বাঙালি হিপোক্রিট পুরুষ-লেখকদের চরিত্র — ১

তসলিমা নাসরিনতসলিমা নাসরিন
Published : 20 August 2017, 04:01 PM
Updated : 20 August 2017, 04:01 PM

গত ১২ অগাস্ট ২০১৭ তারিখে রাজু আলাউদ্দিনের নেয়া কবি নির্মলেন্দু গুণ-এর একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল আর্টস বিভাগে। তাতে কথা প্রসঙ্গে– সাক্ষাৎকারগ্রহিতার প্রশ্নের জবাবে–কবি নির্মলেন্দু গুণ মন্তব্য করেন কবি কলামিস্ট তসলিমা নাসরিন সম্পর্কে। সেই মন্তব্যের সূত্রে তসলিমা নাসরিন এই লেখাটিতে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। বি. স.

বাঙালি পুরুষ-লেখকদের মধ্যে ভয়ংকর পুরুষতান্ত্রিক, ভয়ংকর নারীবিদ্বেষী, দুশ্চরিত্র, দু'নম্বর লোকের অভাব নেই। ব্যক্তিগতভাবে আমি ক'জনকে জানি, যাঁরা মানুষ হিসেবে অতি নিম্নমানের। তাঁরা ঈর্ষাকাতর, মিথ্যেবাদী। পুরুষ-লেখক বলেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তাঁদের নিন্দে করার কেউ নেই। এঁদের দোষগুলোকে অবশ্য সমাজের বেশিরভাগ পুরুষের চোখে দোষ বলে মনে হয় না। কারণ 'সেক্সিজম' এ দেশে দোষের কিছু নয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, হুমায়ুন আজাদ,আহমদ ছফা, সৈয়দ শামসুল হকরা বিনা সমালোচনায় জনপ্রিয়তা ভোগ করতে পারেন বাংলায়, বাংলা বলেই সম্ভব। সভ্য দেশ হলে সম্ভব হতো না। তাঁদের জীবনাচরণের অসততা নিয়ে প্রশ্ন উঠতো। আজ নাস্তিক লেখক স্যাম হ্যারিসের সেক্সিজম নিয়ে নিন্দে হচ্ছে, নাস্তিকরাই নিন্দে করছেন। শুধু স্যাম হ্যারিস নয়, প্রচণ্ড জনপ্রিয় নাস্তিক-বিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্সের কিছু নারীবিরোধী উক্তির কারণে তাঁকে নাস্তানাবুদ করেছেন নাস্তিক-নারীবাদীরা। ডকিন্স নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু বাংলার পুরুষ-লেখকদের ভুল সংশোধনের সুযোগ দেওয়া তো দূরের কথা, ভুল ধরিয়ে দেওয়ার কাজটিতেও নির্বোধ স্তাবকদের আপত্তি। যেহেতু ভালো একটি বই লিখেছেন, সুতরাং তাঁর সাত খুন মাফ—নাস্তিক বাঙালির এই আবেগের সঙ্গে ধর্মান্ধ বাঙালির আবেগের কোনও পার্থক্য নেই।

সম্প্রতি বিডিনিউজ২৪ ডটকম কবি নির্মলেন্দু গুণের একটা সাক্ষাতকার ছাপিয়েছে। ওতে আমার বিরুদ্ধে একগাদা মিথ্যে কথা বলেছেন নির্মলেন্দু গুণ। সম্ভবত 'স্বাধীনতা পদক' পাওয়ার জন্য কিছুকাল আগে তাঁর মরিয়া হয়ে ওঠার সমালোচনা করেছিলাম বলে শোধ নিয়েছেন। আমি লিখেছিলাম – 'শুনলাম কবি নির্মলেন্দু গুণ নাকি স্বাধীনতার পদক পাওয়ার জন্য ক্ষেপেছেন। অনেক তো পুরস্কার পেলেন। আরো পেতে হবে? কী হয় এসব পুরস্কারে? কিছু লোকের হাততালি পাওয়া যায় আর সম্ভবত কিছু টাকা পাওয়া যায়। টাকা তো সেদিনও শেখ হাসিনা দিয়েছেন তাঁকে। হয়তো তিনি মনে করেছেন স্বাধীনতা পদক পাওয়ার যোগ্য তিনি, তাই পদক দাবি করছেন। কত কেউ তো কত কিছুর যোগ্য। সবারই কি সব কিছু পাওয়া হয়? গ্রাহাম গ্রীন যে অত বড় লেখক, নোবেল তো পাননি।

তাতে কী? গ্রাহাম গ্রীন গ্রাহাম গ্রীনই থেকে যাবেন। নোবেল বরং আফশোস করে যাবে বাকি জীবন। আমি তো বাংলাদেশের মানুষের ভালোর জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, দেশ-সমাজ-পরিবার-স্বজন হারিয়ে, ঘর বাড়ি বিষয় আশয় বিসর্জন দিয়ে প্রায় তিন যুগ হলো লিখছি, আমি তো অপমান আর লাঞ্ছনা ছাড়া ও দেশ থেকে কিছু পাইনি! পুরস্কার? প্রশ্নই ওঠে না। পুরস্কার পাইনি বলে তো একটুও রাগ বা দুঃখ হয় না আমার! নির্মলেন্দু গুণ বাংলাদেশের কবি-লেখকদের মধ্যে, আমি মনে করি, খুবই ভাগ্যবান। খুব কম লেখকই জীবদ্দশায় তাঁর মতো সমাদৃত এবং সম্মানিত হয়েছেন। খুব কম লেখকই এত লোকপ্রিয়তা পেয়েছেন। মানুষ তাঁর লেখা পড়তে ভালোবাসে। এটিই কি একজন লেখকের জন্য সবচেয়ে বড় পুরস্কার নয়? সবচেয়ে দামি পদক নয়?'

আমার ওই লেখাটায় শ্লেষ ছিল না, শত্রুতা ছিল না, ছিল ভিন্ন মত, ছিল কিছু সত্য উচ্চারণ। কিন্তু এই সত্য তিনি সইতে পারেন নি। তাঁর সঙ্গে একসময় আমার সখ্য ছিল খুব। তাঁর পারিবারিক বন্ধু ছিলাম বটে। তাঁর দুর্দিনে সত্যিকার শুভাকাংক্ষীর মতো পাশে ছিলাম। চেনা পরিচিতদের বলে কয়ে তাঁকে এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের চাকরির ব্যবস্থাও করেছিলাম। হিন্দুদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে, খবর শুনে তাঁর বাড়িতে ছুটে যেতাম, দেখে আসতাম তিনি ঠিক আছেন কিনা। নিজের দাদারা দূরে ছিল, গুণকেই দাদার মতো শ্রদ্ধা করতাম। তাঁর পক্ষ নিয়ে কবিতা লিখেছি, উপন্যাসে তাঁর কথা উল্লেখ করেছি। একসময় তিনি তাঁর কন্যাকে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কত যে অনুরোধ করেছি সিদ্ধান্তটি বাতিল করার জন্য! কারণ ভয় পেয়েছিলাম, কন্যার সঙ্গে ঘন ঘন সাক্ষাৎ না হলে তিনি মনোকষ্টে ভুগবেন। চেয়েছিলাম কন্যা কাছাকাছি থাকুক, তিনি আনন্দে থাকুন। দেশে থাকাকালীন গুণ এবং শামসুর রাহমানই ছিলেন আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ । আমার বাড়িতে তাঁদের যাতায়াত ছিল অবাধ। সুখে দুঃখে পাশে ছিলেন ওঁরাই। যাদের জন্য জীবন দিই, লক্ষ্য করেছি, তারাই একসময় শত্রু হয়ে ওঠে। দেশ থেকে চব্বিশ বছর আগে বিতাড়িত হওয়ার পর নির্মলেন্দু গুণকে বন্ধুসুলভ কিছু করতে না দেখলেও খুব বিষোদগার করতে দেখিনি। যে গৃহকর্মী নিয়ে প্রায় তিন যুগ বাস করছেন তাঁর কথা আমার আত্মজীবনীতে ঘটনাপ্রসঙ্গে উল্লেখ করায় তিনি ক্ষুদ্ধ হয়েছিলেন সে জানি। কিন্তু হঠাৎ তাঁর সাক্ষাৎকারটিতে আমার সম্পর্কে বলতে গিয়ে এই যে ঘৃণা আর অসহিষ্ণুতা উগড়ে দিলেন, তা কেন? দেরিতে হলেও তিনি কি তাহলে মুখোশ উন্মোচন করলেন? বাংলাদেশের হিপোক্রিট পুরুষ-লেখকদের কাতারে তিনিও কি তবে দাঁড়িয়ে গিয়েছেন? তিনি বলেছেন, হাসিনার কাছে যাওয়ার প্রস্তাব তিনি আমাকে দেননি, আমি খুব অনুরোধ করেছিলাম বলে তিনি অনুগ্রহ করে আমাকে নিয়ে গিয়েছেন, তা না হলে তিনি নিয়ে যেতেন না। ভালোই হলো আসল কথা ফাঁস করেছেন এতদিনে। আমি কিনা ওদিকে ভেবে নিয়েছিলাম তিনি বিরাট দরদী মানুষ; সহমর্মিতার কারণেই তিনি আমার বদলির সমস্যা দূর করতে নিজেই এগিয়ে এসেছিলেন। নিজেই ভেবেছিলেন হাসিনার কাছে আমাকে একবার নেওয়া দরকার, হাসিনাকে বলে যদি বদলিটা ফেরানো যায়, শুভাকাঙ্খী হলে মানুষ যা করে। তাহলে তিনি আমার শুভাকাঙ্খী ছিলেন না, আমিই ভুল করে তাঁকে শুভাকাঙ্খী ভাবতাম! তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি তসলিমাকে পছন্দ করেন না, তসলিমার লেখাও কখনও পড়েন না, পড়ার ইচ্ছেও তাঁর নেই। চমৎকার। দেশে থাকাকালীন অবশ্য এমন নেতিবাচক কথা তিনি কখনও বলেননি আমাকে। নাকি তসলিমার বিরুদ্ধে বললে এখন কিছুটা সুবিধে হবে বলে বলছেন? তসলিমার অসংখ্য নিন্দুকদের আদর পাবেন বলে বলছেন? কী জানি, নিজের সুবিধে হবে এমন জানলে হয়তো তিনি আমি কেন, তাঁর যে কোনও বন্ধুকে ত্যাগ করতে দ্বিধা করবেন না। গুণ অপ্রিয় সত্য কথা বলেন, তাঁর সম্পর্কে এমন মন্তব্য আমি দ্বিখন্ডিত বইয়ে করেছিলাম। কিন্তু ধীরে ধীরে অবশ্য আমার চক্ষু খুলেছে। লক্ষ করেছি, আমাকে এই যে দেশ থেকে অন্যায়ভাবে তাড়ানো হয়েছে, কোনওদিন তিনি এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেননি। তাঁর বন্ধু বান্ধবরাই বহুদিন ক্ষমতায়, কিন্তু কোনওদিন কাউকে অনুরোধ করেননি দেশে ঢুকতে আমাকে যেন ওঁরা বাধা না দেন। হাসিনার সঙ্গে একবার নিউইয়র্কে গিয়েছিলেন, শুনেছি আমার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে কোনও এক বন্ধুর কাছে প্রকাশ করেছিলেন, তারপর সেই ইচ্ছেটা নিজেই আবার বাতিল করেছেন। মানুষটার রস-রসিকতা আমার অসম্ভব ভালো লাগতো, এখনও লাগে, এখনও ওই কারণে আমি তাঁর ভক্ত, কিন্তু এইরকম রসিক মানুষ যে ভীষণ স্বার্থপর হতে পারেন, তা আগে না বুঝলেও পরে বুঝেছি। তিনি বস্তিতে থাকেন বলে, ধনদৌলতের প্রতি তাঁর লোভ নেই বলে তাঁর প্রতি আমার অপরিসীম শ্রদ্ধা ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে দেখেছি কী ধরণের কাপুরুষ তিনি, কী ধরণের ভীতু। শাহবাগ আন্দোলনে যোগ দেননি। একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি যখন একের পর এক দেশ জুড়ে ব্লগার হত্যা চলেছে। একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি, যখন বাকস্বাধীনতার বিরুদ্ধে, মানুষের মত প্রকাশের বিরুদ্ধে অন্য লেখকদের ওপর নির্যাতন চলেছে। গুলশান ক্যাফের ঘটনা নিয়েও একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি যখন হিন্দুদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, জমিজমা দখল করা হয়েছে, দেশ ছেড়ে যেতে হিন্দুদের বাধ্য করা হয়েছে। মানবতা ধর্ষিত হচ্ছে, মনুষ্যত্ব বিলুপ্ত হচ্ছে দেখেও নির্বিকার ছিলেন। এমন সুবিধেবাদী চরিত্রও কী চমৎকার জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেন! শুধু কি লেখার গুণে? নাকি অন্য ছল-কৌশলও যথেষ্ট প্রয়োগ করেন! এত বয়স হয়ে গেলেও যাঁরা প্রচন্ড ঝুঁকিহীন জীবন যাপন করতে চান, মুখে কুলুপ এঁটে বাঁচতে চান, ক্ষমতার সঙ্গে আপোস করতে কোনও দ্বিধা করেন না — তাঁরা মানুষের আদলে কতটুকু অমানুষ জানতে ইচ্ছে করে। আত্মম্ভরী মানুষটি জেনেছেন সমাজে আদরণীয় হতে হলে তসলিমা-বিরোধী হতে হবে। তসলিমার বিরুদ্ধে পাহাড় সমান অন্যায় ঘটলেও একটি অন্যায়ের প্রতিবাদ করা যাবে না, করলেই জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়তে পারে! বরং তসলিমাকে অবজ্ঞা করলে, তসলিমার কুৎসা রটালে, তাকে ঘৃণা করলে জনপ্রিয়তা বাড়তে পারে। গুণের হিসেবটা, আমার আশংকা হয়, হয়তো এমনই কুৎসিত। আমার সঙ্গে কি তিনি ফরহাদ মজহারের মৌলবাদি চরিত্র নিয়ে কথা বলেননি এককালে? আজ আমাকে আর মজহারকে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে অসৎ বলছেন। কী আশ্চর্য হঠকারিতা!

বাংলাদেশে আমার দ্বিখন্ডিত বা প্রকাশ হওয়ার পর চরিত্রহীন পুরুষ-লেখকদের আস্ফালন দেখেছি। একটি পুরুষ-লেখককেও দেখিনি বাকস্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়াতে। সৈয়দ শামসুল হক ময়মনসিংহে আমার কাছে গিয়ে গিয়ে তাঁর শালি এবং কচি কচি মেয়েদের সঙ্গে তাঁর প্রেম কতটা গভীর এবং শারীরিক তার গল্প শোনাতেন। এক মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কের গল্প আরেক মেয়েকে শুনিয়ে হয়তো যৌনানন্দ পেতেন। আর আমি যখন সে কথা আমার আত্মজীবনীতে উল্লেখ করলাম, নির্লজ্জ লোকটি আমাকে মিথ্যুক বললেন। সত্য কথা বললে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। বিচারে আমি দোষী সাব্যস্ত হই। তাঁরা, চরিত্রহীনেরা, অত্যন্ত সহজে জিতে যান। আসলে তাঁরা জেতেন না, তাঁদের পুরুষাঙ্গ জেতে। সমাজ তো পুরুষাঙ্গ-পূজারি। এই সমাজ হিপোক্রিট পুরুষদের গলায় মালার পর মালা পরিয়ে ধন্য হয়। রাষ্ট্র ধন্য হয় তাঁদের চিকিৎসার খরচ বহন করে। লেখক হয়ে অন্য লেখকের মত প্রকাশের অধিকারে বাধা দিতে তাঁদের সামান্য সংকোচও হয় না। আমার বইটি সৈয়দ শামসুল হক আদালতে গিয়ে নিজের লোকবল খাটিয়ে নিষিদ্ধ করেছেন। বইটি আজও নিষিদ্ধ। তাঁর মৃত্যুর পরও নিষিদ্ধ। আমার বই নিষিদ্ধ হওয়ার পক্ষে যে লোকগুলো, যে হিপোক্রিটগুলো—তাঁরাই মত প্রকাশের অধিকারের পক্ষে টেলিভিশনের টক-শোতে গিয়ে বাহারি সব কথা বলে আসেন। লোকে বেজায় শব্দ করে হাততালি দেয়।

আমাকে 'চরিত্রহীন' আখ্যা দিয়ে হুমায়ুন আজাদ, এক চরিত্রহীন পুরুষ-লেখক, কী যৌনানন্দই না পেয়েছেন জীবনে! অসভ্য, অসৎ এবং দুশ্চরিত্র লোকেরা মেয়েদের অশ্লীল গালিগালাজ করে নিজেরা সৎ সাজার চেষ্টা করেন। নারীবিদ্বেষী হুমায়ুন আজাদ বিভিন্ন বই থেকে টুকে নারী নামের বই লিখেছেন, রাতারাতি জনপ্রিয় হওয়ার ইচ্ছেয়। তাঁর ধারণা নারীর পক্ষে লিখে আমার জনপ্রিয়তা হয়েছে; সুতরাং এই জনপ্রিয়তা তাঁর যে করেই হোক চাই। টুকে লেখা 'গবেষণা গ্রন্থ'টি থেকে নাকি আমি টুকেছি – এমন একটা অপবাদও তিনি দিয়েছেন। হিপোক্রেসির চূড়ান্ত। তাঁর 'গবেষণা গ্রন্থ' নিয়ে একটা গবেষণা হলেই সব সত্য বেরিয়ে আসবে। বেরিয়ে আসবে যে আমার নারীবাদী লেখাগুলো জাতীয় পত্রিকাগুলোয় বেরিয়েছে ৮৬ সাল থেকে, ১৯৯১ সালে প্রকাশিত হয়েছে আমার নির্বাচিত কলাম। আর, হুমায়ুন আজাদের নারী বইটি বেরিয়েছে ১৯৯২ সালে, যে বছর আমি আমার নির্বাচিত কলাম-এর জন্য আনন্দ পুরস্কার পাই। আমার নারীবাদী লেখাগুলো যে তাঁর গবেষণা গ্রন্থের আগে লেখা, এবং টোকাটুকির কাজ যে আসলে তিনিই করেছেন তা নিয়ে গবেষণা করার লোক কোথায়? মুশকিল হলো, এই গবেষণা করার ইচ্ছে কারওর নেই, কারণ সবারই স্বভাব হলো, পুরুষলোক যা বলে তা বিশ্বাস করা। পুরুষলোককে জ্ঞানী ভাবার, বুদ্ধিমান এবং বুদ্ধিজীবী ভাবার প্রবণতা আমাদের সমাজে ভয়ংকর। নির্মলেন্দু গুণ একবার তাঁর একটি আত্মস্মৃতিতে লিখেছিলেন, হুমায়ুন আজাদ তসলিমার নারীবাদি কলাম পড়েই নারী লেখা শুরু করেছিলেন। এই কথা এখন হয়তো চেপে যাবেন গুণ। হুমায়ুন আজাদের মুরিদেরা তাদের নারীবিদ্বেষী প্রভুকে 'নারীবাদী' খেতাব দিয়েছে! যে-লোক শামসুর রাহমান কোনও একজন অভিনেত্রীর সঙ্গে টেলিভিশনের অনুষ্ঠান করেছেন বলে বলেছিলেন, 'শামসুর রাহমানকে একটি অভিনেত্রীর সাথে টিভিতে দেখা গেছে। শামসুর রাহমান বোঝেন না কার সঙ্গে পর্দায়, আর কার সঙ্গে শয্যায় যেতে হয়', যে-লোক নারীদের অত্যন্ত জঘন্য ভাষায় অপমান করেছেন, তাঁকে নারীবাদী খেতাব যারা দেয়, তারা জানে না নারীবাদের সঠিক অর্থ কী।

কুৎসা রটানোর প্রতিভা হুমায়ুন আজাদের সাংঘাতিক। একবার লিখলেন, 'আমি বইটি পড়ার উপযুক্ত মনে করিনি বলেই পড়ি নি। এই বইয়ে আমাকেও নানারকম গালাগালি করা হয়েছে, মিথ্যা কথা লেখা হয়েছে। কিন্তু আমার সম্পর্কে কোন যৌনতার অভিযোগ আনতে পারেনি। কারণ আমি কখনই তসলিমার ডাকে সাড়া দিইনি। সম্প্রতি প্রকাশিত 'ক' বইটি সম্পর্কে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় পড়ে আমার মনে হয়েছে, এটি একটি পতিতার নগ্ন আত্মকথন অথবা নিকৃষ্টতম জীবের কূরুচিপূর্ন বর্ণনা।' — আমার সম্পর্কে মিথ্যে উচ্চারণে হুমায়ুন আজাদের কোন অসুবিধে হয় না। নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের নামী অধ্যাপক তিনি, বলে ফেললেন 'তসলিমার ডাকে আমি সাড়া দিইনি'! যেন আমি তাঁকে ডেকেছিলাম কোনওদিন! একজন ডাক্তার, তার ওপর জনপ্রিয় লেখক, বিভিন্ন দেশ থেকে সাহিত্য পুরস্কারসহ প্রচুর মানবাধিকার পুরস্কার পাওয়া প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন নারীর আত্মজীবনীকে তিনি বলে দিলেন, 'পতিতার নগ্ন আত্মকথন এবং নিকৃষ্টতম জীবনের কূরুচিপূর্ন বর্ণনা।' প্রচণ্ড নারী-ঘৃণাকারী বদমাশও কোন নারী সম্পর্কে না জেনে না বুঝে এই মন্তব্য করতো না।

হুমায়ুন আজাদের একটি প্রবচনে দেখেছি লেখা, 'এখানে কোনো কিছু সম্পর্কে কিছু লেখাকে মনে করা হয় গভীর শ্রদ্ধার প্রকাশ। গাধা সম্পর্কে আমি একটি বই লিখেছি, অনেকে মনে করেন আমি গাধার প্রতি যারপরনাই শ্রদ্ধাশীল। গরু সম্পর্কে আমি একটি বই লিখেছি, অনেকে মনে করেন গরুর প্রতি আমি প্রকাশ করেছি আমার অশেষ শ্রদ্ধা। নারী সম্পর্কে আমি একটি বই লিখেছি। একটি পার্টটাইম পতিতা, যার তিনবার হাতছানিতেও আমি সাড়া দিই নি, অভিযোগ করেছেন, নারী সম্পর্কে বই লেখার কোনো অধিকার আমার নেই, যেহেতু আমি পতিতাদের শ্রদ্ধা করি না, অর্থাৎ তাদের হাতছানিতে সাড়া দিই না'।

কত ভয়ঙ্কর নারীবিদ্বেষীর উচ্চারণ এসব! কাউকে দেখিনি তাঁর নারীবিদ্বেষী আচরণের প্রতিবাদ করতে। আমি একাই প্রতিবাদ করেছি। আমি একাই দাঁড়িয়েছি স্রোতের বিপরীতে। দুশ্চরিত্র পুরুষ-লেখকদের মুখোশ আমি একাই খুলতে চেষ্টা করেছি, আর এ কারণে আমাকে প্রতিদিন ছিঁড়ে খেতে আসে একশ হায়েনা।

আরও একজনের কথা না বললেই নয়। কবি হেলাল হাফিজের ফেসবুক পোস্টে প্রায়ই দেখি মেয়েদের কাঁধে বা হাতে হাত রেখে ছবি তুলছেন তিনি। টিভিতে বা মঞ্চে তাঁর ছবি, তাঁর বহু পুরোনো কবিতার অংশ এবং নতুন নতুন মেয়েদের সঙ্গে তাঁর নতুন নতুন ফটো –– মূলত এসবই তিনি পোস্ট করেন। প্রায় প্রতিটি মেয়েকে উদ্দেশ্য করে তিনি প্রেম আওড়ান। ওদের নিজের 'প্রেমিকা' বলে দাবি করেন। অগুনতি মেয়ের সঙ্গে তাঁর প্রেমের কাহিনীও তিনি বর্ণনা করেন টেলিভিশনে, পত্র-পত্রিকায়। এক সময় টাকার বিনিময়ে ধনী মহিলাদের সঙ্গে যৌন-সম্পর্ক করতেন, তাও বলেছেন। তার পরও তাঁর আকাশ-ছোঁয়া জনপ্রিয়তা এতটুকু ম্লান হয়নি। যদি কোনও নারী-কবি এই কাজটি করতেন? তাঁকে নিশ্চিতই রেহাই দিত না এই সমাজ। তাঁকে 'বেশ্যা' তো বলতোই, হয়তো ঘর থেকে টেনে বের করে তাঁকে কুপিয়ে মেরে ফেলতো। একই কাজ করে পুরুষ-লেখক পায় সম্মান, নারী-লেখকের জোটে চরম অসম্মান।

ফেসবুকের উইমেন চ্যাপ্টার ব্লগে কিছু নারী আজকাল নারীবাদি লেখা লিখছেন, এদের বিরুদ্ধেও পুরুষেরা ছুঁড়ে দিচ্ছে ঘৃণা। আমি না হয় আশির দশক থেকে একা সয়েছি পুরুষতান্ত্রিক অপমান! একা প্রতিবাদ করেছি। এখন অনেক মেয়ে প্রতিবাদ করছে। দেখে ভালো লাগে প্রচুর মেয়ে এখন গর্জে উঠছে। সাহিত্যের জগত নারীবিদ্বেষী পুরুষেরা দখল করে আছে, এই হিপোক্রিটদের কবল থেকে সাহিত্যের জগতকে বাঁচাতে হলে সৎ এবং সাহসী নারীবাদি লেখকের প্রয়োজন।