জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পর ক্ষুব্ধ অনেকেই জীবন-জীবিকা নিয়ে চরম উদ্বেগে।
Published : 06 Aug 2022, 08:50 PM
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পর ক্ষুব্ধ অনেকেই জীবন-জীবিকা নিয়ে চরম উদ্বেগের কথা বলছেন, সেই সঙ্গে ঢাকায় টিকতে পারা নিয়ে অনিশ্চয়তার কথাও বলছেন অসহায় কণ্ঠে। আর ঢাকা ছেড়েইবা সহায়-সম্বলহীনরা কী করবেন, তার কূল-কিনারা ভেবে পাচ্ছেন না।
মহামারীর অভিঘাতের মধ্যেই ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে শনিবার থেকে দেশে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে এক লাফে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত। এবার চার ধরনের তেলের দাম বেড়েছে, যার মধ্যে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম আরেক দফা বাড়ানো হয়েছিল গত নভেম্বরেই।
এমন ঘনঘটায় অসহায়ত্বের কথা বললেন মিরপুরের উত্তর পীরের বাগের বাসিন্দা জহির উদ্দিন। তার কথায়, “স্ত্রী ও দুই বাচ্চা নিয়ে আমার সংসার। ছোট একটি দোকান চালিয়ে সংসার চালাতাম। কিন্তু দুই বছর ধরে জীবন ধারণের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় একটি বীমা কোম্পানিতেও মাঠের কাজ করি।
“এই দুই কাজ করেও দুই বাচ্চার পড়াশোনার খরচ মিটিয়ে ঠিকমতো দুই বেলা খেতে-পরতে হিমশিম খাচ্ছি। এরমধ্যে যদি নতুন করে ব্যয় বাড়ে, তাহলে মনে হয় আর ঢাকায় থাকতে পারব না!”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে জহির জানালেন, গ্রামে গিয়েও কিছু করার মতো তার অবলম্বন নেই।
“নতুন করে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করা হলে যে হারে খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, তাতে বেঁচে থাকতে পারব বলে মনে হচ্ছে না।”
এবার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৪২.৫% বেড়ে হয়েছে প্রতি লিটার ১১৪ টাকা। পেট্রোলের দাম ৫১.১৬% বেড়ে প্রতি লিটারের দাম হয়েছে ১৩০ টাকা। আর অকটেনের দাম বেড়েছে ৫১.৬৮%, প্রতি লিটার কিনতে গুনতে হবে ১৩৫ টাকা। এর আগে গত ৩ নভেম্বর ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ২৩ শতাংশ বাড়িয়ে করা হয়েছিল ৮০ টাকা।
ডাইং কারখানায় রাসায়নিক সরবরাহকারী এক কোম্পানির কর্মকর্তা নাজমুল আহসান পারভেজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দেশে বিশেষ করে সকল ধরনের খাদ্য পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে এখন আমরা অনেক চাপে আছি। এর মধ্যে আবার জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে নিশ্চিতভাবে নতুন করে বাড়বে সকল ধরনের পণ্যের দাম।
তিনি বলেন, “সম্প্রতি সরকার প্রধান বললেন, যে আমাদের পেট্রোল ও অকটেন আমদানি করতে হয় না। তাহলে এই পরিস্থিতিতে জ্বালানি দাম কার স্বার্থে বাড়ানো হচ্ছে?”
পণ্যের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে জ্বালানি তেল যে সরাসরি প্রভাব ফেলে, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে নাজমুল বলেন, “চাহিদা অনুযায়ী খেতে না পারলে এবার আঘাত আসবে আমার পুষ্টিতে।”
চোখেমুখে উদ্বেগ নিয়ে তিনি বললেন, “এখন আমার ভয় লাগছে, বাংলাদেশও কি তাহলে শ্রীলঙ্কার পথে হাঁটছে? শ্রীলঙ্কায় তো সরকার দেউলিয়া হয়েছে, বাংলাদেশে কি সাধারণ মানুষ দেউলিয়া হবে?”
শনিবার সকাল ১০টায় রাজধানীর বাসাবো বিশ্বরোড এলাকা থেকে মহাখালী যাওয়ার জন্য রাইড শেয়ারিং অ্যাপ উবারে মোটরসাইকেলে ভাড়া দেখাচ্ছিল ১৯৬ টাকা। বাইকার রফিকুল ইসলামকে ফোন করা হলে তিনি অতিরিক্ত ৫০ টাকা দাবি করে বসেন। কারণ জানতে চাইলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিবেদককে বলেন, “তেলের দাম এখন যে পরিমাণ বেড়েছে, ভাড়া বাড়িয়ে না দিলে পোষাবে না।”
একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত আফিরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার স্যালারি হয় মাসের পাঁচ তারিখে। সেদিন আমি মোটরসাইকেলে অকটেন পূর্ণ করি।
“এবার পাঁচ তারিখ শুক্রবার হওয়ায় বেতন হয়নি। আর তেলের দাম বাড়ার খবরটা রাতে জানতে পেরেছি। তাই আর ফিলিং স্টেশনে যাওয়া হয়নি। এখন অতিরিক্ত দামেই তেল কিনতে হবে।”
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির খবর শুনেই আঁতকে ওঠেন বলে জানালেন মিরপুরের রূপনগর এলাকার বাসিন্দা হেলাল উদ্দিন। দেশগ্রুপের এ কর্মকর্তা বলেন, “শ্রীলঙ্কায় সরকার দেউলিয়া হয়েছে। আমাদের দেশে শোষণ করে সরকার ধনী হবে, কিন্তু কম আয়ের মানুষ দেউলিয়া হবে।”
তেজগাঁও কলেজের অনার্স চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আমিনুল ইসলাম পড়াশোনার পাশাপাশি একটি সুপারশপে খণ্ডকালীন চাকরি করেন। তিনি তেলের দাম বৃদ্ধির বিষয়টিকে এভাবে দেখছেন, “জ্বালানির দাম একলাফে হুট করে এতটা বেড়ে গেল। এখন হয়তো অনেকের গায়ে লাগছে না। এই দামেই যদি তেল কিনতে হয়, তাহলে আমরা যারা বাইক চালাই, পরবর্তীতে খুব খারাপ অবস্থায় পড়ে যাব।
“আমরা আসলে সবকিছু খুব সহজেই মেনে নিই, আর তাই আমাদের সাথেও বেশি বেশি অন্যায় হয়।”
খিলগাঁও থেকে রাইদা পরিবহন বাসে পোস্তগলা যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন তানজিনা খুশবু। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কিছুদিন আগেও গণপরিবহনের ভাড়া নিয়ে একটা ঝামেলা হল। জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই বাসভাড়া বাড়বে। আমরা যারা লোকাল বাসে যাতায়াত করি, তারা বাড়তি ভাড়া দিতে দিতে বিরক্ত! তাহলে তো আমরা সিএনজিতেই যেতে পারি!”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী সাইফুল কবির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন পাঠাও, উবারের খরচ বেড়ে যাবে, বাসভাড়া বেড়ে যাবে। যাদের নিজেদের গাড়ি আছে, তারাও হিমশিম খাবে। যারা গণপরিবহনে যাতায়াত করে তারাও হিমশিম খাবে। এভাবে কি বাঁচা সম্ভব? একের পর এক জিনিসপত্রের দাম বেড়েই চলছে। মানুষ বাঁচবে কী করে?”