ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মাধ্যমে আগের ‘সংবিধান বাতিল হয়ে গেছে’ বলে মনে করে জাতীয় নাগরিক কমিটি। এ কারণে তারা নতুন করে সংবিধান প্রণয়নের প্রস্তাব করেছে, যার মাধ্যমে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ গঠনের কথা বলা হয়েছে।
Published : 03 Dec 2024, 07:47 PM
সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো সংবিধানের যে সংস্কারের কথা বলছে, তার সঙ্গে ‘একমত নয়’ জুলাই-অগাস্টের গণআন্দোলনে সরকার পতনের পর গঠিত সংগঠন জাতীয় নাগরিক কমিটি।
সংগঠনটি বলছে, ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মাধ্যমে আগের ‘সংবিধান বাতিল হয়ে গেছে’ বলে তারা মনে করে। ফলে নতুন করে সংবিধান প্রণয়নের প্রস্তাব তাদের, যার মাধ্যমে হবে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ।
এ ছাড়া নতুন সংবিধান অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি দুইবারের বেশি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। প্রধানমন্ত্রী একইসঙ্গে দলের প্রধান ও সংসদ নেতাও হতে পারবে না বলে তারা প্রস্তাব দিয়েছেন।
মঙ্গলবার জাতীয় সংসদ ভবনের কেবিনেট কক্ষে জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে মতবিনিময় করে সংবিধান সংস্কার কমিশন। সেখানে ৬৯ দফা লিখিত প্রস্তাব দিয়েছেন নাগরিক কমিটির নেতারা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকেও নতুন সংবিধানে প্রণয়নের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তারাও দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের কথা বলছে। তাদের প্রস্তাবগুলো পরে লিখিত আকারে কমিশনে জমা দেওয়ার কথা বলেছে সংগঠনটি।
জাতীয় নাগরিক কমিটি সংবিধান সংস্কার কমিশনকে যে প্রস্তাব দিয়েছে তার মধ্যে রয়েছে, জনগণের ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করার পাশাপাশি পরে তার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিধান না রাখা, বিরোধীদলীয় নেতাকে ছায়া-মন্ত্রিসভা গঠনের অধিকার দেওয়া, মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রকে প্রথম রিপাবলিকের প্রস্তাবনা হিসেবে গ্রহণ করে তা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা, ‘দ্বিতীয় রিপাবলিকের প্রোক্লেমেশন জারি করে’ তা নতুন সংবিধানের প্রস্তাবনা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা।
দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের প্রস্তাব করে জাতীয় নাগরিক কমিটি বলছে, উচ্চকক্ষের নাম হবে জাতীয় পরিষদ ও নিম্নকক্ষের নাম হবে আইনসভা। তিনশ আসনের আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হবে জনগণের ভোটে। আর ১০০ সদস্যের জাতীয় পরিষদ হবে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে। এর মধ্যে ৩৩টি আসনে পেশাজীবী-কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-আইনজীবী-চিকিৎসক-প্রকৌশলী-কৃষিবিদ-সাংবাদিকসহ আইনে তফসিলভুক্ত পেশা এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মানুষকে মনোনয়ন দিতে হবে। আইন পাশে উভয় কক্ষের অনুমোদনের বিধানের প্রস্তাব করে তারা।
তাদের প্রস্তাব- নতুন ‘লিগ্যাল ফ্রেম অর্ডারের’ অধীন গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা, সংবিধান প্রণয়ন সম্পন্ন হলে গণপরিষদই আইনসভায় রূপ নেবে, সংবিধানে প্রত্যেক জাতিসত্তার স্বীকৃতি থাকা, বাংলাদেশের নাগরিকগণ 'বাংলাদেশি' হিসেবে পরিচিত করা, সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘গণ সার্বভৌমত্বের’ স্বীকৃতির বিধান রাখার পাশাপাশি গণভোটের বিধান রাখার প্রস্তাব করেছে সংগঠনটি। একইসঙ্গে সংবিধানে পরিবর্তনও শুধু গণভোটে করার প্রস্তাব করেছে নাগরিক কমিটি।
স্বাধীন বিচার বিভাগ গঠনে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের প্রস্তাব করে নাগরিক কমিটি বলছে, এর প্রধান হবেন প্রধান বিচারপতি। একইসঙ্গে প্রধান বিচারপতির অধীনে আলাদা সচিবালয় ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের প্রস্তাব দিয়েছে সংগঠনটি। তারা মনে করে রাষ্ট্র সরকারের নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপের বাইরে আনা গেলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার আর প্রয়োজন হয় না। তবে আগামী দুই নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে বলেও মত দিয়েছে তারা। এ ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ নিরাপত্তা বাহিনী এবং প্রশাসন নির্বাচনের আগের তিন মাস নির্বাচন কমিশনের অধীনে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে।
সংবিধান কীভাবে পুনর্লিখন হবে, এমন প্রশ্নে জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, “ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আগের সংবিধান বাতিল হয়ে গেছে বলে আমরা মনে করি। আমরা দীর্ঘসময় ধরে নতুন সংবিধানের দাবি জানিয়ে আসছি। সেটা গণপরিষদের মাধ্যমে বা অন্যকে বৈধ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে…সেই দাবি ও প্রস্তাবনা আমরা করছি। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো যে সংবিধান সংস্কারের কথা বলছেন, তাদের সঙ্গে আমরা একমত নই।”
আখতার হোসেন বলেন, “বর্তমান সংবিধানের সজ্জা, গঠন দেখলে মনে হয় এটা যেন আওয়ামী লীগের কোনো দলিল। আমরা আওয়ামী দলিল এবং যে সংবিধানের মধ্যে একজন ব্যক্তিতে স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিস্ট গড়ে তোলার উপাদান রয়েছে, সেরকম সংবিধান রাখতে চাই না। আমরা জনগণের কাছে এ আহ্বান রাখছি। তারাই সিদ্ধান্ত নেবে।”
গণপরিষদ গঠনের বিষয়ে তিনি বলেন, “নির্বাচনের মাধ্যমে গণপরিষদ হবে। সেখানে যারা অংশীজন আছেন, তারা সেটা ঠিক হবে। এ ক্ষেত্রে গণপরিষদ নির্বাচনে যারাই নির্বাচিত হয়ে আসবেন, সংবিধান প্রণয়নের পরে তারাই আইনসভার সদস্য হিসেবে কাজ করবেন। এ ক্ষেত্রে নতুন করে সংসদ নির্বাচনের প্রয়োজন থাকছে না।”
সংবিধান পুনর্লিখনের প্রস্তাব বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকেও দেওয়া হয়েছে বলে জানান এই সংগঠনের সদস্যসচিব আরিফ সোহেল।
তিনি বলেন, “আমরা পুনর্লিখনের কথা বলেছি। গণপরিষদ লাগবে। গণপরিষদ নতুন সংবিধান প্রণয়ন করবে। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের লিখিত স্বীকৃতি থাকতে হবে।”
প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের জন্য রাষ্ট্রপতির হাতে কিছু ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা করেছে বলে জানান আরিফ সোহেল।
তার ভাষ্য, “সংসদ দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট, বিচারপতি নিয়োগের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন, একই সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক দল অগণতান্ত্রিক আচরণ করলে তাদের আদালত থামিয়ে দিতে পারে।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য তরিকুল ইসলাম বলেন, “সংবিধান এমনভাবে সংস্কার করা হোক, যাতে রাষ্ট্রের তিনটি অর্গানের মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকে। বিচারপতি নিয়োগের বিধান নিশ্চিতে আইন প্রণয়ন, বিচার বিভাগের আলাদা সচিবালয় না থাকায় প্রধানমন্ত্রীর কুক্ষিগত হয়ে কাজ করে, তাই আলাদা সচিবালয় করার প্রস্তাব দিয়েছি। সংবিধানে ছাত্রদের মতামতের প্রতিফলন সংবিধানে রাখার পরামর্শ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দিয়েছে।”
মতবিনিময় সভায় জাতীয় নাগরিক কমিটির পক্ষে উপস্থিত ছিলেন মুখপাত্র সামান্তা শারমিন, কেন্দ্রীয় সদস্য সারোয়ার তুষার, মুকুল মুস্তাফিজ, জহিরুল ইসলাম মুসা, আতিক মুজাহিদ ও সালেহ উদ্দিন সিফাত।
আর সংবিধান সংস্কার কমিশনের পক্ষে ছিলেন কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য ফিরোজ আহমেদ, মুস্তাইন জহির, সুমাইয়া খায়ের, অধ্যাপক মোহাম্মদ ইকরামুল হক, মইন আলম ফিরোজি, ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিকি।