রবি ঠাকুর প্রসঙ্গে প্রতিক্রিয়ার জবাবে

আফসান চৌধুরীআফসান চৌধুরী
Published : 20 May 2012, 04:33 AM
Updated : 20 May 2012, 04:33 AM

কিছু দিন আগে লিখিত রবি ঠাকুর ও বাঙালি মুসলমান সমাজের ভাবনা ও জড়িত প্রসঙ্গ নিয়ে আমার লেখার ওপর পাঠকদের প্রতিক্রিয়ায় আমি আনন্দিত। আপনাদের আন্তরিকতার জন্য ধন্যবাদ। যেসব প্রসঙ্গ উঠে এসেছে সে সম্পর্কে আমার কিছু বক্তব্য আছে।

কেউ কেউ লিখেছেন যে রবি ঠাকুরের ব্যাপারে আমার এলার্জি আছে। তাকে ছোট করতে চেয়েছি ইত্যাদি। আমার বক্তব্যের কোথাও আমি তা করিনি, আমার লেখার সেটা উদ্দেশ্য ছিল না।

রবীন্দ্রনাথ বাঙালি সমাজের প্রধান সাহিত্যিক। তাকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হতে পারে কিন্তু তার অবস্থানকে খাটো করার চেষ্টার কোনো মানে হয় না।

রবীন্দ্রচর্চা ও ভাবনার সঙ্গে বাঙালি মুসলমান সমাজের সম্পর্ক নিয়ে লিখেছি। আমার মনে হয় তার অবস্থান নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। তবে তিনি প্রধান সাহিত্যিক কিনা সেই বিষয় নিয়ে নয়।

আমি রবীন্দ্রনাথকে একাধিক পর্যায়ে দেখেছি।
প্রথমে তিনি ছিলেন বাঙালি-হিন্দু শিবিরের মানুষ যার এই চরিত্রের প্রকাশ হচ্ছে ১৯০৬ সালের সময়কালের সাহিত্যে ও ভূমিকায়। তবে ক্রমেই তিনি উভয় বাঙালির কবি হয়ে ওঠেন। বিশেষ করে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর।

দ্বিতীয় পর্যায়ে ছিল ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এবং এটা ঘটে বাংলাদেশে যেখানে তিনি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অন্যতম অনুপ্রেরণার উৎসে পরিণত হন। এটা তার সবচেয়ে রাজনৈতিক ফলপ্রসূ কাল।

তৃতীয় পর্যায়ে এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর যখন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের যে প্রতিবাদী পরিসর ছিল তা শেষ হয়ে যায়। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বদলে তিনি এখন প্রধানত একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। এই অবস্থায় এসে তাকে আগের চেয়ে সবলভাবে দেবত্ব প্রদান করা হয়েছে। কেউ এটা দিতে চাইলে দিতেই পারে তবে আমার জিজ্ঞাসা ছিল কেন এটা হয়।

আমি কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছি। আমার মনে হয়েছে যৌক্তিকতাবাদিতার যে দায়িত্ব ও নিরাপত্তাহীনতার যে সংকট সেটা আমরা সামলাতে পারি না। এটা জাতিগত দুর্বলতাও হতে পারে যার কয়েকটা কারণ হচ্ছে রুজির জন্য প্রকৃতির উপর নির্ভরতা, রাজনৈতিক অবস্থার নিয়ন্ত্রণহীনতা ইত্যাদি।

এই সব কারণে যেহেতু জীবনে অনিশ্চয়তা বেড়েছে, আমরা অতিযৌক্তিকতার দিকে ঝুঁকে পড়ি, কারণ জীবনের ভালো-মন্দের ওপর আমাদের হাত নেই। মাঝেমধ্যে থাকে তবে বেশিরভাগ সময় নয়। এর ফলে আমাদের মনোজগতে রহস্যময়তা একটি বাস্তব উপাদান হিসাবে আছে।

অতএব আমাদের জাতীয়তাবাদও কেবল অযৌক্তিক নয়, প্রধানত আবেগের উপাদানে গঠিত। সেই জাতীয়তাবাদ নির্মিতির অন্যতম প্রধান পুরুষ রবি ঠাকুরও হয়তো তাই অতিমানব। আমাদের জাতীয়তাবাদের ধারণা এবং এর প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ধর্মীয়-রাজনৈতিক ভাবনাপ্রসূত নয়। এই জাতীয়তাবাদের 'পবিত্র' অংশটি, ভাবনা-ভাষা-আচার, এই তিনে মিলে বাঙালির একটি প্রায়-ধর্মীয় অবস্থান সৃষ্টি করেছে। তাই রবীন্দ্রনাথ ও অন্য সবল প্রধানদের আমরা একই স্তরে অর্থাৎ সমালোচনার উর্দ্ধে রাখি। মহামানব হিসেবে দেখি। কারণ ধর্মীয় ভাবনা বা অযৌক্তিকতায় আমাদের জাতীয়তাবাদী ধারণা প্রোথিত।

আমার প্রবন্ধের বিষয়বস্তু সরল। রবীন্দ্রনাথের ঐতিহাসিক ও সামাজিক পটভূমির কারণে তার চর্চায় বাঙালি মুসলমানের জীবন ও ভাবনা প্রায় অনুপস্থিত। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ ছিল দুর্বল হিন্দু-বাঙালি মধ্যবিত্ত বনাম উঠতি বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্তের দ্বন্দ্বের প্রকাশ।


এই দ্বন্দ্বে তার সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বাঙালি মুসলমানের পক্ষে ছিল না। তৎকালীন সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই ঘটনার কয়েক দশকের মধ্যে বাঙালি-মুসলমান বা মুসলমান-বাঙালির যে রাজনীতি নির্মিত হলো তাতে কবির অবস্থান ছিল গুরুত্বপূর্ণ। যদিও সেখানে অন্য সাংস্কৃতিক নক্ষত্রবৃন্দ ছিলেন, কেউই তার সমতুল্য ছিলেন না। এই গোষ্ঠীর প্রধান রাজনীতিবিদ ফজলুল হক ছিলেন তার ভক্ত এবং পরবর্তীতে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের বাঙালি সদস্যদের মধ্যেও কেউ রবীন্দ্র-বিরোধী ছিলেন না, সবাই ভক্ত-স্থানীয়। অর্থাৎ কবির সাহিত্য নির্মাণে এই জনগোষ্ঠীর জীবনচিত্রের অনুপস্থিতি ছাপিয়ে ওঠে তাদের কবিপ্রীতি ও তাকে নিজের বলে মনে করার আগ্রহ।

এর কারণ সম্ভবত এটাই যে মুসলমান হিসেবে তার সঙ্গে ক্ষীণ সম্পর্ক থাকলেও, বাঙালি হিসেবে তার ভূমিকা ছিল এই গোষ্ঠীর জন্য ব্যাপক। তারা কেবল মুসলমান নয়, বাঙালিও হয়ে উঠতে চেয়েছিল।

একদিকে যেমন ছিল মুসলমান-বাঙালিদের আত্মপরিচয়ের বিষয়টি যার মধ্যে একটি বড় ক্ষেত্রে ছিল তাদের স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা এবং অন্য মুসলমান গোষ্ঠীর সঙ্গে ব্যবধান নির্মাণের বিষয়টি, অন্যদিকে ছিল বাঙালি হিসেবে নোবেলবিজয়ী কবিকে নিয়ে তাদের গর্ব। এটা ৪০'এর দশকে বাঙালি মুসলমানের স্বকীয় জাতীয়তাবাদ নির্মাণপ্রক্রিয়ার একটি চিত্র বলা যায়।

সেই কারণে যখন থেকে মুসলমান-বাঙালি রাজনৈতিক পরিচয় নির্মিত হল, তখন থেকেই তিনি তাদের মধ্যে উপস্থিত। সেই নির্মাণে তার কোনো মৌলিক উপাদান না থাকলেও। কিন্তু ১৯৪৭'এর পরে অবস্থা পাল্টে যায়। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ নির্মাণে রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠেন অন্যতম মৌলিক ও কেন্দ্রীয় বিষয়। পাকিস্তানিরা বাঙালি-মুসলমান জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করেন বিশেষ করে তার বাঙালি অংশটুকুর জন্যই। আর বাঙালি মুসলমান রবীন্দ্রনাথকে তুলে ধরেন তার বাঙালিয়ানার প্রতিনিধি হিসেবে। সেই কারণে রবীন্দ্র-আক্রমণ ও প্রতিরোধ ছিল রাজনীতির মৌলিক একটি বিষয়।

এর ফলে নব্য জাতীয়তাবাদ প্রকল্পের মূল সাংস্কৃতিক নায়ক হয়ে ওঠেন রবীন্দ্রনাথ। এর ভিত্তি ছিল রাজনীতি। জাতীয়াতাবাদী আন্দোলন যত সবল হয়েছে, তার অবস্থান ততই গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে। কবি ১৯৭১'এর আন্দোলনের অনুপ্রেরণার অন্যতম প্রধান উৎস হয়ে ওঠেন বিশেষ করে যখন এই আন্দোলনের নায়ক শেখ মুজিব ছিলেন তার একনিষ্ঠ ভক্ত। এটাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্রেষ্ঠকাল।

আমার লেখার তৃতীয় পর্ব হচ্ছে এই ১৯৭১ পরবর্তীতে তার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ভূমিকা নিয়ে। বর্তমানে তার তেমন কোনো রাজনৈতিক ভূমিকা নেই যেমন ছিল আগে। এখন অনেকটাই তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতের মানুষ। তার অবস্থা কি পশ্চিমবঙ্গের মতো হবে যেখানে সর্বভারতীয় রাজনীতির প্রভাবের কারণে রবীন্দ্রনাথ আর ততটা কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব নন?

বাঙালির সমস্যা হচ্ছে, যৌক্তিকতা নিয়ে যে প্রক্রিয়া রয়েছে তার সঙ্গে সে অনভ্যস্ত এবং এর ফলে তার ভেতর তৈরি হয়েছে আত্মবিশ্বাস ও আস্থার অভাব। যেহেতু সে মনে করে জীবন তার অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণাতীত তাই সে আলৌকিকতার আশ্রয়ী হয়। জীবন বা রাজনীতির নেতার সঙ্গে তার দামাদামি হয় না বরং 'যা পাওয়া যায়' তাতেই তাকে খুশি থাকতে হয়। তার ভাগ্য তো মানবের হাতে থাকতে পারে না কারণ সেই তো মানব। অতএব সে তো ক্ষমতাহীন, সব মানবই ক্ষমতাহীন। নিজের ওপর আস্থার অভাবটা বাস্তব বিষয়ে। কারণ তার হাতের নিয়ন্ত্রণে স্বল্প বিষয় রয়েছে। সেই ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার কারণে তার জীবনে মহামানব দরকার যে সকল সমালোচনা, যৌক্তিকতা ও দোষত্রুটির উর্ধ্বে। যে আলৌকিক পন্থায় তার উদ্ধার এনে দেবে। সেখানেই রবীন্দ্রনাথের স্থান, সেখানেই শেখ মুজিবের স্থান।

বর্তমানে এসে রবীন্দ্রনাথের কী ঐতিহাসিক ভূমিকা হবে বোঝা যাচ্ছে না। তবে চরম ধর্মীয় পন্থার যুগে তিনি হয়তো একক ধর্মীয় ভাবনার সঙ্গে সামাজিক নৈতিকতার বিষয়টি আনতে পারতেন। জাতি-রাষ্ট্রভিত্তিক যে জাতীয়তাবাদ নির্মিত হচ্ছে বর্তমানে সেটার স্তম্ভ যৌক্তিকতা নয়, অন্ধবিশ্বাস। আগামীর রবীন্দ্রনাথ কোথায় দাঁড়াবেন বা দাঁড়াবার স্থান পাবেন কিনা সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।