থানার আগে মসজিদ, তার সামনে পড়ে আছে পুলিশের একজোড়া বুট আর গ্রিলে লেগে আছে ছোপ ছোপ রক্ত। তাই দেখতে ভিড় করেছেন কয়েকজন।
Published : 06 Aug 2024, 07:00 PM
মঙ্গলবার দুপুর, ১২টা বাজে প্রায়। ঢাকার বাড্ডা ইউলুপ ধরে রামপুরার দিকে কিছুটা এগিয়ে হাতের বাঁয়ে ডিআইটি আবাসিক এলাকা। সড়কের পাশে উল্টে থাকা ট্রাকের কাছ দিয়ে ডিআইটির গলিতে ঢুকতেই শোরগোল কানে এল।
সেখান থেকে কিছুটা দূরে বাড্ডা থানা। গন্তব্য সেটিই। সোমবার সারা রাত বাড্ডায় গোলাগুলি ও হতাহতের যে তথ্য ছড়িয়ে পড়েছিল, সে সম্পর্কে তথ্য নিতেই সেখানে যাওয়া।
থানার আগে মসজিদ, তার সামনে পড়ে আছে পুলিশের একজোড়া বুট আর গ্রিলে লেগে আছে ছোপ ছোপ রক্ত। তাই দেখতে ভিড় করেছেন কয়েকজন।
পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে থানা ভবনটি। পোড়ার ক্ষত তখনও দগদগে। ভেতর থেকে উঠছে ধোঁয়া, আর বাইরে জ্বলছে এক বস্তা নথিপত্র।
দেখা গেল, ধোঁয়া উঠা ভবনটির ভেতরে ঢুকে পড়েছে কিছু মানুষ, জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছে তারা। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের যন্ত্র (এসি), পানির পাম্প, আসবাবপত্র, স্টেশনারি, পুলিশ সদস্যদের ট্রাঙ্ক, জানালার পর্দা, তোশকসহ যে যা পারছে হাতে, মাথায়, কাঁধে নিয়ে চলে যাচ্ছে।
দেখা গেল, কিছু মানুষ বৈদ্যুতিক তার, বাল্বসহ বৈদ্যুতিক জিনিসপত্র খুলে নিয়ে যাচ্ছে। কয়েকজন ভাঙছে জানালার গ্রিল এবং শেষপর্যন্ত ভেঙেই সেটি রিকশায় তুলে নিয়ে যাচ্ছে।
বাড্ডা থানার সামনে বেশ কিছু সময় দাঁড়িয়ে এই নৈরাজ্য দেখতে দেখতে সেখানে কথা হল কয়েকজনের সঙ্গে। পরিস্থিতিটা বেশ আতঙ্কজনক, কখন কী ঝামেলায় পড়তে হয়, সেই ভয়ে পরিচয় প্রকাশ করতে চাইলেন না কেউ।
তাদের মধ্যে একজন বললেন, সোমবার দুপুরে শেখ হাসিনার পতনের পর থেকেই থানা ঘেরাও করে রাখে স্থানীয় মানুষ। তখন থেকে থেমে থেমে স্থানীয়রা থানার দিকে ইটপাটকেল ছুটতে থাকে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় বাড্ডা এলাকায় পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। আশপাশে বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। রণক্ষেত্রে পরিণত হয় পুরো এলাকা, যেখানে পুলিশের বিরুদ্ধে ‘অতিরিক্ত’ বলপ্রয়োগ ও ব্যাপক গুলি ছোড়ার অভিযোগ রয়েছে। বাড্ডায় হতাহত হয় অনেক মানুষ।
ওই ব্যক্তি কথায় কথায় বললেন, হয়ত সেই ক্ষোভ থেকেই সোমবার থানা ঘিরে রাখে স্থানীয় মানুষ। তারা রাতে থানা আক্রমণের চেষ্টা করলে ভেতর থেকে পুলিশ সদস্যরা গুলি ও টিয়ারশেল ছোঁড়ে। পাঁচ-ছয় ঘণ্টা চলে সেই সংঘাত।
আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, স্থানীয়রা থানা ঘিরে ইট-পাটকেল ছুঁড়তেই থাকে। গুলির কারণে কেউ ভেতরে ঢুকতে পারেনি। তবে গুলিতে অনেকে হতাহত হয়েছে, যাদের রিকশায় করে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
তিনি বলেন, রাত ১২টার পর পুলিশ সদস্যদের উদ্ধারে সাঁজোয়াযান নিয়ে আসে সেনাবাহিনীর সদস্যরা। থেমে থেমে রাত ৩টা পর্যন্ত গোলাগুলি হয়। এর শব্দেই বাড্ডা এলাকা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অবশেষে পুলিশ সদস্যদের উদ্ধার করে নিয়ে যান সেনারা। তারা চলে গেলেই অরক্ষিত থানায় আগুন দেয় জনতা।
থানার কাছাকাছি একজন চায়ের দোকানির সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, “থানায় প্রচুর গুলি জমা আছিল। লোকজন অপেক্ষায় আছিল কখন ওদের গুলি শেষ হয়। শেষপর্যন্ত সেনাবাহিনী আসার পর ওরা গুলি করতে করতে এলাকা ছাইড়া গেছে। অনেক মাইনষের গায় গুলি লাগছে।”
সোমবার রাতের এই ঘটনা নিয়ে আতঙ্ক ও উদ্বেগের তথ্য ভেসে বেড়িয়েছে ফেইসবুক ও ইউটিউবে। মঙ্গলবার সরেজমিন গিয়ে হতাহত, গোলাগুলি ও অগ্নিসংযোগের বাস্তবতা জানা গেল।
সোমবার রাতে ফেইসবুকে অনেকে লিখেছিলেন রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে কিছু একটা হচ্ছে। সেখানে গিয়ে দেখা যায় সুরক্ষিত আছে পুলিশ লাইনস।
তবে বাড্ডা এলাকা থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে লাশ পাঠানোর কথা জানা গেছে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ঢাকা মেডিকেল প্রতিনিধি বলেন, মঙ্গলবার ভোর থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত হাসপাতালে ১৯ জনের লাশ এসেছে। এর মধ্যে বাড্ডা থেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া দুজনের লাশও রয়েছে।
নিহতদের মধ্যে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্যও রয়েছেন। তবে তাদের পরিচয় নির্দিষ্ট হওয়া যায়নি।
সোমবার রাতের এই সংঘর্ষ নিয়ে ফেইসবুকে আতঙ্ক ছড়াতে থাকে। কেউ কেউ লেখেন, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা গুলি চালাচ্ছে।
পুলিশের নির্ভরযোগ্য কয়েকটি সূত্র বলছে, বাড্ডাসহ বিভিন্ন থানায় আটকে পড়া পুলিশ সদস্যদের উদ্ধার করতে গিয়েছিল পুলিশ-সেনাবাহিনীর দল। তারা ফাঁকা গুলি করে বিক্ষুব্ধ লোকজনকে সরানোর চেষ্টা করে। তা থেকেই হয়ত আতঙ্ক ছড়ায়।
ছাত্র-জনতার গণআন্দোলন ও জনরোষের মুখে সোমবার দুপুরে পতন হয় শেখ হাসিনার। দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামে ব্যাপক প্রাণহানির পর চলে যান ভারতে।
বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে দেশ পরিচালনার নতুন ব্যবস্থা নিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কাজ করছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক, বিভিন্ন দলের রাজনীতিক ও বিশিষ্টজনেরা।