এই প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হয়েছে ৭টি শ্রমিক সংগঠন, এছাড়া সহযোগী সদস্য হিসেবে রয়েছে চারটি সংগঠন।
Published : 18 Sep 2024, 04:15 PM
অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার ও দাবি আদায়ের লক্ষে কাজ করতে গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর এক ছাতার নিচে এসেছিল কয়েকটি শ্রমিক সংগঠন ও বেসরকারি সংস্থা।
ট্রেড ইউনিয়ন প্ল্যাটফর্ম ফর মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার্স- টিপিএমডব্লিউ নামের সেই প্ল্যাটফর্মটিরই আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ঘটল এক বছর পর।
বাংলায় প্ল্যাটফর্মটিকে বলা হচ্ছে ‘অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য ট্রেড ইউনিয়ন’।
বুধবার রাজধানীর একটি রেস্তোরাঁয় আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ঘটে প্ল্যাটফর্মটির।
এই প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হওয়া ১১টি সংগঠনের মধ্যে সাতটি মূল সদস্য আর চারটি সহযোগী সদস্য।
মূল সদস্য সংগঠনগুলো হলো- বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশন, বাংলাদেশ মুক্ত গার্মেন্টস শ্রমিক ইউনিয়ন ফেডারেশন, বাংলাদেশ বিপ্লবী গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ফেডারেশন, সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন, একতা গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন, গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতি ফেডারেশন এবং জাতীয় গার্হস্থ্য নারী শ্রমিক ইউনিয়ন।
চার সহযোগী সদস্য হচ্ছে- সলিডারিটি সেন্টার বাংলাদেশ, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটি, আওয়াজ ফাউন্ডেশন এবং বাংলাদেশী অভিবাসী মহিলা শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশন।
অভিবাসীদের দুঃখগাথা
বুধবারের অনুষ্ঠানে অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা অধিকারকর্মীদের পাশাপাশি বিদেশে গিয়ে বঞ্চনার শিকার হওয়া কয়েকজন শ্রমিক তাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।
জর্ডানে কাজ করতে যাওয়া হিরা ইসলাম নামের এক অভিবাসী নারী নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, “আমি সেখানে নানা রকম নির্যাতনের শিকার হয়েছি। অনেকে বলেন, শারীরিক নির্যাতন হয়। আমি বলব, সেখানে শারীরিক নির্যাতন নয়- বরং মানসিক নির্যাতনের শিকারও হয় অনেকে। ভাষা না জানার কারণে অনেকে সেই নির্যাতনের কথা ঠিকমতো বলতেও পারেন না। এজন্য আমি বলব বিদেশে যে যাবেন, ভাষা শিখে যাবেন।”
বেনাপোলের জাফর ইকবাল এক যুগ অবৈধভাবে ছিলেন মালয়েশিয়ায়।
সেই অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, “কিছু না জেনেই আমি বিদেশে যাই। আমি সেখানে যে কাজের জন্য গিয়েছিলাম, আমাকে দিয়ে অন্য কাজ করানো হতো। আমি সেই কাজ পারতাম না। তাছাড়া আমি যেখানে কাজ করেছি, তারা ছিল ভিয়েতনামের। ফলে তারা যে খাবার খেত- সেগুলো খেতে পারতাম না। আমি যাওয়ার পর পাসপোর্টও নিয়ে নেয়। এজন্য দেশে চলে আসব, তারও সুযোগ ছিল না। ফলে অনেক কষ্ট করেছি।”
প্রবাসী কর্মীদের স্বার্থরক্ষায় বাংলাদেশি দূতাবাসগুলোর নিষ্ক্রিয়তার কথাও উঠে আসে আলোচনায়।
ফরিদা নামের এক অভিবাসী শ্রমিক বলেন, “আমি দুবাইয়ে নানা রকম নির্যাতনের কারণে দেশে চলে আসতে চাই, তখন পথে পথে ঘুরেছি, জানতাম না কার কাছে যাব। পরে আমাদের অ্যাম্বাসিতে গেলে তারাও সহযোগিতা করেনি। পরে আমি অ্যাম্বাসির এক কর্মকর্তাকে গিয়ে বলি- আমি ভিডিও করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দেব। তখন তারা আমাকে সহযোগিতা করে। আমি দেশে আসি।”
মানিক বিশ্বাস নামের আরেক শ্রমিক গিয়েছিলেন ওমানে, দুই বছর পর তিনি চলে আসেন।
অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মানিক।
তিনি বলেন, “ওই দুই বছরের কথা বলতে গেলে কান্না চলে আসে, আমি আর কিছু বলতে পারি না।”
অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্য দেন সলিডারিটি সেন্টার বাংলাদেশের সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার লিলি গোমেজ। পরে উপস্থিত সবাই মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন। এছাড়া ‘অভিবাসী ও ট্রেড ইউনিয়ন’ নামে একটি পুস্তিকারও মোড়ক উন্মোচন করা হয়।
শ্রমিকবান্ধব আইন প্রণয়নে সোচ্চার থাকবে টিপিএমডব্লিউ
সূচনা বক্তব্যে সলিডারিটি সেন্টারের সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার লিলি গোমেজ বলেন, “বাংলাদেশ থেকে অভিবাসন এখনও নিরাপদ নয় এবং অভিবাসনকালে শ্রমিকরা প্রায়শ মানবপাচারসহ নানা ঝুঁকিপূর্ণ ঘটনার মুখোমুখি হয়। আশঙ্কাজনক বিষয় হচ্ছে, প্রবাসী শ্রমিকেরা নিপীড়ন ও শোষণ বয়ে বেড়ায় নিরবে। তাদের সমস্যা নিয়ে কথা বলার জন্য বাংলাদেশে কোনো ট্রেড ইউনিয়ন প্লাটফর্ম গঠিত হয়নি।”
অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার ও দাবি আদায়ে শ্রমিকদের অংশগ্রহণমূলক কার্যক্রমের পাশাপাশি অভিবাসন সম্পর্কিত নীতি প্রণয়ন এবং শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য এই প্ল্যাটফর্ম কাজ করবে বলে জানান টিপিএমডব্লিউয়ের সমন্বয়ক চন্দন কুমার দে।
তিনি বলেন, “আমরা অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে আরও বড় পরিসরে কাজ করতে পারব বলে আশা করি। অভিবাসী শ্রমিক এবং শ্রমিকের অধিকার রক্ষায় আন্তর্জাতিক শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকবান্ধব আইন প্রণয়নে সোচ্চার থাকবে এই ট্রেড ইউনিয়ন। শ্রমিকের বিরুদ্ধে সংগঠিত সকল নিপীড়ন ও শোষনের অবসানের উদ্দেশ্যে কাজ করবে এই প্ল্যাটফর্মটি।”
সমাপনী বক্তব্যে সলিডারিটি সেন্টারের কান্ট্রি প্রোগ্রাম ডিরেক্টর একেএম নাসিম বলেন, “উদ্যোগটি ভিন্ন এ কারণে, যে এটি শ্রমিকদের নিজস্ব ট্রেড ইউনিয়ন। এখন পর্যন্ত সুশীল সমাজের সংগঠনগুলো মূলত অভিবাসন সমস্যা নিয়ে কথা বলত বা কাজ করত।
“টিপিএমডব্লিউর কাজ হবে দুই ধরনের। একটা হলো নীতিনির্ধারণী মহলের সঙ্গে কাজ করা এবং আরেকটি হলো মাঠ পর্যায়ে শ্রমিকদের সঙ্গে কাজ করা। পরিকল্পিতভাবেই আমরা কিছু কাজ নিয়ে এগুচ্ছি।”
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সলিডারিটি সেন্টার বাংলাদেশের ডেপুটি কান্ট্রি প্রোগ্রাম ডিরেক্টর মনিকা হার্টসেল, ইউএসএআইডির ডেপুটি ডাইরেক্টর ব্লেয়ার কিং এবং অভিবাসন বিষয়ক বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা।