গদিতে সরকার নেই; পথে পথে ছিল উন্মত্ত উল্লাস আর অরাজকতা।
Published : 06 Aug 2024, 03:05 AM
শেখ হাসিনা বিদায় নিচ্ছেন, সোমবার দুপুরের আগেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু এরপরেও থেমে থাকেনি সংঘাত আর গুলি।
দিন শেষে ঢাকায় মৃত্যুর সংখ্যা অর্ধশত ছাড়িয়েছে, যার মধ্যে পুলিশ ও আন্দোলনকারীরা রয়েছেন। গুলিতে আহত হয়েছেন আরও বহু মানুষ।
৩৬ দিন আগে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার চেয়ে শুরু হওয়া আন্দোলন ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত রূপ লাভ করল। এই সময়ে সারা দেশে তিন শতাধিক মানুষ সংঘাত-সহিংসতায় নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ।
গত ১৪ জুলাই থেকে ঢাকা অশান্ত হয়ে উঠে। সংঘাত, ঢালাও গুলিতে প্রচুর মানুষের মৃত্যু, এরপরে কারফিউ- সব মিলিয়ে ঢাকা হয়ে উঠেছিল আতঙ্ক আর উদ্বেগের নগরী।
সেই ঢাকা সোমবার দুপুর থেকে হঠাৎ পাল্টে যায়। শেখ হাসিনার পতনের খবরে রাস্তায় নেমে আসেন হাজারো মানুষ। এদের মধ্যে কিছু মানুষকে ঢাকার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায় ভাঙচুর, লুটতরাজ করতে দেখা যায়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পূর্ব ঘোষিত ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘিরে ঢাকার মূল প্রবেশপথগুলোতে পুলিশের পাশাপাশি সেনা সদস্যদেরও মোতায়েন করা হয়।
সকালে যাত্রাবাড়ী ও উত্তরায় ঢাকার প্রবেশমুখে জমায়েত হয় হাজারো মানুষ। উত্তরায় সেনা সদস্যরা দুপুরের আগেই বাধা তুলে নিয়ে মানুষকে ঢোকার সুযোগ করে দিলে হাজারো মানুষের মিছিল হাঁটতে থাকে ঢাকার দিকে।
তবে যাত্রাবাড়ীতে সকালেই জমায়েত হওয়া মানুষের সঙ্গে পুলিশের সংঘাত হয়। সারা দিনে ২০ জনের বেশি মানুষ সেখানে নিহত হন, গুলিবিদ্ধ হন আরও অনেক মানুষ।
সংঘাত চলতে থাকে বিকেল পর্যন্ত। এক পর্যায়ে মানুষ যাত্রাবাড়ী থানা আক্রমণ করে ১১ জন পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করে।
সংঘাত হয় রামপুরা এলাকাতেও। তবে দুপুর ১টার দিকে পরিস্থিতি পাল্টে যেতে শুরু করে। সেনাসদস্যরা সকলকে আর কিছুক্ষণ শান্ত থাকার অনুরোধ জানিয়ে বলতে থাকেন, “সেনাপ্রধানের বক্তব্য পর্যন্ত আপনারা ধৈর্য ধরুন, আমরা আপনাদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত আছি।”
বেলা ২টার পর সেনাবাহিনী বাধা সরিয়ে নিলে স্রোতের মত মানুষ রামপুরা-বনশ্রী থেকে আসতে শুরু করে শহরের কেন্দ্রের দিকে। তারা সেনাবাহিনীর সদস্যদের অভিবাদন জানিয়ে তাদের সঙ্গে হাত মেলাতে থাকেন। দুই আঙুল তুলে বিজয়ের চিহ্ন দেখিয়ে উল্লাস প্রকাশ করতে থাকেন।
পথে পথে উল্লাস, গণভবনে লুটপাট
শেখ হাসিনার পদত্যাগ করে দেশত্যাগ করার খবরে রাজধানীতে বিজয় উল্লাসে মেতে ওঠে মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, শাহবাগ ও শহীদ মিনার এলাকায় জনস্রোত নামে। অনেকে বিজয়সূচক ‘ভি’ চিহ্ন দেখিয়ে, ভেঁপু আর ঢোল বাজিয়ে নেচে-গেয়ে উল্লাস করেন। তাদের অনেকের হাতে ও মাথায় বাঁধা ছিল জাতীয় পতাকা।
বিপুল মানুষের জমায়াতে স্লোগান ওঠে– ‘এই মুহূর্তে খবর এল, শেখ হাসিনা পালিয়ে গেল’, ‘হৈ হৈ রৈ রৈ, শেখ হাসিনা গেলি কই’।
বিকালে টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের পেছনে মেট্রোরেলের খুঁটিতে আঁকা শেখ হাসিনার প্রতিকৃতি বিকৃত করে ঝাল মেটান অনেকে। তারা ছাত্রলীগ নেতাদের ছবি পুড়িয়ে উল্লাস করেন। সন্ধ্যায় টিএসসি এলাকায় ফোটানো হয় আতশবাজি।
টিএসসি এলাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাদিয়া তাসনিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “স্বৈরাচার থেকে দেশ আবার স্বাধীন হল। খুবই খুশি লাগছে, এটা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।”
শেখ হাসিনার দেশত্যাগের খবরে এদিন গণভবনের দিকে ঢল নামে মানুষের। তারা গণভবনের ভেতরে প্রবেশ করে উল্লাস করেন। সেখান থেকে দামি জিনিসপত্র, টেলিভিশন, ফুলের টব, হাঁস, বালতি, মাছ, মাংস নিয়ে বের হতে দেখা যায় অনেককে। কেউ সাবার করেছেন খাবার দাবার। শেখ হাসিনার বিছানায় পায়ের ওপর পা তুলে শোয়া এক যুবকের ছবি ফেইসবুকে ভাইরাল হয়েছে।
সংসদ ভবনের বিভিন্ন কক্ষেও প্রবেশ করেন তারা। চেয়ার বসে ছবি তোলেন। সেখানে কেউ বসে সিগারেট টানেন। কেউ নাচানাচি আর হৈ-হুল্লোরে মাতেন। সংসদের লেকে নেমে গোসলও করেন।
ঢাকার প্রায় সব সড়কেই মানুষের ঢল নামে। গুলশান, বনানী ও মহাখালী এলাকাতেও মানুষের বিজয়োল্লাস করতে যায়। ছোট ছোট খণ্ডে মিছিল নিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছিলেন তারা। এলোমেলো ঘোরাফেরা করছিলেন। অনেকে জনস্রোতের ছবি ও ভিডিও ধারণ করছিলেন।
সরকার পতনের খবরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও সভাপতির কার্যালয়ের পর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে হামলা চালিয়ে আগুন দেওয়া হয়।
থানায় থানায় হামলা, হতাহত
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঢাকামুখী লংমার্চ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সকালে যে সংঘাত হয়েছিল তা অনেক বেলা অবধি গড়ায়। লোকজন স্থানীয় থানা, পুলিশের স্থাপনায় হামলা চালাতে গেলেও সংঘাত বাঁধে।
সব মিলিয়ে সোমবার দিন শেষে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে জমা হয় ৩৫ জনের লাশ, আহত পাঁচ শতাধিক। তাদের বেশিরভাগেই গুলিবিদ্ধ।
এছাড়া উত্তরার ক্রিসেন্ট হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ ১০ জনের লাশ থাকার কথা জানানো হয়। উত্তরা পূর্ব থানা থেকে পুলিশের ছোড়া গুলিতে তারা হতাহত হন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমমের ঢাকা মেডিকেল প্রতিনিধি আমিনুল ইসলাম জানাচ্ছেন, হাসপাতালে সারা দিনে সংঘাতে আহত হয়েছেন অন্তত ৫০০ জন। তাদের মধ্যে ৭০ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। হাসপাতালে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছে ও হাসপাতালে আনার পর মারা গেছেন মোট ৩৫ জন।
সোমবার সন্ধ্যায় উত্তরা পূর্ব থানা ঘিরে রাখে কয়েকশ মানুষ। থানার নিচে আগুন দেওয়া হলে সেখানে সংঘর্ষ হয়। প্রচুর মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়। তাদের অনেককে নেওয়া হয় কাছের উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে।
রাতে ওই হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ১২ জনের লাশ ছিল। আহত অনেকেও গেছেন সেখানে, তাদের অনেকে গুলিবিদ্ধ।
শেখ হাসিনার পতনের খবরে রাজধানীর ৫০টি থানার মধ্যে বেশ কয়েকটি থেকে হামলার খবর আসতে থাকে। থানাগুলোর মধ্যে রয়েছে যাত্রাবাড়ী, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, মোহাম্মদপুর, উত্তরা পূর্ব, বাড্ডা, রামপুরা, খিলগাঁও।
শীর্ষস্থানীয় পুলিশের কর্মকর্তারা বলেছেন, হামলা হতে পারে এমন আশঙ্কায় অনেক থানা থেকে পুলিশ সদস্যরা আগেই সরে যান। তবে উত্তরা পূর্ব থানায় সংঘর্ষের সময় হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিবেদক বিকাল ৪টার দিকে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় আগুন জ্বলতে দেখেন। এ থানায় এর আগেই হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়। পরে দেওয়া হয় আগুন।
মোহাম্মদপুর থানায় হামলা হয় বিকাল ৫টার পর। এরপর আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে সন্ধ্যা ৬টার পরও আগুন জ্বলতে দেখা যায়।
খিলগাঁও থানায় সন্ধ্যার পরও আগুন জ্বলতে দেখেছেন প্রতক্ষদর্শীরা। এর আগে কদমতলী থানা আগের রাতেই পরিত্যক্ত ঘোষণা করে পুলিশ।
লালবাগ বিভাগের একজন এসআই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, হামলার আশঙ্কায় তাদের অস্ত্র ও জরুরি দলিল নিরাপদ হেফাজতে রেখে নিরাপদে সরে যেতে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের একাধিক থানার ওসি ও পরিদর্শকরা বলেছেন, রাজধানীর ৫০টি থানার বেশির ভাগই ফাঁকা হয়ে পড়েছে।
থানার পাশাপাশি হামলা হয়েছে র্যাবের দপ্তরেও। র্যাব সদর দপ্তরের এএসপি মো. মুজাহিদ বলছেন, কেরানীগঞ্জে র্যাব- ১০ এর কার্যালয়ে হামলা হয়েছে। পিটিয়ে দুজন সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে। দুজন কর্মকর্তার অবস্থা সঙ্কটাপন্ন, তারা আইসিইউতে রয়েছেন।