখতারের কাছে ফোন এসেছিল।

“৩৫ লাখ থেকে নেমে ২০ লাখ টাকা দিলে ছেড়ে দেওয়া হবে বলে ফোন করে জানায়। টাকা কোথায় দেওয়া হবে, কীভাবে দেওয়া হবে, সে বিষয়ে ফরহাদ মজহারের পরিবারের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু চূড়ান্ত কোনো কথা হয়নি।”

অনুসন্ধানে যুক্ত থাকা পুলিশ কর্মকর্তা ডিএমপির উপ-কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ফরহাদ মজহার যে আইফোনটি সচরাচর ব্যবহার করেন ভোরে বের হওয়ার সময় তা সঙ্গে নেননি।   

“তিনি গ্রামীণ নাম্বারের যে মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন এবং যে নম্বরটি সবার কাছে আছে সেটি বের হননি। এটি আইফোন। যে নাম্বারটি রবি নম্বারের এবং সাধারণ একটি সেটের, সেটা নিয়ে তিনি বের হয়েছেন। এই নম্বারটি সবার কাছে নেই।”

বিপ্লব বলেন, “এ নম্বর থেকে ফোন করার পর বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। যখন ফোন করার প্রয়োজন হয়, তখন আবার ফোনটি খুলছে।”

রাত ১০টার দিকে ফরিদাও সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ফরহাদ মজহার ফোন করলেও কেবল যোগাযোগ করা যাচ্ছিল, অন্য সময় ফোনটি বন্ধ থাকত।