চার ঘণ্টায় রাজধানীতে অর্ধশত জায়গায় আগুন দেওয়া হয়েছে, সারা দেশে ঝরে গেছে ডজনখানেক প্রাণ।
Published : 18 Jul 2024, 09:15 PM
সরকারি চাকরির কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিতে পথে পথে অবরোধ আর সংঘর্ষের মধ্যে বহু ভবনে আগুন দেওয়া হয়েছে, ঝরে গেছে দুই ডজনের বেশি প্রাণ।
দিনের প্রথম ভাগে ঢাকার উত্তরা, মেরুল বাড্ডা, মহাখালী, মিরপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের দফায়-দফায় সংঘর্ষ হয়। বিকাল থেকে একের পর এক ভবনে আগুন দেওয়ার খবর আসতে থাকে, যার অনেকগুলোই সরকারি ভবন।
সংঘাতে ঢাকার সড়কপথের যোগাযোগ ব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে সারাদেশের সঙ্গে রেল যোগাযোগ। দুপুরের পর মেট্রোরেলের মিরপুর অংশ বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর বিকাল সাড়ে ৫টার পর এ সেবা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
দুপুরে সংবাদ ব্রিফিংয়ে এসে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনার বার্তা দিয়ে আন্দোলন স্থগিতের আহ্বান জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। কিন্তু আন্দোলনকারীরা এখন বলছে, “আলোচনা ও গোলাগুলি এক সঙ্গে চলে না।”
উত্তরা
বেলা ১১টার দিকে উত্তরার জমজম টাওয়ারের সামনে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলের শিক্ষার্থীরা জড়ো হন। তারা মিছিল নিয়ে মূল সড়কে উঠতে চাইলে পুলিশ ও র্যাব তাদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। পরে সংঘর্ষ শুরু হয়।
কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. মিজানুর রহমান বিকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন পর্যন্ত চারজনের মরদেহ আমরা পেয়েছি। তাদের সবারই ঘটনাস্থলে মৃত্যু হয়েছে।”
তিনি নিহতদের নাম ও পরিচয় জানাতে পারেননি। তবে তিনি জানিয়েছেন তাদের একজনের বয়স ৪৫ বছর।
উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞ মাহমুদুল হাসান জানান, ৪০০ জনের বেশি আন্দোলনকারী আহত হয়ে তাদের হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।
মিরপুর
সকাল থেকেই মিরপুর ১০ নম্বরে দফায় দফায় পুলিশের সঙ্গে কোটা বিরোধীদের সংঘর্ষ চলছে। সকাল ১০টার দিকে মিরপুর টোলারবাগে ডেল্টা মেডিকেল কলেজ ও হাসাপাতাল এলাকার সড়কে জড়ো হওয়ার চেষ্টা করেন আন্দোলনকারীরা। পুলিশ ধাওয়া দিয়ে তাদের হটিয়ে দেয়।
সকাল ১১টার দিকে মিরপুর ১২ নম্বর বাসস্ট্যান্ডে জড়ো হওয়ার চেষ্টা করেন আন্দোলনকারীরা। ওই সময় পুলিশ তাদের ধাওয়া দিয়ে মিরপুর ডিওএইচএস এলাকার ভেতরে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে পুলিশ ও যুবলীগের সদস্যদের হাতে পিটুনির শিকার হন আন্দোলনকারীরা।
পরে ১০ নম্বর গোলচত্বরের পশ্চিম পাশে পুলিশকে লক্ষ্য করে আন্দোলনকারীদের ইট-পাটকেল ছুঁড়তে দেখা যায়। জবাবে পুলিশও সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। মিরপুর ও এর আশপাশের এলাকায় সব ধরনের দোকানপাট বন্ধ রয়েছে।
দুপুর সোয়া ১২টার পরে মিরপুরে ১০ নম্বর গোলচত্বর এলাকায় আন্দোলনকারীরা ধাওয়া দিয়ে পুলিশকে মিরপুর থানার দিকে নিয়ে যায়। আবার পুলিশ ধাওয়া দিয়ে আন্দোলনকারীদের মিরপুর ১০ নম্বরের দিকে নিয়ে যায়।
বেলা ১টার দিকে পুলিশ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা গোলচত্বরে অবস্থান নেন। আর আন্দোলনকারীদের অবস্থান ছিল গোলচত্বর থেকে কাজীপাড়ার দিকে আসতে আল-হেলাল হাসপাতালের সামনে। আন্দোলনকারীদের আরেকাংশের অবস্থান ছিল মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়ামের দিকে। তখন আন্দোলনকারীদের দিকে সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে পুলিশ।
বেলা দুইটার কিছু পরে মিরপুর ১০ নম্বরের একটি পুলিশ বক্সে আগুন দেওয়া হয়। বেলা পৌনে ৩টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়।
বেলা ৩টার দিকে ১০ নম্বর এলাকায় আন্দোলনকারীদের অবস্থান করে বিক্ষোভ করতে দেখা যায়। এ সময় তারা খণ্ড খণ্ড মিছিল করছিলেন, স্লোগান দিচ্ছিলেন। এ সময় ওই এলাকায় পুলিশ দেখা যায়নি।
মেরুল বাড্ডা
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে দুলাল মাতবর নামে এক মাইক্রোবাস চালক মারা গেছেন। বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রাস্তায় গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর দুলালকে রামপুরা বনশ্রীর ফরাজী হাসপাতালে নেওয়া হয়।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নের উত্তরে হাসপাতালের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার রুবেল হোসেন বলেন, ওই ব্যক্তিকে হাসপাতালে মৃত অবস্থায় নেওয়া হয়। সে কারণে তাকে ভর্তি নেওয়া হয়নি।
“আমাদের এটা প্রাইভেট হাসপাতাল। এখান থেকে ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়ার নিয়ম নেই। আর ওই সময় এখানে এত মানুষ আসছিল, আমরা তাদের সেবা দিতেই ব্যস্ত ছিলাম। খবর পেয়ে উনার আত্মীয়স্বজন এসেছেন। তারা মরদেহ নিয়ে গেছেন।”
এদিকে আফতাবনগরের ইম্পেরিয়াল কলেজের জনসংযোগ কর্মকর্তা মোর্শেদ আলম শিশির জানান, রামপুরায় তাদের প্রতিষ্ঠানের একাদশ শ্রেণির এক ছাত্র মারা গেছে। নিহতের নাম জিল্লুর শেখ।
মহাখালী
দুপুরে ঢাকার মহাখালী ও নাখালপাড়া এলাকায় রেলপথ অবরোধ করেছে শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনকারীরা রেললাইনে আগুন জ্বালিয়ে তারা বিক্ষোভ করে। পুলিশ ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের সঙ্গে তাদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়াও হয়েছে।
তাদের অবরোধের কারণে বৃহস্পতিবার বেলা ১২টার পর থেকে ঢাকার সঙ্গে সারাদেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ আছে বলে জানিয়েছেন কমলাপুরের স্টেশন মাস্টার মো. আনোয়ার হোসেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, মহাখালী ও নাখালপাড়া এলাকায় ট্রেন চলার পথে বাধা সৃষ্টি করেছে। এতে ট্রেন চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে।
দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, মহাখালী রেলক্রসিং এলাকায় রেললাইনে অবস্থান নিয়েছে পুলিশ। তাদের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের কর্মীরা রয়েছে।
আন্দোলনকারীদের একটি অংশ আরজতপাড়া এলাকায় রেললাইনে, আরেকটি অংশ মহাখালী থেকে জাহাঙ্গীরগেইট যেতে সড়কে অবস্থান নিয়েছে। মহাখালীর আরজতপাড়ার কাছে রেললাইনে আগুন দেওয়া হয়েছে।
৩ ঘণ্টায় ৩৯ আগুন
বৃহস্পতিবার দুপুর ২টা থেকে বিকাল ৫টার মধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও গাড়িতে আগুন ধরার ৩৯টি ফোন পাওয়ার কথা জানিয়েছেন জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ এর পরিদর্শক আনোয়ার সাত্তার।
বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে মহাখালীর আমতলী মোড় থেকে বীর উত্তম একে খন্দকার সড়কে লাঠিসোঁটা নিয়ে এগিয়ে আসে একদল যুবক। একপর্যায়ে মহাখালীর ওই সড়কের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবনের সামনে আসে। ওই ভবন লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুঁড়তে থাকে। এতে ভবনের সামনের অংশের বেশকিছু গ্লাস ভেঙে যায়।
পরে ওই ভবনের সামনের সড়ক এবং ভবনের প্রবেশপথের সামনে থাকা কয়েকটি গাড়ি ও মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে তারা। এক পর্যায়ে কয়েকটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
এক পর্যায়ে পাশে থাকা গাড়িগুলোতে আগুন ধরে যায়। আধঘণ্টা আগুন জ্বলার পর ওই ভবনেও আগুন ধরে যায়। ভবনের সামনের গাড়িগুলো থেকে একটু পরপর বিস্ফোরণ হতে থাকে। আধাঘণ্টা পর ওই ভবনেও আগুন লেগে যায়।
তার আগে বিকালে আগুন দেওয়া হয় বিটিভি ভবনে। আর সন্ধ্যায় সেতুভবনের হামলা হয়। দুই জায়গাতেই পোড়ানো হয় বহু গাড়ি।
একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, যারা এসব করছে, তাদের দেখে ছাত্র মনে হয়নি।
যাত্রাবাড়ী
বৃহস্পতিবার সকালে যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া ও মাতুয়াইল এলাকা ঘুরে দেখা যায়, শনির আখড়া এবং মাতুয়াইলের শিশু-মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সামনের সড়ক অবরোধ করে রেখেছে আন্দোলনকারীরা। সেখানে গাছের ডাল, টায়ার জ্বালিয়ে আগুন দেওয়া হয়েছে সড়কে। এতে ওই সড়ক দিয়ে ঢাকায় প্রবেশ এবং বের হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গেছে।
ওই সড়কে রিকশা বা মোটরসাইকেলও চলতে দেওয়া হচ্ছে না। লোকজন হেঁটে গন্তব্যে যাচ্ছেন।
যাত্রাবাড়ী থেকে বের হওয়ার পথে মহাসড়কের একটি পার্শ্বসড়ক ধরে যাওয়ার চেষ্টা করেছে বেশকিছু যানবাহন। তবে সেগুলোও আটকে আছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মুনিবুর রহমান বৃহস্পতিবার সকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যাত্রাবাড়ী ও শনিরআখড়া ছাড়ার ঢাকার আর কোনো সড়কে সকাল পর্যন্ত আন্দোলনাকারীরা বসেনি। কোনো সড়কও অবরোধ করা হয়নি।”
সাভার
বৃহস্পতিবার দুপুরে সাভার বাসস্ট্যান্ডের মুনসুর মার্টের সামনে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দফায় দফায় সংঘর্ষের সময় ‘গুলিতে’ এক শিক্ষার্থী নিহত হন।
আহত অবস্থায় ওই শিক্ষার্থীকে সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে এলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন বলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ ইউসুফ সাংবাদিকদের জানান।
নিহত ইয়ামিন সাভারের এমআইএসটির শিক্ষার্থী ছিলেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ কাঁদুনে গ্যাস, রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। এতে অর্ধ শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন।