“আরব বসন্তের কথা আমরা জানি, মিশরেও দেখেছি, তার পরিণতিও দেখেছি”, বলেন তিনি।
Published : 16 Aug 2024, 11:28 PM
সরকার পতনের সফল আন্দোলনের সুফল ‘হাতছাড়া’ হয়ে যায় কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বামপন্থি বুদ্ধিজীবী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
আরব বসন্ত নামে মধ্যপ্রাচ্যের নানা দেশে বিপ্লব এবং ইরান বিপ্লবের কথা তুলে ধরে তিনি এই শঙ্কা প্রকাশ করেন।
শুক্রবার বিকেলে ঢাকার ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের অধ্যাপক এসআই মান্নান মিলনায়তনে ‘অংশগ্রহণমূলক গণপাঠ: এর পর কী?' শীর্ষক আলোচনায় এ কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের সফল আন্দোলনকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ আখ্যা দিলেও বিষয়টিকে এভাবে দেখছেন না বামপন্থি এই বুদ্ধিজীবী। তিনি একে ‘বিপ্লব’ বলতেও নারাজ। তবে আন্দোলনের সুফল ঘরে তোলার জন্য সতর্ক পদক্ষেপ চান তিনি।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “আরব বসন্তের কথা আমরা জানি, মিশরেও দেখেছি, তার পরিণতিও দেখেছি। ইরানে তো সত্যি সত্যিই বিপ্লব ঘটেছিল। বিপ্লব হলেও তা কীভাবে ছিনতাই হয়ে যায়, তাও আমরা জানি।"
অন্য বক্তাদের আলোচনায় সংবিধানসহ পুরো শাসন কাঠামোতে পরিবর্তনের তাগিদ দিয়ে বলা হয়েছে, নইলে আবারও ‘স্বৈরতন্ত্রের পথেই’ হাঁটার সম্ভাবনা প্রবল। বৈষম্যের বিরুদ্ধে জনতার জাগরণেও সেই পথ থেকে সহসা মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়।
'সমাজতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবী সংঘ' আয়োজিত এই সভায় বুদ্ধিজীবীদের পাশাপাশি রাজনীতিবিদ, শিক্ষার্থীরাও বক্তব্য দেন।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “স্বাধীনতা আগেও এসেছে, তবে মুক্তি ঘটেনি। কোটাবৈষম্য নিয়ে যে আন্দোলনটা হয়েছে, তাতে তরুণরা যুক্ত হয়েছে। কারণ, আমাদের এখানে যে ধরনের উন্নয়ন হয়েছে, তাতে কর্মসংস্থান ঘটেনি।
“আজকে বৈষম্যের কথা বলতে হলে আমাদের পুঁজিবাদের কথা বলতে হবে, সাম্রাজ্যবাদের কথা বলতে হবে। এই বৈষম্যের সূত্র তো পুঁজিবাদ। এই কাঠামো থাকলে তো আমাদের মুক্তি নেই।"
সামনের দিনগুলোতে করণীয় কী? প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, "অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ তো একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচিত সরকারের কাছে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া। সামনে নির্বাচন হবে। এই নির্বাচনে বামপন্থিদের একটা জোট করা যায় কি না, এটা ভাবতে হবে।"
আলোচনায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, “এখন বেশিরভাগেরই প্রত্যাশা জায়গা- আগের মত চাই না। এই না চাওয়াটাই হতে পারে আমাদের শক্তি। তাহলে কী চাই, সেটি ভাবতে হবে। বিভিন্ন জায়গায় দেয়ালে গ্রাফিতিগুলো দেখছি, সেখানে কিন্তু জনআকঙ্ক্ষার কথাগুলো এসেছে। এই আকাঙ্ক্ষাগুলো একটা বড় সম্ভাবনার জায়গা।”
তিনি বলেন, "অপরাধীর বিচার, লুণ্ঠন, দুর্নীতি, অর্থপাচার, চাঁদাবাজি বন্ধের দাবি কিন্তু জনতার। আর যারা স্বৈরতন্ত্রের সুবিধা নিয়ে সম্পদশালী হয়েছে তাদের রুখতে হবে।"
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, "এবার ছাত্র সমাজের অভ্যুথান আগের সকল অভ্যুথানকে নানাভাবেই ছাড়িয়ে গেছে। একটা জায়গায় ঘাটতি আছে, আগের মুভমেন্টে যে অর্গানাইজড ওয়েতে ছিল, এবার সেটা হয়নি। দ্রুত আমাদের অর্গানাইজড জায়গা তৈরি করতে হবে।
“এই গণজোয়ারের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে, কিন্তু আরও অনেক দল তো রয়ে গেছে, যারা একই শ্রেণির। আমরা লুটেরা ধনিক শ্রেণিতে আঘাত করতে পেরেছি, কিন্তু পতন করতে পারিনি।"
বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, "আন্দোলনের বিজয় হয়েছে, স্বৈরতন্ত্রের পতন হয়েছে। এখন কী পদ্ধতিতে গণতন্ত্রে যাবেন, তা স্পষ্ট হতে হবে।
“এক নতুন বাংলাদেশ গড়ব। সেই বাংলাদেশ বসবাস উপযোগী হতে হবে, এটাই প্রত্যাশা। আমরা আওয়ামী লীগকে সরিয়ে কি আরেকটা স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার দিকে হাঁটব? তা নিয়ে ভাবতে হবে।"
সরকার পতন আন্দোলনে অংশ নেওয়া ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ইলমা বলেন, “আমরা যখন আন্দোলনে ছিলাম, তখনও আমাদের অনেকেই প্রশ্ন করেছে- এর পর কী হবে? তোমরা কি দায়িত্ব নিতে পারবা? আমরা আসলে ওই সময়টাতে চোখের সামনে মানুষকে মরতে দেখে বসে থাকতে পারিনি।”
আরেক শিক্ষার্থী আবু মুহাম্মদ জারার ভাষ্য, "আমাদের আসলে এই জায়গাটায় দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি ভায়োলেন্স করার ছেলে না। মারকুটে ছেলেও না। সেই আমিও রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেছি।
“আমরা কয়েকজন ছিলাম, কিন্তু আমাদের সঙ্গে মাস-পিপল না যুক্ত হলে এটা সম্ভব হতো না। মানুষের যে সাহস দেখেছি, তা অবিশ্বাস্য। মানুষ যে কি পরিমাণ রাগ-পুষে রেখেছিল। তার প্রকাশ দেখেছি। আমি অনেক সিনেমা দেখেছি। কিন্তু নিজেই যে এমন মুহূর্তে দাঁড়াব ভাবিনি।"
'এই আন্দোলনের কৃতিত্বটা শেখ হাসিনাকেই দিতে হবে'- অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ এমন কথা বলতেই সবাই হেসে উঠেন।
তিনি বলেন, "শেখ হাসিনাই তো আন্দোলনটাকে এই পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। জনমনে ক্ষোভ থেকেই সবাই বেরিয়ে এসেছেন। নইলে সাধারণ একটা কোটা আন্দোলন এভাবে সরকার পতনের পর্যায়ে যেত না।"
কোটা আন্দোলনে জনগণ যেভাবে যুক্ত হয়েছে, তারা কিন্তু রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দাঁড়ায়নি এবং এই ব্যাপারটির আলাদা তাৎপর্য রয়েছে উল্লেখ করে আনু মুহাম্মদ বলেন, "রাজনৈতিক দলের প্রতি জনগণের একটা অনাস্থা আছে। তারই প্রকাশ কিন্তু এটি।"
সংবিধান সংশোধন ছাড়া মুক্তি নেই
আনু মুহাম্মদ বলেন, "এই সংবিধান রেখে যে-ই ক্ষমতায় যাবে, তার অবস্থা শেখ হাসিনার মতই হবে। প্রধানমন্ত্রীকে এককভাবে এত ক্ষমতা না দিয়ে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে।"
পাহাড়ে সামরিকীকরণে কী কী ঘটনা ঘটেছে, তার একটা শ্বেতপত্র প্রকাশ করা উচিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, “দেশে অন্য যে জাতিগোষ্ঠী আছে, তাদের স্বীকৃতি বর্তমান সংবিধানে নেই। এটা যুক্ত করতে হবে।"
সংবিধান সংশোধনের কথা বলেছেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীও।
মান্না বলেন, “আমাদের বর্তমান সংবিধান যেভাবে প্রধানমন্ত্রীকে সর্বক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তা ভাঙতে হবে। একজন ব্যক্তির কাছে এত ক্ষমতা দেওয়া উচিত নয়।”
ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ কেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় না, তা মূলত এই তারণ্যের শক্তিকে দমন করে রাখার জন্য। তারুণ্যের শক্তিটাকে লুটেরা শ্রেণির রাজনীতিতে ব্যবহার করা হয়।
“এই আন্দোলনের আরেকটি দিক হলো, মেয়েরা রাতেও বেরিয়ে এসেছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এটি একটি বিশেষ দিক।”
মানুষ যখন জেগে উঠে, অস্ত্র দিয়ে কাজ হয় না উল্লেখ করে আনু মুহাম্মদ বলেন, “নির্বাচিত সরকার আসার পর আমরা আর ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেখি না। যে দল ক্ষমতায় আসে, তারা ছাত্রদের শক্তিটা ব্যবহার করে। এই কাঠামো যদি একইভাবেই থাকে, তাহলে তো একই চিত্র ঘটবে। এই কাঠামো তো ভাঙতে হবে।”