আদিবাসী নারীর অধিকার আদায়ের রাজনীতি করতে হবে: সন্তু লারমা

সন্তু লারমা বলে, “আমাদেরকে এমন লড়াই ও রাজনীতি নির্ধারণ করতে হবে, যে রাজনীতি আদিবাসী নারীকে সম্মান দেবে, অধিকারের স্বীকৃতি দেবে।”

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 August 2022, 04:16 PM
Updated : 10 August 2022, 04:16 PM

আদিবাসী নারীকে সম্মান এবং অধিকারের স্বীকৃতি দেবে যে রাজনীতি, সেই লড়াই বেছে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)।

বুধবার বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের আয়োজনে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস-২০২২ উপলক্ষে ‘ঐতিহ্যগত বিদ্যা সংরক্ষণ ও বিকাশে আদিবাসী নারী সমাজের ভূমিকা’ শীর্ষক সেমিনারে একথা বলেন তিনি।

সন্তু লারমা বলেন, “সামাজিক জীবন বা রাষ্ট্রীয় জীবন কোনো ক্ষেত্রেই নারীকে সম্মান দেওয়া হয় না, তাদের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। কাজেই সমাজে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নারীদেরকে সংগ্রামী হতে হবে এবং অধিকার সচেতন হয়ে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে হবে।”

তিনি বলেন, “সমাজে গরীব, নিরীহ এবং মেহনতী মানুষের সংখ্যা বেশি, যাদের প্রতিনিধি সরকারে নেই। কাজেই আমাদেরকে এমন লড়াই ও রাজনীতি নির্ধারণ করতে হবে, যে রাজনীতি আদিবাসী নারীকে সম্মান দেবে, অধিকারের স্বীকৃতি দেবে।”

আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে এবারের প্রতিপাদ্য উল্লেখ করে সন্তু লারমা বলেন, “সারা বিশ্বে নারীকে বাদ দিয়ে সমাজ, সংস্কৃতির কোনো কিছুই ভাবা যায় না। নারীকে বাদ দিয়ে সমাজের অগ্রগতি কল্পনাতীত।

“কিন্তু আমাদের সমাজে নারীর জীবনচক্র চলে আতুঘরে, শয়নঘরে ও রান্নাঘরে। পুরুষ শাসিত সমাজে নারীর অবদান সেটা যাই হোক না কেন, সেটা স্বীকৃতি লাভ করেনি।”

প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা তুলে দেওয়ারও সমালোচনা করেন আদিবাসী ফোরামের সভাপতি।

“পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনো হাজার হাজার মানুষ রয়েছে যারা বাংলা বলতে পারে না, বাংলা বুঝে না। তাহলে তারা কিভাবে মূলধারার বাঙালি সমাজের সাথে প্রতিযোগিতা করে চাকরি লাভ করবে?”

বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সহ সভাপতি চন্দ্রা ত্রিপুরা বলেন, “আদিবাসীদের স্বকীয় সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও বিকাশ সাধন, মাতৃভাষা ও নিজেদের ঐতিহ্যগত পোশাক-পরিচ্ছদ সংরক্ষণ ও বিকাশে নারী সমাজের রয়েছে অগ্রণী ভূমিকা।

“আদিবাসী শিশুরা মায়ের কাছ থেকেই মাতৃভাষা শিখতে শুরু করে এবং এক্ষেত্রে মায়েরাই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও আদিবাসী পোশাক-পরিচ্ছদ সংরক্ষণ ও বিকাশের ক্ষেত্রে আদিবাসী নারীদের একচেটিয়া অবদান।

“জুমে তুলা উৎপাদনের পর তুলাকে সুতায় রূপান্তর করা, সুতার রঙ করা এবং বুননের নানা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পরিধানযোগ্য নানা পোশাকের উৎপাদন নারীরাই করে থাকে।”

সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে বাংলাদেশের আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান, আদিবাসীদের জ্ঞান-বিজ্ঞানকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি প্রদান, জলের সহজলভ্যতা ও পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার জন্য আদিবাসী অঞ্চলে প্রাকৃতিক বন ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সার্বিক সহযোগিতা দেওয়াসহ ৬টি সুপারিশ তুলে ধরেন তিনি।

ফেরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, “আদিবাসী নারীরা অনেক খাদ্য দ্রব্যের আবিষ্কারক। সাধারণ বাঙালি সমাজের সাহিত্য বলে পুরুষ নারীকে রক্ষা করে। কিন্তু আদিবাসী সমাজে আদিবাসী নারীরাই পুরুষদের রক্ষা করে।”

তিনি আরও বলেন, “জাতিসংঘের মতে আদিবাসী নারীরা পাঁচ স্তরের বৈষ্যমের শিকার হয়। প্রথমত নারী হিসেবে, দ্বিতীয়ত আদিবাসী নারী হিসাবে, তৃতীয়ত দরিদ্র নারী হিসাবে, চতুর্থত পাহাড়ের প্রান্তিক জায়গায় বসবাসের কারণে, পঞ্চমত বন-ভূমি-পাহাড় থেকে উচ্ছেদের শিকার হওয়ার কারণে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, “পুরুষতন্ত্র নারীর বসা, পোশাক পরা সবকিছুকেই নির্মাণ করে দিয়েছে। নারীরা সবখানেই পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতির শিকার।”

হ্লাকিংমে চাকমা অপহরণের প্রসঙ্গ এনে তিনি বলেন, “হ্লাকিংমে ১৩ বছরের এক আদিবাসী নারী, যাকে এক বাঙালি দ্বারা অপহরণ করা হয়েছে। তাকে ধর্ম পরিবর্তনে বাধ্য করা হয়েছে, জোর করে বিবাহ করতে বাধ্য করা হয়েছে।

“তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। তারপর তাকে হত্য করা হয়েছে এবং তার লাশ অনেক দিন পড়ে ছিল হাসপাতালের লাশ ঘরে। কাজেই তার উপর ধর্মীয়, জাতিগত, পুরুষতান্ত্রিক সব ধরণের নিপীড়ন হয়েছে। এটাই বাংলাদেশে আদিবাসী নারীর চিত্র।”

আদিবাসী নারী পরিষদের সভাপতি বাসন্তী মুর্মু বলেন, “আমি আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, নারীরা পরিবারে, সমাজে তার কতটুকু অধিকার তা নিজেরাই জানে না। সন্তান জন্ম দেওয়া, লালন পালন করা- গ্রামে গঞ্জের নারীরা মনে করেন এটাই কেবল নারীর কাজ এবং এটাতেই শেষ।

আদিবাসী নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তৃণমূল পর্যায়ের কাজগুলোতে আরও গুরুত্ব দেয়া উচিত বলেও মনে করেন তিনি।

রাজধানীর কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউয়ের ডেইলি স্টার ভবনে এই সেমিনার হয়।

বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সদস্য সচিব চঞ্চনা চাকমার সঞ্চালনায় ও সংগঠনটির আহ্বায়ক মিনু মারিয়া ম্রং এর সভাপতিত্বে সেমিনারে সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের উপ-পরিচালক শাহনাজ সুমী, কলাম লেখক ও নারী অধিকারকর্মী রাখি ম্রং,খাগড়াপুর মহিলা কল্যাণ সমিতির নির্বাহী পরিচালক শেফালিকা ত্রিপুরা, পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী হেডম্যান কার্বারী নেটওয়ার্কের সভাপতি জয়া ত্রিপুরা, সমতলের আদিবাসী নারী অধিকার কর্মী হৈমন্তী সরকার, অনন্যা দ্রং অংশ নেন।