সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের অগ্রন্থিত সাক্ষাৎকার: বাংলাদেশের সাহিত্যিকদের ‘কলকাতা জ্বর’ কাটিয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে হবে

মাহমুদ হাফিজ
Published : 11 Nov 2019, 02:24 PM
Updated : 11 Nov 2019, 02:24 PM


ভূমিকা: প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ষাটতম জন্মদিনের আগের দিন এই সাক্ষাৎকারটি নিই। ৮২ বছর বয়সে ২০১২ সালে তিনি মারা যান এবং এটি প্রকাশিত হতে যাচ্ছে তারও বহু বছর পর। সময়ের স্রোত প্রবহমান। এর মধ্যে পশ্চিমবাংলা ও বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতিতে অনেককিছু ঘটে গেছে। শিল্প-সাহিত্য কার্যত কালজয়ী। সময় গড়িয়ে গেলেও সাহিত্য বিচারে সাক্ষাৎকারটি এখনো জীবন্ত ও কাললগ্ন। দীর্ঘবছর পর এটি প্রকাশের জন্য দেয়ায় এই ভূমিকার অবতারণা।
কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩০ সালের ১৪ অক্টোবর। এ সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করি ১৯৯০ সালের ১৩ অক্টোবর, কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা অফিসে, তার কর্মস্থলে। বাংলাদেশের একজন উদীয়মান সাহিত্যকর্মী হিসেবে কলকাতায় গিয়ে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের জন্য যোগাযোগ করলে তিনি কিছু শর্ত দিয়ে সাক্ষাৎকারে রাজি হন। শর্ত হচ্ছে, আগে প্রশ্ন পাঠাতে হবে, প্রশ্ন দেখে তিনি সময় দেবেন এবং তাঁর সামনেই সাক্ষাৎকারটি সংক্ষিপ্ত আকারে লিখতে হবে। পুরো সাক্ষাৎকারের উত্তরগুলো দেখে তিনি তাতে স্বাক্ষর করে দেবেন।
এসব শর্তে সম্মত হয়ে অনেকগুলো প্রশ্নের খসড়া তাঁকে পৌঁছে দিই। প্রশ্ন দেখে সম্মত হওয়ার পর সাক্ষাৎকারের জন্য তিনি সময় দেন। নির্ধারিত তারিখে বিকাল সাড়ে পাঁচটায় তাঁর অফিসে উপস্থিত হই । চা'বিস্কুটের প্রাণবন্ত আড্ডার মধ্যে এই সাক্ষাৎকারের আলাপচারিতা প্রায় দুইঘন্টা ধরে চলে। সাক্ষাৎকার সারাংশ লিখে তাঁর কাছে দেয়ার পর তিনি গভীর মনোযোগসহ পড়েন। পরে শেষপাতায় কোণে দলিল স্বাক্ষর করার আদলে স্বাক্ষর করে নিচে তারিখ দেন ১৩ অক্টোবর ১৯৯০।

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ মুর্শিদাবাদ জেলার খোশবাসপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। আমার বাবার নাম সৈয়দ আবদুর রহমান ফেরদৌসী, মায়ের নাম আনওয়ারা বেগম। কলেজ অব্দি লেখাপড়া করেন তিনি। তাঁর ভাষায় তিনি এক 'ঘর পালানো কিশোর'। কিশোর বয়সেই বাড়ি থেকে পালিয়ে রাঢ় বাঙলার পাঁচালি গাইতে লোকনাট্যদল 'আলকাপে'র সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। জেলায় জেলায় ঘুরে নাচ গান অভিনয়ে মেতে ওঠেন। পরে স্কুলজীবন শেষ করে বহরমপুর কলেজে লেখাপড়া করেন।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবনে তিনি কলেজ অব্দি লেখাপড়া করেছেন। তবে তাঁর জ্ঞান ও নিরবিচ্ছন্ন চর্চা তাকে ভারতের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী হিসাবে বিদ্বানসমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ইতিহাস,সমাজতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব, বিজ্ঞান, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব – সব বিষয়েই তাঁর বিস্ময়কর জ্ঞান ও বিদ্যার গভীরতা তাঁকে পণ্ডিতমহলে উচ্চ আসন দিয়েছে।
আনন্দবাজার পত্রিকায় সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি নিরবচ্ছিন্ন সাহিত্যচর্চা চালিয়ে গেছেন এবং দেড়শ উপন্যাস ও তিন শতাধিক ছোটগল্প সৃজন করেন। তাঁর "ইন্তি, পিসি ও ঘাটবাবু", "ভালোবাসা ও ডাউনট্রেন", "তরঙ্গিনীর চোখ", "জল সাপ ভালোবাসা", "হিজলবিলের রাখালেরা", "রণভূমি", "উড়োপাখির ছায়া", "রক্তের প্রত্যাশা", "মৃত্যুর ঘোড়া", "রানীরঘাটের বৃত্তান্তসহ অসংখ্য ছোটগল্প পাঠকমহলে সাড়া জাগায়। তাঁর উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে, "নীলঘরের নটী" অলীক মানুষ, "নির্জন গঙ্গা", "মায়া মৃদঙ্গ", "পিঞ্জর সোহাগিনী", "ছবির মানুষ", "কালের প্রহরী", "কিংবদন্তীর নায়ক","হিজলকন্যা", "আশমানতারা", "উত্তর জাহ্নবী", "তৃণভূমি", "প্রেমের প্রথম পাঠ", "বন্যা", "নিশিমৃগয়া", "কামনার সুখদুঃখ", "নিশিলতা", "এক বোন পারুল", "কৃষ্ণা বাড়ি ফেরেনি", "নৃশংস", "রোডসাহেব","জানগুরু"ইত্যাদি।লেখকের গল্প ও একাধিক গ্রন্থ ইংরেজীসহ ভারতের প্রায় সব স্বীকৃত ভাষায় অনূদিত হয়েছে। কিশোর পাঠকদের উপযোগী তাঁর "গোয়েন্দা কর্নেল" রহস্য চরিত্র বিপুল জনপ্রিয়তা পায়।
ভারত সরকারের সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের নরসিংদাস পুরস্কার, রাজ্য সরকারের বঙ্কিম পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কা, সন্তোষ স্মৃতি পুরস্কারসহ সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ অসংখ্য পুরস্কার লাভ করেন।
২০১২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর কলকাতায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এই প্রখ্যাত সাহিত্যিকের মহাপ্রয়াণ ঘটে।

মাহমুদ হাফিজ: বাংলাদেশে আপনার সম্পর্কে পাঠকদের কৌতূহল ও আগ্রহ আছে, বাংলাদেশের সাহিত্য চর্চা নিয়ে আপনার আগ্রহ কেমন?
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ: ভীষণ কৌতূহল আছে। অনেকে বইপত্র পাঠিয়েও থাকেন। বাংলাদেশ থেকে ব্যাপক বইপত্র আসে না। নিজের আগ্রহে যতোটুকু জানতে পারি এই আর কি! তবে একই ভাষায় যেহেতু দুটি দেশে সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা হয়, সেহেতু জানার প্রবল আগ্রহ থাকাটাই স্বাভাবিক। সে আগ্রহ আমার সবসময়ই ছিল, আছে।
মাহমুদ হাফিজ: কোন সৃজনশীল রচনার শিল্পসফল হওয়ার পূর্বশর্ত কী?
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ: জন্মগত প্রতিভা ও ক্ষমতা আসল। সে ক্ষমতাকে কাজে লাগানোর জন্য প্রচুর চর্চা প্রয়োজন। বিবিধ বিষয়ে পড়াশুনা, জীবন সম্পর্কে কৌতুহল, পর্যবেক্ষণ-প্রবণতা ইত্যাদি লেখকের মধ্যে থাকতে হবে। বড় কথা, ভাষাকে সুন্দরভাবে ব্যবহারের ক্ষমতা অর্জন করতে হবে।
মাহমুদ হাফিজ: উপন্যাস বা ছোটগল্পে আপনি কিভাবে জীবনকে তুলে আনেন, আনতে চান ?
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ: সাহিত্য তো বাস্তব জীবনের একটি নতুন রূপ। বাস্তব জীবনকে দিয়ে অন্য একটি জীবনের সৃষ্টি। আমার ব্যাক্তিগত মতে, সৎ সাহিত্যিকের কাজ হলো, ইতিহাসের মানুষকেই খুঁজে বের করা। অর্থ্যাৎ যে মানুষ ইতিহাস গড়ছে, তাকে খোঁজা। আমার সকল লেখাতেই এভাবে জীবন অন্বেষার চেষ্টা করেছি।
মাহমুদ হাফিজ: ঢাকা বাংলা সাহিত্য চর্চার আরেকটি কেন্দ্র, এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ: নিশ্চয়ই পারে। ভাষা এক হলেও দেশ যেহেতু দু'টো, অতএব দু'দেশের কেন্দ্র তো দু'টো হবেই। এখানকার কলকাতা, ওখানকার ঢাকা। আমি দেখেছি, বাংলাদেশের লেখকেরা কলকাতা বা কলকাতার লেখকদের নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগেন। ঠাট্টা করে আমি একে বলি, বাংলাদেশের লেখকদের 'কলকাতা জ্বর'। এটা কাটিয়ে ওঠা দরকার।
মাহমুদ হাফিজ: বাংলাদেশের বইপত্র, সাহিত্য কর্ম এই বাংলায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আসে না। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক বিনিময় সমতার ভিত্তিতে হওয়া উচিৎ বলে কি আপনি মনে করেন?
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ: নিশ্চয়ই চাই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের পাঠক সম্ভবত বাংলাদেশের সাহিত্য সম্পর্কে ততোটা আগ্রহী নন। কারণটা বলতে হলে অপ্রিয় সত্য উচ্চারণ করতে হয়। তাহলো ধর্ম সম্প্রদায়ঘটিত ব্যাপার। বাঙালি মুসলিম পাঠক হিন্দু জীবন সম্পর্কে যতোটা আগ্রহী, বাঙালি হিন্দু পাঠক (তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি) স্বাভাবিক মুসলিম জীবন সম্পর্কে ততোটা আগ্রহী নন।
মাহমুদ হাফিজ: ধর্ম, ভাষাগত উচ্চারণগত ভিন্নতা, জীবনযাত্রার মান-এরকম বহুবিধ কারণে ঢাকার সাহিত্য, কলকাতার সাহিত্য থেকে আলাদা-এ সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী?
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ: সে তো হবেই। আমেরিকার ইংরেজি, বৃটেনের ভাষাও ইংরেজি। তাই বলে দু'দেশের সাহিত্যের ভাষা (আক্ষরিক অর্থে নয়) কখনোই এক নয়। আর বিশেষ করে ঢাকা, কলকাতার ক্ষেত্রে ধর্ম ব্যাপারটা একটা বড় সমস্যা। মুসলিম জীবনের আচার, আচরণ, ধর্মচর্চা ও নিয়ম-নীতি, খাদ্যাভ্যাস আর জীবনের সমগ্রতাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত ঢাকার সাহিত্য। কলকাতার হিন্দু জীবন ও সনাতন ধর্ম সংস্কৃতি বা সামগ্রিক জীবনের বাস্তবতায় গড়ে উঠেছে কলকাতার সাহিত্য। তবে সাহিত্যবিচারে ধর্ম বাধা হওয়া বা বিবেচ্য হওয়ার কোন কারণ নেই। কিন্তু উপমহাদেশ এমন একটি জায়গা, যেখানে ধর্ম শিল্পের ক্ষেত্রে বিপজ্জনক উপাদান।
মাহমুদ হাফিজ: বর্তমানে উপন্যাস ও ছোটগল্পে বিষয়বৈচিত্র থাকলেও আঙ্গিক গতানুগতিক। এই ঘুর্ণমান অনুকারবৃত্তি থেকে আজকের সাহিত্যের মুক্তি কোথায়?
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ: সমকাল কখনো সমকালের সৃষ্টির প্রতি সুবিচার করেত পারে না। হাফিজ, যে প্রশ্নটা করেছেন, বঙ্কিমযুগেও একরমের প্রশ্ন করা হতো। বরাবরই এ জাতীয় কথা বলা হয়ে থাকে। আমার মতে, আজকের সাহিত্য শুধু বিষয়বৈচিত্র্যে নয়, আঙ্গিকের দিক থেকেও নতুনত্ব হাজির করেছে। কিন্তু ওই যে বললাম, সমকাল সমকালের সাহিত্যকে খুব সুবিচার করতে পারে না। আজকের সাহিত্যের সঠিক মুল্যায়ণ ভবিষ্যতেই কেবল হতে পারে।
মাহমুদ হাফিজ: বাংলাদেশের সাহিত্যসেবীদের উদ্দেশে আপনার পরামর্শ?
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ: পরামর্শ দেয়ার ইচ্ছে ও যোগ্যতা কোনটিই আমার নেই। তবে মনে করি, বাংলাদেশের সাহিত্যিকদের 'কলকাতা জ্বর' কাটিয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে হবে। নিজেদের হীনমন্যতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কলকাতার সাহিত্যের প্রতি তোষামোদপ্রিয়ভাব কাটাতে হবে। বাংলাদেশের সাহিত্যিকদের মনে রাখতে হবে, যে জাতি মাতৃভাষার জন্য আন্দোলন করে একে প্রতিষ্ঠা করেছে এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে, তাদের সাহিত্যও স্বাধীন। সে সাহিত্য মূল্যায়ণপ্রশ্নে কারো মুখাপেক্ষী হওয়ার প্রয়োজন নেই।
মাহমুদ হাফিজ: বাংলাদেশের সাহিত্য সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ণ কী?
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ: বাংলাদেশের সাহিত্য খুবই সম্ভাবনাপূর্ণ। বিশেষ করে কিছু কিছু মহিলা সাহিত্যিকের লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। এক্ষেত্রে একটি নাম উল্লেখ না করলে অবিচার করা হবে, তিনি হচ্ছেন সেলিনা হোসেন। আমার মতে, মহিলাদের মধ্যে তারঁ সমকক্ষ সাহিত্যিক পশ্চিমবঙ্গেও নেই। পুরুষলেখকদের মধ্যে, হাসানা আজিজুল হক, শওকত আলী, শওকত ওসমান, রশিদ হায়দারসহ আরও অনেকের শক্তিশালী লেখা পড়েছি। অনেকে আছেন, যাঁরা নিজেরা স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে ফেলেছেন।
মাহমুদ হাফিজ: বাংলাদেশে সাহিত্যিকদের মধ্যে বিভাজন ও গ্রুপিং সম্পর্কে জানেন কী?
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ: হ্যাঁ, সম্যক ধারণা আছে। এটা মনে হয় বাঙালির স্বভাব। দলাদলি, গ্রুপিং ইত্যাদি বাঙালি যেখানে আছে, সেখানেই আছে। এ ক'রে সাহিত্যের ক্ষতি ছাড়া লাভ যে কিছু হয় না, সেটাও সবাই জানে।
মাহমুদ হাফিজ: শামসুর রাহমান না আল মাহমুদ- কে বড় কবি এ নিয়ে বাংলাদেশে বিতর্ক আছে।….
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ: কে বড় কে ছোট শিল্প সাহিত্যে এ ধরনের প্রশ্ন বোকামি বলে মনে করি। তবে আমার ব্যাক্তিগত মত বলতে পারি, আল মাহমুদ দুই বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি বলে মনে করি। জীবনান্দ দাশের পর তাঁকে স্থান দিই। আল মাহমুদ জীবনের খুব গভীরে যান। জীবনের শেকড় থেকে তিনি কাব্যমসলা সংগ্রহ করেন। তাঁর কবিতায় হিন্দু-মুসলমান এই অসাম্প্রদায়িক চেতনা দেখতে পাই। তিনি প্রাচ্যীয় মিথ ব্যবহারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত অসাম্প্রদায়িক ও উদার। এ গুণ তাঁর কবিতাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করেছে। আজকাল তাঁকে বদনাম করা হয়, তিনি খুব ধার্মিক হয়েছেন ইত্যাদি। তিনি হজ্জ্ব করেছেন কিনা, ধার্মিক হয়েছেন কিনা-সাহিত্য বিচারে আমাদের জানার প্রয়োজন নেই। তাহলে তো বাংলা সাহিত্যের বহু রথী-মহারথীকে নস্যাৎ করে দিতে হয়। ধর্ম ব্যাক্তির একান্ত নিজস্ব ব্যাপার। বিশ্বসাহিত্য বিচারের ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য।
মাহমুদ হাফিজ: আপনার গল্প খুব জনপ্রিয়। আপনার নিজের প্রিয় গল্প সম্পর্কে জানতে চাই।
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ: দেখুন, লেখকের কাছে তার সব সৃষ্টিই প্রিয়। পাঠকের কাছে প্রিয় নয়, এমন গল্পও আমার কাছে প্রিয়। কারণ সেই পাঠক অপ্রিয় গল্পও তো আমারই সন্তান, আমারই সৃষ্টি। সম্প্রতি 'আমার প্রিয় গল্প' নামে একটি সংকলন বেরিয়েছে মন্ডল এ্যান্ড সন্স প্রকাশনা সংস্থা থেকে। এই প্রকাশনীর ঠিকানা শ্যামাচরণ স্ট্রীট, কলকাতা-৭৩। এই বইয়ের সব গল্প হয়তো সব পাঠকের প্রিয় নয়, কিন্তু আমার কাছে প্রিয়। এই সংকলনে অন্তর্ভূক্ত 'মৃত্যুর ঘোড়া' শীর্ষক গল্পটি আমার সবচেয়ে প্রিয়। (এই গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় 'একালের বাংলা গল্প', রামায়ণ-১৯৬৫)।
মাহমুদ হাফিজ: কেন প্রিয়?
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ: প্রিয় কেন? কারণ এই গল্পে আমার ব্যাক্তিজীবনের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। তাছাড়া আমার লেখার দার্শনিক বোধটিই ওখানে প্রচ্ছন্ন। তাহলো, মৃত্যু চেতনা। মানুষের জীবনে মৃত্যুর মতো অবধারিত সত্য বলে আর কিছু নেই। একটি বিষয়েই পুরোপুরি একশ'ভাগ সত্য হিসাবে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায়, তা হচ্ছে মৃত্যু। মৃত্যুর অনিবার্যতা থেকে মানুষের মুক্তি নেই। আমার সকল লেখার দার্শনিক ভিত্তি এই মৃত্যুর অনিবার্যতা। তাই মৃত্যু চেতনা আমার লেখার মধ্যে ঘুরে ফিরে এসেছে। তাই কেউ যদি বলে আমার লেখার মৃত্যুর উপস্থিতি বেশি, তাহলে সেটা ভুল বলা হবে না।