“মানুষের শোনা প্রয়োজন- নারীরা কী চায়, নারীদের কী প্রয়োজন, দাবিটা কী। নারী তো অন্যায্য কিছু চাচ্ছে না, নারীর হিস্যাটা বুঝে নিতে চায়; সেটাই তো বাধার মুখে পড়ে।”
Published : 09 Mar 2025, 01:29 AM
এ মাসটিই যেহেতু হাতে আছে, তাই এর মধ্যে নিজেদের প্রতিবেদন প্রকাশের প্রস্তুতি নিচ্ছে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন।
প্রতিবেদন তৈরিতে সংস্কার কমিশন ঢাকা ও ঢাকার বাইরের সব শ্রেণিপেশার নারীদের সঙ্গে সভা করেছে। তাদের মতামত এবং কমিশনের সদস্যদের পর্যবেক্ষণের সম্মিলনে সুপারিশ তৈরির কথা বলছেন কমিশনের প্রধান শিরীন পারভীন হক।
কী কী সুপারিশ থাকতে পারে, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের এমন জিজ্ঞাসায় তিনি বলেছেন, যেসব ক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্য হচ্ছে সেগুলো তারা খুঁজে বের করে পরিত্রাণের সুপারিশ রাখবেন।
“সেটা আইনে হোক, সংবিধানে হোক, নীতিতে হোক, কর্মসংস্থাতে হোক। আমরা ছক করে নিয়েছি সংবিধান ও আইন, প্রাতিষ্ঠানিক, কর্মসূচি, নীতি- সেগুলোর যেখানে বৈষম্য রয়েছে সেগুলোর বৈষম্য বিলোপের সুপারিশ থাকবে। এটা হবে বৈষম্য বিলুপ্তি এবং সমতার পক্ষে পদক্ষেপ নেওয়া।”
তবে কমিশনের অনেক সুপারিশই নানা বাধার মুখে পড়তে পারে, সে আশঙ্কাও করছেন তিনি।
এর কারণ হিসেবে শিরীন পারভীন হক বলছেন, নারীদের ব্যাপারে বাংলাদেশের সমাজ এখনও রক্ষণশীল। এর সঙ্গে নারী বিদ্বেষও রয়েছে।
“এটার আমরা নমুনা দেখতে পাচ্ছি। নারী বিদ্বেষী সমাজ, নারীর প্রতি বৈষম্য করে, জাজ করে এমন সমাজেইতো আমরা বাস করছি। সুতরাং অনেকগুলো সুপারিশই আমি জানি গ্রহণ করা হবে না বা অনেক বাধা আসবে। কিন্তু তারপরও আমরা সুপারিশগুলো করব, এ কারণে করব- এ সুপারিশগুলো মানুষ শুনুক, জানুক এবং এগুলো নিয়ে মানুষ বিতর্ক করুক, সমালোচনা করুক, যাই করুক পাবলিক পর্যন্ত অন্তত এ বিষয়গুলো উঠে আসুক।
তিনি বলেন, “মানুষের শোনা প্রয়োজন- নারীরা কী চায়, নারীদের কী প্রয়োজন, দাবিটা কী। নারী তো অন্যায্য কিছু চাচ্ছে না, নারীর হিস্যাটা বুঝে নিতে চায়; সেটাই তো বাধার মুখে পড়ে।”
জুলাই-অগাস্টে কোটা সংস্কার থেকে সরকার পতনের আন্দোলনে নারীদের জোরালো অংশগ্রহণ থাকলেও এরই মধ্যে তাদের ‘অদৃশ্য’ করে ফেলা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন শিরীন পারভীন হক।
তিনি বলেন, “তাদের দেখাই যাচ্ছে না। এই মেয়েদের দেখে তো আমরাও অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। যে কয়টা মেয়েকে সামনে পেয়েছি, বলেছি- ‘জায়গা ছাড়বা না’। জায়গা ছাড়লে আমাদের সমাজে যে প্রবণতা, পুরুষের আধিপত্য- সেটাই বজায় থাকবে।”
সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেছেন, সুপারিশগুলো তিন ভাগে বাস্তবায়নের জন্য তৈরি করা হবে। এর মধ্যে কিছু সুপারিশ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, কিছু মধ্যম মেয়াদে- যেগুলো নির্বাচিত সরকার বাস্তবায়ন করবে আর কিছু সুপারিশ দীর্ঘমেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য রাখা হবে।
স্বাধীনতা দিবসে কমিশনের সুপারিশগুলো জনপরিসরে প্রকাশ করার পরিকল্পনা রয়েছে নারী সংস্কার কমিশনের।
“এর আগে আমরা কোনো সুনির্দিষ্ট সুপারিশ প্রকাশ করতে চাচ্ছি না। আমাদের দলিলটা হবে- নারীর মুক্তির পক্ষে, নারীর স্বাধীনতার পক্ষে,” বলেন শিরীন পারভীন হক।
ক্ষমতার পালাবদলের পর অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রের অন্যান্য খাতের মতো নারীদের বিষয়েও পরিবর্তন আনতে গত ১৮ নভেম্বর ‘নারীপক্ষ’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিরীন পারভীন হককে প্রধান নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন গঠন করে।
৯০ দিনের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা ছিল। পরবর্তীতে মেয়াদ বাড়িয়ে ৩১ মার্চ করা হয়।
কমিশনের কাছে কী প্রত্যাশা?
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেছেন, তারা নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের কাছে সুপারিশ পাঠিয়েছেন। সেখানে তাদের মূল চারটি সুপারিশ রাখা হয়েছে।
“নারীদের সংরক্ষিত আসন বাড়ানো এবং সরাসরি ভোট, সিডও সংরক্ষণ প্রত্যাহার, বাল্যবিয়ের বিশেষ বিধান প্রত্যাহার, সহিংসতা প্রত্যাহারে হাই কোর্টের রায় আছে… অফিসে অফিসে অভিযোগ কমিটি করতে হবে, যৌন হয়রানির জন্য কী শাস্তি হবে, কোন ধরনের যৌন হয়রানিতে কী শাস্তি হবে- এরকম নির্দেশনার আইন করতে হবে।”
বর্তমানে সংসদে নারীদের জন্য ৫০টি সংরক্ষিত আসন রয়েছে। জনসংখ্যা বাড়ার ফলে সংরক্ষিত আসন বাড়িয়ে ১৫০টি করার প্রস্তাব করেছে মহিলা পরিষদ।
জাতিসংঘ কর্তৃক পুরুষের সমান পর্যায়ে নারীর মানবাধিকার আদর্শগত ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে ১৯৮১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ঐতিহাসিক সিডও সনদ বা নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য নিরসন সনদ পরিগৃহীত হয়। বাংলাদেশ ১৯৮৪ সালের ৬ ডিসেম্বর কিছু ধারা সংরক্ষণ সাপেক্ষে সিডও সনদ অনুমোদন করে।
সিডও সনদের ২ এবং ১৬ (১) এর গ ধারায় সংরক্ষণ আরোপ করায় এই ধারা অনুযায়ী প্রচলিত আইনে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক ধারার সংশোধন এবং বৈবাহিক জীবনে নারী-পুরুষ সমান অধিকার পাচ্ছে না।
ফওজিয়া মোসলেম বলেন, “এগুলো প্রত্যাহার না হলে সিডও’র বাকি ধারাগুলোর জায়গাটা সীমিত হয়ে যায়।”
এর বাইরে আদিবাসী নারীর অধিকার. কর্মক্ষেত্রে নারী শ্রমিকের পরিবেশ, রাস্তাঘাটে নারীর নিরাপত্তা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মস্থলে এবং গণপরিসরে নারী সহিংসতা প্রতিরোধের জন্য আইন রাখার প্রস্তাব করেছেন তারা। যেগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েই বাস্তবায়ন করা সম্ভব বলে মনে করছেন ফওজিয়া মোসলেম।
গত শনিবার রাজধানীর লালমাটিয়ায় দুই তরুণীর প্রকাশ্যে ধূমপান নিয়ে বয়স্ক একজনের ‘আপত্তি’ থেকে ‘বাকবিতণ্ডা’কে কেন্দ্র করে মুহূর্তেই মব তৈরি হয়। পরে ওই দুই তরুণীকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ।
এরপর মোহাম্মদপুর থানায় প্রায় চার ঘণ্টা ধরে দুই পক্ষের 'দেন-দরবারে আপসের' পর তাদেরকে পরিবারের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়।
এ প্রসঙ্গ টেনে মহিলা পরিষদের সভাপতি বলেন, “এটা তো সহিংসতা হল একটা। এরকম সহিংসতা প্রতিরোধের জন্য আমাদের আইন থাকতে হবে। নারীর স্বার্থ রক্ষায় আইন আছে, আইনগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে হবে, নারীকে তার দাবি তুলতে হবে।”
বাজেটে নারীর জন্য যে বরাদ্দ রাখা হয় সেটাকে সহিংসতা প্রতিরোধ, নারীর কর্মসংস্থান, নারীর ক্ষমতায়ন, সেফটি নেটওয়ার্ক বাড়ানোর ক্ষেত্রে ব্যবহারের কথা বলেছেন তিনি। পাশাপাশি এর ব্যবহার সঠিকভাবে হচ্ছে কি না, তা সরকারকে নিয়মিত তদারকি করার কথাও বলছেন ফওজিয়া মোসলেম।
ক্ষুদে ব্যবসায়ী গীতা রানী বিশ্বাস কমিশনের কাছে নারীদের কর্মসংস্থান বাড়ানোর সুপারিশ রাখার প্রত্যাশা করছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমাদের তো সবসময় অর্থের অভাব থাকে। এজন্য কিছু করার সাহস করতে পারি না, করলেও ছোটখাটো কিছু করতে হয়।
“সরকার যদি আমাদের (নারীদের) অর্থ, ট্রেনিং দিয়ে কাজের ব্যবস্থা করে দিত তাইলে মহিলারা অনেক আগাইতে পারবে। এরকম সুপারিশ রাখলে ভালো হয়।”
সম্প্রতি পথে-ঘাটে নারী হেনস্থার ঘটনা বেড়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ তুলে মিরপুরের বাসিন্দা নাজনীন নাজু বলছেন, এখন তার একা বাইরে বের হতে ভয় হয়। ফলে কমিশনের কাছে নারীদের চলাফেরায় নিরাপত্তার সুপারিশ রাখার দাবি করছেন তিনি।
“আজকে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভয়ে যেতে পারিনি। ছেলেদের সময় নেই। সমাজে বা দেশে যে পরিবর্তনই আসুক, নারীদের যেন ভয় পেতে নাহয়, কোনঠাসা করা নাহয়- সে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ রাখতে হবে।”