যুদ্ধাহতের ভাষ্য-১০৯: ৭ মার্চকেই স্বাধীনতা দিবস ঘোষণা করা উচিত ছিল

সালেক খোকনসালেক খোকন
Published : 28 Oct 2021, 11:51 AM
Updated : 28 Oct 2021, 11:51 AM

ছোটবেলা থেকে সিনেমা দেখার নেশা ছিল খুব। কুষ্টিয়াতে পাক পিকচার সিনেমা হল আর রকসি হল ছিল। মা বাজারে পাঠাতেন, বাজারের টাকা থেকে চার আনা চুরি করতাম। সিনেমা হলের গেটম্যানকে পয়সা দিলেই হলের এককোণে বসার সুযোগ হতো। তাতেই আমাদের সেকি আনন্দ!

নাটক করতাম ছোটবেলা থেকেই। জীবনে প্রথম নাটক করি ডাকাত চরিত্রে। দুষ্ট ছিলাম বলে সবাই জোর করে ওই চরিত্রটিই দিয়েছিল। পূর্ব মজমপুর পূর্বাচল ক্লাবের পক্ষ থেকে নাটকটির আয়োজন করা হয়। গ্রামে গ্রামে চলত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। বিভিন্ন জায়গায় নাটকের গ্রুপ ছিল। শীতজুড়ে নাটক আয়োজনের রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলত। আমরা আগেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে চৌকি চেয়ে নিয়ে আসতাম। সেগুলো দিয়ে বানানো হতো নাটকের স্টেইজ। মা-বোনদের কাছ থেকে কাপড় এনে তাই দিয়ে সাজাতাম। একটা উদ্যোম ছিল তখন।

ওই সময় নাটক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ভেতরও মিছিল করতে হয়েছে। ছাপানো পোস্টার ছিল না। আক্কাস ভাই আসতেন, এক বান্ডিল কাগজ হাতে নিয়ে। একটা চিরকুট দিয়ে বলতেন, এই স্লোগানগুলো লিখতে হবে। নিজেরা এক আনা দুই আনা দিয়ে কালি কিনে এনে পোস্টার লিখতাম। খেজুর গাছের ডাল কেটে, আগা ছেচে ব্র্যাশ বানিয়ে সেটা দিয়ে পোস্টার লিখতাম। কুষ্টিয়া জেলা স্কুলের বারান্দাতে রাত জেগে পোস্টার লিখেছি। সেগুলো শুকালে আঠা দিয়ে দেওয়ালে দেওয়ালে সেটে দিতাম।

সেই দিন তো এখন নাই ভাই। কয়েকদিন আগে পরিমল থিয়েটারের নিচে চেয়ার নিয়ে বসে আছি। কয়েকজন যুবক মিছিলে যাচ্ছে। তারা বলাবলি করছে, মিছিলে কত করে পিছ (?)। মানে নেতাদের পেছনে যারা থাকবেন তাদের মাথাপ্রতি কত টাকা দেওয়া হবে? এটা আমরা চিন্তাও করতে পারতাম না।

ভাত খেতে বসেছি, বলল, রিন্টু মিছিল। খাওয়া বাদ দিয়েই চলে যেতাম। কণ্ঠ আকাশে তুলে স্লোগান তুলতাম- 'মানতে হবে আমাদের দাবি', স্বাধীন করো স্বাধীন করো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।'

শৈশব ও কৈশোরের নানা ঘটনার কথা এভাবেই তুলে ধরেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ সানোয়ার উদ্দিন রিন্টু। যুদ্ধকালীন শেখ আনোয়ার নামে বিশেষ পরিচিত ছিলেন। কুষ্টিয়ায় পরিমল থিয়েটারের সভাপতি তিনি। এক সকালে ওই থিয়েটারের কার্যালয়ে বসেই কথা হয় একাত্তরের নানা প্রসঙ্গে।

তার বাবা আরিফ উল্লাহ্র সাইকেলের দোকান ছিল। পরবর্তীতে রেশন শপেরও ব্যবসা করেন। মা হালিমা বেগম ছিলেন গৃহিণী। সাত ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে রিন্টু সপ্তম। তাদের বাড়ি কুষ্টিয়া শহরের থানা পাড়ায়। তার লেখাপড়ার শুরু কুষ্টিয়ার পাঁচ নম্বর পৌর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর ভর্তি হন কুষ্টিয়া হাইস্কুলে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী। স্কুলে থাকতেই রিন্টু যুক্ত হয়েছিলেন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে। তার সেজ ভাই শেখ গিয়াস উদ্দিন আহমেদ মিন্টুও ছাত্রলীগ করতেন, কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের ভিপি ছিলেন।

ছাত্রজীবনের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, 'ছয় দফার আন্দোলন চলছে তখন। হাফ প্যান্ট পরেই মিছিলে যেতাম, মজমপুর থেকে মোহিনী মিল পর্যন্ত। ক্লাস টেইনে উঠে ফুলপ্যান্ট পরা শিখলাম। তখন চলছে ঊনসত্তরের গণআন্দোলন। কুষ্টিয়াতে নেতৃত্ব দিতেন আমার ভাই গিয়াস উদ্দিন মিন্টু, মাসুম ভাই, দলিল ভাই, বারি বাই, অ্যাডভোকেট আজিজুর রহমান আক্কাস সাহেব, আহসান উল্লাহ সাহেব প্রমুখ। সবচেয়ে বেশি বলতে হয় ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামের কথা। উনি তখন ইয়ং, দ্যুতিময় চেহারা। আমরা তার মুখপানে শুধু তাকিয়ে থাকতাম।

মাঝেমাধ্যেই তৎকালীন আইউবীয় গুণ্ডা বাহিনী এনএসএফের (ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফোর্স) সঙ্গে মারপিট করতে হতো। মিছিল বের হলেই ওরা আক্রমণ করে। মাছি, ধুনসি, ইয়াকুব, সাদ আহমেদ ছিল কুষ্টিয়ায় এনএসএফের নেতা। এরাই স্বাধীনতা ও মুজিববিরোধী একটা দল গড়ে তোলে। কিন্তু আমরা সবকিছু বানের জলের মতো ভাসিয়ে দিই। জিগা গাছ নামে একটা গাছ হয়। লম্বা লম্বা ডাল গাছটার। এগুলো ভেঙ্গে নিয়ে আসতাম। দু-একটা হকিস্টিকও ছিল। হাতিয়ার বলতে এগুলোই ছিল সম্বল। কিন্তু মনোবল ছিল অটুট।'

কুষ্টিয়াতে যখন আর্মি আসে আপনারা তখন কী করলেন?

'প্রথমে গ্রামের দিকে লুকাই। বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে খোঁজ করি কার ঘরে বন্দুক, গুলি আর কার্তুজ আছে। সেগুলো কালেকশন করতে থাকি। বর্ডার থেকে মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর নেতৃত্বে অস্ত্র নিয়ে ইপিআরের বাঙালি সদস্যরা চলে আসে কুষ্টিয়াতে। উনাদের রাখা হয় মিরপুরের নওপাড়া নামক গ্রামে। তাদের নিয়ে পাকিস্তানি আর্মিদের ওপর হামলার পরিকল্পনা করেন নেতারা।

৩০ মার্চ ভোর রাত থেকে হামলা শুরু হয়। আর্মিদের ক্যাম্প ছিল ছোট ওয়্যারলেস, কুষ্টিয়া সদর থানা, পুলিশ লাইন ও জেলা স্কুলে। এই চারটি জায়গায় পরিকল্পিতভাবে আক্রমণ করা হয়। ছাত্রনেতারাসহ পুলিশের বাঙালি সদস্য ও আনসাররাও এতে অংশ নেন। ট্রেনিং নাই। তবুও ওখানে ছিলাম।

সারাদিন যুদ্ধ হলো। ১ এপ্রিল আমরা কুষ্টিয়াকে পুরো নিয়ন্ত্রণে নিই। ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত মুক্ত থাকে। কিন্তু ১৭ এপ্রিল পাকিস্তান আর্মিরা গানবোট নিয়ে পদ্মা পার হয়ে ঢুকে পড়ে কুষ্টিয়াতে। জেট বিমানে হামলাও চালায়। তখন নেতারা বললেন, তোমরা যে যার মতো ইন্ডিয়াতে চলে যাও। আমরা তাই করি।'

ছোট ভাই আনোয়ার, জাহিদ, মাজেদ আর কুদ্দুসসহ মিরপুরের ভেতর দিয়ে দৌলতপুর সীমানা হয়ে ভারতের শিকারপুর যান রিন্টুরা। সেখানে গিয়ে নেতাদের খোঁজ করেন।

এরপর কি ঘটলো?

তার ভাষায়– 'অনেকে বলেন একাত্তরে আওয়ামী লীগ নেতারা ইন্ডিয়ায় গিয়ে বসে ছিলেন। ভুল কথা। নেতারা ওখানে না গেলে কাদের সাথে যোগাযোগ করতাম, হাতিয়ার কীভাবে আসত, প্রশিক্ষণ কোথা থেকে নিতাম, এই যোগাযোগটা তাহলে কে রাখত! এটা তো এমন না যে কেউ একজন বাঁশি ফু দিলো আর সব হয়ে গেল। নেতাদের উদ্যোগেই করিমপুর ইয়ুথ ক্যাম্প চালু হয়। সেখানে আমাদের বাছাই করে ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় ভারতের বিহার চাকুলিয়া ক্যাম্পে। ওখানেই পয়তাল্লিশ দিন ট্রেনিং করি। আমার এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নম্বর ছিল ৪৫৪৪।

ট্রেনিং খুব সহজ ছিল না। আমাদের ছয়টা ছেলের কবর আছে ওখানে। সাপে কেটে মেরে ফেলেছিল ওদের। দশটা উইং ছিল। পাঁচ নম্বর উইংয়ে ছিলাম, দুই নম্বর প্লাটুন। আমার উইংয়ের দায়িত্বে ছিলেন আহসানুল হক বাবলা, আব্দুর রহমান প্লাটুন কমান্ডার। পুরো চাকুলিয়া ক্যান্টনমেন্টের দায়িত্বে ছিলেন কর্নেল চ্যাটার্জি। ট্রেইনার সুখদেব সিং ও মেজর ফাটকার কথা এখনও মনে আছে। আপন ভাইয়ের মতোই আন্তরিক ছিলেন তারা।'

একাত্তরে বাঙালিদের প্রতি ভারতীয় জনগণের আন্তরিকতার কথা একটি বাস্তব ঘটনার মাধ্যমে তুলে ধরেন এই মুক্তিযোদ্ধা।

'আমরা তখন করিমপুরে। সঙ্গে এক বন্ধুও ছিল। হেঁটে আসার ফলে পা ফুলে গেছে। টিপ টিপ বৃষ্টি হচ্ছিল। ভিজে যাওয়ায় ঠান্ডায় কাঁপছি। রাস্তার পাশে ছোট্ট একটা শেড। তার নিচে কোনোরকমে দাঁড়িয়ে আছি। রাস্তার ওপাশেই বড় একটি মন্দির। মন্দিরে পূজা শেষে এক ঠাকুর বের হয়ে আসেন। তার কপালে তিলক আঁকা। মন্দিরে তালা দিয়ে বের হচ্ছেন তিনি। আমাদের ওভাবে ভিজতে দেখেই থমকে দাঁড়ালেন। এরপর যা বললেন তা আমি কান দিয়ে শুনে মগজে রেখে দিয়েছি। বললেন– 'আহা! অতিথি নারায়ণ এখানে জলে ভিজবে আর দেবতা মন্দিরে আরামে থাকবেন, তা তো হতে পারে না।' উনি দৌড়ে চলে গেলেন অরবিন্দ বাবুর কাছে। করিমপুর থানা কংগ্রেসের সভাপতি তিনি। মন্দির কমিটিরও সভাপতি ছিলেন। অনুমতি নিয়ে মন্দির খুলে দিয়ে তিনি বললেন, 'বাবা তোমরা এখানে থাকো।' আমরা দুই রাত ছিলাম মন্দিরে। দেখেন মানুষের মানবতার উদাহরণ এমনই। এগুলো আমরা ভুলব কীভাবে?

ট্রেনিং শেষে মুক্তিযোদ্ধা শেখ সানোয়ার উদ্দিন রিন্টুদের পাঠানো হয় প্রথমে কল্যাণীতে এবং সেখান থেকে শিকারপুর অ্যাকশন ক্যাম্পে। ওই ক্যাম্প থেকে ভেতরে ঢুকে আক্রমণ করে আবার ফিরে আসতেন। আট নম্বর সেক্টরের শিকারপুর সাব-সেক্টরের অধীনে তিনি যুদ্ধ করেন মিরপুর, ভেড়ামারা, বটতলি, ধর্মদহসহ কুষ্টিয়ার বিভিন্ন এলাকায়।

এক অপারেশনে রক্তাক্ত হন এই বীর যোদ্ধা। কি ঘটেছিল ওইদিন?

শেখ সানোয়ার উদ্দিন রিন্টু বলেন দিনটির আদ্যোপান্ত।

'নভেম্বরের প্রথম বা অক্টোবরের শেষের ঘটনা। আমরা ক্যাম্পে থাকতাম। ক্যাম্পের আগেই তিনটা বাঙ্কার ছিল–একটা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর, একটা গুরখা, আরেকটা শিখ রেজিমেন্টের। পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ছিল একটু দূরে, একটা চার্চের ভেতরে। ওরা ওখান থেকে শেলিং করত।

ক্যাম্পে আমাদের খড়ি কালেকশন করতে হতো। তাই ধর্মদহ মাঠে বাবলা গাছ কেটে রেখেছি তিনদিন আগেই। ওইদিন সকালে খড়ি আনতে যাচ্ছি। তার আগে নুরু বলে, চল কিছু খেয়ে আসি। ফুনকো তলার মোড় নামক একটা জায়গা আছে। ওইখানে যারা যুদ্ধ করেছেন তারা সবাই এ নামটি জানেন। ষাট টাকা করে বেতন দেওয়া হতো আমাদের। তা থেকে লুচি কিনে খাচ্ছি আর ইন্ডিয়ান আর্মিদের সঙ্গে মজা করছি। হঠাৎ ঠুস করে একটা গুলির শব্দ হয়। এরপরই দ্রিম! দ্রিম! শেল পড়তে লাগল। তৌফিক-ই-ইলাহী ও নুরুন্নবী স্যার ছুটে এসে বললেন– মার্চ। হাতিয়ার রেডিই থাকত। আমরা নদীর দিকে ছুটে যাই।

পাকিস্তানি আর্মিরা আমাদের দিকে ঢুকতে চাইছিল। কিন্তু ধর্মদহ মাঠের আগেই তিনটা বাঙ্কারে ওরা বাধার মুখে পড়ে। অলরেডি যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আমরা গিয়ে শুধু সংখ্যাটা বাড়ালাম। একটা বাবলা গাছের আড়ে পজিশনে যাই। ওখান থেকে ফায়ার করছি। অনবরত শেলিং আর বৃষ্টির মতো গুলি আসছে। হঠাৎ আমার সামনে এসে একটা শেল পড়েই বার্স্ট হয়। সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য স্প্লিন্টার এসে লাগে দুই পায়ের হাঁটুর নিচে ও ডান হাতের আঙ্গুলগুলোতে।

মাটিতে পড়ে গেলাম। পা দুটি রক্তে ভেজা। ভাবলাম পা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। নুরুন্নবী স্যার সহযোদ্ধাদের দিয়ে তুলে আমাকে হাসপাতালে পাঠান। শ্যামা প্রসাদ দত্ত, কামরুল ইসলাম মিন্টু ও আমি আহত হই ওইদিন। চিকিৎসা হয় করিমপুর ফিল্ড হাসাপাতালে। ডান হাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুল এখনও পুরোপুরি মুঠো বা ভাজ করতে পারি না। ওই আঙ্গুলে জোরও নেই।

ওই যুদ্ধে ৪০-৪৫ জন পাক সেনাও মারা যায়। ভেতর থেকে অপারেশন শেষ করে ফিরে আসছিল সাতজন মুক্তিযোদ্ধা। ওরা আর্মিদের মুখোমুখি হলে ধরে নিয়ে যায়। পরে একটা ব্রিজের কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে তাদের। খবরটা শুনে হাসাপাতালে বসেই অনেক কেঁদেছিলাম।'

দিন দশেক চিকিৎসার পর মুক্তিযোদ্ধা রিন্টু আবার ফেরেন রণাঙ্গনে। তখন কুষ্টিয়ার মিরপুর অঞ্চলেই থাকতেন। ৮ ডিসেম্বর মিরপুর থানা দখল করে কুষ্টিয়া সুগারমিলের পেছন দিয়ে শহরে ঢোকার চেষ্টা করেন। ১০ ডিসেম্বর প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। সে যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেন তিনি। ওই রাতেই পাকিস্তানি আর্মিরা কুষ্টিয়া থেকে পালাতে থাকে। ১১ ডিসেম্বর কুষ্টিয়া পুরোপুরি মুক্ত হয়ে যায়।'

৭ মার্চকে স্বাধীনতা দিবস মনে করেন এই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। তার ভাষায়– 'বঙ্গবন্ধু তো ওইদিন বলেছিলেন, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি….. তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ…..।' এটাই ছিল স্বাধীনতার সুস্পষ্ট ঘোষণা। উনি তো জানতেন ওনাকে মেরে ফেলা হবে। যে কারণে উনি নির্দেশটা আগেই দিয়ে গিয়েছিলেন। ওই ভাষণের পরেই সবাই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। তাই ৭ মার্চকেই স্বাধীনতা দিবস ঘোষণা করা উচিত ছিল।'

জিয়াউর রহমানের শাসনামলকে রাজাকারদের শাসনামল বলে অভিহিত করেন এই সূর্যসন্তান। নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন– 'যাদেরকে একাত্তরে কবর দিলাম। জিয়া তাদেরকে কবর থেকে উঠিয়ে এনে ক্ষমতা দিয়ে দিলো। রাজাকার শাহ আজিজ, আমাদের কুষ্টিয়ার কুলাঙ্গার। সে হলো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী! কত বড় লজ্জার কাজ। বঙ্গবন্ধুর সময় থেকে আমাদের ৭৫ টাকা করে ভাতা দেওয়া হতো। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়াউর রহমান এসে সে ভাতা বন্ধ করে দেয়। জিয়ার আমলে সেনাবাহিনী আমাকে ও আমার সেজ ভাই শেখ গিয়াস উদ্দিন আহমেদ মিন্টুকে (বর্তমানে কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি) ধরে নিয়ে জেলা স্কুলে আটকে রাখে। দরজার হুরকো দিয়ে পেটায়। উপজেলার বিল্ডিংয়ে আটকে রাখে কয়েকদিন।'

অপরাধ কি?

'তোমাদের কাছে অস্ত্র আছে। তোমরা জয় বাংলা বলো। ওটাই অপরাধ। এটাই ছিল স্বাধীনতা বিরোধীদের আক্রোশ।'

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে তিনি অকপটে বলেন, 'বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে জিয়া স্বাধীনতাবিরোধীদের সাথে নিয়েই ক্ষমতায় এসেছে। এখন যতই বলেন জিয়াউর রহমান না, খন্দকার মোশতাক করেছে। এসব তো কোনো কথা না। সবাই করল ক্রাইম, দোষ শুধু মীরজাফরের। মীরজাফরের বাপের ক্ষমতা ছিল যদি ক্লাইভ তার সঙ্গে না থাকত। তাই আমার মতে, খন্দকার মোশতাক মীরজাফর, জিয়া হইল ক্লাইভ।'

জিয়াউর রহমানের খেতাব বাতিলের পক্ষে এই মুক্তিযোদ্ধার যুক্তি এমন– 'আমি যে কাজটি করার জন্য ওই খেতাবটি পেলাম, খেতাব হাতে নেওয়ার পরে যদি ঠিক তার উল্টো কাজটি করি, তাহলে কি ওই খেতাবটা আমার থাকা উচিত? আমি পাশ করলাম ডাক্তারি, মানুষের সেবা করব বলে। কিন্তু যদি বাজারে গিয়ে গরুছাগল জবাই করে কসাইয়ের কাজ করি। তাহলে আমাকে কি কেউ ডাক্তার বলবে? আমাকে বলবে কসাই। তখন ডাক্তারি লাইসেন্স বা সনদও থাকবে না। আমার সেন্সে আমি এটুকুই বুঝি।'

বঙ্গবন্ধুকে জানলে বাংলাদেশকে জানা হবে বলে মনে করেন এই বীর। তার ভাষায়– 'বঙ্গবন্ধুকে যদি না জানি তাহলে আমরা বাংলাদেশের ইতিহাস জানব কীভাবে? আমি বাঙালি এটা তো আমাদের কাছে থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। পারেওনি কখনও। আমাদেরকে বারবার মুসলিম বানানোর চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু আমি তো বলি আমরা মুসলিম। ধর্ম ইসলাম। কিন্তু প্রথমে আমি বাঙালি। বাঙালি কি জিনিস ওটা টের পেয়েছে পাকিস্তান।'

বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ সানোয়ার উদ্দিন রিন্টু এখন প্রয়াত। আলাপচারিতার কিছুদিন পর, গত ১৬ অগাস্ট ২০২১ তারিখে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। কিন্তু একাত্তরের বীরদের মৃত্যু নেই। এই মুক্তিযোদ্ধার বলা সকল কথাই ইতিহাস হয়ে থাকবে। যা ছড়িয়ে পড়বে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।

প্রজন্মের প্রতি তার ছিল পাহাড়সম আশা। তাই তাদের উদ্দেশেই তিনি বললেন শেষ কথাগুলো– 'তোমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রতি পরিপূর্ণ আস্থা রেখো। ধর্মান্ধতাকে প্রশ্রয় দিয়ো না। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বের ইতিহাস জেনে নিয়ো। সবাই মিলে দেশের জন্য কাজ করো। তোমাদের প্রতি আমাদের বিশ্বাস ও আস্থা রইল।'

সংক্ষিপ্ত তথ্য

নাম: যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ সানোয়ার উদ্দিন রিন্টু ।

ট্রেনিং: পয়তাল্লিশ দিন ট্রেনিং করেন ভারতের বিহার চাকুলিয়া ক্যাম্পে। এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নম্বর ছিল ৪৫৪৪।

মুক্তিযুদ্ধ করেছেন: আট নম্বর সেক্টরের শিকারপুর সাব-সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করেন মিরপুর, ভেড়ামারা, বটতলি, ধর্মদহসহ কুষ্টিয়ার বিভিন্ন এলাকায়।

যুদ্ধাহত: নভেম্বরের প্রথম বা অক্টোবরের শেষের ঘটনা। ধর্মদহে পাকিস্তানি সেনাদের শেলের অসংখ্য স্প্লিন্টার ঢুকে যায় দুই পায়ের হাঁটুর নিচে ও ডান হাতের আঙ্গুলগুলোতে।

ছবি: সালেক খোকন