ব্যক্তিগত অটোরিকশার পাশাপাশি ঢাকা জেলা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে নিবন্ধিত অটোরিকশাও বিনাবাধায় রাজধানীতে চলছে। পুলিশও বিষয়টি অস্বীকার করছে না।
Published : 10 May 2023, 01:25 AM
দুই বছর আগে হাই কোর্টের এক রায়ে রাজধানীতে ধূসর বা রুপালি রংয়ের ‘প্রাইভেট’ অটোরিকশার বাণিজ্যিক চলাচল নিষিদ্ধ হলেও অনেকটা লাগামহীনভাবেই চলছে এসব তিন চাকার বাহন।
অটোরিকশার মালিক-চালকদের ভাষ্য, পুলিশকে ‘মাসোহারা’ দিয়ে এসব অবৈধ গাড়ি চলছে রাজধানীতে। ঢাকার পরিবহন জগতে পুলিশকে দেওয়া এই মাসোহারা ‘মান্তি’ বা মান্থলি’ হিসেবে পরিচিত।
বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা মহানগরে যাত্রী পরিবহনের জন্য নিবন্ধিত অটোরিকশার সংখ্যা সাড়ে ১৫ হাজার। চালক-মালিকদের হিসাবে, এর বাইরেও প্রায় ২০ হাজারের মত অটোরিকশা রাজধানীতে অবৈধভাবে চলছে, যার মধ্যে রয়েছে ব্যক্তিগত হিসেবে নিবন্ধিত এবং ঢাকার বাইরে নিবন্ধিত অটোরিকশা। ফলে অবৈধ অটোরিকশার দাপটই বেশি। উল্টো হয়রানিতে পড়তে হয় বাণিজ্যিক হিসেবে নিবন্ধিত (সবুজ) অটোরিকশাগুলোকেই।
দুই বছর আগে হাই কোর্টে এক রায়ে ঢাকা মহানগরে বাণিজ্যিক হিসেবে নিবন্ধিত ছাড়া অন্য অটোরিকশা চলাচলের সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
বিচারপতি জেবিএম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের হাই কোর্ট বেঞ্চ ২০২১ সালের ১৯ জানুয়ারি একটি রুল খারিজ করে দিয়ে ওই রায় দেয়। রুল খারিজ হওয়ায় ধূসর বা রুপালি রংয়ের ‘প্রাইভেট সিএনজি’ (ঢাকা মেট্রো-দ) চলাচলে আর অনুমতি আর নেই বলে সে সময় জানান আইনজীবীরা।
ঢাকায় ‘টু স্ট্রোক’র বেবিট্যাক্সি নিষিদ্ধ করার পর ২০০১ সালে ‘ফোর স্ট্রোক’ থ্রি হুইলার অটোরিকশার (সিএনজিচালিত) বাণিজ্যিকভাবে চলাচলের অনুমতি দেয় সরকার। এরপর ১৩ হাজার অটোরিকশা (ঢাকা মেট্রো-থ) নিবন্ধন দেয় বিআরটিএ। ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত বিআরটিএ আরও ৩৯৫৭টি ‘ফোর স্ট্রোক’ অটোরিকশা ব্যক্তি মালিকানায় (ছাই রঙের) চলাচলের জন্য নিবন্ধন দেয়।
যদিও সিএনজি/পেট্রলচালিত ফোর স্ট্রোক থ্রি হুইলার্স সার্ভিস নীতিমালা-২০০৭ অনুযায়ী ঢাকা মহানগর এলাকায় ‘ফোর স্ট্রোক’ থ্রি হুইলার (ঢাকা-দ) ব্যক্তি মালিকানায় চলাচলের সুযোগ নেই।
পরে ব্যক্তি মালিকানায় নিবন্ধন পাওয়া অটোরিকশার মালিকরা বাণিজ্যিক নিবন্ধনের দাবি জানায়। সরকারের সাড়া না পেয়ে ২০১৬ সালে প্রাইভেট সিএনজি অটোরিকশা ওনার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের কোষাধ্যক্ষ দেলোয়ার হোসেন হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন।
প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ওই বছরের ২৭ জুলাই রুলসহ আদেশ দেয় হাই কোর্ট, তাতে ওই অটোরিকশা রাস্তায় চলার অনুমতি দেওয়ার নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। পাশাপাশি অনুমতি না দেওয়া অবধি ব্যক্তিগত অটোরিকশা ঢাকায় বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে চলাচলে বাধা না দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। পাঁচ বছর পর সেই রুল খারিজ করে আদালত রায় দিলে ব্যক্তিগত অটোরিকশার বাণিজ্যিক চলাচলের সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
কিন্তু অটোরিকশার মালিক-চালকরা বলছেন, ছাই রঙের অটোরিকশার পাশাপাশি ঢাকা জেলা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে নিবন্ধিত অটোরিকশাও বিনাবাধায় রাজধানীতে চলছে। পুলিশও অবৈধ অটোরিকশা চলার বিষয়টি অস্বীকার করছে না।
ওপেন সিক্রেট ‘মান্তি’
চালক ও মালিকরা বলছেন, অবৈধ বাহনগুলো চালানোর জন্য প্রতি মাসে গাড়িপ্রতি চার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা পুলিশের সার্জেন্ট ও টিআইদের (ট্রাফিক ইন্সপেক্টর) দেওয়া হয়। বিনিময়ে পুলিশ তাদের কয়েকজন কর্মকর্তার নম্বর ও ওই মাসের ‘কোড’ দিয়ে দেয়। এরপর কোথাও পুলিশ গাড়ি আটকালে মোবাইলে সেই কর্মকর্তাকে ফোন করে কোড বললেই তিনি সেটি ছাড়িয়ে নেন।
ছাই রঙের একটি অটোরিকশা চালান মো. রাসেল। গত বৃহস্পতিবার তার গাড়ির যাত্রী হয়ে এই প্রতিবেদক আগারগাঁও থেকে মহাখালী আসছিলেন। আগারগাঁও সিগন্যালে সব গাড়ি জেব্রা ক্রসিংয়ে থামলেও রাসেল গাড়িটি নিয়ে জেব্রা ক্রসিংয়ের উপরে উঠে যান।
পুলিশ মামলা দিতে পারে এই কথা বলার পর রাসেল উল্টো বলেন, “মাসে মাসে সাড়ে চার হাজার কইরা টেকা দিই। সব গাড়ি পুলিশে ধরলেও এই গাড়ি ধরব না।”
রাসেল বলেন, “আমাগো লগে কন্টাক (চুক্তি) হইছে, কুনো পুলিশ এই গাড়িত্তে কুনো টেকা খাইলে সেইটা যেই স্যারের কাছে মান্তি করছি হ্যার টেকা থিকা কাটা যাইব। একেবারে গ্যারান্টি ভাই, গ্যারান্টি।”
রাসেল জানান, তিনি সাত বছর ধরে ছাই রঙের অটোরিকশা চালান। কোভিড মহামারী আগে ব্যক্তিগত হিসেবে নিবন্ধিত এইসব ছাই রঙের গাড়িপ্রতি মাসে ছয় হাজার টাকা করে ‘মান্তি’ দিতে হত। এখন সেই মান্তি কমে চার হাজারে এসেছে।
যখন মান্তি বেশি ছিল তখন এই গাড়িগুলো সাড়ে তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকায় হাত বদল হত। এখন পুলিশি ঝামেলা ‘কম থাকায়’ এই গাড়ি ১০ লাখের নিচে পাওয়া যায় না।
গাড়ির জমাও এখন বেড়েছে। আগে ৫০০ টাকাও জমা নিতেন মালিকরা। এখন সারাদিন চালালে জমা হাজার টাকা। আর দুই বেলা গাড়ি চললে প্রতিবেলার জন্য ৬০০ টাকা করে জমা দিতে হয় বলে রাসেলের ভাষ্য।
তার দাবি, এখন ঢাকায় যেসব ছাই রঙের অটোরিকশা চলে, তার বেশিরভাগের মালিক ‘সরকারি কর্মকর্তা’।
ঢাকা মহানগর সিএনজি অটোরিকশা ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি হাজী বরকতুল্লাহ বুলু বলেন, “একেবারে গায়ের জোরে সব আইন-কানুন অমান্য করে এই গাড়িগুলো চালাইতেছে পুলিশ। এখন কেবল ছাইরঙের (ঢাকা মেট্রো-দ) গাড়িগুলান না, ঢাকা জেলা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর নম্বরের গাড়িও মান্তি দিয়া দেদারছে চলতাছে।”
বরকতুল্লাহর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা মহানগরে বাণিজ্যিকভাবে যাত্রী বহনের অনুমতিপ্রাপ্ত সবুজ নম্বরপ্লেটের অটোরিকশা আছে ১৫ হাজার ৬০০। অন্যদিকে ঢাকা মেট্রো নম্বরের ব্যক্তিগত নিবন্ধিত অটোরিকশা রয়েছে ৩ হাজার ৯৫৭টি। ঢাকা জেলায় চলাচলের জন্য নিবন্ধিত, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর এমনকি মুন্সীগঞ্জে নিবন্ধিত গাড়িও এখন ঢাকা শহরে চালাচ্ছেন এক শ্রেণীর মালিক। সব মিলিয়ে এদের সংখ্যা ২০ হাজারের বেশি হবে।
“এখন আপনি হিসাব করেন, ২০ হাজার গাড়ি গড়ে ৪ হাজার করে টাকা দিলে মাস শেষে কত টাকা মান্তি ওঠে।”
‘হ্যারা চলে রাজার লাহান’
ঢাকা মহানগরে বাণিজ্যিক হিসেবে নিবন্ধন পাওয়া সবুজ অটোরিকশার চালকরা বলছেন, সিগন্যালে একটু ‘উল্টো-পাল্টা’ করলেই পুলিশ তাদের আটকায়। তবে ছাই রঙের অটোরিকশার সব মাফ।
সবুজ অটোরিকশার চালক শেখ ফারুক বলেন, “আমাগো গাড়ির দামও বেশি, ডেইলি জমাও বেশি, আবার পুলিশের প্যারাও (হয়রানি) বেশি। মিটারে চালাইলে তো পুষবই না। আর ওরা (অবৈধরা) যেই ভাড়ায় যাইতে পারব, আমরা সেই টাকায় যাইতে পারি না।
“আমরা সিগন্যালে এদিক-ওদিক করলেই মামলা, কুনো কথা নাই। আর হেই গাড়িগুলানরে পুলিশ কিছুই কয় না। হ্যাগোরে কওয়ারও তো কিছু নাই, হ্যারা তো অবৈধই। বেশিরভাগের কাগজই নাই, মামলা দিব কিসের উপ্রে। হেগুলার একমাত্র উপায় ডাম্পিংয়ে পাডানো। তয় পুলিশই তো টেকা খায়, তারা কী আর হেইডা করব? শুধু টেকার জোরে এই গাড়িগুলান হ্যারা চালাইয়া খাইতেছে।”
পুরনো অটোরিকশা ব্যবসায়ী বুলু বলেন, “এদের (অবৈধ) দাপটে অহন আমরাই কোনঠাসা। হ্যারা এইহানে অবৈধ। কিন্তু হ্যারা রাস্তার চলে রাজার লাহান আর আমরা বৈধ হয়েও পদে পদে হয়রানির শিকার হই। পুরা খেলাটাই হচ্ছে টেকার। আগে ঢাকার বাইরের কিছু গাড়ি রাইতের বেলায় ঢাকা ঢুইকা চুপচাপ কিছু ভাড়া মাইরা বাইর হইয়া যাইত। এহন এগুলা সারাদিনই চলে। ঢাকা শহরের গ্যারেজেই এগুলারে রাখে মালিকরা।”
ঢাকার মগবাজার রেল গেইটের একজন গ্যারেজ মালিক নাম না প্রকাশের শর্তে বলছেন, সবুজ নম্বর প্লেটের একটি গাড়ির দাম এখন ১৭-১৮ লাখ টাকা। এর অর্ধেকে একটা ছাই রঙের গাড়ি পাওয়া যায়। তারও অর্ধেকে ঢাকার বাইরের নম্বরের গাড়ি পাওয়া যায়। এখন ‘পুলিশকে ম্যানেজ’ করার বিষয়টি সবাই জেনে যাওয়ায় অল্প পুঁজিতে বেশি লাভের আশায় অনেকেই ঢাকার বাইরের গাড়ি বা ছাই রঙের গাড়ি কিনছেন।
এসব গাড়ির মালিকদের বেশিরভাগ নাকি সরকারি কর্মকর্তা– এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওই গ্যারেজ মালিক বলেন, “এই গাড়িগুলান চলেই পুলিশের নামে। পুলিশ ছাড়া আর কেউ এগুলি ঢাকা শহরে চালাইতে পারব না।”
পুলিশ কী বলছে?
হাই কোর্টের রায়ের পরেও কীভাবে অবৈধ অটোরিকশা চলছে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মুনিবুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যারা এই গাড়িগুলো চালায় তারাও জানে যে এগুলো অবৈধ। তারা জেনেশুনেই চালাচ্ছে। আমরা সব সময়ই তাদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করছি।
“আর বিভিন্ন জেলা থেকে যে গাড়িগুলো ঢাকায় ঢুকছে তারা (সংশ্লিষ্ট জেলা কর্তৃপক্ষ) যদি চেক করতে পারত, তাহলে কিন্তু এই গাড়িগুলো আমাদের এখানে আর আসে না। আপনি খেয়াল করলে দেখবেন, ঢাকার গাড়ি কিন্তু বেশি বাইরের জেলায় যায় না।”
তিনি বলেন, “আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে বাইরের অনেক জায়গায় সিএনজি স্টেশন নাই। যেমন কেরানীগঞ্জে সিএনজি স্টেশন নাই, সাইনবোর্ডের ওদিকেও নাই। যে কারণে সিএনজি নিতে তারা ঢাকায় ঢুকে বিভিন্নভাবে অবৈধ ট্রিপ ধরে। যে কারণে সমস্যা হয়। যখনি আমাদের নজরে আসে তখনি আমরা ধরি। আর ছাই রঙের অটোরিকশাগুলো যে ভাড়া মারে এগুলো আমাদের নজরে এলে কিন্তু আমরা আইনগত ব্যবস্থা নিতে সচেষ্ট থাকি।”
চালক-মালিকদের কাছ থেকে ‘মাসোহারা’ নেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে মুনিবুর বলেন, “আমরা যদি দেখি যে কেউ অবৈধ কোনো ট্রানজ্যাকশনে জড়িত আছে বা কোনো অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে আগেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, এখনো নেওয়া হবে।”
তবে ‘মাসোহারার’ বিষয়টি পুলিশ জানে না, তা মানতে নারাজ সিএনজি অটোরিক্সা মালিক সমিতির সভাপতি হাজী বরকতুল্লাহ বুলু।
পুলিশ কর্মকর্তা মুনিবুরের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, “মান্তি তো ঢাকা শহরে ওপেন সিক্রেট। উনি ট্রাফিকের হেড, আর উনি এইসব জানবেন না, এটা কোনো কথা?”
তিনি বলেন, “আমরা যখন হাই কোর্টের অর্ডার বাস্তবায়নের জন্য ডিএমপি কমিশনার স্যারের কাছে যাই, স্যার আমাদের ট্রাফিক (অতিরিক্ত কমিশনার মুনিবুর) স্যারের কাছে পাঠান। তখন মুনিবুর স্যার আমাদের সামনে ওয়্যারলেসে একটা মেসেজ দিয়ে দেন। তখন হঠাৎ করে কয়েক ঘণ্টার জন্য এই গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরদিন এই অবৈধ গাড়ির ড্রাইভারদের ডাইকা ডাইকা সার্জেন্ট-টিআইরা রাস্তায় নামায়। স্যার চাইলে সব সম্ভব বলে আমরা বিশ্বাস করি।”