বাদাম, সরিষা আর অল্পবিস্তর ধান চাষেই চলে স্থানীয় মানুষের জীবন। তবে সময় বদলেছে; দুর্মূল্যের বাজারে বাড়তি আয় আর সঞ্চয়ের আশায় প্রতিটি পরিবারেই যোগ হয়েছে গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি।
Published : 13 Apr 2024, 09:22 AM
লোকালয় থেকে বহু দূরে, নদীর ধার ঘেঁষা বিস্তীর্ণ বালুর মাঠ জুড়ে, সন্ধ্যায় ভেসে আসে শেয়ালের হাঁক।
সেখানে গোধূলিতে শূন্য হয় মাঠ, সরু পথে পড়ে থাকে সহস্র পায়ের ছাপ, ভোরের আলোয় সেই পথে নামে জনস্রোত আর ব্রহ্মপুত্রের মাঝিদের হাঁকডাক।
নদী ঘেঁষা দুর্গম চরের ‘খামার বাঁশপাতা’ গ্রামের এই চিত্র যেন জীবনান্দ দাশের ‘এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে’ কবিতার বর্ণনার মত। সবুজ ফসলের মাঠ, কড়া রোদে জ্বলজ্বল করে টিনের চালার ঘর, লাগোয়া উঠোন, খড়ের গাদা ঘেঁষা মাচায় ঝোলা দু-চারটা লাউ-কুমড়া।
স্বাভাবিক যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে বেশ দূরে খামার বাঁশপাতায় দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট। গোছানো ঘর, আঙিনা আর চরের সবুজ মাঠে রাখালের দূরন্তপনার দৃশ্যেই মেলে তাদের জীবনযাপনের চিত্র। ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে লড়াই করে তারা টিকে আছে বছরের পর বছর।
উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামের চিলমারীর অষ্টমীর চর ইউনিয়নের একটি বিচ্ছিন্ন গ্রাম খামার বাঁশপাতা। বাদাম, সরিষা আর অল্পবিস্তার ধান চাষেই চলে এখানকার মানুষের জীবন।
তবে সময় বদলেছে; দুর্মূল্যের বাজারে বাড়তি আয় আর সঞ্চয়ের আশায় প্রতিটি পরিবারেই যোগ হয়েছে গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি।
চিলমারী ঘাট থেকে নৌকায় ব্রহ্মপুত্র পাড়ি দিয়ে নামতে হয় খামার বাঁশপাতার মাটিতে। তবে লোকালয় আরো দূরে। সেখানে যেতে হয় পায়ে হেঁটে, অবশ্য ঘোড়ার গাড়িও চলে।
দুর্গম এই গ্রামে ঢুকেই কথা হয় গৃহবধূ সালমা বেগমের সঙ্গে। এপ্রিলের খাঁ খাঁ রোদের মধ্যে নিজের নিকানো উঠোনে দাঁড়িয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলছিলেন, “আবাদ-সুবাদ তো হামরা খলানোত (উঠানে) শুকাই। খলান না লেপলে তো ধানের সাতে মাটি উটি আসপে; তকন ঝাড়ার কষ্ট। এর জইন্যে খলান লেপা থাকে।”
সালমা বেগমের কাছে শোনা গেল খামার বাঁশপাতার মানুষের জীবনের গল্প। চরের প্রধান ফসল বাদাম, পাশাপাশি সরিষা আর ধানও হয়। ধান যেটুকু হয়, তাতে নিজেদের সারা বছরের খোরাকি চলে। অন্য ফসল বিক্রি করে মেলে কিছু নগদ টাকা।
তবে ঝড়ঝাপ্টা, বন্যা আর নদীভাঙনের মত দুর্যোগের কারণে কেবল চাষাবাদের ওপর নির্ভর করলে এখন চলে না। সে কারণেই গ্রামের মানুষ বাড়িতে হাঁস-মুরগি কিংবা গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ পালনে ঝুঁকছেন।
চরের মানুষের কাছে ‘মুরব্বি’ হিসেবে পরিচিত মফিজুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটেকার (এখানকার) মানুষ আবাদ সুবাদ করি চলে। তারবাদে দুই-চাইরটা গরু ছাগলও পুষি, দুধ পোয়া (পাওয়া) যায়। যকন কুরবানির ঈদ আইসে, গরু ভালো দামে বেচে টাকাও কামাই করা যায়।”
খামার বাঁশপাতায় অন্যদের চেয়ে স্বচ্ছল মফিজুল। চরের মানুষের জীবন নিয়ে আলাপে তিনি বলেন, “তোমার তো জমি-জাগা, সোনা-দানা সম্পদ; হামার সম্পদ গরু-ছাগল। মোর নিজের নয়টা গরু, তিনটা ভেড়া। বাঁশপাতা চরে গরু আছে তিন হাজারের মত।”
পুরো খামার বাঁশপাতা ঘুরে মফিজুল হকের বর্ণনার প্রমাণও পাওয়া গেল। এখানকার প্রায় প্রতিটি বাড়ির আঙিনায় রয়েছে গোয়ালঘর। পাশেই গরুর খাবার আর বিশ্রামের জায়গা।
এই চরে একসময় ভয়ঙ্কর দুঃসময় কেটেছে স্থানীয় দুলারী বেগমের। ২০০৪ সালের বন্যায় ব্রহ্মপুত্রের ভয়াল থাবায় স্বামীসহ সর্বস্ব খুঁইয়েছিলেন তিনি।
পুরনো সেই স্মৃতি স্মরণ করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দুলারী বলেন, “মোর দেওয়ানি (স্বামী) মরছে ২০০৪ সালের বানোত। ছাওয়া ছোট নিয়া দিশাহারা হইছুনু। পরে সরকার থাকি একটা গরু দিলে। এখন মোর পাঁচটা গরু। অ্যার ভিতর কয়বার গরু বেচনু। আবাদ করি কোনোরকম চলে।”
বড় কোনো বিপদে পড়লে বাড়ির আঙিনায় বাঁধা দু-চারটে গরু-ছাগলই যে তাদের ভরসা, সে কথাই জানালেন দুলারী বেগম।
বছর দুই আগের বন্যায় দুলারীর মতই বিপদে পড়েছিলেন চরের বাসিন্দা আবু তালেব। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “২০২২ সালের বানের পানিত চর ঢুবি গেইলো, তকন হাতোত একটা টাকাও না আছলো। ছাওয়ার ঘর প্যাটের ভোকে (ক্ষুধায়) মরে। কয়দিন পর দুকনা গরু বেচে বাড়ি ঘর ঠিক করনু। তকন গরু দুকনা না থাকিলে সবাকে মরা নাগিল হয়।”
চরের আরেক বাসিন্দা রুহুল আমিন বলছেন, “গরু ছাগল পুষিলে হামার খরচ হয় না তেমন। দোলায় ডাঙায় মেলা ঘাস। সেগলা খাইলে গরু ছাগল তাজা। এলা তো সগায় গরু ছাগল পুষে।
“বিয়ান বেলা গরু ছাড়ি দিয়া আইলে গরু ছাগল আপন মনে ঘাস খায়া সইন্দার সময় বাড়ি আইসে। কোনো খাটুনি নাই।”
খামার বাঁশপাতার বিস্তীর্ণ মাঠে নিজেদের মহিষের পাল আর ভেড়া চরাচ্ছিল ১৪ বছরের কিশোর রাসেল। আর্থিক অনটনে স্কুলে যাওয়া হয় না তার।
রাসেলের ভাষ্য, “টাকার অভাবে আর মোর পড়াশুনা হইল না। মোর ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ত। অয় প্রাইভেট পড় (পড়িয়ে), সেই টেকা দিয়া এই গরু মইষ কিনি দিছে, মুই যেন স্বাবলম্বী হবার পাও। গরু মইষগুলা তো আগোত ছোট আছিল, একন বড় হইছে।”
এই মহিষগুলোই রাসেলের সংসারের হাল। সেগুলোর কিছু বেচে নিজেদের বাড়িঘর ঠিক করার স্বপ্ন দেখে সে।
“আশা তো করঙ হামার নিজের জইন্যে দুইটা থুইয়া বাকিগুলা বেচে ফেলাইম কুরবানির ঈদদ। বাড়িঘর ঠিক করা নাইগবে।”
গবাদি পশু পালনের মাধ্যমে চরের মানুষগুলো যেন ঘুরে দাঁড়াতে পারে সেই লক্ষ্যেই সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা জানালেন চিলমারীর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. আলতাব হোসেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “চরাঞ্চলে বাসিন্দাদের জন্য আমরা চেষ্টা করছি চাহিদা-মাফিক সুবিধা দেওয়ার। এজন্য আমাদের ইউনিয়নভিত্তিক প্রডিউসার গ্রুপ বা সমিতি আছে। কিছু সার্ভিস প্রোভাইডারও আছে।
“এখানে মহিষ পালন থেকে শুরু করে প্রকল্প সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এছাড়া বিভিন্নভাবে গবাদি পশু পালনেও সহায়তা করা হয়ে থাকে। অষ্টমীর চরেও আমাদের এমন একটি গ্রুপ আছে। ধরেন- কারো ক্ষুরা রোগের টিকা দেওয়া লাগবে, দিবে। আবার কেউ চায় তড়কার টিকা, তাকে সেটা দেওয়া হয়। প্রকল্পের আওতাধীন না হলেও আমরা চেষ্টা করি সেবা দেওয়ার।”
প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প (এলডিডিপি) প্রধান কারিগরী সমন্বয়কারী গোলাম রব্বানী বলেন, “চিলমারী আমাদের এলডিডিপি প্রকল্পের মধ্যে পড়ে। সেখানে একটা ফারমার্স গ্রুপ আছে, যেখানে নির্বাচিত খামারিরা বা পশুপালনকারীরা সুবিধা পায়।
“এছাড়া চরাঞ্চলের জন্য আমাদের সুনির্দিষ্ট প্রকল্প আছে, আপনি যে চরটির (খামার বাঁশপাতা) কথা বললেন, সেখানে প্রকল্পের আওতা বাড়াবার চেষ্টা করছি। বাংলাদেশের গবাদি পশু পালন এখনো ‘ইন্টিগ্রেটেড’ পর্যায়ে আছে। তো সেই জায়গা থেকে এসব ছোট ছোট পর্যায়ে গবাদি পশু পালনের ভূমিকা অনেক।”