একজন শিবরাম বা একজন গভীর ক্ষতজাত মানুষ

সেঁজুতি জাহানসেঁজুতি জাহান
Published : 16 July 2022, 01:49 AM
Updated : 16 July 2022, 01:49 AM


'সংগ্রহ করার বাতিক কোনো কালেই ছিল না কাকার! কেবল টাকা ছাড়া। কিন্তু টাকা এমন জিনিস যে যথেষ্ট পরিমাণে সংগৃহীত হলে আপনিই অনেক গ্রহ এসে জোটে এবং তখন থেকেই সংগ্রহ শুরু।'

অতি উচ্চমার্গীয় বুদ্ধিদীপ্ত হাস্যরসের এমন দুর্দান্ত আরম্ভ যাঁর গল্পে সেই মানুষটির জীবন কি নির্ভার আর স্বাচ্ছন্দ্যে ভরপুর থাকবার কথা?

শিবরাম চক্রবর্তী। যিনি লেখকের বাইরে আপাদমস্তক একজন বিভ্রান্তকারী মানুষ। না, বিভ্রান্ত সৃষ্টি করা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না, কিন্তু তাঁকে নিয়ে বিকট আগ্রহের জন্য লোকেরা একেবারেই নিজ দায়িত্বে বিভ্রান্ত হত।
তাঁর লেখা পড়ে বুঝবার জো নেই কী চরম দারিদ্র্য তাঁর জীবনকে দখল করে থাকলেও মন ও মস্তিষ্কে ছিল জীবনকে কৌতুকের হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ঋদ্ধ করার অভিপ্রায়। অথচ,জীবনের প্রতি কোনো অভিযোগ ছিল না এই লেখকের।
আশ্চর্য ধৈর্য শক্তির অধিকারী ছিলেন।

তাঁর সম্পর্কে লোকের বুঝ কেমন ছিল তার কিছু নমুনা দেওয়া যাক।

যাযাবর কিংবা ভবঘুরে না বললেও পাশ্চাত্যের বোহেমিয়ান অনেক সাহিত্যিকের সঙ্গে শিবরাম চক্রবর্তীর মিল খুঁজে পেতেন অনেকে। এটা এমনকি ইংরেজদের স্পাই সন্দেহেও গড়িয়েছিল।
এক সময়কার বিপ্লবী বিপিন বিহারী গাঙ্গুলীর এমনটা ভাববার কারণ শিবরাম কখনই শৃঙ্খলাপরায়ণ ছিলেন না এবং গণ্ডীবদ্ধ জীবনও যাপন করেননি কখনো।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন শিবরামকে একশো টাকা দিয়েছিলেন হাত খরচের জন্য, শিবরাম সেই টাকা দিয়ে বিছানা-পত্র বা জামাকাপড়, খদ্দর না কিনে ফাউন্টেন পেন এবং ঘড়ি কিনেছিলেন। বাকি পয়সার কিছু দিয়ে সিনেমা দেখে এবং খেয়েই শেষ করেছিলেন। পয়সার অভাবে একদিকে খবরের কাগজের হকারি করছেন, অন্যদিকে ইলিসিয়াম রো'য়ে যাচ্ছেন। যে কারণে বিপিনবাবু তাঁকে ইংরেজদের স্পাই বলে অপমাণিতও করেছেন।
ড. সৌরেন বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন,"মালদহের বিপিন কলকাতার বিপিনের পিন খেয়ে শিবরাম বেরিয়ে পড়লেন অজানা জগতের উদ্দেশ্যে।"( শিবরাম চক্রবর্তী:জীবন ও সাহিত্য)

'ইঁদুরদের দূর করো' পড়ে কি কেউ অনুধাবন করতে পারবে এমন অজানা ভাগ্যের গন্তব্যারোহী লেখক শিবরাম চক্রবর্তীর জীবন কতোটা দুর্বিষহ ছিল?
ইঁদুরের মতো তুচ্ছকে সর্বদা তাচ্ছিল্য করবার শাস্তি তিনি গল্পের মাধ্যমে প্রদান করলেন। একজন ভাগ্য বিড়ম্বিত মেধাবী লেখকের পক্ষে আর কী বা করা সম্ভব!

শরৎচন্দ্রকে ঈশ্বরের মতো শ্রদ্ধা করতেন শিবরাম।
দারিদ্রক্লিষ্ট শিবরাম নিজের একটি বইয়ের পান্ডুলিপি নিয়ে গিয়েছিলেন শরৎচন্দ্রের কাছে,ভূমিকায় যদি দুটো লাইন লিখে দেন তাহলে একটা প্রকাশক জোটে–এই আশায়।
লিখেও দিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র। কিন্তু, 'রিনি' নামের মেয়েটিকে ভুলতে না পারার স্মারক হিসেবে অবিবাহিত থাকবার জন্য ভুল বোঝার শিকার হন শরৎচন্দ্রের কাছে। ঐশ্বরিক সে সম্পর্কে ধরে যায় ফাটল। কারণটা খুব তুচ্ছ মনে হলেও শিবরামকে ভুল বোঝার ক্ষেত্রে এই সব তুচ্ছ বিষয়ই বৃহত্তর আকার ধারণ করে শেষমেষ।

শরৎচন্দ্রের 'দেনাপাওনা' উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়েছিলেন শিবরাম। নাম দিয়েছিলেন'ষোড়শী'। সেকালে সবাই অবগত এ বিষয়ে, এমনকি খোদ লেখকও।
অথচ সেই নাটক যখন 'ভারতী' পত্রিকায় প্রকাশিত হল তখন সেখানে নাট্যকারের নাম শিবরাম চক্রবর্তীর বদলে শরৎচন্দ্রের নাম গেল!

শিবরামের বদলে শরৎবাবুর নাম দিলে পত্রিকা বিক্রি হবে বেশি– সম্পাদকের যুক্তি শুনে সর্বংসহা শিবরাম চুপ থাকলেন। নাটক নিয়ে গেলেন শিশিরকুমার ভাদুড়ীর কাছে। নাটক পড়ে উচ্ছ্বসিত নাট্যাচার্য। বললেন,"অসাধারণ নাট্যরূপ দিয়েছেন! আমি শো করব।"

শুরু হল শো। প্রায় প্রতিদিনই হাউসফুল। এদিকে চিরায়ত দেনার দায়ে জর্জরিত খোদ নাট্যকার শিবরাম। নাট্যাচার্যকে বললেন, 'শিশিরবাবু, কিছু টাকা পেলে ভাল হয়। নাটকে আমার লভ্যাংশ থেকে যদি কিছু দিতেন… বড়ো উপকার হতো।'
নাটকের বেনিফিট শোয়ের দিন শিবরামকে আসতে বললেন শিশির কুমার। তিনি গেলেনও।
শো শেষে সাজঘরে গিয়ে টাকা চাইতেই শিশিরকুমার বললেন, ' বড়ো দেরি করে ফেললেন মশাই। আজ টিকিট বিক্রির সব টাকা একটি থলেতে ভরা ছিল, শো শেষ হতেই শরৎবাবু সাজঘরে এসে সব টাকা নিয়ে চলে গেছেন।'

'সে কী! আপনি বললেন না আমার কথা!' শিবরাম হতবাক হয়ে বললেন।

'বলেছিলাম। শরৎ উত্তরে আমায় বললেন, "শিবরাম টাকা দিয়ে কী করবে? বিয়ে-থা করেনি, কিচ্ছু না। ছেলেপুলে নেই, ঘর-সংসার নেই,তার কীসের জন্য টাকার দরকার?" আমি বললাম তবু কিছু দিন অনুগ্রহ করে…। খুব খারাপ অবস্থায় রয়েছে ও। আজ আসবে ও কিছু টাকার আশায়। শুনে বললেন, "না না। এই বেনিফিট নাইটের বখরা ওকে দিতে যাব কেন? এ রাত্তিরে টিকিট বিক্রি হয়েছে আমার নামে। এর মধ্যে শিবরাম আসছে কোথা থেকে!"বলে টাকার থলে নিয়ে একটু বেশিই তাড়াতাড়ি চলে গেলেন শরৎ । হয়তো আপনার মুখোমুখি যাতে না হতে হয় সেই জন্যই।'

শিশিরকুমারের কাছে এই কথা শুনে শান্ত শিবরাম একেবারে চুপ হয়ে গেলেন। ঋণ আর ক্ষুধার ভার কার ওপর দেবেন? ভাগ্যকেই বা কী বোঝাবেন তিনি?

মাথা নিচু করে অজানা গন্তব্যে মনের সকল ভাবনাকে ছিটিয়ে দিয়ে ফিরে আসছেন শিবরাম, পিছন থেকে ডাক দিলেন শিশিরকুমার, 'দাঁড়ান একটু।' বলে একজনকে বললেন, 'আমার চেক বইটা নিয়ে আয় তো।'

শিশির বাবুর অ্যাকাউন্টে মাত্র একশো কুড়ি টাকা। সেটাই শিবরামকে দিতে চাচ্ছিলেন তিনি। বললেন,'শিবরামবাবু, আপনার নামের বানান বলুন।'

'আমার তো কোনও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টই নেই।' উত্তরে শিবরাম বললেন।

'বেশ তাহলে এই একশো কুড়ি টাকারই একটা সেলফ চেক কেটে দিলাম। আমার আর কিছু নেই, বিশ্বাস করুন, থাকলে সেটুকুও দিতাম। কিছু মনে করবেন না।'

সেই চেক হাতে নিয়ে ক্ষতবিক্ষত মনে ফিরে এসেছিলেন শিবরাম। হীন, দরিদ্র জনসমাজের রূপকার কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের প্রতি জমে ওঠা এত দিনের শ্রদ্ধা যেন চোখের সামনে এক নিমেষেই চোখের জলে ভেসে যেতে শুরু করল!

যে শিবরাম কখনও কারও নিন্দা করেননি, সেই তিনিও 'দরদি' কথাশিল্পীর অমন আঘাত নির্বিবাদে হজম করে গেছেন।

অথচ, 'ঋণং কৃত্বা' পড়ে কিছুতেই বোঝার উপায় নাই যে,কৌতুকের ঝিলিকের অন্তরালে একজন ঋণ জর্জরিত মানুষের দুর্ভাগ্যের যন্ত্রণা কীভাবে নিভৃতে জ্বলতে থাকে!

শিবরাম চক্রবর্তী যতোই নিজেকে নিয়ে 'সিট-আরাম'(খাদ্যপ্রীতি ও আলস্য বোঝাতে) জাতীয় কৌতুক করুন না কেন, বা সেই কৌতুককর জীবনের নির্যাসকে পাঠকের সম্মুখে উত্থাপন করুন না কেন, জীবনের কঠিন সময়টুকু যে একা একাই কাটাতে হয়, সেখানে কোনো প্রকার কোনো উদযাপন চলে না — এই সত্যটুকু শিবরাম অনেক খ্যাতিমানের চেয়ে বেশি ভালো বুঝতেন।