হাবীবুল্লাহ সিরাজী, একটি কবিতা ও মৃত্যুচিন্তা

আবদুস সেলিমআবদুস সেলিম
Published : 26 May 2021, 05:02 PM
Updated : 26 May 2021, 05:02 PM


একথা অনস্বীকার্য মানুষ, যেকোনো মানুষ, কোনো না কোনো সময়ে মৃত্যুর কথা বলে বা ভাবে। কারণ মৃত্যু এমন একটি অনিবার্য যৌক্তিক এবং অভিজ্ঞতালব্ধ সত্য যা থেকে কোনো প্রাণী কোনো প্রকারেই পরিত্রাণ পায়নি, পাবেও না, এবং মানুষ যেহেতু এক চিন্তাশীল কল্পনাপ্রবণ প্রাণী, যে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ ঘটনা প্রবাহকে নিজ জ্ঞানের অন্তর্গত করতে সক্ষম, তার নিজের মৃত্যুর কথা একসময় না একসময় ভাবেই।
সম্ভবত এমনি এক ভাবনা এবং কল্পনা থেকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, 'মরণরে,/তুঁহু মম শ্যামসমান!/মেঘবরণ তুঝ, মেঘজটাজুট,/রক্ত কমল কর, রক্ত অধর-পুট,/তাপ-বিমোচন করুণ কোর তব,/মৃত্যু-অমৃত করে দান!/তুঁহু মম শ্যামসমান।' জীবনানন্দ লিখেছিলেন তার কবিতায়: 'আমরা মৃত্যুর আগে কি বুঝিতে চাই আর? জানি নাকি আহা,/সব রাঙ্গা কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মতো এসে জাগে/ধূসর মৃত্যুর মুখ;- একদিন পৃথিবীতে স্বপ্ন ছিলো-সোনা ছিলো যাহা/নিরুত্তর শান্তি পায়;-যেন কোন মায়াবীর প্রয়োজনে লাগে।/কি বুঝিতে চাই আর? … রৌদ্র নিভে গেলে পাখি-পাখালির ডাক/শুনিনি কি? প্রান্তরের কুয়াশায় দেখেনি কি উড়ে গেছে কাক!' স্পষ্টতই দুই কবি মৃত্যুকে অবলোকন করেছেন, উপলব্ধি করেছেন দুভাবে, একজন মৃত্যুকে বন্ধনমুক্তি এবং মোক্ষ হিসেবে দেখেছেন আর অপরজন মৃত্যুকে বর্ণনা করেছেন কল্পনার স্মৃতিময় আশ্রয়ী রূপে। মানতেই হবে বাংলার এই দুই মহান কবি তাদের চিন্তা-চেতনা, উপমা-উৎপেক্ষায় একাঙ্গিকের ছিলেন না এবং এই ভিন্নতা সত্ত্বেও তারা দুজনই মৃত্যুচিন্তায় নিমগ্ন হয়েছেন, কবিতা লিখেছেন। তাদের এই ভিন্নতা কালের কারণে, জীবনের পরিবর্তনের কারণে, জীবনের উপলব্ধির বৈচিত্রের কারণে—একজন জন্মেছিলেন উনবিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে আর অন্যজন ঐ শতাব্দীর শেষ বছরে—প্রায় চার দশকের ব্যাবধানে।
সম্ভবত কবিরা জীবনের অনিবার্যতায় যতটা সংবেদনশীল হয় অন্যরা ততটা হয় না, যদিও মৃত্যুচিন্তা সবাইকেই প্রভাবিত করে, আক্রান্ত করে। হাবীবুল্লাহ সিরাজী মারা গেছেন গত চব্বিশ তারিখ রাতে। তিনি কবি ছিলেন, বাংলাদেশের একজন প্রথমসারির অকৃত্রিম কবি—যার স্বীকৃতি শুধু তার একাধিক পুরস্কার প্রাপ্তিতে মেলে না, মেলে তার কবিতা রচনার শৈলীতে, মেলে তার অগণিত বাংলাভাষী পাঠকগোষ্ঠীর ভালোলাগা এবং ভালবাসাতে। সিরাজীও একসময় ওই অনিবার্য মৃত্যুচিন্তাতে অবসিত হয়ছিলেন—অল্প বয়সেই—মাত্র পঁচিশ বছরের তারুণ্যে। কবি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ এবং জীবনানন্দের উত্তরসূরি, সিরাজী তার মৃত্যুচিন্তা-কাব্য লিখেছেন রবীন্দ্রনাথের জন্মের সাতাশি বছর এবং জীবনানন্দের জন্মের উনপঞ্চাশ বছর পর। কবিতার শিরনাম 'কেবল যাবার থাকে'।

হাবীবুল্লাহ সিরাজীর সাথে আমাদের পরিচয়—আমার এবং আব্দুল মানান সৈয়দের—গত শতাব্দীর সত্তুরের প্রারম্ভে। তখন সিরাজী কর্মরত ছিলেন কৃষি দফতরে। প্রকৌশলী কবির প্রতি আমার ব্যক্তিগত বেশ আকর্ষণ ছিল এবং তখন তার অফিস ছিল আমার বাসস্থান মালিবাগ চৌধুরিপাড়ার কাছে তদানীন্তন কালে নির্মিত একটি সুদর্শন বাড়িতে। মান্নানই আমাকে তার অফিসে নিয়ে গিয়েছিল এবং পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। সিরাজী অমায়িক সম্ভাষণে আমাদের আপ্যায়ন করেছিলেন। আমরা তাকে অনুরোধ করেছিলাম আমাদের আসন্ন প্রকাশিতব্য পত্রিকা শিল্পকলা-র ক্রোড়পত্র কবিতাগুচ্ছ-তে তার একটি কবিতা দিতে। সিরাজী পান চিবাতে চিবাতে সানন্দে তাৎক্ষনিক রাজি হয়েছিলেন, এবং আজ বিস্ময়ে আবিষ্কার করছি সে কবিতা প্রচ্ছন্নভাবে তার মৃত্যুচিন্তারই অসংশয় প্রতিচ্ছবি, যে-মৃত্যুচিন্তা অনিবার্যভাবে রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ থেকে ভিন্নতর, কারণ কালের ব্যাবধানে, আমি যেমন বলেছি, উপলব্ধি এবং প্রকাশভঙ্গীতে অনেক পার্থক্য ঘটে যায়, তেমনটাই ঘটেছে, যদিও মৃত্যুর অনিবার্যতা এই তিন কবিকেই সমভাবে স্পর্শ করেছে। ১৯৭৩ সালে মান্নান সৈয়দ এবং আমার যৌথ-সম্পাদনা শিল্পকলা পত্রিকার অষ্টম সঙ্কলনে প্রকাশিত হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতাটি আজ তার প্রয়াণ-ক্ষণে পাঠ করা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হবে বলে আমি অনুমান করি। উল্লেখ্য আমি এ কবিতাটি আমার প্রথম ইংরেজি কবিতা অনুবাদগ্রন্থ Selected Poems from Bangladesh-এ ভাষান্তর করে ছেপেছিলাম (প্রকাশকাল ১৯৭৫)।
কেবল যাবার থাকে
হাবীবুল্লাহ সিরাজী

কণ্ঠলগ্ন সাপ তুমি বেড়ে উঠো ধীরে
বয়স বাড়ার মতো,
লতায় পাতায় ঢাকো গেরুয়া জমিন জোড়া বৃক্ষের আকার—
ঢাকো দিন, রাত-দিন একাকার করে দাও আঁধারে আলো,
হাতে হাতে জল দাও পত্র-পুষ্প শিরে,
জন্ম থেকে তুলে নাও
পরিপুষ্ট তিথিজোড়া
রক্তভুমি বীজ। শেকড়েই গড়ো ঘর
সাপ তুমি,–সোনালি ফনায় আছো আদি জাগরণে
ক্রমান্বয়ে হেলেদুলে উর্ধ্বগামী শাখা
সূর্যের গমনে ঝুলো পুবে ও পশ্চিমে …
সবুজ দেহের সাথে ঝুলে আছো
আরেকটা পিপাসার ঘোরে
বোঝো না সময়ভার তড়িঘড়ি দুর্দন্ড প্রহর—
আকণ্ঠ পান করো টলমল নবীন নহবত,
দূর থেকে ডাক দাও, তুলে নাও সমুদ্রের স্বর
গভীর প্রদেশে যাও, ব্যাপে থাকো তৃণভূমি;
দূরে থাকে রাজ্যপাট, সিংহাসন রাজার মুকুট
রাজদণ্ড অবিচল,
খা খা করে পাত্রমিত্র অমাত্য চেআর—
ভুলে যাও সবকিছু, নদী ও যৌবন;
কেবল যাবার থাকে, সাথে যায়
জন্ম থেকে বয়ে নেয়া নিম্নগামী ছায়া!

সিরাজী আপনি সঠিক উপলব্ধি করেছিলেন মৃত্যু 'কণ্ঠলগ্ন সাপ তুমি বেড়ে উঠো ধীরে/বয়স বাড়ার মতো,/লতায় পাতায় ঢাকো গেরুয়া জমিন জোড়া বৃক্ষের আকার—' ; . . . শেকড়েই গড়ো ঘর/সাপ তুমি,–সোনালি ফনায় আছো আদি জাগরণে/ক্রমান্বয়ে হেলেদুলে উর্ধ্বগামী শাখা' এবং 'কেবল যাবার থাকে, সাথে যায়/জন্ম থেকে বয়ে নেয়া নিম্নগামী ছায়া!'