সলিল চৌধুরী: বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ সংগীতকার

গোলাম মুরশিদ
Published : 6 March 2021, 06:38 AM
Updated : 6 March 2021, 06:38 AM


বাংলা গণসংগীতের সূচনা নজরুলে, আর পরিণতি সলিলে। নজরুল যখন অস্তমিত, তখন সলিলের আবির্ভাব। কৃষক, শ্রমিক এবং জেলেদের নিয়ে তিনটি গান রচনা করেছিলেন নজরুল। এই গান তিনটি ছিলো মশালের আলো ফেলে সমাজের নিম্ন শ্রেণীকে দেখার মতো। অপর পক্ষে, সলিল সরাসরি সেই শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে গলাগলি করে তাদের মাঠের মধ্যে চলে যান। তাঁর ভাষা আলাদা, তাঁর অবস্থান আলাদা। তিনি কৃষক-শ্রমিককে দূর থেকে সহানুভূতি জানান না। তিনি তাদের একজন বনে যান। তেভাগা আন্দোলনের সময় তিনি যে-গান লিখেছিলেন, তা থেকে তাঁর এই অবস্থান স্বচ্ছ হয়ে ওঠে:
হেই সামালো হেই সামালো ধান হো,
কাস্তেটা দাও শাণ হো
জান কবুল আর মান কবুল
আর দেব না আর দেব না রক্তে বোনা ধান মোদের প্রাণ হো।

তেভাগা আন্দোলন হয়েছিলো ১৯৪৬ সালের শেষ দিকে। কিন্তু তার আগেই তিনি গণসংগীত রচনা করেছিলেন। বিদ্যাধরী নদীর বন্যায় বিরাট এলাকা ভেসে গিয়েছিলো। কৃষকদের ওপর অত্যাচারের খবরও পাওয়া গিয়েছিলো সেই সঙ্গে। এই উপলক্ষে তিনি একটি গণসংগীত রচনা করেন। এটি সম্ভবত তাঁর প্রথম গণসংগীত: 'দেশ ভেসেছে বানের জলে ধান গিয়েছে মরে।' তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ উপলক্ষেও তিনি কয়েকটি গণসংগীত লেখেন। যেমন, 'তোমার বুকে খুনের চিহ্ন খুঁজি এই আঁধারের রাতে','পৌষালি বাতাসে পাকা ধানের বাসে', 'আয় বৃষ্টি ঝেঁপে ধান দেব মেপে' ইত্যাদি।
সলিলের জন্ম হয়েছিলো ২৪-পরগনায়। কিন্তু তিনি বড়ো হন আসামের এক চা-বাগানে। তাঁর পিতা ছিলেন সেই বাগানের ডাক্তার। পিতা গান খুব ভালোবাসতেন এবং তাঁর সংগ্রহে ছিলো বহু পশ্চিমা উচ্চাঙ্গ সংগীতের রেকর্ড। বিশেষ করে সিম্ফনির রেকর্ড। সিম্ফনি কথাটার অর্থ হলো একটা সমবেত সাংগীতিক পরিবেশনা।
'সাংগীতিক পরিবেশনা' কথাটার অর্থ বরং বুঝিয়ে বলি। ধরা যাক, কয়েকজন বাদ্যযন্ত্রী মিলে এক সঙ্গে সেতার, সরোদ, বেহালা এবং বাঁশি বাজানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। তাঁরা একটা রাগও বেছে নিলেন। তারপর কে কী বাজাবেন, কখন বাজাবেন, কার পরে বাজাবেন, তা ঠিক করলেন। 'আলাপে'র সময় কে কখন কতোটুকু বাজাবেন, তাও ঠিক করলেন। এক কথায়, তাঁদের সংগীত পরিবেশনার একটা সুনির্দিষ্ট ছক এঁকে ফেললেন এবং তার স্বরলিপি লিখে ফেললেন। এটা হলো সিম্ফনি। এই পরিবেশনার অন্তত চারটা অংশ থাকে। এক কথায় 'গান' যেমন একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ সৃষ্টি, সিম্ফনিও তেমনি একটি সাংগীতিক সৃষ্টি। তবে গান কণ্ঠসংগীত, সিম্ফনি যন্ত্রসংগীত।
সলিলের পিতা এসব সিম্ফনির রেকর্ড বাজিয়ে শুনতেন। তাঁর দুই পুত্রও শুনতেন। এভাবে বাল্যকালে ও কৈশোরে সংগীতের প্রতি সলিলের আকর্ষণ গড়ে ওঠে। তবে প্রথমে এই আকর্ষণ তৈরি হয় পশ্চিমা উচ্চাঙ্গ সংগীতের প্রতি।
লোকসংগীত-সহ দেশীয় সংগীত এবং দরিদ্র শ্রমিকদের প্রতি তাঁর আকর্ষণ তৈরি হবারও একটা ইতিহাস আছে। সলিলের পিতা চা-বাগানের শ্রমিকদের নিয়ে 'নাটক' করতেন, গান-বাজনা করতেন। সেই থেকে দরিদ্র শ্রমিকদের প্রতিও সলিলের সহানুভূতি সৃষ্টি হয়। চা-বাগানের কুলিদের গান-বাজনার দিকেও তাঁর কৌতূহল জেগে ওঠে এভাবে। সলিল তখন গান গাইতেন। বাঁশি, পিয়ানো আর এসরাজও বাজাতেন। বিশেষ করে বাঁশি বাজানোয় তিনি দক্ষতা অর্জন করেছিলেন।
তিনি কলকাতার কলেজে ভর্তি হন স্নাতক শ্রেণীতে লেখাপড়া করবেন বলে। চার দিকে তখন প্রবল রাজনৈতিক আন্দোলন চলছিলো দেশকে স্বাধীন করার জন্যে। সেই সঙ্গে একে একে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, সাম্প্রদায়িক হানাহানি, গণনাট্য আন্দোলন, ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, তেভাগা আন্দোলন (১৯৪৬-৪৭), হিন্দু-মুসলিম দাঙা (১৯৪৬), দেশবিভাগ, দেশত্যাগ ইত্যাদি।
সলিল কলকাতায় আসার পর বামপন্থী গণনাট্য আন্দোলনে অর্থাৎ আইপিটিএতে যোগদান করেন। তখন প্রথম দিকে তিনি এঁদের সমবেত সংগীতে অংশ নিতেন বাঁশিবাদক হিসেবে। তারপর তিনি দেখা দেন সংগীত-রচয়িতা, সুরকার, গায়ক এবং কবি হিসেবে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি নিজের বৈশিষ্ট্য এবং প্রতিভার পরিচয় দেন। তেভাগা আন্দোলন নিয়ে তিনি আর-একটা গান রচনা করেছিলেন। সে গানে তাঁর বক্তব্য আরও স্পষ্ট।
আয়রে ও আয়রে,
ও ভাই রে, ও ভাই রে,
ভাই বন্ধু, চল্ যাই রে,
ও রাম-রহিমের বাছা,
ও বাঁচা আপন বাঁচা
চল্ ধান কাটি আর কাকে ডরি,
নিজ খামার নিজে ভরি,
কাস্তেটা শানাই রে।।

বস্তুত, রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে, এমন প্রতিটি ঘটনার দিকে তিনি তাঁর চোখ-কান খোলা রাখতেন। যেমন, ১৯৪৬ সালের জুলাই মাসে যখন নৌবিদ্রোহ হলো, অমনি তিনি রচনা করলেন তাঁর বিখ্যাত গান:
ঢেউ উঠছে কারা টুটছে আলো ফুটছে
প্রাণ জাগছে ঢেউ উঠেছে কারা টুটেছে
আলো ফুটেছে প্রাণ জাগছে জাগছে জাগছে
গুরু গুরু গুরু গুরু ডম্বুর পিনাকী বেজেছে বেজেছে বেজেছে

এ ছাড়া, তিনি বহু গণসংগীত রচনা করেছিলেন, যা বিশেষ কোনো ঘটনা উপলক্ষে নয়। বরং সামাজিক ও রাজনৈতিক নিপীড়নের প্রতিবাদ। যেমন,
বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা
আজ জেগেছে এই জনতা, এই জনতা।।
তোমার গুলির, তোমার ফাঁসির,
তোমার কারাগারের পেষণ শুধবে তারা

এ গানটির রচনা-কাল ১৯৪৭ সাল। অথবা নীচের গানটি:
আমার প্রতিবাদের ভাষা
আমার প্রতিরোধের আগুন
দ্বিগুণ জ্বলে যেন
দ্বিগুন দারুণ প্রতিশোধে
করে চূর্ণ ছিন্ন-ভিন্ন
শত ষড়যন্ত্রের জাল যেন

দেবব্রত বিশ্বাসের কণ্ঠে এ গানটি আজও অমর হয়ে আছে। এ রকমের আরও গান 'পথে এবার নামো সাথী, পথেই হবে পথ চেনা', 'ও আলোর পথযাত্রী' ইত্যাদি। নিপীড়িতদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন সলিল:
সেদিন রাত্রে সারা কাকদ্বীপে হরতাল হয়েছিল
তাই
গ্রাম নগর মাঠ পাথার বন্দরে তৈরী হও
কার ঘরে জ্বলেনি দীপ চির আঁধার তৈরী হও
কার বাছার জোটেনি দুধ শুকনো মুখ তৈরী হও
ঘরে ঘরে ডাক পাঠাই তৈরী হও জোটবাঁধো
মাঠে কিষান কলে মজুর নওজোয়ান জোট বাঁধো…

তবে তাঁর গণসংগীতগুলোর দুর্বলতার একটা দিক হলো, এ গানগুলো বেশির ভাগই কোরাস। এমন কি, তা হারমোনাইজ করা নয়। ফলে সুরে তেমন বৈচিত্র্য দেখা দেয়নি।


সলিল চৌধুরীর জীবনটাকে তাঁর গান দিয়ে বিচার করলে তিন ভাগে বিভক্ত করা যায়। প্রথম ভাগে আছেন কমিউনিস্ট সলিল চৌধুরী—এ পর্যন্ত যেসব গানের কথা বলা হয়েছে, তাদের রচয়িতা যিনি। এসব গানে তিনি সরাসরি শ্রমজীবী মানুষদের প্রতিবাদ ও বিদ্রোহ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
দ্বিতীয় ভাগের সূচনা মোটামুটি ১৯৪৯ সাল থেকে। এই পর্বের প্রথম গান 'কোনো এক গাঁয়ের বধূর / কথা তোমায় শোনাই শোনো / রূপকথা নয় সে নয়।' ঘুঘু-ডাকা ছায়ায় ঢাকা এক গ্রামের নামহীন এক বধূর জীবনের করুণ কাহিনী এই গান। এ তার সুখের নীড় ভেঙে যাওয়ার শোক-গাথা। এই পর্বে আমরা দেখতে পাই আর-এক সলিলকে, দরদী সলিলকে, বৈশিষ্ট্যপূর্ণ রোম্যান্টিক গান রচনা করেন যিনি, তাতে কাস্তেটাকে শাণ দেওয়ার কথা বলা হয়নি, বরং এসব গানে আছে চিরন্তন কাব্যের স্বাদ। এসব গান শ্রমজীবী মানুষদের উদ্দেশে লেখা নয়। এতে আছে তাদের সংগ্রামী জীবনের করুণ চিত্র। উদ্দেশ্য এর মাধ্যমে গণমানুষের প্রতি মধ্যবিত্তদের সহানুভূতি জাগিয়ে তোলা।
'গাঁয়ের বধূ' গানটিতে সুর নিয়ে সলিলের যে-পরীক্ষানিরীক্ষা, তা অভিনব এবং বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। ইতিপূর্বে রবীন্দ্রনাথ তাঁর কয়েকটি গানে (যেমন ঐ আসে ঐ অতি ভৈরব রভসে, হে নিরুপমা গানে যদি লাগে বিহ্বল তান, নৃত্যের তালে তালে হে নটরাজ) তাল এবং লয় পরিবর্তন করে যে-সফল পরীক্ষা করেছিলেন, সলিলের এ গান সেই শ্রেণীতে পড়ে। পার্থক্য এই যে, এ গানে সলিল অনেক বেশি সাহস দেখিয়েছেন। সুরকার সলিল এ গানে কেবল তাল অথবা লয় বদল করেননি, বরং কয়েক জায়গায় সপ্তকের স্কেল পরিবর্তন করেছেন। বাংলা গানে এমন দুঃসাহস তাঁর আগে অন্য কেউ দেখাননি। অবশ্য স্বীকার করতে হবে যে, এই পরীক্ষায় তিনি তাঁর সহযোদ্ধা হিসেবে পেয়েছিলেন স্বর্ণকণ্ঠ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে। হেমন্ত নিজেও এ বিষয়ে সচেতন ছিলেন। তিনি বলেছেন যে, তাঁর কণ্ঠকে এমন বিচিত্রভাবে সলিল ছাড়া অন্য কেউ ব্যবহার করেননি।
এই দুজনের মিলিত সৃষ্টি 'রানার' এবং 'পাল্কীর গান'। এ গান দুটি অবশ্য সলিল চৌধুরীর লেখা নয়। এতে তিনি কেবল সুর দিয়েছেন। 'রানার ছুটেছে তাই ঝুম ঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে' কবিতাটি লিখেছিলেন সুকান্ত ভট্টাচার্য। এই কবিতার নায়ক দরিদ্র এক রানার প্রতি রাতে চিঠিপত্র এবং টাকার বোঝা নিয়ে যথাস্থানে পৌঁছে দেয়। কিন্তু তার পিঠে টাকার বোঝা থাকলেও, ট্র্যাজেডি এখানটায় যে, সে টাকা তো যাবে না ছোঁয়া। পাল্কীর গানও সলিল চৌধুরীর রচনা নয়। এটি লিখেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। এ কবিতায় পাল্কীবাহকদের গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছোটার ঘাম-ঝরানোর কাহিনী লিখেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। দুই কবিতাই ছিলো দরদী সলিলের জন্যে আদর্শ কবিতা। কিন্তু এই দুই কবিতায় সুর দিয়ে সলিল এদের প্রাসাদের মতো, সিম্ফনির মতো স্তরে স্তরে গড়ে তুলেছিলেন। সুকান্তের আর-একটি কবিতা 'অবাক পৃথিবী অবাক করলে তুমি /জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি'কেও নতুন জীবন দিয়েছিলেন সলিল চৌধুরী।

বস্তুত, সলিল আর হেমন্ত—এ দুজন মিলে অতঃপর একটার পর একটা সাফল্যের নিশান উড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেছেন। এই শ্রেণীর আর-একটা গান হলো: 'ধিতাং ধিতাং বোলে / কে মাদলে তান তোলে / কার আনন্দ উচ্ছলায় আকাশ ভরে জোছনায়।' এ গানে সলিল সবাইকে দ্রুত এসে হাসির কলরবে নতুন জীবন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। তবে তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, 'এ দেশ তোমার আমার / আমরা ভরি খামার / আমরা গড়ি স্বপন দিয়ে সোনার কামনায়।' সেই সঙ্গে তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন যে, মেঘের আড়ালে চাঁদের আলো হারিয়ে যাবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, বর্গীরা হামলা করতে ছুটে আসছে এবং শুভ সময় চলে যাচ্ছে। কাজেই তিনি দ্রুত জনতাকে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। এই গানটিকে আপাতদৃষ্টিতে গণসংগীত বলে মনে হয় না। এতে কাস্তেটাকে শাণ দেবার মতো সরাসরি কিছু বলা হয়নি। কিন্তু এ দেশ আমাদের এবং আমরা এ দেশের ফসল উৎপাদন করি, খামার ভরি—এই গুরুত্বপূর্ণ বার্তাটা তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন।

সলিল চৌধুরীর জীবনের তৃতীয় পর্বে ছিলো প্রধানত ফিল্মী গান। তিনি বাংলা, হিন্দী, মালয়ালম ইত্যাদি ভাষার শতাধিক চলচ্চিত্রের জন্যে গান লিখেছেন। সিনেমার গান, তাই বেশির ভাগ গানই প্রেমের। কিন্তু বেশির ভাগ গীতিকারের মতো সলিল চৌধুরী তুমি, আমি, ভালোবাসা, বিরহ, জোছনা, ফুল, মনে রেখো ইত্যাদি শব্দ দিয়ে প্রেমের গান বাঁধেননি। তাঁর প্রেমে আনন্দ, বেদনা, সংশয়, হতাশা—সবই আছে, কিন্তু সবচেয়ে বেশি আছে প্রেমের ধারা শুকিয়ে যাবার কথা। তবে এ ক্ষেত্রেও সেই শুকিয়ে যাবার কথাটা তিনি বলতে চান রেখে-ঢেকে, আভাসে-ইঙ্গিতে। নিজের জীবনের শূন্যতা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন:
কখন জানি না সে
তুমি আমার জীবনে এসে
যেন সঘন শ্রাবণে প্লাবনে দুকূলে ভেসে
শুধু হেসে ভালবেসে
যত যতনে সাজানো স্বপ্ন
হল সকলে নিমেষে ভগ্ন

কিন্তু তিনি আশা হারিয়ে ফেলেননি। বরং ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছেন:
ওগো ঝরাপাতা
যদি আবার কখনো ডাকো
সেই শ্যামল হারানো স্বপন মনেতে রাখো
যদি ডাকো, যদি ডাকো
আমি আবার কাঁদবো হাসবো
এই জীবন জোয়ারে ভাসবো

কিন্তু কখনো কখনো তিনি বিভ্রান্ত, দিশাহারা। তিনি বুঝতে পারেন না, তাঁর কোন পথে যাওয়া উচিত। বোঝার আগেই তিনি আবিষ্কার করেন যে, তিনি তাঁর সঙ্গীকে হারিয়ে ফেলে একাকী হয়ে গেছেন, তাঁর ভাষায় 'আমি তুমিহারা':
আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা
আর কত কাল আমি রব দিশাহারা
রব দিশাহারা।
জবাব কিছুই তার দিতে পারি নাই শুধু
পথ খুঁজে কেটে গেল এ জীবন সারা,
এ জীবন সারা।…
নিজের ছায়ার পিছে ঘুরে ঘুরে মরি মিছে
একদিন চেয়ে দেখি আমি তুমিহারা।
আমি তুমিহারা। …
আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা।
গতিহীন ধারা।

সলিল ছিলেন সত্যিকার সংগীতকার। আগেই আমরা লক্ষ করেছি যে, তিনি পাশ্চাত্য এবং দেশীয় সংগীতের আবহাওয়ায় বড়ো হয়েছিলেন—দু-ই তাঁর আপন। তাই বাংলা গানের জগতে কেউই তাঁর মতো এমন দেশীয় এবং পাশ্চাত্য সুরের সমন্বয় ঘটানোর পরীক্ষানিরীক্ষা করেননি। তবে দেশীয় সুরকে পাশ্চাত্য রীতিতে হারমোনাইজ করার অনেক সমস্যা। তার ওপর আছে শ্রোতাদের হারমোনাইজেশনের প্রতি অনভ্যস্ত কান। সে সমস্যা কাটিয়ে ওঠা কঠিন ব্যাপার—প্রায় অসম্ভব। সে জন্যে তিনি গানের সুরে কেবল কোরাসের জায়গায় হারমোনাইজ করতেন। কিন্তু তা শ্রোতাদের কতোটা ভালো লাগতো, তা বলা মুশকিল।


তাঁর আর-একটা পরীক্ষানিরীক্ষার ক্ষেত্র ছিলো প্রিলিউড এবং ইন্টারলিউড—গান শুরুর আগে এবং গানের ফাঁকে ফাঁকে যে-বাজনা থাকে, তা নিয়ে। এই বাজনার জন্যে তিনি অনেক রকমের যন্ত্র ব্যবহার করতেন। বেশির ভাগই পাশ্চাত্যের বাদ্যযন্ত্র। সেই যন্ত্রগুলোতে যে-সমবেত সংগীত তিনি বাজাতেন, গানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হলেও, তা একেবারে ভিন্ন কম্পোজিশন। বাঙালি সুরকারদের কাছে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু তিনি একে খুব গুরুত্ব দিতেন। তা ছাড়া, তাঁর বহু গানই একাধিক ভাষায় অনুবাদ করতেন। গান এক হলেও সেসব গানের প্রিলিউড এবং ইন্টারলিউড এক হতো না। কারণ, তিনি জানতেন যে, এসব ভাষার শ্রোতাদের রুচি এক রকমের নয়। তাঁর ইন্টারলিউড এবং প্রিলিউড সম্পর্কে আরও একটা কথা বলা উচিত। এই বাজনা অত্যন্ত উচ্চস্বরবিশিষ্ট।
সলিল চৌধুরীর আর-একটি পরিচয় এই যে, তিনি কবি। যাঁরা গান রচনা করেন, তাঁদের অনেক সময় কবি হিসেবে গণ্য করা হয় না। সেদিক দিয়ে বিচার করলে, সলিল চৌধুরীর কবি-পরিচয় হারিয়ে যেতে পারে। কিন্তু তা করা হলে তাঁর প্রতি অবিচার করা হবে। তাঁর কবিতার ভাষা আপাতদৃষ্টিতে সরল, সহজ ও নিজস্ব বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। ছোটো ছোটো ছবিতে ভরা। একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। কবি বলছেন যে, কাছেই, বকুল-বনের ধারে, বাঁধানো ঘাটের পাড়ে, যেখানে কিছু ফুল অবহেলায় শুকিয়ে পড়েছিলো, সেখানে তাঁর মাতাল হৃদয় হারিয়ে গিয়েছে। দুটি শুকশারি সেখানে গাইতো, আর পাশ দিয়েই নদীটা বয়ে যেতো। সেখানে একটি
বনহরিণী ত্বরিত চকিত
চরণে চমক লাগায়ে দিয়ে
তার চেয়ে ভাল চোখ দুটি দেখে
যেখানে যেত সে দাঁড়িয়ে
সেখানে আমার করুণ হৃদয়
সেদিন গিয়েছে হারিয়ে

কবি বলছেন, সেই সুন্দর জায়গাটিতে
মোর মানসী কলসি কাকেঁতে লইয়া
ওখানে দাঁড়াতো এসে, মুখে মধুর মধুর হেসে।
তার তনুর তীরথে ডুবিয়া
মরিতে নদীও উতলা হতো
তার ঢেউয়ে ঢেউয়ে আরো দুটি
ঢেউ যেখানে দিত সে বাড়িয়ে
সেখানে আমার উতল হৃদয়
সেদিন গিয়েছে হারিয়ে

অথবা আর-একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক, যেখানে তিনি গভীর একটি ভাব প্রকাশ করেন অত্যন্ত সরল ভাষায়:
এবার আমি আমার থেকে আমাকে বাদ দিয়ে
অনেক কিছু জীবনে যোগ দিলাম
ছোটো যতো আপন ছিলো
বাহির করে দিয়ে
ভুবনটারে আপন করে নিলাম
সবার হরষে হাসি বেদনে কাঁদি
বাধান প্রিয়রে মুক্তির জলে বাঁধি
সবই হারায়ে আবার সবই কিছু যে পেলাম

সলিল চৌধুরী শত শত সার্থক গান রচনা করেছেন। তাই বলে তিনি কেবল গীতিকার নন। তিনি একাধারে গীতিকার, কবি, গায়ক, বাদক, সুরকার, সংগীত পরিচালক। তিনি বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগের সবচেয়ে বড়ো সংগীতকার।