“বদলটা আসলে কোথায় হয়েছে? বদলটা যেন আমরা দেখতে পারি।”
Published : 18 Jan 2025, 08:30 PM
পাঠ্যবই থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দযুক্ত চিত্রকর্ম বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে রাস্তায় নামা ‘সংক্ষুদ্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতার’ ওপর হামলা এবং সচিবালয়ে যাওয়ার পথে পুলিশের লাঠিপেটা ও জলকামান ব্যবহারের ঘটনায় বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক।
শনিবার দুপুরে ঢাকার মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে অনুষ্ঠিত এ সমাবেশে হামলাকারীদের অবিলম্বে যথাযথ বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।
নবম-দশম শ্রেণির বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও নির্মিতি বইয়ের পেছনের প্রচ্ছদে ‘আদিবাসী’ শব্দযুক্ত একটি চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছিল। সেখানে একটি গাছের পাঁচটি পাতায় লেখা ছিল মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ও আদিবাসী; পাশে লেখা ছিল ‘পাতা ছেঁড়া নিষেধ’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী ‘স্টুডেন্ট ফর সভরেন্টি’ ব্যানারে গত ১২ জানুয়ারি এনসিটিবি ঘেরাও করার পর রাতে ওই বইয়ের অনলাইন সংস্করণ থেকে চিত্রকর্মটি সরিয়ে ফেলা হয়।
এর প্রতিবাদে বুধবার পাঠ্যপুস্তক ভবন ঘেরাওয়ের ঘোষণা দেয় ‘সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতা’ নামে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের একটি সংগঠন। ‘স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টি’ও একইসময়ে পাঠ্যপুস্তক ভবন ঘেরাও করার ঘোষণা দেয়। সেখানে কর্মসূচি চলাকালে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা করা হয়।
এ হামলার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার ‘সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতার’ ব্যানারে শিক্ষার্থীরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় ঘেরাও করতে গেলে শিক্ষাভবনের সামনে তাদের বাধা দেয় পুলিশ। শিক্ষার্থীরা বাধা উপক্ষো করে এগোতে গেলে জলকামান ব্যবহার ও লাঠিপেটা করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়।
এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারকে সাহসী ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছেন শিক্ষক নেটওয়ার্কের সদস্য ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের অলিউর সান।
সমাবেশে তিনি বলেন, “এত এত মানুষের লাশের উপর, এত রক্তের উপর গঠিত সরকারের যে নৈতিক মনোবল থাকার কথা, সেই নৈতিক মনোবল তাদের ধারণ করার সক্ষমতা থাকতে হবে।
“যে অভূতপূর্ব ভূমিকায় তাদের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে, সেই দায়িত্ব তারা গ্রহণ করবেন এবং পালন করবেন। সেই আশাবাদ আমরা রাখতে চাই।’’
গণঅভ্যুত্থানের অংশীদার হিসেবে সকল পক্ষই অংশগ্রহণ করেছে, কারও অংশই কম নয় বলেছেন তিনি।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সৌম্য সরকার বলেন, “দেশটা হঠাৎ করে আবার কারও কারও বাপের হয়ে যাচ্ছে। এই জন্য নিশ্চয় আমাদের দেশে গণআন্দোলন হয়নি। গণআন্দোলন বাংলাদেশ বেশ কয়েকটি দেখেছে এবং এভাবেই সেই গণআন্দোলনগুলো হাতছাড়া হয়েছে।”
বিগত আওয়ামী লীগ সরকার যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের কৃতিত্ব নিজেরা নেওয়ার চেষ্টা করেছে, চব্বিশের গণআন্দোলনের ক্ষেত্রেও কিছু মানুষকে সেরকম চেষ্টা করতে দেখা যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বহু বছর ধরে পাহাড়ের সমতলের আদিবাসীদের উপর নিপীড়ন, অত্যাচার, ধর্ষণ, লুটপাট হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক নিজের লজ্জার কথা তুলে ধরে বলেন, “এইটা তো বৈচিত্র্য নয়, একটা দেশ এভাবে এগোতে পারে না।”
হামলার সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘নীরব ভূমিকার’ সমালোচনা করার পাশাপাশি পরের দিন লাঠিপেটা ও জলকামান ব্যবহারের বিষয়টি তুলে ধরেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ইসমাইল সাদী।
তিনি বলেন, “এর মধ্য দিয়ে একটি বিষয় স্পষ্ট, এই সরকার সবার হয়নি। যেটা গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ছিল, আমাদের ছাত্র-জনতা, পেশাজীবী সবার আকাঙ্ক্ষা ছিল—এই সরকার সবার সরকার হবে। কিন্তু সেটা আমরা প্রতীয়মান হতে দেখিনি।”
ইসমাইল সাদী বলেন, “যে গ্রাফিতিগুলো নিয়ে ড. ইউনূস সাহেব গর্ব করেছেন, অ্যালবাম উপহার দিয়েছেন বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানকে, সেই গ্রাফিতি থেকে একটি শব্দ মুছে গেল। একটি শব্দের কারণে একটা বইয়ের একটা পৃষ্ঠা মুছে যাচ্ছে। সে গ্রাফিতিকে মুছে দেওয়া হচ্ছে ‘আদিবাসী’ শব্দ। কেন?”
প্রতিদিন বৈষম্য বাড়ছে এবং তা বাড়ার কথা ছিল না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আপনি (প্রধান উপদেষ্টা) বলেছিলেন, এই বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যেকে একটি পরিবারের সদস্য। পরিবার কি ভেঙে গেছে? পরিবারের সদস্যরা এভাবে সাপ মারার মতো পেটায় মানুষকে। আপনারা খেয়াল করেন না, ওখানে বসে আছেন।”
পাঠ্যপুস্তক ভবনের সামনে হামলার ঘটনা তুলে ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কাজলী সেহরীন ইসলাম বলেন, তার সরাসরি ছাত্রী রূপাইয়া শ্রেষ্ঠা তঞ্চঙ্গ্যা আহত হয়েছেন। আন্দোলনের সময় ৪ অগাস্ট তার পরিবার ছাত্রলীগের ভয়াবহ হামলার শিকার হয়েছিল।
চার-পাঁচ মাস পর একই মানুষ এখনো বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে যাচ্ছে তুলে ধরে তিনি বলেন, “বদলটা আসলে কোথায় হয়েছে? বদলটা যেন আমরা দেখতে পারি।”
তার আগে শুক্রবার আদিবাসী শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক।
সে বিবৃতিতে দায়ীদের শনাক্ত করে তাদের রাজনৈতিক পরিচয় প্রকাশ এবং আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।