যুদ্ধাহতের ভাষ্য-১০৬: ‘তুম লোক জয় বাংলা কহ, হাম নেহি গুলি চালায়ে’

সালেক খোকনসালেক খোকন
Published : 23 August 2021, 12:49 PM
Updated : 23 August 2021, 12:49 PM

১৯৭০-এর নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা দিতে টালবাহানা করে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। ফলে সারাদেশে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। মিছিল-মিটিং হলেই পুলিশ গুলি চালাত। টাঙ্গাইল জেলা ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক ছিলাম। সভাপতি এনায়েত করিম আর সেক্রেটারি ছিলেন কাদের সিদ্দিকী। আমরা চ্যালেঞ্জ নিয়ে একদিন মিটিং করি, কালিহাতির চারান এলাকায়। খুব লোক হয়েছিল ওখানে। সবকিছুকে উপেক্ষা করে মিছিলও বের করি। পরে একদিন কাদের সিদ্দিকী নিয়ে যায় ঢাকায়। দেখা করি বঙ্গবন্ধুর সাথে, ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরের বাড়িতে। নেতার সঙ্গে ওটাই আমার প্রথম দেখা। মিটিং-মিছিলের খবরগুলো শুনে উনি খুব খুশি হলেন। বসা থেকে উঠে সামনে দাঁড়ালেন। অতঃপর তাঁর মুষ্টিবদ্ধ হাত আমাদের বুকে হালকা স্পর্শ করিয়ে বললেন, 'সাবাস বাঙাল'। বলেই বুকে জড়িয়ে ধরলেন। ওই স্পর্শ ও স্মৃতিটা কোনোদিনও ভুলব না। এখনও মনে হলে বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে। জলে ভিজে যায় চোখ দুটো।

আমার নাম ছিল কাজী আশরাফ হুমায়ুন। ওইদিনের পর নামের শেষে 'বাঙ্গাল' শব্দটা লাগাই। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অনেকবার বুক মিলিয়েছি। কিন্তু ওইদিন বুক মেলানোর অনুভূতি ছিল অন্যরকম। প্রথম সান্নিধ্যেই বদলে গিয়ে পুরো নাম হয়– 'কাজী আশরাফ হুমায়ুন বাঙ্গাল।' এখনও 'বাঙ্গাল' বললে সবাই একনামেই চিনে। বাঙ্গাল শব্দটা শুনলেই গর্বিত হই, তখন মনে পড়ে বঙ্গবন্ধুর কথা।'

বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকে ধারণ করেত নিজের নাম বদলে ফেলার ইতিহাসটি এভাবেই তুলে ধরেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী আশরাফ হুমায়ুন বাঙ্গাল।

তার কথা প্রথম জানান তারই সহযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন পাহাড়ি (বীরপ্রতীক)। মুঠোফোন নম্বরটি দিয়ে সহযোগিতাও করেন। কিন্তু আন্তরিকতার সঙ্গে কথা বললেও সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হন না হুমায়ুন বাঙ্গাল।

কেন?

দায়িত্ব ছিল, যুদ্ধ করেছি। সেই যুদ্ধের কথা শুনে কি হবে? আমার জীবন ইতিহাস কে শুনবে, মরে গেলেই তো সব শেষ! এখন মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে কী হবে? এমন নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হই। তার মনের ভেতর তৈরি হওয়া অভিমানের জাল প্রথমেই ভেদ করতে পারিনি। কিন্তু হালও ছাড়ি না। মুঠোফোনে কথা চলত মাঝেমধ্যেই। এভাবেই কেটে যায় বছর দুয়েক। যখন থাকবেন না তখন প্রজন্ম আপনার বীরত্বের ইতিহাস জেনে উদ্দীপ্ত হবে, বীরদের কথা না জানলে তারা কীভাবে বীরত্বপূর্ণ কাজ করবে। একেকজন মুক্তিযোদ্ধার জীবনের গদ্যই মুক্তিযুদ্ধের একেকটি ইতিহাস। এ কারণেই মুক্তিযুদ্ধের সকল ঘটনা যত্নসহকারে তুলে আনা প্রয়োজন। একাত্তরের কথা না বললে প্রজন্ম ইতিহাস জানবে কীভাবে? একদিন এমন কিছু কথায় তার মন গলে। ফলে এক বিকেলে তার কালিহাতির বাড়িতে বসেই চলে আলাপচারিতা। হুমায়ুন বাঙ্গাল তুলে ধরেন একাত্তরের অজানা সব ইতিহাস।

কাজী রিয়াজউদ্দিন ও ফাতেমা বেগমের চতুর্থ সন্তান কাজী আশরাফ হুমায়ুন বাঙ্গাল। বাবা ছিলেন ম্যারেজ রেজিস্ট্রার। পৈত্রিক বাড়ি গোপালপুর থানার করিয়াতা গ্রামে। চাকুরির সুবাদে তিনি চলে আসেন কালিহাতিতে। ফলে হুমায়ুন বাঙ্গালের জন্ম ও বেড়ে ওঠা কালিহাতির বেতডোবা গ্রামেই। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি হামিদপুর মাদ্রাসায়। তিনি মেট্রিক পাশ করেন কালিহাতি রামগতি শ্রী গোবিন্দ (আরএস) উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। এরপর চলে যান চট্টগ্রামে, ভর্তি হন চট্টগ্রাম পলিটেকনিকে। সেখানে ছাত্রলীগের হোস্টেল শাখার সেক্রেটারি ছিলেন হুমায়ুন বাঙ্গাল। রাজনীতি করতে গিয়ে জেলেও যেতে হয় তাকে।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'স্কুলে থাকতেই ছাত্রলীগের সাথে যুক্ত হই। কালিহাতি উপজেলায় ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি ছিলাম। সভাপতি ছিল হামিদপুরের আব্দুর রাজ্জাক। চট্টগ্রামে ৬৯-এর গণআন্দোলন করতে গিয়েই একবার অ্যারেস্ট হই। এগার দিন জেলেও খাটতে হয়েছে। সেলিম ভাই ও মহিউদ্দিন ভাইরাও ছিলেন নেতা। আন্দোলনের মুখে আমাদের তেরজন ছাত্রকে পুলিশ ছেড়ে দিলেও পরে একটি মামলা হয়ে যায়। তখন পালিয়েই চলে আসি টাঙ্গাইলে। ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হই সাদাত কলেজে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলাম ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র।

৭ মার্চ ১৯৭১। হুমায়ুন বাঙ্গালসহ টাঙ্গাইলের নেতাকর্মীরা গাড়ি ভাড়া করে চলে যান ঢাকায়, রেসকোর্স ময়দানে। মঞ্চের খুব কাছাকাছি ছিলেন তারা। ধরেই নিয়েছিলেন কিছু একটা ঘটবে। নেতার হুকুমের অপেক্ষায় সবাই। বঙ্গবন্ধু বললেন, '…এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম..। এই লাইন দুটিই সবকথা বলে দেয়। পুরো ভাষণটাই ছিল আল্লাহ প্রদত্ত। স্বাধীনতার জন্য এরপর আর কোনো ঘোষণার প্রয়োজন পরেনি বাঙ্গালদের। ফলে তারা ফিরে এসেই প্রস্তুতি নেন সশস্ত্র সংগ্রামের।

কী করলেন?

তাঁর ভাষায়, 'কালিহাতি রামগতি শ্রী গোবিন্দ (আরএস) স্কুল মাঠে ছাত্র, কৃষক, জনতাসহ পাঁচশতাধিক মানুষকে বাঁশের লাঠি দিয়ে ট্রেনিং করানো শুরু করি। এ উদ্যোগের সঙ্গে ছিলেন মির্জা ফরহাদ, আলী আজগর, আবুল কাশেম ভুঁইয়া, লাল মিয়া, আব্দুর রাজ্জাক প্রমুখ। ট্রেনিং করান মোতালেব নামের একজন রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার। থানায় ছিলেন জহির দারোগা। তিনিও সাহায্য করেছেন। পরে কালিহাতি থানার ভেতরের মাঠে আমাদের বিশ-পঁচিশজনকে গোপনে হাতিয়ার চালানো শেখান তৎকালীন ওসি শাহ নেওয়াজ ফরাজি। পাকিস্তানের চাকুরি করলেও উনি সহযোগিতা করেছিলেন। এ কারণে ইতিহাসে ওসি শাহ নেওয়াজ ফরাজির নামও লেখা থাকবে।'

২৫ মার্চে রাতে ঢাকায় শুরু হয় গণহত্যা। টাঙ্গাইলের নেতারা তখন যুদ্ধ পরিচালনায় দুজনকে দায়িত্ব দিয়ে কমিটি করেন। একজন বদিউজ্জামান, আরেকজন ছিলেন আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী। ওইসময়ই বাছাই করা ছেলেদের নিয়ে হুমায়ুন বাঙ্গালকে টাঙ্গাইলে যেতে খবর পাঠান লতিফ সিদ্দিকী। আনিসুর রহমান, লাল মিয়া, মতিন প্রমুখ সাতজন নিয়ে তিনিও চলে যান টাঙ্গাইল শহরে।

হুমায়ুন বাঙ্গাল বলেন, 'এখন টাঙ্গাইলে যেটা সেটেলমেন্ট অফিস, তখন ওটার সামনে ছিল ট্রেজারি। ওখানে একটা বাড়ি থেকে লতিফ সিদ্দিকী প্রত্যেককে দুশো রাউন্ড গুলি ও একটি করে রাইফেল দেন। ওটা নিয়ে আমরা চলে যাই নাটিয়াপাড়ায়। ৪ এপ্রিল পাকিস্তানিদের সঙ্গে প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ হয় ওখানেই। কিন্তু ওদের আক্রমণের মুখে আমরা টিকতে পারি না। চলে আসি কালিহাতিতে।'

টাঙ্গাইল শহর দখলে নিয়ে আর্মিরা কালিহাতির দিকে অগ্রসর হলে হুমায়ুন বাঙ্গালরা প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। কিন্তু অস্ত্রের মুখে টিকতে পারেন না। ১৭ এপ্রিল তারিখে কালিহাতি পাকিস্তানি আর্মিদের দখলে চলে যায়। তারা তখন প্রথমে বাগুন্ডিয়ায় এবং পরে চলে যান বহেরাতলী ক্যাম্পে। সেখানে কিছুদিন মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র চালানো শেখান হুমায়ুন বাঙ্গাল। একবার বাসাইল কাউজানির কাইলান নামক জায়গায় আর্মিদের একটি নৌকায় অ্যাটাকও করেন। সেখান থেকে মেলে কয়েকটি অস্ত্র। এভাবে আরও কিছু অস্ত্র জোগাড় হয়। তখন কাদের সিদ্দিকীকে বলে ১৭-১৮ জনের একটি গ্রুপ নিয়ে হুমায়ুন বাঙ্গাল চলে যান গোপালপুর এলাকায়। সেখানে নিজের মতো করে গড়ে তোলেন মুক্তিযোদ্ধাদের বড় একটি দল।

তার ভাষায়– 'ওখানে গিয়ে ঝাওয়াইল, বেংগুলা প্রভৃতি এলাকায় যুবকদের ট্রেনিং করাই। ফলে বাড়তে থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা। আমার পরিচিতিও বেড়ে যায়। একবার ভুয়াপুরে (ভুঞাপুরে) যমুনা নদীতে পাকিস্তানিদের আর্মস ভর্তি জাহাজ বিধ্বস্ত করে মুক্তিযোদ্ধারা। জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিলেন বাঙালি। উনি জাহাজ থেকে নেমে গোপনে এসে খবর দেন হাবিব কমান্ডারকে। ওরা দ্রুত অ্যাটাক করে জাহাজে আগুন ধরিয়ে দেয়। গোটা জাহাজ বিস্ফোরিত হয়। আকাশের অনেক ওপরের দিকে উঠে যায় আগুনের লেলিহান শিখা।

ওই সময়ই বেশ কয়েকজন পাঞ্জাবি গোপালপুর থেকে স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় নরদা শিমলার দিকে আসছিল। খবরটি পেয়েই আমরা ক্যারামজল থেকে দ্রুত এসে নরদা শিমলায় পজিশন নিয়ে থাকি। ওরা কাছাকাছি আসতেই শুরু হয় তুমুল গোলাগুলি। ওইদিন দুইজন পাক আর্মিকে ধরে ফেলি। তখন জয় বাংলা স্লোগান তুলি। চারপাশ থেকে হাজার হাজার মানুষও ছুটে আসে। তারা আর্মি দুজনকে নিমিষেই পিটিয়ে মারে। তাদের দেহও ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। পাকিস্তানিদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের চাপা ক্ষোভ সেদিন হিংস্রতায় রুপ নিয়েছিল।

এরপর কাদের সিদ্দিকী খবর পাঠালে ৩০ অগাস্ট প্রায় একশ মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে গোপালপুর থেকে বেংগুলা ঝাওয়াইল হয়ে নদী পথে চলে যাই ভারতের মানকাচরে। সেখানে হিরো ক্যাম্পে সাত দিনের উচ্চতর ট্রেনিং হয়। এর পরই সাতটা নৌকায় করে মুক্তিযোদ্ধা ও প্রচুর আর্মস-অ্যামুনেশন নিয়ে বেংগুলা হয়ে চলে আসি গোপালপুরের করিয়াটায়।'

হুমায়ুন বাঙ্গালের অধীনে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি ক্যাম্প। একটি ক্যারামজানি, আরেকটি বেংগুলায়। স্থানীয় মানুষ তাদের সহযোগিতা করত সবসময়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি মানুষের ভালবাসার স্রোতেই স্বাধীনতা এসেছে– এমনটাই মনে করেন এই বীর যোদ্ধা।

দুর্ধর্ষ একটি অপারেশনের কথা শুনি এই বীর মুক্তিযোদ্ধার মুখে। তিনি বলেন, 'কয়রা নামক জায়গায় এক রাতে একটি কবরস্থানে প্রায় দুই গাড়ি আর্মস ও অ্যামুনেশন আমরা লুকিয়ে রাখছি। ওইসময় একজন এটা দেখে ফেলে। সে খবর দিয়ে আসে মধুপুর আর্মি ক্যাম্পে। ওরা তখন পুরা প্রস্তুতি নিয়ে মার্চ করে। এ খবর পেয়ে আমরাও প্রস্তুতি নিই। তখন আমাদের কাছে এলএমজি, এমজি, থ্রি-নট-থ্রি, টু ইঞ্চ ও থ্রি ইঞ্চ মর্টারসহ পর্যাপ্ত আর্মস ছিল। ওরা নদী পার হয়ে আসছে। গাছের ওপর থেকে দূরবীন দিয়ে দেখছি। কয়েকশ আর্মি, আমরা মাত্র ৫০-৬০জন। তবুও সাহস হারাই না। চরপাড়া কয়রায় ওরা রেঞ্জের ভেতর ঢুকতেই বলি 'ফায়ার'। পাখির মতো মরতে থাকে আর্মিরা। কিন্তু তবুও অ্যাডভান্স হয়। খুব কাছাকাছি চলে আসলে আমরা উইথড্র করে সরে পড়ি। পাকিস্তানি সেনারা ওদের প্রায় দুই গাড়ি লাশ তুলে নিয়েছিল ওই দিন। খুব বড় অপারেশন ছিল ওটা। অপারেশনের খবর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকেও প্রচার করা হয়। কিন্তু পাক আর্মিদের হাতে ওইদিন ধরা পড়ে সহযোদ্ধা সালাম। তাকে ওরা নির্মমভাবে মুখে ও গলায় টর্চার করে, রশি দিয়ে টেনে রাস্তায় ফেলে হত্যা করে। কবরস্থান থেকে আর্মসগুলোও তুলে নিয়ে যায়। কিন্তু তবুও থেমে থাকি না। অপারেশন করি পানকাতা, বেংগুলা, সুন্দরপাড়া, গোপালপুর থানাসহ বিভিন্ন এলাকায়।'

মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ুন বাঙ্গাল ছিলেন 'হনুমান' কোম্পানির কমান্ডার।

কোম্পানির নাম কেন এমন?

মুচকি হেসে তিনি বলেন, 'একাত্তরে গোপালপুর ও তার আশপাশের এলাকায় প্রায়ই সশস্ত্র অপারেশন করতাম। আমাদের ভয়ে পাকিস্তানি আর্মিরা সবসময় তটস্থ থাকত। ওই সময় আর্মিরা মাইক মারে গোটা গোপালপুরে। জীবিত কিংবা মৃত আমাকে ধরিয়ে দিতে পারলেই মিলবে দশ হাজার টাকা পুরস্কার। পাকিস্তানি সেনারা আমার 'হুমায়ুন' নাম বলতে পারত না। বলত, 'হনুমান'। আক্ষেপ করে বলত, 'হনুমান কেসা চিজ? এরপর থেকেই মানুষের মুখে মুখেই আমার নাম হয়ে যায় 'হনুমান'। এভাবে কোম্পানিরও নাম হয় 'হনুমান কোম্পানি'।

নাগরপুর থানা অপারেশনের সময় এই সূর্যসন্তান রক্তাক্ত হন। কী ঘটেছিল ওইদিন? কোম্পানি কমান্ডার হুমায়ুন বাঙ্গাল জানান রক্তাক্ত ওই দিনটির আদ্যোপান্ত। তার ভাষায়, 'আমরা আগেই নাগরপুরের লাউহাটিতে গিয়ে ক্যাম্প করি। ট্রেনিং করিয়ে সেখানেও আরেকটা কোম্পানি গড়ে তুলি। মির্জাপুর, নাগরপুর, লাউহাটি ও ধামরাইয়ের ছেলেরা ছিল বেশি ওখানে। দুটি কোম্পানিরই কমান্ড করতাম। একটার টুআইসি আনোয়ার হোসেন পাহাড়ি, আরেকটায় ছিল মকবুল হোসেন।

একদিন কাদের সিদ্দিকী সিগন্যাল পাঠান নাগরপুর থানা অ্যাটাকের। আমরাও ফোর্স নিয়ে প্রস্তুত থাকি। অনেকগুলো গ্রুপ একসঙ্গে অ্যাটাক করে। তারিখটা ৩০ নভেম্বর, সকালবেলা। উত্তর-পশ্চিম সাইডে আমরা। মধ্যে একটা গ্রুপ, কাদের সিদ্দিকী ছিলেন দক্ষিণে। নাগরপুর থানার পেছনটায় ছিল একটা বড় বিল, ডান পাশে রাস্তা। অ্যাটাক করে ওদের ভাগানোর উপায় নেই। হয় তাদের মেরে ফেলতে হবে। না হয় আমাদের মরতে হবে। এ কারণেই তিনবার নাগরপুর থানা অ্যাটাক করেও মুক্তিযোদ্ধারা ফেল করে।

ওইদিন সবাই বিভিন্ন জায়গায় পজিশনে। আমি আর পাহাড়ি খালের পাশে একটু নিচু জায়গায়। সঙ্গে গ্রেনেড থ্রো রাইফেল। পাহাড়ি রাইফেলটা ফিট করে, গ্রেনেড থ্রো করি আমি। প্রথমটা পাকিস্তানিদের বাঙ্কারে গিয়ে পড়ে। ধুম করে বিকট শব্দ হয়। দেখলাম বাঙ্কার থেকে ওদের ছিন্নভিন্ন দেহ আশেআশে ছিটকে পড়ছে। আনন্দে জয় বাংলা স্লোগন তুলি। চিৎকার দিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের বলি, 'এই শুয়োর কা বাচ্চা, তুম লোক জয় বাংলা কহ, হাম নেহি গুলি চালায়ে।' শুনেই ওরা ক্ষেপে যায়। গুলি চালিয়ে বলে, 'শালা কুত্তার বাচ্চা 'বাঙ্গাল'।

আমার শরীরে রাগ ধরে যায়। তখনই আরেকটা গ্রেনেড থ্রো করি। ওটাও ওদের বাঙ্কারে গিয়ে ঢুকে। আমরা তো মহাখুশি। খুশিতে হুশ নাই। নিচের দিকে বসা ছিলাম। রাস্তার ওপরে উঠে বসি তখন। গ্রেনেড থ্রো রাইফেলটা পাহাড়ি সেট করে। গ্রেনেডটা ঢুকিয়েছি মাত্র। অমনি ওদের এলএমজির একটা গুলি আমার পিঠের ডান পাশে ঢুকে বাঁ পাশ দিয়ে বেরিয়ে পাহাড়ির গাল ও চোয়াল ভেঙ্গে চলে যায়। এক গুলিতেই দুজন ধুপ করে পড়ে গেলাম। রাইফেলে যে গ্রেনেডটা ঢুকিয়েছিলাম ওটা যদি একটু বেরিয়ে যেত, তাহলে আমরা আর বাঁচতে পারতাম না।

সারা শরীর রক্তে ভেজা। অনুভব করি গোটা শরীর যেন আগুনের মতো গরম হয়ে যাচ্ছে। সহযোদ্ধারা দেখেই ঘাবড়ে যায়। পাশে মরার মতো পড়ে থাকে পাহাড়ি। নিজের ব্যাথা ভুলে ওকে কোলে নিয়ে বলি, 'পাহাড়ি বলো, লা-ইলাহা-ইল্লালাহু মোহাম্মাদুর রাসুল…।' কিন্তু ওর কোনো শব্দ নাই। পাহাড়ি মরে গেছে! না। খানিক পরেই সে গোঙ্গায়।'

সহযোদ্ধারা এগিয়ে আসলে আমিও তখন জ্ঞান হারাই। ওরা চোঙ্গার ওপর শুইয়ে ঘাড়ে করে আমাদের নিয়ে যায় দশ-বারো মাইল দূরে, লাউহাটি ক্যাম্পে। ওখানে কাদেরীয়া বাহিনীর চিকিৎসক ছিলেন ডা. শাহজাদা। অবস্থা খারাপ দেখে উনি দ্রুত কল করেন ডাক্তার জামান ও মায়াধর নামে একজন নার্সকে। বর্ণিল নামক স্থানে চিকিৎসা চলে আমাদের। ওই অপারেশনে সামসু নামে একজন মুক্তিযোদ্ধাও আহত হয়েছিল। কিছুদিন চিকিৎসার পর আবারও ফিরি রণাঙ্গনে।'

কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন, একাত্তরে দেশের জন্য রক্ত দিলেন। স্বপ্নের দেশ কি পেয়েছেন?

'দেশ পেয়েছি। এ দেশে একটা সময় ছিল বাঙালিরা এসপি, ডিসি, টিএনও, বড় কর্মকর্তা হতে পারত না। এখন তো অনেক অফিসার, সবাই বাঙালি। সবচেয়ে বড় কথা বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে পেরেছি। আমার রক্ত এই মাটিতে ফেলতে পেরেছি। এরচেয়ে বড় শান্তি নাই ভাই। কিছু পাওয়ার জন্য তো যুদ্ধে যাইনি। বেঁচে থাকব এমন চিন্তাও ছিল না। তখন শুধু চেয়েছি সাত কোটি জনগণ সুখে থাক, শান্তিতে থাক। এখন তো বঙ্গবন্ধুর কন্যার হাত ধরে সে পথেই এগোচ্ছে দেশ।'

স্বাধীনতার ঘোষণায় জিয়াউর রহমানের অবস্থান নিয়ে এই যোদ্ধা যুক্তি দিয়ে তুলে ধরেন নিজের মতটি। তার ভাষায়, 'জিয়া তো বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা করেছেন। মানে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা তিনি পড়েছেন। এখন রেহেনা পারভীন খবর পড়ছে, তার মানে কি রেহেনা পারভীন ওটা তৈরি করেছে? জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক হলে সেক্টর কমান্ডার হবেন কেন? দুঃখ লাগে, এখনও ইতিহাস বিকৃত করছে তার দল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ইতিহাস বিকৃতি ও তা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চলেছে বহু বছর। বঙ্গবন্ধুর কন্যা যদি ক্ষমতায় না আসত, মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থার যদি পরিবর্তন না ঘটত, তাহলে হয়তো পুরো ইতিহাসটাই বিকৃত করে ফেলত।'

এই বীরের আবেদন 'মুক্তিযুদ্ধের সময় কে হিন্দু, কে বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান সেটা তো গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। এটা এখনও গুরুত্বপূর্ণ নয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু তো অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। এ দেশটা যেন সেই পথেই থাকে।'

দেশ কেমন চলছে?

'বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে দেশ আজ উন্নয়নের পথে এগোচ্ছে। সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশ আজ রোল মডেল। বঙ্গবন্ধুর নাম এখন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। এটা তো আমরা দেই নাই। এটা আল্লাহতাআলা দিয়েছেন। আল্লাহ সৎ ও ন্যায়ের পক্ষে সবসময় থাকেন।'

কী করলে দেশ আরও এগোবে?

এই মুক্তিযোদ্ধার অকপট উত্তর: 'রাজনীতির ভেতরে যে দুর্নীতিবাজরা রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে। এখন যে রাজনীতিতে যুক্ত হয় সে একটা কাজ বা সুবিধার চিন্তা করে। ফলে নিজেও নষ্ট হয় আর রাজনীতিটাকেও নষ্ট করে। ভালোদের রাজনীতিতে আনার ও টিকিয়ে রাখার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। নেত্রী বলেছেন, স্বাধীনতাবিরোধীরা যেন দলে না ঢুকে। কিন্তু আমরা তো দেখি রাজাকার ফ্যামেলির লোকেরাও আওয়ামী লীগের নেতা বনে যাচ্ছে। এটা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে। এদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে।'

প্রত্যেক গ্রামে স্কুল আছে। সেখানে মাসে একবার হলেও স্থানীয় এক মুক্তিযোদ্ধাকে এনে তার মুখে মুক্তিযুদ্ধের কথা শোনানোর উদ্যোগ নিলে খুব সহজেই প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হবে, ত্যাগের ইতিহাসটাও তারা জেনে যাবে। পাশাপাশি এ মাটি ও দেশের প্রতি তাদের ভালবাসা জন্ম নিবে। এমনটাই মনে করেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী আশরাফ হুমায়ুন বাঙ্গাল। প্রজন্মের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন, 'তোমরা নিজেদের কাজে সৎ থেকো। দেশের স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাসটা জেনে নিও। মনে রেখো, এই দেশটা তোমার মা। তাকে মায়ের মতোই ভালবেসো। তাহলেই তুমি সামনে এগিয়ে যেতে পারবে।'

সংক্ষিপ্ত তথ্য

নাম: যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী আশরাফ হুমায়ুন বাঙ্গাল।

ট্রেনিং: স্থানীয়ভাবে অস্ত্র চালানো এবং ভারতের মানকাচরে হিরো ক্যাম্পে সাত দিনের উচ্চতর ট্রেনিং নেন।

মুক্তিযুদ্ধ করেছেন: কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে বাসাইল, গোপালপুর, ভুঞাপুর, নাগরপুরসহ টাঙ্গাইলের বিভিন্ন এলাকায় পঁচিশটির ওপর অপারেশনে অংশ নিয়েছিলেন।

যুদ্ধাহত: ৩০ নভেম্বর ১৯৭১। সকালবেলা। টাঙ্গাইলের নাগরপুর থানা অপারেশনের সময় পাকিস্তানি সেনাদের এলএমজির একটি গুলি তার পিঠের ডান পাশে ঢুকে বাঁ পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়।

ছবি ও ভিডিও: সালেক খোকন