কলকাতার বেকার হোস্টেলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহপাঠী এম এ সালেহ আহমেদ বুক স্টলটি স্থাপন করেন।
Published : 08 Jul 2023, 10:28 AM
শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এখনও টিকে আছে বইয়ের দোকানটি। এখন বই তেমন একটা বিক্রি না হলেও দোকানটি আছে ঠিকই।
‘ক্যামলট বুক স্টল’ নামের প্রায় শতবর্ষী এই বইয়ের দোকানটি আছে রাজধানী ঢাকার বুকেই; কমলাপুর রেল স্টেশনে।
১৮৯৫ সালে ফুলবাড়িয়ায় ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন প্রতিষ্ঠার পর সেখানেই জন্ম ক্যামলট বুক স্টলের। ১৯৬৮ সালে ফুলবাড়িয়া রেল স্টেশন কমলাপুরে চলে এলে বুক স্টলটিও স্থানান্তরিত হয়।
রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, কলকাতার বেকার হোস্টেলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহপাঠী এম এ সালেহ আহমেদ প্রায় ১০০ বছর আগে বুক স্টলটি স্থাপন করেন। সালেহ আহমেদ মারা যাওয়ার পর তার নিয়োগ করা কর্মচারীরা এটি চালাতেন।
১৯৮০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ক্যামলট বুক স্টলটি চালাচ্ছেন মো. হান্নান খান মুকুল। স্টেশনের টিকেট বিক্রির ২০ নম্বর কাউন্টারলাগোয়া আট ফুট দৈর্ঘ্য আর আট ফুট প্রস্থের বুক স্টলে এখনো মেলে গল্প, উপন্যাস, ম্যাগাজিন, অ্যাডভেঞ্চার এবং বিদেশি বইয়ের বাংলা অনুবাদসহ বিভিন্ন ধরনের কয়েক হাজার বই।
ক্যামলট যেভাবে মুকুলের হাতে
মুকুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাবা বইয়ের ব্যবসা করতেন। সেই থেকে গ্রন্থাগার করার ইচ্ছে ছিল। বাবার মুখে ছোটবেলায় শুনতাম বইয়ের ব্যবসাটা ভদ্রলোকের ব্যবসা। এই ব্যবসটা আমার কাছে রুচিসম্মত মনে হয়।
“একসময় সেবা প্রকাশনীতে মার্কেটিংয়ে কাজ করতাম। ১৯৭৬ সালে আমাকে সেবা প্রকাশনীর ঢাকার ডিস্ট্রিবিউটর করা হয়। বাবারও বইয়ের ব্যবসা ছিল বলে ক্যামলট বুক স্টলের দায়িত্ব নেই। এই বুক স্টলের জন্য রেলওয়ে শুধু জাগয়া দিয়েছে। তিন বছর পর পর রেলওয়ের সঙ্গে চুক্তি নবায়ন করতে হয়।”
স্মৃতিচারণ করে মুকুল বলেন, “১৯৮০ সালে বুক স্টলটির দায়িত্ব নেওয়ার পর ব্যবসার অবস্থা বেশ ভালো ছিল। তখন বইয়ের এত কালেকশনও ছিল না। কিন্তু মানুষ বই, দেশি-বিদেশি ম্যাগাজিন কিনত। তখন ৫০টির মতো রিডার ডাইজেস্ট বিক্রি হত। এখন পাঁচটি রিডার ডাইজেস্ট আনলে ছয় মাসেও সবগুলো বিক্রি হয় না।”
একসময় অনেক দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ বই কিনতে আসত জানিয়ে তিনি বলেন, “গুলশান-বানানী থেকে গাড়ি নিয়ে অনেকে বই কিনতে আসতেন। রাত ১১টায় ফোন দিয়ে বলতেন, আছেন নাকি? থাকেন ১০ মিনিটের মধ্যে আসছি। এসে চার-পাঁচ হাজার টাকার বই নিয়ে যেতেন। তেমন কাস্টমার এখন আর দেখি না। এখন মানুষের বই পড়ার সময় নেই।”
বই কেনায় মানুষের আগ্রহ কমে যাওয়ার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং অনলাইনে বইয়ের পিডিএফ কপি বিনামূল্যে সংগ্রহের সুবিধা থাকাকে দায়ী করেন মুকুল।
“এখন হাতের মুঠোয় সবকিছু মিলছে। বিনোদনের জন্য কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মোবাইল আছে। মোবাইলের মধ্যেই সবকিছু পাচ্ছে। মেধার অপচয় হচ্ছে, নতুন জেনারেশনের বইয়ের প্রতি আগ্রহ নেই। নতুন পাঠক সৃষ্টি হচ্ছে না। আমি দেখেছি সবাই বসে বসে মোবাইল টিপে, মোবাইলে গেমস খেলে।
“মাঝেমধ্যে তরুণ কাস্টমাররা একসঙ্গে এসে বই দেখে। এরপর নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে পিডিএফ ডাউনলোড করে মোবাইলে পড়বে। বই না কিনে চলে যায়, তখন সবচেয়ে বেশি কষ্ট লাগে।”
কোভিড মহামারী শুরুর পর থেকে বই বিক্রি করে তেমন আয় না হওয়ায় বুক স্টলটি টিকিয়ে রাখতে ডিজিটাল অর্থ লেনদেনের কার্যক্রমও চলানো হচ্ছে। এখান থেকে যা আয় হয় তা দিয়েই টিকে আছে বুক স্টলটি।
মুকুল বলেন, “কোনো উপায় নেই, বইয়ের দোকানের পাশাপাশি ওসবের লাইসেন্স করতে হয়েছে। ওগুলো না থাকলে আমি এখানে টিকতে পারতাম না।”
এরপরেও বুক স্টলটি কেন চালাচ্ছেন, এমন প্রশ্নে মুকুল বলেন, “বই বিক্রি করে ব্যবসা না হলেও, আমার শ্রমের দাম না পেলেও আমি চাই দোকানে বইয়ের ভালো কালেকশন থাকতে হবে। পাঠাকের কাছ থেকে রিপোর্ট নিয়ে আমি এখনও ভালো ভালো বই সংগ্রহ করি। কারণ বই বিক্রি করায় আমি সামাজিকভাবে সম্মান পাই, এটিই সবচেয়ে ভালো লাগে।
“৪৩ বছরের মধ্যে একদিন শুধু একটি কলম বিক্রি করেছিলাম, সেদিন কোনো বই বিক্রি হয়নি। কোনো কোনো দিন দু’একটি বই বিক্রি হয়। দোকান না খুললে ভালো লাগে না। মনে হয় বইয়ের গন্ধটা না থাকলে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ব। যার জন্য এরমধ্যে এখনও পড়ে আছি এবং যতদিন সুস্থ আছি ততদিন এই বুক স্টল চালু রাখব। কারণ বইয়ের গন্ধটা আমার রক্তের সাথে মিশে গেছে।”
মুকুল জানান, বছরে দুই ঈদে দুই দিন করে চারদিন ক্যামলট বুক স্টল বন্ধ থাকে। এর বাইরে প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
এই বুক স্টলের একমাত্র কর্মচারী কর্মচারী রুহুল আমিনও জানান, আগের মতো আর বই বিক্রি হয় না।
তবে ৪০-৫০ বছর আগের অনেক ক্রেতা এখনও এই বুক স্টলে এসে বই কেনেন জানিয়ে রুহুল বলেন, তারা স্কুল-কলেজের ছাত্র থাকার সময় থেকেই বই কেনা শুরু করেছেন।
রুহুল আমিন বলেন, বুক স্টলটির নাম কেন ‘ক্যামলট’ রাখা হয়েছে অনেকেই তা জানতে চান। কিন্তু এর কোনো অর্থ তিনি খুঁজে পাননি।
তবে মুকুল জানালেন, প্রতিষ্ঠাতা সালেহ আহমেদ লর্ড ক্যামলটের নামে এটির নামকরণ করেন, সেই থেকে ওই নামেই বুক স্টলটি চলছে।
বুক স্টলটির নাম নিয়ে রেলের কয়েকজন কর্মকর্তারাও একই তথ্য দেন।