ভ্রমণে ভুবনে জলা জংলায়

মিফতাহুল জান্নতী স্নিগ্ধা
Published : 20 Sept 2021, 07:17 AM
Updated : 20 Sept 2021, 07:17 AM

প্রথম পর্ব, (যাত্রা শুরু)
বছর পেড়িয়ে ফিরছি প্রকৃতির প্রাণে। পৃথিবীর সব কিছু প্রতিদিন নতুন রূপ নেয়। আর অদেখা কোনো নতুন যেন প্রাণের সঞ্চার করে। চিত্রা-দহনে রাত্রিযাপন, নিঃসন্দেহে আড্ডা আর আনন্দময় ছিল সেই যাপন। যাত্রা পথের সঙ্গী ছিল প্রিয় কিছু মুখ।

দ্বিতীয় পর্ব, (নাইটমেয়ার)
আগেরবার যখন এই চিত্রায় চড়েছিলাম, সেটা ছিল ১৮ সাল। বড় হওয়ার পর প্রথম রেলগাড়ীতে চড়া। সাথে আমেনা ছিল। সময়ের দূরত্ব প্রায় চার বছর। চিত্রার অবস্থা আজও যেই কে সেই। আজকাল দাঁড়িয়ে যাওয়ারও বৈধতা দেওয়া হয়। তাই মানুষ মানুষের ঘাড়ে চড়ার সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না। কমলাপুর থেকে এয়ারপোর্ট, আবার গাজীপুর, জয়দেবপুর, মির্জাপুর, টাঙ্গাইল, যমুনা পূর্ব-পাড়, এম মুনসুর আলী স্টেশন, ঊল্লা পাড়া, ঈশ্বরদী, ভেড়ামারা( কুষ্টিয়া), পিরাতাং, আলম ডাঙা এক এক করে স্টেশনে থামছে, লোক নামছে, যত না নামছে, তারচেয়ে বেশি লোক উঠছে। মানুষ নিঃশ্বাসের সাথে সাথে বগীকে উত্তপ্ত করে দিচ্ছে।
তবুও উৎসাহ আর আনন্দ সীমাহীন।
পথে এয়ারপোর্ট থেকে স্ন্যাকস উপহার পেলাম, পরে টাঙ্গাইলের পুরান বাসস্ট্যান্ডের মিষ্টি উপহার পেলাম। প্রতিটি ভ্রমণ আমাকে নতুন কিছু উপহার দেয়।

যমুনার পূর্ব-পাড়ে এসে সালাউদ্দীন ভাই জানালেন, পুরো ২০ মিনিট বিরতি। সবাই বাইরে যাওয়ার লোভ সামলাতে না পেরে নেমে গেছি। ওখানেই মিষ্টির গোষ্ঠীর সমাধি হলো। বেগ ভাই গল্প করছিলেন। সামনেই ঠিক পদ্মার আগে রূপপুরের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সৌন্দর্যের কথা বললেন বেগ ভাই। ইউসুফ ভাই আমাদের ব্যাগের পাহারা দিচ্ছিলেন। তিনি আমাদের কাছে বাইরে আসার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, আর তখনই ট্রেন হঠাৎই ছুটতে লাগলো, কোনো শোরগোল ছাড়াই। আমরা সবাই খুব তড়িঘড়ি করে কোন মতে ট্রেনে ওঠার সময় মনে হচ্ছিল যদি ট্রেনটা ধরতে না পারি তখন কী হবে! কখন কিভাবে যেন বগীতে পৌঁছলাম। চোখের পলকে কি হলো বুঝার আগেই বসে আছি আমার সীটে। কয়েক সেকেন্ডেই যেন সবকিছু ঘটে গেলো চোখের পলকে। কিছুক্ষণ যেন ভিতরটা স্তব্ধ হয়েছিল। গল্পে গল্পে মাঝ রাত। এই করে যমুনা নদী ও পদ্মাবতী পেড়িয়েছি। শত চেষ্টার পর ঘুম নেই চোখে। বগীর ছাদে লাইট জ্বলছে আপন মনে, ঘুমের শত্রু আলোকে যে রোধ করা যাচ্ছে না!


তৃতীয় পর্ব, (শুভ সকাল)
সকাল পাঁচটা বাজে। চিত্রার ক্লান্তি নেমেছে। সূর্য দেবের দেখা এখনো মেলেনি। বের হওয়ার আগে কড়া নজরদারিতে চেকিং চলছে। আমাদের সাথে বয়সে কেউই অপ্রাপ্ত নয়, অথচ আমাদের কাছে একটি টিকিট অপ্রাপ্ত বয়সের। চেকম্যানের নজরে পরতেই, আমরা জানালাম রাতে আমরা সিট পরিবর্তনের সময় টিকিটও পরিবর্তন করি।
স্টেশন থেকে বের হতেই চোখে পড়ে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশাগুলোতে।চালকদের হাঁকডাক আর এসব চালকরা মার্কেটিং-এ এতোটাই অভিজ্ঞ বলে মনে হলো যেন এরা বিশেষজ্ঞদের হার মানিয়ে দেবে। ষাট টাকার ভাড়া একশত কুড়ি টাকা দর করে খুলনার সোনাডাঙা বাসস্ট্যান্ডের বরিশাল খাবার হোটেলের সামনে নামিয়ে দিলো। পথে আমাদের যিনি গাইড করছিলেন, তিনি এমন অহংকারী ভঙ্গিতে এরশাদ সিকদারের বাড়ি দেখাচ্ছিল। কিন্তু কোন এরশাদ? সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ? তাঁর পুরো নাম মনে করার চেষ্টা করছিলাম। কুখ্যাত না সু-বিখ্যাত, দ্বিধায় পরে গেছি।
খাবার আয়োজন সুসজ্জিত হলেও রান্নার শিল্পে আনাড়ি, খাবার মুখে দিতেই তা বুঝতে দেরি হলো না কারো। খাবার নষ্ট করা মহাপাপ—এই বিশ্বাসে বাঙ্গালী খাবার যথাসাধ্য খেয়ে নিলাম। এখানে চা পানের সাহস হলো না।

বেগ ভাইয়ের বিশেষত্ব অনেক শুনলেও নিজ চোখে দেখলাম। পকেট চুলা, সাথে সিলিন্ডার, চায়ের যত সরঞ্জাম–সবই বেগ ভাই সাথে নিয়ে এসেছে। সুবিধা মতো জায়গায় চা তৈরি আর তা পান করে মংলা বাসস্ট্যান্ডে যাওয়ার জন্য বাসে চড়ে বসি। বাসের সামনেই লেখা ছিল গেটলক, কার্যত ভুল প্রমাণিত হবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই।

অনেকদিন পর লং জার্নি, তাই স্বভাবতই ঘুম নিয়ে আমার ঝামেলা হলো। বাস ছাড়তে না ছাড়তেই ঘুম ঘুম পাচ্ছে, কখন ঘুমিয়ে পরেছি বুঝতে পারিনি। পূর্বে সূর্যের আলো তীরের মতো লাগছিল জানালার গ্লাস ভেদ করে। অভিযাত্রীর স্বভাবসুলভ আন্তরিকার স্পর্শে তাও লাঘব হয়ে এলো, সালেহ ভাইয়ের হেড ক্যাপ মাথায় দিয়ে। প্রায় দুই ঘন্টা পর মংলা ঘাটে পৌঁছালাম। ডান দিকেই "পশুর হোটেল" নামটা দেখে অবাক হতেই বেগ ভাই বলে বসলেন পশুর নদীর পাশে হওয়ায় এর নাম অনুসারে এই হোটেলের নামকরণ করা হয়।

আমাদের জন্য বাসস্ট্যান্ডে সাম্পানের কাকা অপেক্ষা করছিলেন, কেডস পরে যাওয়ায় একটা স্লিপার কিনতে হলো লোকাল হকারের থেকে, এসব খুঁজতে সহজ হলো সাম্পান কাকার জন্য, মানুষটা কি আন্তরিকতা নিয়ে স্বাগতম জানালেন। বুঝতে দেরি হলো না বাকি সময় আমাদের জন্য জটিল হবে না। ঘাট থেকে সাম্পানে চড়েই সবাই খুশি হলাম সাম্পানের আসন ব্যবস্থা দেখে। সাম্পান চলছে পশুর নদীর গায়ে ভেসে। উপরের চানদিনা থাকায় রোদও সহনীয় মনে হচ্ছে, কৌতুহলী চোখ জোড়া দূরে জলের গায়ে জংলার খোঁজ করছে…..


চতুর্থ পর্ব, (শরৎ প্রভাব)
শরতের প্রকৃতি এমনই রূপ-মোহনীয়। সকাল থেকেই দিনের আলোর উজ্জ্বলতা সাজিয়ে দেয় বিশ্বলোক। আকাশ থাকে মেঘ মিঠাই-এ পরিপূর্ণ। সমুদ্রে যে কয়েকবার গিয়েছি, জোয়ারের আছড়ে পড়া ভয়ংকর রূপ দেখেছি দুপুরের পর থেকেই। এদিকে সুন্দরবনের পশুর নদীর বিপরীত রূপ, জোয়ারের নোনা জলে সুন্দরী, গোলপাতা, পাইন এরা সবাই অর্ধেক শরীর স্নানে রাখে দিনের বেশির ভাগ সময়। এমনই মোহে যেন অনায়াসে ভেসে চলে দূর দূরান্ত থেকে আসা জাহাজ। মাঝেমধ্যেই জংলার মধ্যে থেকে সুন্দরী গাছের চিরযৌবনে উঁচিয়ে তোলা সৌন্দর্য দেখা যায়।

সবাই সবার মতো করে প্রকৃতির সুরা পানে ব্যস্ত। কেউ জংলায় কুমির কেউবা চিল দেখে সবাইকে দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পরে। আবার কেউ পশুর জলে ডলফিনের স্বপ্ন দেখছে। বেগ ভাই ও শিল্পী আপা সুরের সুক্ষ্ম বিচার বিশ্লেষণে ব্যস্ত হয়ে পরে।

করমজলের গহীনে যেতে অনুমতির প্রয়োজন। ইউসুফ চাঁদপাই রেঞ্জের সুন্দরবর পূর্ব বন বিভাগ অফিস থেকে একজন গানম্যান সহ অনুমতি নিয়ে এলো।

চলছি করমজলের গহীন পথে। দুই পাশের সুগঠিত গাছের সারিগুলো দেখে বারবার মনে হচ্ছে এরা আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে এই জল জংলার রাজ্যে। আমরা সবাই তা প্রাণ ভরে গ্রহণ করছি। আর আমার ছোটবেলায় বিটিভিতে দেখা প্রকৃতি বিষয়ক প্রামাণ্য অনুষ্ঠান দেখলেই সেসব জায়গায় যাওয়ার ইচ্ছে জাগত। আজ সেই ইচ্ছেরা আনন্দ হয়ে ধরা দিচ্ছে। এইসব মুহূর্ত শুধুই আনন্দ, উল্লাসের। এতো আয়োজনের পরেও রাজা মহাশয়ের দেখা মিলেনি।
হার না মেনে এবার সংরক্ষিত অংশে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি…

পঞ্চম পর্ব, (অপরাহ্ন)।
অপরাহ্নে সূর্য দেব ক্লান্তিতে পশ্চিম আকাশে হেলেছেন। আমরাও প্রায় শ্রান্ত। সুন্দরবনের পূর্ব বন বিভাগ অফিসসহ বেশ ক্ষানিকটা অংশ মানুষের ঘুরে দেখবার জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। আমরা সাম্পান থেকে নামতেই, এক জোড়া বানর সাদরে আহ্বান করছে, অভিজ্ঞ কেউ কেউ সতর্ক করে দিচ্ছে কারো হাতে যেন কিছু না থাকে, তবে বানর নিজ অধিকারবশে হাত থেকে কেড়ে নিবে। এমনটাই হলো, এপি'র হাতে রুটি কলা দেখে পিছু নিতেই এপি সে-গুলো দিয়ে দেয়। সালেহ ভাইয়া কলা দিয়েছিল, তাই তার পিছু ছাড়বার নামই নিচ্ছিল না। সামনেই কুমিরের প্রজনন ও লালন স্থান। হরিণের খাবার এক ধরনের ঘাস নিয়ে বাবু নামের ছেলেটি বসে ছিল। হরিণের ঘাসগুলো খাওয়া দেখে মনে হলো খুব প্রিয় খাবার ওদের এই ঘাস। সামনে এগোতেই কুমিরের বাস স্থান। বৃহৎ আকৃতির মা কুমির গভীর নিদ্রায় আছেন, পাশেই তার ছানারা খেলছিল। আরেকটু হাঁটতেই এক লোক মধু বিক্রি করছিল। এমনভাবে তার পণ্যের বিশেষত্ব বুঝাচ্ছিলেন, এ যেন আদি বৈদ্যের কোনো ঔষধ, যেখানে আদি বচন, "বিশ্বাস করে নিলে ভালো হবে"। লোকটি বললেন প্রমাণ কি করবো! খেয়ে দেখেন, বিশ্বাস করে নিলে ঠকবেন না। সত্যি কি তাই! কোনো পন্য বিশ্বাস করে নিলেই কি কিনে জিতে যাবার শতভাগ নিশ্চয়তা রয়েছে?
সালেহ ভাই দুই ধরনের মধু নিলেন প্রায় দিগুণ দামে, বিশ্বাস করে।

এমন ধূপ দাহনেও যে বটের ছায়া পাবো, কল্পনাতীত ছিল। ক্লান্ত মুসাফির সকল, বটের ছায়ায় নিজেদের সপে দিয়েছেন। আমার মনে পরে গেলো জাফলং এ যাওয়ার পথে এমনই কোনো গাছের ছায়ায় নিজেকে সপে দিয়ে বলেছিলাম
" আমি হাজার বার জন্ম নিতে চাই এমন গাছের ছায়ায় শ্রান্ত হবার লোভে"।

শান্ত শীতল পরশ পেয়ে গল্পরা প্রাণ ফিরে পেলো। এপির বিয়ের আলোচনায় বেশ গল্প জমে উঠলো। হঠাৎ দেখি মনজু ভাইয়া গাছে উঠে বসে আছেন। ইচ্ছে করছিল ছোটবেলার গেছো মেয়ের স্বভাবে ফিরে গিয়ে গাছে চড়ি। ক্লান্ত সবাই, কিন্তু তৃষ্ণা কথা যেন স্তিমিত হয়ে আসছে। এর মাঝে হঠাৎ বেগ ভাই নিদ্রাপুরে চলে গেছেন। শিল্পী আপার কাছেই শোনা, "বেগ ভাই যেখানে কাত সেখানেই তার রাত"।
পথের যেখানেই তিনি সময় পান, হোক সে সময় মিনিট দুই তাতেও নাকি তিনি দীর্ঘ ঘুমের স্বাদ নিয়ে নেন।

তৃষ্ণার সমাধানে আমি আর চাইনিজ সাহেব সাম্পান থেকে পানি নিয়ে আসি। এসে দেখি শিল্পী আপা গাছে বসে, এবার আর নিজেকে ধরে রাখা গেলো না। সবাই বলছিল, আমি উঠতে পারবো না, আমি হেসে উত্তর দিলাম একসময় নারিকেল গাছেও চড়েছি। চোখের পলকেই গাছে চড়লাম।
টারজানের মতো সালেহ ভাই বটের লতা ধরে গাছে উঠে এলেন, আমাকে উৎসাহ দিলেন, আমি শঙ্কায় ছিলাম, তবুও লতা ধরে গাছে উঠে আবার নেমেও এলাম।
সবাই অবাক হলো, আমার প্রশংসা করলো সকলে, এই দেখে নিজের ঢোল ক্ষানিকটা নিজেও পিটিয়ে নিলাম।
এবার গহীন বনে চলতে হবে।


ষষ্ঠ পর্ব, (দিনের শেষ)।
সবাই চলছি কাঠের তৈরি ব্রিজ দিয়ে বনের গহীনে যাওয়ার জন্য।
ইউসুফ ও বেগ ভাই বলছিল, বনে চলতে সময় জোরে কথা বলতে হয় না। বনবাসীদের বিশেষ আপত্তি আছে এতে। আবার কখনো কখনো পাখিদের কলতান শুনতে পাওয়া যায় শান্ত স্বরে থাকলে।
জানতাম না বনে আসলে রংচঙয়ে পোশাক পরা উচিত না, "ক্যামোফ্লাজ" মানে প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য রাখে এমন রঙের পোশাক পরিধান করা উচিত। "ক্যামোফ্লাজ" এই আদি শিল্পটি ছিল প্রাণীদের শিকারীর হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর প্রক্রিয়া। আবার মানুষেরও বনের প্রাণীর সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে এমনটা অনুসরণ করতে হয়। বেগ ভাই বল্লো তোমার পোশাক ঠিক তেমন, "ক্যামোফ্লাজ স্ট্রাকচারাল"। হঠাৎ এক বাচ্চা মেয়ের চিৎকার শুনে দৌড়ে গিয়ে দেখি মেয়েটির হাতে খাবার ছিল তাই বানরের থাবায় পরেছে। মেয়েটি প্রচন্ড ভয়ও পেয়েছে। পাশেই ওয়াচ-টাওয়ার, সবাই উঠে চারপাশে শুধু সারি সারি গাছ দেখছি যত বিস্তৃত চোখ যায়। পরক্ষণেই শুনি, এপিকে কোনো এক মেয়ে বানর খামচি কেটেছে। শুনেছি, কোনো এক পুরুষ বানরের সাথে সখ্যতা করছিল।
শিল্পী আপা কাঁকড়ার ছবি তুলতে ব্যস্ত কিন্তু ব্যর্থ হলো। ওয়াচ-টাওয়ার থেকে নেমেই দেখি বানর বংশ রাজত্ব করছে। বেগ ভাই এই প্রথম বল্লো আমার ছবি তুলেন, আমি দেখছি প্রানীগুলো আপন ভরে তাঁর পাশে বসেই ছবির ফ্রেমে বন্দী হলো। আমরা এগোতেই হঠাৎ সালেহ ভাইয়া তার হাত থেকে মধুর বোতল দুটি ফেলো দিলো। কারণ, বানর গুলো বোতল দেখে তার পিছু নিয়েছে। পাছে কামড়ে না দেয় সেই ভয়ে বিশ্বাসের মধুর জলাঞ্জলি দিলেন। এদের বোতলের মধু খাওয়ার নাকি এক অভিনব কৌশল রয়েছে, ছোট্ট একটা ছিদ্র করে দীর্ঘ সময় নিয়ে খেয়ে থাকে।

পথে পথে গাছ দেখছিলাম, হঠাৎ চোখে পড়লো কোনো এক নাম না জানা লতার ঝাক মাটিতে হেলিয়ে, নতুন লতাদের কোনো এক গাছে বাইয়ে দিয়েছে। এদের ছোট ছোট খুব সুন্দর সাদা ফুলও হয়।
আমাদের এই হাঁটার পথ শেষ হতেই এক গুইসাপ দেখি, এদের চলনবলন বড্ড ধীর তাই ক্ষানিকটা দেখার সুযোগ পাওয়া যায়। অনেক বছর পর হকার মামার কাছ থেকে আইসক্রিমও খেলাম তা আবার লবন মিশিয়ে ।
এখানকার নিয়ম ট্রেইলের শেষে টাকা পরিশোধ করে বের হতে হয়। এর মধ্যে সালেহ ভাইয়া পুনরায় মধু কিনে আনলেন। এবার আমাদের ফিরে যাবার পালা। কোনো এক ঘাটে নামবো পশুর জল-স্নানে। নদীর ভাঁটায় গাছের কঙ্কালসার বেড়িয়ে পড়েছে, টান দেখে সাম্পান মামা নোঙর গেঁড়ে দিলেন, আমরা সবাই নেমে পরলাম নদীতে। স্রোতের টানে হাঁটতেই মুশকিল হচ্ছিল, সেখানে স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটছি, অদ্ভুত অনুভব হচ্ছিল, এ যেনো কোনো জল ছবির দৃশ্য।
সূর্য দেবের এবার বিশ্রামের সময় হয়ে এসেছে।

সপ্তম পর্ব, (ফিরে আসা)।
সন্ধ্যার আকাশ ঘন কালো হয়ে আছে। দূরের আলোর রশ্মিতে নদীর পানি ঝলঝল করছে। এবার ঢাকায় ফিরার পালা। পূর্ব নির্ধারিত কোনো পরিকল্পনা না থাকায় মংলা বাসস্ট্যান্ড থেকে ঢাকায় ফিরার বাসের টিকিট কাটতে হলো। দিগন্ত বাস, বাসের পিছনে লেখা ছিল, " সড়ক পথে বিমানের ছোঁয়া " । ওদিকে আমরা সবাই ক্ষুধার্ত। সংখ্যায় আমরা দশ জন ছিলাম তাই বাসের সুপারভাইজার পর্যাপ্ত সময় দিলেন রাতের খাবার খাওয়ার জন্য। নেহাৎ নিরীহ বাঙ্গালি আমি, অন্ন দোষ ধরার দুঃসাহস আমার নেই, আবার অন্ন নষ্ট করার মতো মহাপাপ ও করি কেমন করে!
বাসে চড়ে বসেছি, সবারই প্রায় শরীর ছেড়ে দিয়েছে। আমি যেনো স্থীর হতে পারছি না। আমি বুঝে গেছি আজ রাতেও আমার ঘুম হবে না। ইতোমধ্যে বাসের পিছনের লেখার প্রমাণ দিতে শুরু করেছেন বাসের চাকল। দিনে একবার বলেছিলাম, ফিরার পথে আমি সবার উদ্দেশ্য কিছু কথা বলবো। শিল্পী আপা সেই কথা মনে করিয়ে দিলেন। আমিও অভিজ্ঞ বক্তার মতো অনায়সে সারাদিনের ভলোলাগা, মানুষ-বিশেষণ করে কথা বলছিলাম। নিজেকে বেশ পরিপক্ব বক্তা মনে হচ্ছে। ভাবছি, কবে আমি বড় হয়ে গেলাম, এতো পরিপূর্ণতা কবে এলো আমার মধ্যে।
বক্তৃতা শেষ হলো। কাটাখালি বাসস্ট্যান্ডে বাস থেমেছে। বেগ ভাই এখানে নেমে গেলেন। কি বিশেষ কাজে খুলনাতে তাকে আজ রাত থেকে যেতে হবে।
শুরু হলো সড়ক পথে বিমানের ছোঁয়া, আমরা সবাই আতঙ্কিত। এমন ভাবে বাস চলছে নিশ্চিত মনে হচ্ছিল, আজ এক দূর্ঘটনা ঘটবেই। সবাই সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে বাড়ি ফিরার আসা প্রায় ছেড়েই দিয়েছি। আমার বাড়ির মানুষের সাথে সাথে আমার ডায়েরির কথা বারবার মনে পড়ছে, গতকাল আসবার সময় লিখে রেখে এসেছি, বেঁচে ফিরলে বাকি কথা লিখবো। ডায়েরিটা আমার পথ চেয়ে আছে।
কোনো রকম দৌলতদিয়া এসে পৌঁছলাম রাত এগারোটায়। প্রায় সবাই বিভোর নিদ্রাছন্ন। আমি অনেকটা পথ ম্যানেজার সাহেব ও চাইনিজ সাহেবকে জাগিয়ে রেখেছিলাম, একা একা জেগে আছি বলে। তারাও নিরেট ভালো মানুষ, আমার সাথে গল্প করে কাটিয়ে দিলেন অনেকটা পথ। বিরক্ত হলেও তাদের মুখের হাসি দেখে বুঝবার উপায় নেই। পথে বিরতি নেওয়ার কথা থাকলেও বাস চালক কোনো প্রকার বিরতির ব্যবস্থা করেননি। অথচ,ফেরির এপার দৌলতদিয়া ঘাটেই তার শতগুণ উশুল হয়ে গেলো। ছয় ঘন্টার বিরতি পেলাম। এ সময়ে কেউ কেউ হালকা খাবার খেয়ে নিলো, কারো কারো জরুরত সেরে নিলেন। ভোর পাচঁটার দিকে ফেরিতে বাস উঠলো। আমি জীবনের প্রথম ফেরিতে নেমেছি। বাবার কাছে শুনেছি, ফেরিতে নেমে নদী দেখতে খুব সুন্দর লাগে। আজ তার প্রমাণও পেলাম। ফেরির সফর প্রায় চল্লিশ মিনিটের মতো। এবার বাস চলছে তার আপন গতিতে, বিমানে ছোঁয়া দিয়ে। সবাই আবারও বাসে ঝিমিয়ে নিচ্ছিল। পথে সাভার পাড় হতেই বাসের ইঞ্জিনের কোনো একটা তার ছিড়ে গিয়েছে। বাসেরও তো ধৈর্য্য বলে কথা, এতো অত্যাচার কে সয়!
এখানেও সময় গেলো মিনিট পনেরো।

অবশেষে, বাস এসে পৌঁছাল গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে। বাস থেকে নামতেই দেখা মিললো নূর ভাবির অর্ধাঙ্গ, মানে অভিযাত্রীর সর্বজন প্রিয়। অভিযাত্রীর সবার মতোই তাঁর বিশেষ গুনাগুন সম্পর্কে আমি শুনেছি, মেঘে ঢাকা আকাশের কোনো এক তারা দেখিয়ে অন্য সকল তারার দূরত্ব বিস্তারিত বলে দিতে পারেন।
ভাইয়া আমাদের সাথে দেখা করতে আসলেন সাথে ভাবিকে নিয়ে যেতে। বিদায় নিয়ে যে যার পথে ফিরে গিয়েছে। আমি শিল্পী আপা একসাথে আজিমপুরে এসেছি। আমি শিরু'মার বাসায় উঠেছি।
জীবনের প্রথম ভ্রমণ ১৭ সাল, ঢাকায় ফিরে বাসায় কাউকে পৌছাঁনোর খবর না দিয়েই ঘুমিয়ে পরেছিলাম। তারপর, আমার যত বান্ধবী আছে সবাইকে ফোন দিয়ে হত্যাযজ্ঞ, সাথে পারলে পুলিশেও খবর দেওয়া হয়ে যেতো, যদি না উর্মি আমার রুমে আসতো!
আজও পুনরায় ঘটল ঘটনা। সব বন্ধুদের ফোন করে কোনো খবর না পেয়ে অবশেষে শিরু'মাকে কল দিয়ে বাসার মানুষ শান্ত হলো।
আমি আগেরবারের মতোই শান্তিতে ঘুমাচ্ছি মোবাইল চার্জে রেখে।