তৃতীয় সত্তার সন্ধানে

সন্দীপন চক্রবর্তী
Published : 9 May 2021, 06:30 AM
Updated : 9 May 2021, 06:30 AM


১.
'আমি যদি না-ও থাকি তবুও আমিই পড়ে থাকে' – শঙ্খ ঘোষের লেখা এই লাইনটির সামনে আমি স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি খানিক। সত্যিই তো, যে কোনো প্রকৃত সৃষ্টিশীল মানুষের ক্ষেত্রেই তো মৃত্যুর পরেই শুরু হয় এক 'দ্বিতীয় জীবন'। হয়তো সেটাই তাঁর অনশ্বর পরিচয়। তিনি না থাকলেও তো আসলে তিনিই রয়ে যান! সেদিক থেকে ভাবলে, সাহিত্যিক শঙ্খ ঘোষের কাজ নিয়ে, তাঁর দার্শনিক প্রস্থানভূমি আর যাত্রাপথের দিকনির্দেশ নিয়ে, আবার নতুন করে বিচার ও বিশ্লেষণ এখন খুবই জরুরি। কিন্তু প্রায় সাতাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে, খুব কাছ থেকে এই মানুষটিকে দেখতে পাওয়ায়, মনে হয়েছে আরও অন্য কিছু কথা। সাহিত্যিক হিসেবে তিনি বিরাট মাপের হলেও, বাংলা সাহিত্যে তাঁর মাপের সাহিত্যিক হয়তো তাঁর আগেও কয়েকজন এসেছেন, হয়তো পরেও কয়েকজন আসবেন। কিন্তু তাঁর মাপের কোনো মানুষ আর আসবেন কি? জানি না। আমরা সত্যিই কি কিছু শিখতে পেরেছি তাঁর জীবনচর্যার থেকে? শিখতে চেয়েছি কি আদৌ?
একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। ষাটের দশকের এক খ্যাতিমান কবি এই শতকে মাঝেমধ্যেই আসতেন শঙ্খ ঘোষের বাড়ি। এবং তাঁকে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গেই আপ্যায়িত করতেন শঙ্খ ঘোষ। এরকমই এক রবিবার সকালের আড্ডায় শঙ্খ ঘোষের বাড়িতে এসেছেন তিনি,- সঙ্গে আরেক ব্যক্তি। এবং খানিক অপ্রাসঙ্গিকভাবেই দীর্ঘ ভাষণ দিয়ে যাচ্ছেন তিনি – আজকাল এই হয়েছে এক কবিতার বইয়ের উদ্বোধন। অনেককেই দেখছি করতে। এসব একেবারেই ফালতু ব্যাপার। কবিতার বইয়ের আবার উদ্বোধন কী? আমি তো বুঝি না। কবিতার বইয়ের এভাবে কোনো উদ্বোধন করা কি আদৌ সঙ্গত…ইত্যাদি ইত্যাদি। এসবের মিনিট তিরিশ পরে, তিনিই বলে ওঠেন – 'শঙ্খদা, আমার একটা নতুন বই বেরিয়েছে। কবিতার বই।' তারপর নিজের কাঁধের ঝোলাতে ঢুকে যায় তাঁর হাত, আর বেরিয়ে আসে সুদৃশ্য র‍্যাপিং পেপারে মোড়া একটি প্যাকেট। আর তারপরেই, 'আপনি, এটার মোড়ক খুলে, একটু উদ্বোধন করে দিন। আসলে, এটা হলো, উদ্বোধনের বিরুদ্ধে উদ্বোধন।' তারপর নিজের সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে 'এই, ছবিটা তোলো ঠিক করে।' পটাপট ছবি তুলতে থাকেন সেই সঙ্গী। আর সামান্য হেসে, সেই মোড়ক উন্মোচন করেন শঙ্খ ঘোষ।
ঘটনাক্রমে, আমি জানতাম যে, ১৯৭৭-এ শঙ্খ ঘোষের 'বাবরের প্রার্থনা' কাব্যগ্রন্থটি সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পাওয়ার পর, ষাটের দশকের ওই কবি লিখিতভাবেই এক পত্রিকায় জানান যে, শঙ্খ ঘোষের মতো এইরকম তৃতীয় শ্রেণীর একজন কবি কী করে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পান! এমনকি আমরা শঙ্খ ঘোষের অধিকাংশ কবিতার বইতেই যে দেখি কবিতাগুলি দৃশ্যত তিনটি পর্বে বিন্যস্ত করা আছে, সে নিয়েও ষাটের দশকের ওই কবি লিখেছিলেন – শঙ্খ ঘোষ এরকম তিনটি পর্বে কাব্যগ্রন্থ সাজানোর কায়দাটিও নাকি আসলে চুরি করেছেন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তর থেকে। মজার কথা হলো যে, শঙ্খ ঘোষের কাব্যগ্রন্থে এই তিন পর্বে কবিতা সাজানো শুরু হয়েছে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'দিনগুলি রাতগুলি' থেকেই, যার প্রকাশকাল ১৯৫৬। এবং তারপর থেকে তাঁর অধিকাংশ কাব্যগ্রন্থেই এই বিন্যাসভঙ্গী দেখা যায়। আর অলোকরঞ্জন তাঁর কাব্যগ্রন্থকে এভাবে প্রথম তিনটি পর্বে বিন্যস্ত করেন 'রক্তাক্ত ঝরোখা'-য়, যার প্রকাশকাল ১৯৬৯।
ফলে, চার-পাঁচ দিন পরে, একবার একান্তে শঙ্খ ঘোষকে পেয়ে, জিজ্ঞাসা করি যে, আপনি কী করে পারেন ওই মানুষটিকে এত যত্ন করে আপ্যায়ন করতে? রাগ হয় না? আপনি কি ভুলে গেছেন যে আপনি সাহিত্য আকাদেমি পাওয়ার পর এই মানুষটি কী লিখেছিলেন আপনার সম্পর্কে? তার পরেও কী করে পারেন? কয়েক সেকেণ্ড চুপ। তারপর ধীর, অথচ স্থির কন্ঠে উত্তর আসে – 'না, ভুলিনি। এখনও ওই লেখার প্রতিটি শব্দ মনে আছে। রাগ হয়নি, তবে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। ওই তিন পর্বে বই ভাগ করা নিয়ে যা লিখেছিল, তাতে বুঝেছিলাম যে, আমার কবিতা তো পড়েইনি, এমনকি অলোকের কবিতাও পড়েনি। অবাক হয়েছিলাম যে, না পড়েও এতটা লেখা যায়! তবে, আমার বিরুদ্ধে লিখেছে বলেই তো আর, ও নিজে যা লিখেছে তার মহিমা নষ্ট হয়ে যায় না। ফলে সেই সম্মানটা কিন্তু ওর প্রাপ্য। সেটা ওকে না দিলে অন্যায় হবে।' এই উত্তরের সামনে স্তব্ধ হয়ে যাই আমি। মনের কতটা উদারতা থাকলে, একজন মানুষ ভাবতে পারেন এইভাবে? আমি নিজেকে দিয়ে ভাবার চেষ্টা করি। আমার সঙ্গে কেউ এরকম করলে, আমি কি এভাবে ভাবতে পারতাম? আমরা সত্যিই কি কিছু শিখতে পেরেছি তাঁর জীবনচর্যার থেকে? শিখতে চেয়েছি কি আদৌ? সেই ১৯৬৬ সালেই কিন্তু কবিতা নিয়ে কথা বলতে বলতে, এই মানুষটি লিখে যেতে পেরেছিলেন – 'মজ্জার ভিতরে গর্ব কই, উপেক্ষা কই? মুখ ঘুরিয়ে উদাসীন স'রে-দাঁড়ানো কই? এখন আমরা দাম্ভিক কিন্তু গর্বিত নই, নির্জীব কিন্তু উদাসীন নই, লুব্ধ কিন্তু লিপ্ত নই।' আমরা কি তার থেকে পাল্টেছি একটুও, এই লেখার অর্ধশতক পরেও?

২.
কিন্তু একটা প্রশ্ন তবু থেকেই যায়। সামান্য দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া, এই যে গোড়া থেকেই শঙ্খ ঘোষ তাঁর কবিতার বইগুলিকে বিন্যস্ত করতেন তিনটি পর্বে, এমনকি তাঁর শেষ কবিতার বইতেও, তার কারণ কী? কোন ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে এই বিন্যাসের ধরণ? লেখালিখির শুরুর দিনগুলোর কথা বলতে গিয়ে, শঙ্খ ঘোষ ১৯৭২ সালে লেখা তাঁর 'পা তোলা পা ফেলা' লেখায় জানাচ্ছেন – 'আমাদের চেয়ে বড়ো যাঁরা, তাঁদের দিকে তাকিয়ে মনে হলো কোথায় যেন এক নিয়মবৃত্ত আছে, যেন না-লেখা এক কানুন মেনে চলেন অনেকে, কবিতা যেন ভাগ হয়ে আছে মুখ-না-দেখা দুই ভিন্ন শিবিরে। কী নিয়ে লেখা হবে কবিতা? আমার বাইরের পৃথিবী নিয়ে? না কি আমারই ব্যক্তিগত জগৎ নিয়ে? এই ছিল তর্ক, দেশবিদেশের বহুকালের পুরোনো তর্ক। কিন্তু এই দুই কি ভিন্ন নাকি? এই দুইয়ের মধ্যে নিরন্তর যাওয়াআসা করেই কি বেঁচে নেই মানুষ? তার থেকেই কি প্রতিমুহূর্তে তৈরি হয়ে উঠছে না একটা তৃতীয় সত্তা? তাকে সব কথাই বলতে হয় তাই।'
ধরা যাক, 'আমার বাইরের পৃথিবী নিয়ে' যে লেখা, তাকে বললাম 'বাইরের দিকে মুখ-ঘোরানো লেখা', আর 'আমারই ব্যক্তিগত জগৎ নিয়ে' যে লেখা, তাকে বললাম 'ভিতরের দিকে মুখ-ঘোরানো লেখা'। এবার খেয়াল করলে দেখবো যে, গোড়া থেকেই শঙ্খ ঘোষের কবিতাবইয়ের বিন্যাসে যে তিনটি বিভাগ থাকে, তার একটি বিভাগে থাকে এই 'বাইরের দিকে মুখ-ঘোরানো লেখা' আর আরেকটি বিভাগে থাকে ওই 'ভিতরের দিকে মুখ-ঘোরানো লেখা'। আর দীর্ঘকেশী মেয়েরা যেমন, অনেকসময়েই তাদের চুলের দুটি গুছি বানিয়ে, তা দিয়ে বিনুনি রচনা করে, ঠিক সেইভাবেই, এই দুই বিপরীত ধরণের মেজাজের পারস্পরিক আনাগোনা থাকে যেসব লেখায়, সেই ধরণের লেখাগুলি নিয়ে তৈরি হয়ে ওঠে একটি তৃতীয় বিভাগ। এবার বিভিন্ন বইতে এই তিনটি বিভাগ আবার বিভিন্ন ক্রমে সাজানো হয়। কিন্তু ওই যে প্রাথমিক বিশ্বাস – 'এই দুই কি ভিন্ন নাকি? এই দুইয়ের মধ্যে নিরন্তর যাওয়াআসা করেই কি বেঁচে নেই মানুষ? তার থেকেই কি প্রতিমুহূর্তে তৈরি হয়ে উঠছে না একটা তৃতীয় সত্তা?', তারই ভিত্তিতে, 'সব কথাই' ধরে রাখার এক সামগ্রিকতা গড়ে তোলার জন্য, একেবারে শুরুর থেকেই, তাঁর কবিতার বইগুলিতে দেখা দেয় এই বিন্যাসগত গড়ন।
কবিতা পড়ার ধরণ নিয়ে বলতে গিয়ে, 'নিঃশব্দের তর্জনী'-র ভূমিকায় শঙ্খ ঘোষ জানিয়েছিলেন – 'কবিতা পড়বার সময়ে আমরা লক্ষ করতে চাই তার রূপটুকু, সেই রূপের মধ্যে জেগে-ওঠা কবির ব্যক্তিত্বটুকু।' এই যে 'কবির ব্যক্তিত্ব', আর বাস্তবজীবনে যাপন করা মানুষটির ব্যক্তিত্ব – এ দুয়ের মধ্যে কোথাও যেন একটা আশ্চর্য সাধারণ ভূমি ছিল তাঁর ক্ষেত্রে। ফলে তাঁর জীবনবোধ, তাঁর দৈনন্দিন যাপনের ধারা দিয়েও, যেন ছোঁয়া যেত তাঁর কবিতাকে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই 'যে লেখে, সে আমি নয়'-এর ধরণ তাঁর নয়, বরং তাঁর ক্ষেত্রে – যে লেখে, সে-ও তো আমিই। দুটি খুব ছোট ছোট অভিজ্ঞতার কথা বললে হয়তো খানিক স্পষ্ট হবে আমার এই কথা।
প্রায় বছর চার-পাঁচ আগে, গুরুত্বপূর্ণ এক সামাজিক সংকটের সময়ে, আমরা বের করেছিলাম এক প্রতিবাদী মিছিল। তিনি সমর্থন জানিয়েছিলেন আমাদের প্রতিবাদে। তখন তাঁর কাছে প্রশ্ন তুলেছিলাম যে, এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে, আপনি নিজে মিছিলটার ডাক দিলেন না কেন? আপনি ডাকলে তো এটা আরও অনেক বেশি গুরুত্ব পেত। তখন, খানিক থেমে, উত্তর দিয়েছিলেন – 'একই অস্ত্র বারবার প্রয়োগ করলে, তার ধার নষ্ট হয়ে যায়। তার আর গুরুত্ব থাকে না।' তাৎক্ষণিকভাবে খুব যে মেনে নিতে পেরেছিলাম এই যুক্তি, এমন নয়। বুঝে উঠতে সময় লেগেছিল আরও বছর দুয়েক। বুঝতে পেরেছিলাম, এ কোনো তাৎক্ষণিক বিচ্ছিন্ন সিদ্ধান্ত ছিল না। এর পিছনে কাজ করছিল তাঁর সারা জীবন ধরে চর্চা করে চলা খুবই সুচিন্তিত এক নির্বাচনের বোধ ও বিবেচনা। এবং একদম নিখুঁত ছিল তাঁর সেই সিদ্ধান্ত।
তারপর কেটে গেছে অনেকদিন। মাস দেড়েক আগে একদিন, ডেকে পাঠালেন আমায়। আমার লেখা কিছু কবিতা নিয়ে নাকি কিছু কথা বলার আছে ওঁর। গেলাম। কথা চলছে। আমার লেখা দুটি কবিতায় আমি একটি শব্দ ব্যবহার করেছিলাম – 'তাড়াহুড়োলতা'। আমায় জিজ্ঞাসা করলেন যে, এই শব্দটি কি আমি আগে কারও লেখায় পেয়েছি? আমি জানাই যে – 'না, থাকতে পারে হয়তো কারও লেখায়। কিন্তু আমি অন্তত পড়িনি।' তখন বললেন – 'হ্যাঁ ঠিকই। আমিও কারও লেখায় এই শব্দ পাইনি। এবার বলো, এই শব্দটার এরকম লাগসই ব্যবহার করতে পেরে, ভালো লাগেনি কি তোমার?' বাধ্য হয়েই স্বীকার করি – 'তা সেই সময়ে একটু লেগেছিল বটে'। খানিক থেমে বলেন – 'যখন নিজে বুঝবে যে, নিজের লেখায় এরকম একটা নতুন শব্দের কোনো অনিবার্য প্রয়োগ করতে পারছ, তখন সে শব্দ বারবার ব্যবহার করতে যেও না। একই অস্ত্র বারবার প্রয়োগ করলে, তার ধার নষ্ট হয়ে যায়।'
বলার সঙ্গেসঙ্গেই আমার আচমকা ফিরে এলো সেই চার-পাঁচ বছর আগেকার স্মৃতি। বাইরের পৃথিবী নিয়ে, সামাজিক সংকট নিয়ে কথা বলতে গিয়ে, যে বিচার ছিল তাঁর, ব্যক্তিগত জগৎ নিয়ে, কবিতায় শব্দের ব্যবহার নিয়ে কথা বলতে গিয়েও, বিচারের সেই একই প্রয়োগ! ব্যক্তিত্বের এক অটুট সমগ্রতা ছাড়া এ কি সম্ভব? বুঝতে পারছিলাম যে, তাঁর জীবনবোধের সঙ্গে কীভাবে অবিচ্ছেদ্য তাঁর সামাজিক মন আর সৃষ্টিশীল মনের গড়ন। আর ফিরে আসতে আসতে, তাই বারবার মনে পড়ছিল ওই কথাগুলো – 'এই দুই কি ভিন্ন নাকি? এই দুইয়ের মধ্যে নিরন্তর যাওয়াআসা করেই কি বেঁচে নেই মানুষ? তার থেকেই কি প্রতিমুহূর্তে তৈরি হয়ে উঠছে না একটা তৃতীয় সত্তা?' আর সেই তৃতীয় সত্তার সঙ্গেই তো এই একটু আগে কথা বলে এলাম আমি!