সব দলকে নিয়েই ভোট করতে চান নতুন সিইসি

পূর্বসূরিদের ব‌্যর্থতা কাটিয়ে আগামী সংসদ নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলকে আনার লক্ষ‌্য ঠিক করেছেন নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা।

মঈনুল হক চৌধুরী জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Feb 2017, 12:09 PM
Updated : 16 Feb 2017, 12:47 PM

বৃহস্পতিবার চার নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে ইসি সচিবালয়ের সচিব ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরিচিতিমূলক প্রথম বৈঠকে নিজের এই লক্ষ‌্যের কথা তিনি জানান বলে বৈঠকে একাধিকজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন।

কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন কমিশনের বিদায়ের পর বুধবার শপথ নিয়ে দায়িত্ব নেয় নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন কমিশন। বৃহস্পতিবার সকালে তারা সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দেওয়ার পর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে যান তারা।

দশম সংসদ নির্বাচনে অধিকাংশ দল বর্জন করায় একাদশ সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাকে নতুন ইসির প্রধান চ‌্যালেঞ্জ মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

বৈঠকে নূরুল হুদা নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের উপর জোর দেন বলে ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

কর্মকর্তাদের আলোচনার সূত্র ধরে নতুন সিইসি বলেন, “এই বাংলাদেশ কতগুলো অত্যন্ত সফল নির্বাচন উপহার দিয়েছে, আর যে নির্বাচনগুলো বিতর্কিত ছিল, তা কেন বিতর্কিত ছিল, তা বিশ্লেষণে আমি যাব না।

“একটা কথাই বলতে পারি, আপনারা অনেকেই বলেছেন যে ইনক্লুসিভ নির্বাচন ছিল না বলেই বিতর্কিত ছিল।”

কর্মকর্তাদের কাছে নিজের মনোভাব তুলে ধরে তিনি বলেন, “নির্বাচন যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক না হয়; যদি সব দলের অংশগ্রহণ না থাকে, সেক্ষেত্রে নির্বাচন বিতর্কিত হবেই। সুতরাং আমরা আশা করব, সব দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে।”

বিএনপি ইতোমধ্যে নতুন সিইসির নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে; যদিও নূরুল হুদা তার কোনো ধরনের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ও পক্ষপাতের অভিযোগ নাকচ করে আসছেন।

নতুন সিইসি কে এম নূরুল হুদা (বুধবার প্রথম সংবাদ সম্মেলনে)

বৈঠকে তিনি বলেন, “আমার একটাই কথা, সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমরা কাজ করতে বদ্ধপরিকর।

“আমরা যারা সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার হিসাবে যোগদান করেছি, শপথ নিয়েছে, আমাদের একটাই কথা- দল মত নির্বিশেষে সব কিছুর ঊর্ধ্বে থেকে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করব।”

সমঝোতার সব চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার মধ‌্যে নৈরাজ্য-সহিংসতা এবং বিএনপি জোটের দশম সংসদ নির্বাচন বর্জনের পর আগামী সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে শঙ্কা এখনও কাটেনি।

বিএনপি প্রশ্ন তুললেও নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন কমিশনের অধীনে সংসদ নির্বাচনে না যাওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। দলটি বলেছে, নতুন ইসির ভূমিকা এবং নির্বাচনকালীন সরকার দেখে তারা সিদ্ধান্ত নেবে।

পরবর্তী নির্বাচন ঘিরে দেশবাসীর আগ্রহের কেন্দ্রে যে এখন নতুন ইসি, সে বিষয়ে নিজেও সচেতন সাবেক আমলা নূরুল হুদা।

“দেশে এ রকম আলোচিত ও সবার আগ্রহ আমাদের নিয়ে; অতীতে কখনও এমনটি হয়নি। সাধারণ মানুষ, দল, আন্তর্জাতিক সংস্থা সবার সবাই তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। আশা করি, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে পারব।”

এক্ষেত্রে ইসি কর্মকর্তাদের দায়িত্বশীলতাও স্মরণ করিয়ে দেন তিনি; তাদের উদ্দীপ্ত করতে এবং মনোবল বাড়াতে নানা নির্দেশনাও দেন তিনি।

ইসি সচিবালয় সার্বিক অগ্রগতি, কাজের পরিধি-কাঠামো ও পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে একটি ধারণাপত্রও নতুন সিইসি ও নির্বাচন কমিশনারদের সামনে তুলে ধরেন ইসি সচিব মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ।

কর্মকর্তাদের সাহসিকতা ও দৃঢ়তার উদাহরণ টেনে ২০১০ সালের চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তা জেসমিন টুলীর প্রসঙ্গ টানেন নূরুল হুদা।

“জেসমিন টুলী যখন চট্টগ্রামে একেবারে নিরপেক্ষতার সঙ্গে, দৃঢতার সঙ্গে প্রত্যয়ের সঙ্গে পরিচালনা করে সফল একটা নির্বাচন উপহার দিলেন। তখন দেশবাসী তার দিকে তাকিয়ে ছিল। সমস্ত মানুষ বলেছিল, কীভাবে সম্ভব? তাকে কিন্তু কেউ প্রভাবিত করতে পারেনি, বা তার সিদ্ধান্ত থেকে তাকে কোনো রকম কেউ বিব্রত বা বিচলিত করতে পারেনি। ইসির দক্ষতা সচিবালয়, মাঠ পর‌্যায়ের কর্মকর্তাদের সক্ষমতার বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ থাকার কোনো কারণ নেই।”

বুধবার ইসি কর্মকর্তাদের সঙ্গে নতুন কমিশনের সদস্যরা

ইসি কর্মকর্তাদের নির্ভয়ে দায়িত্ব পালনে অভয় দিয়ে তিনি বলেন, “যে দক্ষ জনবল রয়েছে তাতে বাংলাদেশে ভালো নির্বাচন উপহার দেওয়া সম্ভব হবে। শুধু একটা না, সামনে যেসব নির্বাচন আসবে তা দৃঢতার সাথে মোকাবেলা করব।”

মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তারা ভোটে অনিয়ম ঠেকাতে ব্যর্থ হলে ইসির ক্ষমতা নিয়ে পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেন নূরুল হুদা; যে ক্ষেত্রে কাজী রকিব কমিশনের ঘাটতি ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।

একজন নির্বাচন কমিশনারের কথা টেনে তিনি বলেন, “আমাদের অবস্থান জিরো টরারেন্স। কাউকে কোনো পর‌্যায়েই রেহাই দেওয়া হবে না। আমরা প্রাইভেটলি যে আলোচনা করেছি, তাতেও আমরা বলেছি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতার নির্বাচনি দায়িত্ব পালন করবো।”

ইসির সফল হওয়ার ক্ষেত্রে গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের সমর্থনের গুরুত্বও তুলে ধরেন তিনি।

“অংশীজনরা বলেছে-শুধু নির্বাচন কমিশনের উপরে দায়িত্ব চাপিয়ে দিলে ভালো নির্বাচন সম্ভব নয়। স্টেকহোল্ডার যারা আছে, তারা যদি সহযোগিতা না করে এবং অংশগ্রহণ না করে, তা হলে সম্ভব নয়।”

নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার নিজের বক্তব্যে ভারতের প্রসঙ্গ টেনে স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের কাজের স্বাধীনতার কথা বলেন বলে ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

মাহবুব তালুকদার (বুধবার শপথ অনুষ্ঠানে)

আমলা হিসেবে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ পেয়ে গর্ব বোধ করছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “ভারতে সুকুমার সেন ও টি এন সেসন দুই জনই আমলা ছিলেন। তারা ভারতের মতো এত বড় বৃহত্তর একটা গণতান্ত্রিক দেশে কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছেন। সেজন্য আমি যখন ভাবি- আমিও একজন আমলা ছিলাম, তখন তাদের কথা ভেবে অত্যন্ত গৌরব বোধ করি।”

একাদশ সংসদ নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে জাতির প্রত‌্যাশার পূরণের অঙ্গীকার করেন মাহবুব তালুকদার।

“সমগ্র পৃথিবীর দৃষ্টি এখন আমাদের দিকে। কেবল বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ নয়, পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ বাংলাদেশের নির্বাচনের দিকে, বিশেষ করে আগামী জাতীয় নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে।”

“সবার সম্মিলিত প্রয়াসে আগামী দিনগুলো উজ্জ্বল করে তুলব। আমাদের কাছে দেশবাসীর যে প্রত্যাশা তা আমরা পূরণ করব,” বলেন এই কথাসাহিত‌্যিক।

নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম ও শাহাদৎ হোসেন চৌধুরীও বৈঠকে বক্তব‌্য রাখেন।