দুই সপ্তাহে চক্রের আরও অন্তত ছয়জন গ্রেপ্তার, যাদের বেশিরভাগ বাংলাদেশি।
Published : 10 Jul 2024, 12:27 AM
মানব শরীরের জরুরি অঙ্গ কিডনির অবৈধ কেনাবেচা ও বিপুল আর্থিক লেনদেনে প্রতিস্থাপনের পন্থা বের করা ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যকার একটি আন্তর্জাতিক চক্রের অন্তত ছয় সন্দেজভাজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে দিল্লি পুলিশ।
গ্রেপ্তারদের মধ্যে দিল্লির নামিদামি ‘ইন্দ্রপ্রস্থ অ্যাপোলো হাসপাতালের’ সন্দেহভাজন একজন চিকিৎসক রয়েছেন, যাকে গত সপ্তাহে ধরা হয়েছে। তাকে নিয়ে গত দুই সপ্তাহে চক্রের ছয় থেকে সাত সদস্য দিল্লি পুলিশের অপরাধ শাখার জালে ধরা পড়েছে বলে ভারতের কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ও হিন্দুস্তান টাইমস লিখেছে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কিডনি বাণিজ্যে সক্রিয় এই চক্রের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে ৫০ বছর বয়সী চিকিৎসক বিজয়া কুমারী কাজ করতেন বলে পুলিশের ভাষ্য। তিনি দিল্লির নয়ডাভিত্তিক ‘ইয়াথার্থ হসপিটালে’ ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ১৫-১৬টি কিডনি প্রতিস্থাপন করেছেন।
মামলার বিবরণ অনুযায়ী, দিল্লির বিভিন্ন বড় হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপনের কথা বলে দালালের মাধ্যমে বাংলাদেশি রোগীদের চিকিৎসক বিজয়া কুমারী ও তার সহযোগীদের কাছে নিয়ে আসত চক্রটি।
দিল্লি পুলিশের বরাত দিয়ে নিউজ এইটিন লিখেছে, চক্রের সদস্যরা বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে ডায়ালাইসিস সেন্টারে ঘুরে ঘুরে রোগী জোগাড় করত। যেসব রোগীর অর্থনৈতিক সামার্থ আছে, ভারতে নিয়ে গিয়ে কিডনি প্রতিস্থাপনের গোপন চুক্তি করত তাদের সঙ্গে। প্রতিটি কেসের জন্য এই চক্র কিডনি গ্রহীতার কাছ থেকে ২০-২৫ লাখ টাকা নিয়ে থাকে।
সংবাদমাধ্যমটি আরও জানাচ্ছে, রোগী খোঁজার পাশাপাশি তারা কিডনিদাতাও বাংলাদেশেই খুঁজে বের করত। অভাবি, অসহায় মানুষদের টাকার লোভ দিয়ে কিডনি বিক্রিতে রাজি করায় চক্রের দালালরা। তারপর তাদের ভারতে এনে রোগী অর্থাৎ কিডনি গ্রহীতার সঙ্গে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে চুক্তি চূড়ান্ত করত।
গত মাসে এই চক্রের তিন বাংলাদেশি সদস্যকে গ্রেপ্তার করে দিল্লি পুলিশ।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস লিখেছে, ভারতীয় আইনে কিডনিদাতা ও রোগীর মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকার বাধ্যবাধকতা আছে। সেটি মানতে গিয়ে চক্রটি দিল্লিতে বাংলাদেশ হাই কমিশনের নামে ভুয়া নথিপত্র তৈরি করত। এমন নথিও জব্দ করেছে পুলিশ।
অ্যাপোলো হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ও কিডনি প্রতিস্থাপন সার্জন বিজয়া কুমারী প্রায় ১৫ বছর আগে স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিতে যোগ দিয়েছিলেন জুনিয়র চিকিৎসক হিসেবে। তিনি বেতনভুক্ত চিকিৎসক ছিলেন না, সেবাভিত্তিক অর্থসুবিধা পেতেন।
ইয়াথার্থ হাসপাতালের অতিরিক্ত মেডিকেল সুপারিনটেনডেন্ট সুনীল বালিয়ান বলেন, বিজয়া কুমারী সেখানে ভিজিটিং কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করছিলেন। তার নামে যেসব রোগী আসত, তিনি তাদেরই কিডনি প্রতিস্থাপন করাতেন।
“ইয়াথার্থ হাসপাতালের কোনো রোগীর চিকিৎসার দায়িত্ব তাকে দেওয়া হয়নি এবং গত তিন মাসের মধ্যে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের মাত্র একটি কাজ করেছেন বিজয়া।”
ইন্দ্রপ্রস্থ অ্যাপোলো হাসপাতালের এক মুখপাত্র ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেছেন, পুলিশি ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ওই চিকিৎসককে বরখাস্ত করা হয়েছে। তদন্তের অংশ হিসেবে পুলিশের অপরাধ বিভাগ কিছু তথ্য চেয়েছিল, সেগুলো এরই মধ্যে সরবরাহ করা হয়েছে।
ওই মুখপাত্রের ভাষ্য, “অন্য হাসপাতালে দেওয়া চিকিৎসার বিষয়ে তদন্ত শুরু হওয়ার পর এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বিজয়ার এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ইন্দ্রপ্রস্থ অ্যাপোলো হাসপাতালের কোনো সম্পর্ক নেই।”
সূত্রের বরাতে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের রাসেল (২৯), মোহাম্মদ সুমন মিঞা ও ইফতি এবং ভারতের ত্রিপুরার রতীশ পাল লোকজনকে কিডনি বেচতে প্রলুব্ধ করে দিল্লিতে নিয়ে যেত। চক্রটি কিডনিদাতাদের ৪-৫ লাখ টাকা করে দিলেও গ্রহীতার কাছ থেকে ২৫-৩০ লাখ টাকা নিত। তাদের মধ্যে ইফতি বাদে বাকিরা পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে।
ওই সূত্র বলেছে, “রাজস্থানে কিডনি প্রতিস্থাপনের একটি চক্র ধরা পড়ার পর আমাদের কাছে খবর আসে এবং এ নিয়ে আমরা মাস তিনেক আগে কাজ শুরু করি।”
প্রতিটি কিডটি প্রতিস্থাপনে চক্রটি চিকিৎসকে ২-৩ লাখ টাকা দিত বলে জানতে পেরেছেন তারা।
আল-শিফা নামের একটি মেডিকেল টুরিজম কোম্পানির মাধ্যমে কিডনি দাতা ও গ্রহীতাদের থাকা, চিকিৎসা ও পরীক্ষার কাজ চালানো হয়। ভুক্তভোগীদের একজন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।
ভুক্তভোগীদের চিকিৎসাসংক্রান্ত নথি ইয়াথার্থ হাসপাতাল থেকে জব্দ করা হয়েছে, যার মধ্যে বাংলাদেশ হাই কমিশনের নামে করা জাল নথিও রয়েছে।
ভুক্তভোগীর কিডনি প্রতিস্থাপন রেকর্ডের সঙ্গে যুক্ত মেডিকেল ফাইলের তথ্য সম্পূর্ণ করতে জাল নথি ব্যবহার করা হয়েছিল বলে জানিয়েছে ওই সূত্র।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস লিখেছে, পুলিশ ওই সংঘবদ্ধ চক্রটি নিয়ে তদন্ত চালাচ্ছে। তদন্ত চলাকালে বিজয়ার সহকারী হিসেবে বিক্রম নামের একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
রাসেল যশোলা গ্রামে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করেছিলেন। সেখানে পাঁচ থেকে ছয়জন দাতা অবস্থান করছিলেন। অঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য তাদের সব ধরনের পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছিল। ওই ফ্ল্যাটে তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন অঙ্গ গ্রহীতারাও।
রাসেলের বাড়ি কুষ্টিয়ায়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় ওই ফ্ল্যাটে মোহাম্মদ সুমন মিঞা (২৮) ও মোহাম্মদ রোকন (২৬) নামে তার দুজন সহযোগী ছিলেন।
গ্রেপ্তারের সময় রাসেলের কক্ষ থেকে একটি ব্যাগ জব্দ করা হয়, যার মধ্যে ৯টি পাসপোর্ট, দুটি ডায়েরি ও একটি রেজিস্টার খাতা মিলেছে। জব্দ করা পাসপোর্টগুলো কিডনি দাতা ও গ্রহীতাদের এবং তাদের আর্থিক লেনদেনের বিবরণী ডায়েরিতে আছে।
পুলিশ বলেছে, গ্রেপ্তার রোকনের কাছ থেকে আরেকটি ব্যাগ জব্দ করা হয়েছে, যেখানে ভিন্ন ছাপের ২০টি স্ট্যাম্প, দুটি বাবার স্ট্যাম্প প্যাড (কালি) পাওয়া গেছে। জাল নথি তৈরিতে এসব উপকরণ ব্যবহার করা হত বলে ধারণা করা হচ্ছে।