কোভিড-১৯ এর কথা ভাবলে মনে যে ছবিটি ভেসে ওঠে, চাঁদের মতো গোলাকার লাল বৃত্ত, পৃথিবীর সব স্বাভাবিক বাস্তবতাকে যা ক্রমশ বেইমান অতিবাস্তবতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। চারদিকের সমাজ, জীবন থমকে আছে। দিন আসছে। দিন চলে যাচ্ছে। লকডাউনের অনিশ্চিত, অন্তহীন সময়ে কোটি কোটি মানুষ চেষ্টা করছে সর্বগ্রাসী দুঃস্বপ্নের অভিঘাতের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে।
হতাশা, শূন্যতাবোধ আর অন্তহীন ক্লান্তির শৃঙ্খলিত সময়ে মানুষের কল্পনাকে উজ্জীবিত ও উদ্দীপ্ত করতে পারে লেখকরা। স্বপ্ন-মায়া-ফ্যান্টাসিভরা লেখা দিয়ে পাঠকের জীবনকে নতুন করে ভালোবাসার উষ্ণতায় স্নিগ্ধ আর মধুময় করে তুলতে পারে। বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ আনোয়ার পাশার লেখা রাইফেল রোটি আওরাত এমনই এক অমর উপন্যাস, লেখা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে। তিন মাসের গল্প নিয়ে লেখা সে উপন্যাস ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রথম উপন্যাস। বর্তমান সময়ের মুমূর্ষু বাস্তবতা নিয়ে ব্যাপক আর গভীর কোনো উপন্যাস নিশ্চয়ই আমরা একদিন পড়ব।
করোনার মহামারির মত গত দুইশ বছরে বিশ্বে সাতবার কলেরা মহামারি দেখা দিয়েছিল। উনিশ থেকে বিশ শতকে রাশিয়ায় কলেরা মহামারিতে দশ লক্ষের মত মানুষের প্রাণহানী ঘটেছিল। রুশ সাহিত্য এই isolation বা বিচ্ছিন্ন থাকার অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। সম্প্রতি 'লেখক যখন বাড়িতে', হ্যাশট্যাগে সাহিত্যিকদের ঘরে আটকা পড়ে থাকার সময়কার কিছু ভাবনা লেখক, প্রকাশক এবং সাহিত্যের জাদুঘরগুলো প্রকাশ করছে। Russian Life ম্যাগাজিনে ছাপা হওয়া ফিচারটিতে জানা যায়, কলেরা মহামারির সময় তিন মাস ধরে পারিবারিক বলডিমো এস্টেটে আটকা পড়েছিলেন আলেকজান্ডার পুশকিন, এবং এ সময়টিই তাঁর জীবনের সবচেয়ে ফলপ্রদ সময় হিসেবে পরিগণিত। এছাড়াও অন্যরা, যেমন লিও তলস্তয়, বলতে গেলে কখনোই নিজের এস্টেট ছেড়ে বেরোতেন না (অবশ্য আজকের রাশিয়ানদের যে ধরনের বাড়িঘরে আটকা পড়ে থাকতে হয় তার তুলনায় এসব ঘরবাড়ি অনেকটাই বড় ছিল)।
বিপর্যস্ত সময়ের শৈল্পিক অভিঘাতে ভরা লেখাগুলোর কয়েকটি লেখকদের মুখনিঃসৃত, তলস্তয়েরটি তাঁর সেক্রেটারীর লেখা, মারিনা ইভানোভ্না স্ভেতায়েভার বন্দিত্বের সময়টি উঠে এসেছে তাঁর বোন আনাস্তাসিয়া ইভানোভ্না স্ভেতায়েভার লেখায়।
আন্তন চেকভ বিশ্বসাহিত্যের কালজয়ী লেখক। চেকভ একাধারে কথাসাহিত্যিক এবং নাট্যকার। চেকভের জন্ম ১৮৬০ সালে। পিতা ছিলেন ভূমিদাস। চেকভ পড়াশোনা করেছিলেন চিকিৎসা বিজ্ঞানে। ১৮৯১ সালে লেখা চেকভের যে চিঠিটি 'চেকভ মিউজিয়ম' প্রকাশ করেছে সেখানে দেখা যাচ্ছে, লকডাউনের মধ্যে বাড়িতে বসে আছেন চেকভ, লিখছেন, 'বলে দিয়েছি আমার ঘরে যাতে কেউ না ঢোকে। নলখাগড়ার বনের মধ্যে বসে থাকা বকের মতো বসে আছি নিজের ঘরে। কারো সঙ্গে দেখা করি না আমি, অন্যরাও আমার সঙ্গে নয় । এটাই ভালো, নইলে আমার ডোর বেলটা ভেঙে ফেলবে লোকজন, পড়ার ঘরটা ভরে যাবে সিগারেটের ধোঁয়া আর মানুষের বকবকানিতে। এভাবে বেঁচে থাকাটা খুবই একঘেয়ে, কিন্তু কী আর করা যাবে!'
মারিনা ইভানোভ্না স্ভেতায়েভা, ১৮৯২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। মারিনাকে বিংশ শতাব্দীর রাশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি বলে বিবেচনা করা হয়। বোন আনাস্তাসিয়া ইভানোভ্না স্ভেতায়েভার কাছে এক স্মৃতিচারণায় মেরিনা বন্দি সময়গুলোর বিবরণ দিয়েছিলেন। আনাস্তাসিয়াও কবি ছিলেন। তিনি তাঁর আবেগবর্জিত ভাষায় লেখেন, 'দিনের অর্ধেকটা সময় সে নকশা আর পোর্ট্রেটে ভরা বদ্ধ ছোট ঘরটিতে আটকে রাখে নিজেকে। চারপাশে ফরাসি বইপত্র ছড়ানো; ভিন্ন এক যুগের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখে সে, আর বাস করতে থাকে ভিন্ন সব নামের মধ্যে। যে সমাজে সে বাস করে সেই সমাজ ও প্রাত্যহিক জীবন, সবকিছুই অনেক দূরে। ওর পড়াশোনার পথে সবকিছুই একটা বাধা। যখন একেবারে হতক্লান্ত হয়ে যায় তখনই কেবল ঘর থেকে বের হয় সে, ক্ষীণদৃষ্টি মানুষের মতো চোখ কুঁচকে তাকায়, মিনিটখানেকের জন্য আশপাশে সবাইকে দেখে, অন্য সবকিছুও দেখে ও শোনে তারপর ফের নিজের ভেতর এবং নিজের ঘরের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে নেয়ার জন্য তৈরি হয়ে যায়।'
১৮২৮ সালে জন্ম নেয়া লিও তলস্তয় খ্যাতিমান রুশ লেখক। তাকে রুশ সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক, এমনকি বিশ্ব সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক বলে বিবেচনা করা হয়। তলস্তয়ের সেক্রেটারী ভ্যালেন্তিন বুলগাকভ এর লেখা থেকে তলস্তয়ের গৃহবন্দিত্বের সময়টুকু ধরা পড়ে। 'বড় ডাইনিং হলটা ছিল কাউন্টেস সোফিয়া আন্দ্রেয়েভনার প্রিয় জায়গা, কেবল নাস্তা, দুপুরের খাবার আর বিকেলের চায়ের জন্য এখানে আসতেন তলস্তয়। বাকি সময়টা নিজের পড়ার ঘরেই কাটাতেন। সন্ন্যাসীর মতো জীবনযাপনের জন্য বিখ্যাত তলস্তয়। বৃদ্ধ হলেও বাইরের দুনিয়ার সাথে যেরকম প্রাণবন্ত ও বৈচিত্র্যপূর্ণ যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন তিনি, তাতে রাজধানীর অনেক বাসিন্দাকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। সবসময়ই হাতের কাছে রাখতেন বই, সাময়িকী আর দৈনিক পত্রিকা, পড়তেন, নেড়েচেড়ে দেখতেন, চোখ বোলাতেন। আর চিঠিপত্র? অসংখ্য চিঠি লিখতেন প্রতিদিন, মাসে কয়েক'শ, বছরে কয়েক হাজার।'
রুশ কবি সের্গেই ইয়েসেনিন জন্ম নিয়েছিলেন ১৮৯৫ সালে রাশিয়ার রিয়াজন প্রদেশের এক সাধারণ কৃষক পরিবারে । রুশ ভাষার অত্যন্ত জনপ্রিয় কবি ইয়েসেনিনের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে সাধারণ পাঠক বা বিদগ্ধ সমালোচক কারো মধ্যে কোনো মতপার্থক্য নেই। ১৯২৪ সালে গালিনা বেনিস্লাভ্স্কায়াকে লেখা এক চিঠিতে তিনি লেখেন, 'তোমাকে, শুরা আর কাটিয়াকে ছাড়া একঘেয়ে সময় কাটছে এখানে। অবিশ্রান্ত বৃষ্টি এসে আঘাত হানছে জানালার কাঁচে। আমি একা। কাজেই অবিরাম লিখে চলি। বিকেলে নাটক দেখতে বা রেস্তোরাঁয় খেতে যাই আমি আর লিওভা। আমাকে চা খাওয়ার অভ্যাস করিয়েছে সে, অতএব দুজনে ঠিক দু বোতল ওয়াইন খাই প্রতিদিন দুপুর আর রাতের খাবারের সময়। জীবনটা নিরিবিলি, সন্ন্যাসীদের মতো।'
লুদমিলা উলিৎস্কায়ার জন্ম ১৯৪৩ সালে । খ্যাতিমান এই লেখিকা মূলত উপন্যাস এবং ছোটগল্প লেখেন। কঠিন প্রতিকূল সময় নিয়ে লুদমিলার লেখা, 'অতএব, পিটার ও পল দুর্গে থাকার সময় নিকোলাই চেরনিসেভস্কি যে ধারালো দার্শনিক প্রশ্নটি রেখেছিল সেটিই এখন আমাদের সামনে: 'কী করা যায়?' তবে আমার জবাবটা দার্শনিক নয়, গার্হস্থ্য ধরনের। 'নতুন জীবনের' শুরুতেই কব্জা করা আমার প্রথম জয়টি ছিল দরজার মুখের পাপোশটা পরিষ্কার করা, যেটি করার কথা কিছুদিন ধরেই ভাবছিলাম। তারপর ঘষে ঘষে বাথরুমটা পরিষ্কার করি । সাধারণত ঘর পরিষ্কার করার সাথে একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়, একটা থেকে বের হয়ে আসে আরেকটা কাজ, আর সেসব কখনোই শেষ হয় না।'
আন্তন চেকভের 'দি থ্রি সিস্টার্স' নাটকের শেষে এর কেন্দ্রীয় চরিত্র ওলগার করুণ আর মর্মস্পর্শী একটি জিজ্ঞাসু উক্তি ছিল, 'কেন আমরা বাঁচি, কেন কষ্ট পাই-যদি জানতে পারতাম, শুধু যদি জানতে পারতাম !'
প্রত্যাশা করি পৃথিবীর এই ব্যাধিগ্রস্ত, দুঃখবাদী, হতাশাবাদী সময় কেটে যাবে।
আশার সংযোগতো রবীন্দ্রনাথের কবিতায়ই রয়েছে…
যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে
সব সংগীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া,
যদিও সঙ্গী নাহি অনন্ত অম্বরে,
যদিও ক্লান্তি আসিছে অঙ্গে নামিয়া,
মহা আশঙ্কা জপিছে মৌন মন্তরে,
দিক্-দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা–
তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।