“কোনো গাফিলতি, অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত হওয়ার সুযোগ নেই। আমাদের প্রত্যাশা আকাশচুম্বি এবং তারা আমাদের আশাহত করবেন না।”
Published : 09 Aug 2024, 11:50 PM
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নজিরবিহীন পরিস্থিতিতে দেশের শাসনভার নিয়েছে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
এ সরকার এমন এক সময়ে দায়িত্ব নিয়েছে, যখন হত্যা, ধ্বংসযজ্ঞের অভিজ্ঞতায় পুরো দেশ বিমূঢ়, থানাগুলো পুলিশশূন্য হয়ে পড়ায় ছিনতাই-ডাকাতির মত নৈরাজ্য ছড়িয়ে পড়েছে।
কঠিন এই সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে তিন চ্যালেঞ্জ দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং রাজনীতি ও নির্বাচন ব্যবস্থায় সংস্কার আনার ওপর সবার আগে জোর দিতে হবে দায়িত্ব পাওয়া উপদেষ্টাদের।
গণ আন্দোলনের মুখে গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের সরকারের অবসান ঘটে। এরপর বৃহস্পতিবার রাতে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ নেয়।
জরুরি স্থিতিশীলতা ফেরানো
দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনাটাই এখন সবচেয়ে জরুরি বলে মনে করছেন মানবাধিকার কর্মী খুশী কবির।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “যে হারে পুলিশ মারা হয়েছে, পুলিশ স্টেশন পোড়ানো হয়েছে- এগুলোকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা তো সময়ের ব্যাপার। তাদের আস্থা তো ফিরিয়ে আনতে হবে। পুলিশ ছাড়া কীভাবে আমরা দেশ চালাব? আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে পুলিশের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।”
জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদ-জানিপপের চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহ বলছেন, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, যে বিষয়টি এখন হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছে।
পরিস্থিতি বিবেচনায় নতুন সরকার দায়িত্ব ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করবে আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “এতোগুলো তাজা প্রাণের বিনিময়ে এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে। তাদের মনে রাখতে হবে, যে অমূল্য জীবনগুলো ঝরে গেছে, তাদের অমর্যাদা যাতে না হয়।
“কোনো গাফিলতি, অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত হওয়ার সুযোগ নেই। আমাদের প্রত্যাশা আকাশচুম্বি এবং তারা আমাদের আশাহত করবেন না।”
অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুরও দ্রুত নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়ে বলেছেন, সময় নষ্ট করা যাবে না। এখানে সেনাবাহিনীকে আরও সক্রিয় হতে হবে।
“দৈনন্দিন জীবনে যে সেবাগুলোর প্রয়োজন হয়, সেগুলো পেতে যেন বেগ পেতে না হয়। ঘুষ দিতে না হয়। বিভিন্ন জায়গায় সেবাটা ত্বরান্বিত করতে হবে। এটা করলে জনমনে একটা আস্থার জায়গা তৈরি হবে। এখানে খুব দ্রুত একটা পরিবর্তন আনতে হবে।”
বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, পুলিশ সাময়িক আতঙ্কের মধ্যে আছে। তারা অচিরেই তাদের দায়িত্ব পালনে সক্রিয় হবে। জনগণ তাদের সহযোগিতা করবে।
“বিগত দিনে সাধারণ মানুষের ওপর অনেক অত্যাচার করেছে। মানুষের ক্ষোভ জমেছে। বর্তমান সরকার ক্ষোভ কমানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেবে বলে মনে করি। আন্দোলনে বিজয়ীদের দায়িত্ব হচ্ছে দেশটাকে পরিচালনা করতে সহযোগিতা করা। পুলিশ যদি দায়িত্ব পালন করতে না পারে আইন শৃঙ্খলাও ঠিক থাকবে না।”
রাজনৈতিক সংস্কার
অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর রাজনৈতিক সংস্কারেও চ্যালেঞ্জ দেখছেন।
তিনি বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্র, তৃণমূল থেকে নেতৃত্ব বের করে আনতে হবে, নির্বাচন প্রক্রিয়ায়ও সংস্কার আনতে হবে। যাতে ২-৩ শতাংশের ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত হয়ে সংবিধান পরিবর্তন করতে না পারে। কোনো একটা দল যেন তার ইচ্ছায় সংবিধান পরিবর্তন করতে না পারে।”
স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করারও পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
নির্বাচন বিশ্লেষক নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহও নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন এনে ১ শতাংশ ভোট বেশি পেলেও কাউকে জয়ী নির্বাচন করার পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আসার তাগিদ দিয়েছেন।
বিদ্যমান নির্বাচন কমিশনকে সংস্কার করতে বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ।
“এ মুহূর্তে যে প্রধান রাজনৈতিক দল, তারা হয়ত সরকারের ওপর এ বিষয়ে চাপ প্রয়োগ করবে। সংবিধান অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশন কীভাবে পদত্যাগ করবে- সেটিই বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ এ নির্বাচন কমিশনকে এখন তারা চায় না।”
খুশী কবিরের মতে, শিক্ষার্থীরা যেসব সংস্কারের কথা বলছে, তা বাস্তবায়ন করাও চ্যালেঞ্জ হবে।
“তারা বলছে, একটা সময় ধরে থেকে ঠিক করে যাবে। তাহলে এটা আবারও একটা অগণতান্ত্রিক, জবাবদিহিহীনতা চলে আসে কিনা। এটা যদি একেবারে অনির্দিষ্টকাল হয়ে যায়, তখন কার কাছে তাদের জবাবদিহিতা থাকবে?”
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতিনিধি থাকা উচিত ছিল বলে মনে করেন প্রতিবন্ধী নাগরিক সংগঠনের পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সালমা মাহবুব।
“বৈষম্যহীন ছাত্র আন্দোলনের নেতারা সমতা এবং সাম্যের কথা বলেছেন। আমরা আশা করি, সেদিক বিবেচনা করেই তারা প্রতিবন্ধী মানুষের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করবেন। এছাড়াও আন্দোলনে বহু মানুষ প্রতিবন্ধিতা বরণ করেছেন, তাদের কথা ভুলে গেলে চলবে না।”
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য কোটা থাকলেও নতুন সরকারে তারা উপেক্ষিত কেন- সে প্রশ্ন রেখেছেন সালমা মাহবুব।
অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ
অধ্যাপক সাব্বির রিজার্ভ কমে যাওয়া, মূল্যস্ফীতি ও অর্থনীতিতে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির চাপ সামলানোর চ্যালেঞ্জও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
“সরকারের প্রধান দায়িত্ব হবে যারা অর্থ পাচার করেছে, তাদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করা। ডলারের মূল্যমান বেড়ে যাওয়া, সার্বিকভাবে উৎপাদন স্থিতিশীল আছে কিনা সেদিকে লক্ষ্য রাখা, একটি সামগ্রিক অর্থনৈতিক নীতিমালা বাস্তবায়নের মাধ্যমে যদি এগোনো যায় এবং সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তাহলে মানুষের জীবনে স্বস্তি আসতে পারে।”
আহসান মনসুরও বলছেন, সরকারকে অর্থনীতিতে পরিবর্তন আনার চ্যালেঞ্জ নিতে হবে।
“ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ে একটি কমিশন করতে হবে। যারা দুর্বল ব্যাংকগুলো নিয়ে কাজ করবে। কাকে কীভাবে উদ্ধার করতে হবে, সে বিষয়ে নির্দেশনা দিবে। স্টক মার্কেট, বন্ড মার্কেট, ইন্সুরেন্স সেক্টর নিয়ে আরেকটি টিমকে কাজ করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদে এ কাজগুলো করতে হবে।”
মানবাধিকার কর্মী খুশী কবিরের পর্যবেক্ষণ, শেখ হাসিনার সরকার বিশ্ব ব্যাংক আর আমেরিকার প্রতি নির্ভরশীল ছিল না, ব্রিকসসহ অন্যদের সঙ্গে তাদের অর্থনৈতিক ভারসাম্য ছিল।
“এখন যে চেহারাগুলো দেখছি সেখানে আমার মনে হয় এটা দেখতে লাগবে- আমাদের একটা নিরপেক্ষ অর্থনৈতিক অবস্থা আসবে নাকি পুরোপুরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে থাকবে! রেমিটেন্স কমে গেছে, মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেছে- অর্থনৈতিক ধস যেটা নামতে শুরু করেছে এটাকে ফিরিয়ে আনাও একটা বড় দিক।”
বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকারের প্রতি ব্যবসায়ীদের দিক থেকে সব ধরনের সহযোগিতা থাকবে। আগের সরকারের সময় অনেক নীতিগত ও তথ্যগত ভুল ছিল। ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে অনেক ভুল নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। ব্যবসা বাণিজ্য এসব ভুলের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
“বিগত দিনে সরকার পতন আন্দোলনের সময় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে অনেক ক্রেতা চলে গেছে। ফলে আগামী ছয় মাসের অর্ডার হাতছাড়া হয়ে গেছে। ফলে আগামী ছয় মাসের ঋণের কিস্তি পরিশোধ স্থগিত করার জন্য আমরা আহ্বান জানাব।”
যা বলছেন উপদেষ্টারা
অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, তাদের সরকার দেশে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ওপর অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
নানা চ্যালেঞ্জ থাকলেও অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করাকে নিজের জন্য বড় কাজ হিসেবে দেখছেন তিনি।
শুক্রবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর তিনি বলেন, “ব্যবসা মন্থর হয়ে গেছে, মানুষের জীবিকায় যে প্রভাব পড়েছে সেটাকে তাড়াতাড়ি টেনে তুলতে হবে।”
স্বরাষ্ট্রের দায়িত্ব পাওয়া অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা এম সাখাওয়াত হোসেনও বলেছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রথমে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির চেষ্টা করবে।
"এবং দুই নম্বর হচ্ছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার আস্থা ফিরিয়ে আনা, যা আমি মনে করি খুব মারাত্মকভাবে কমে গেছে," রয়টার্সকে বলেছেন তিনি।
হাসিনা সরকারের পতনের পর নৈরাজ্য, ভাঙচুর, লুটপাট এবং সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ঘটনা বিষয়ে প্রশাসন ‘খুব সজাগ’ ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, এসব ঘটনা ‘কিছুটা অতিরঞ্জিত’ ছিল।
শেখ হাসিনার শেষ দিনগুলোতে বিক্ষোভকারীদের ওপর দমন-পীড়নের কারণে জনরোষের সম্মুখীন হওয়ার কারণে বেশিরভাগ থানাই জনশূন্য হয়ে পড়েছে। বহু থানা ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ বিভিন্ন মালামাল লুট করা হয়।
“এখন তাদের উপর হামলা হচ্ছে, থানাগুলোতে আক্রমণ করা হচ্ছে। এই অসহায় মানুষগুলো যাবে কোথায়,” বলেন সাখাওয়াত হোসেন।
সব দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক ধরে রাখার ওপর জোর দিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন।
পররাষ্ট্র ক্যাডারের সাবেক এই কর্মকর্তা বলেন, “আমরা সব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক রাখব, বড় যে দেশগুলো আছে তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের একটা ব্যালেন্স মেইনটেইন করতে হবে।”
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের উপর চাপটা হচ্ছে সংস্কার করে দিয়ে যাওয়ার। এই সংস্কারগুলো কোন কোন ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিয়ে করব সে ক্ষেত্রগুলো বের করা, সংস্কারের ব্যাপারে মতৈক্য গড়ে তোলা, দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংস্কার কাজ যতটা আমাদের ক্ষমতায় পোষায়, ততটুকু শেষ করে যাওয়া।”