পিতৃপুরুষ ও উত্তরসাধকদের শিল্প

মইনুদ্দীন খালেদ
Published : 5 April 2017, 02:04 PM
Updated : 5 April 2017, 02:04 PM

বাংলাদেশের আধুনিক চিত্র ঐতিহ্যের কাল-গণনা কখন থেকে শুরু হতে পারে? এ প্রশ্নের উত্তরে নিশ্চিতভাবে বলা যায় তা হবে অবিভক্ত বাংলার শিল্পচর্চার ইতিহাসের ১৯৩০-এর দশক থেকে। এ দশকের শেষে জয়নুল আবেদিন জলরংয়ের ভূদৃশ্য এঁকে সর্বভারতীয় আয়োজনে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার অর্জন করেন। জয়নুলের বিষয় ছিল তখনকার পূর্ববঙ্গ, আজকের বাংলাদেশের নদীতীরবর্তী মনোহর প্রকৃতি। এই ছিল নিখিল ভারতের শিল্পচর্চার ব্যাপ্ত প্রেক্ষাপটে স্বাতন্ত্র্যের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত পূর্ববঙ্গজ শিল্পের আবির্ভাব।

গত শতকের তিরিশের দশক থেকে এই নবীন শতক অবধি কাল বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশের চারুশিল্পের আধুনিকতা পঁচাত্তর বছর বয়সী। জয়নুল সর্বাগ্রগণ্য, আমাদের শিল্পচর্চার পিতৃপুরুষ। এ উপমহাদেশের শিল্পচর্চাও তার হাতে বিশেষ বাঁক নিয়েছে। তাই শুধু বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বিবেচনায় নয়, মহাভারতেরও তিনি অন্যতম ঋত্বিক; নিরীক্ষা-ধর্মিতার দাবিতে যুগপুরুষ।

তিরিশের দশকের ক্রান্তিকালে কলিকাতাকেন্দ্রিক চর্চায় মেধাবী উত্থান ঘটে সফিউদ্দিন আহমেদের। তার ছাপচিত্রে বিশেষ সূক্ষ্ণদর্শিতা পরিকীর্ণ হয় উডকাটে। চল্লিশের দশকের দুঃসহ অগ্নিগর্ভ সময়ে কালের বৈশিষ্ট্য ডাগর ভাষায় জানান দিয়ে সেই চারুমঞ্চে আবির্ভূত হন কামরুল হাসান।

জয়নুল, কামরুল ও সফিউদ্দিন–এই তিন পিতৃপুরুষ রচনা করেছেন বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পচর্চার ভিত। তারপর পঞ্চাশের দশকের সারথিরা নানা প্রান্তে পৌঁছেছেন শিল্পের সেই রথে। একজন মোহাম্মাদ কিবরিয়া, দশকের হিসেবে ওই সারথিদের সমকালিন হলেও বিমূর্ত ধারায় ধ্যান করে ফলালেন নতুন ফসল। বস্তুত বাংলাদেশে যে বিমূর্ত শৈলীর দর্শণীয় বিকাশ ঘটেছে এ শিল্পীই তার আদি পুরোহিত। ওই তিন পিতৃপুরুষ আর এক বিমূর্ত শৈলীর অগ্রনায়ক আর সাত জন উত্তরসাধক আমিনুল ইসলাম, মুর্তজা বশীর, আব্দুর রাজ্জাক, রশিদ চৌধুরী, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, রফিকুন নবী ও মনিরুল ইসলামসহ এগার জন শিল্পীর কাজ নিয়ে দেশের স্বনামধন্য প্রদর্শনশালা 'গ্যালারী চিত্রক' আয়োজন করেছে 'প্রদর্শনী- ২০১৭'। নির্বাচিত শিল্পীদের শিল্পকর্মগুলো এ দেশের চিত্রসাধনার রূপরেখা অনুধাবনে শিল্পরসিকদের মনের অনুভূতিকে নতুন করে সজীবতা দেবে। আজও আমরা আমাদের আধুনিক শিল্পের স্থায়ী জাদুঘর বা সংগ্রহশালা গড়ে তুলতে পারিনি। এ কারণেও চিত্রক-এর আয়োজন বিশেষভাবে গুরুত্ববহ। গুরুশিল্পীদের গুরুত্বপূর্ণ শিল্পের অরিজিনাল বা আদত রূপ প্রত্যক্ষ না করলে শিল্পপ্রিয় মানুষের তৃষ্ণা কি মেটে!

জয়নুল আবেদিন

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন আছেন ছাত্রজীবন থেকে শুরু শুরু করে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের শিল্পসাক্ষী নিয়ে। জয়নুলে আবছায়া নেই, আছে অভূতপূর্ব স্পষ্টতা। জোর তার রেখায় আর বলিষ্ঠ গড়নের জ্যামিতিতে। চর্চার কেন্দ্র তার প্রধানত মানুষ। মানুষের দেহ শিল্পাচার্যের সাধনার প্রধান লক্ষ্য। দেহের বাঁক-ভঙ্গি বোঝার জন্য কলিকাতার সরকারি আর্ট স্কুলের ছাত্রজীবন থেকেই যে ছিল তার গভীরতর অভিনিবেশ তা ড্রইংগুলো দেখলে সহজেই অনুমেয় হয়ে ওঠে। ছাপাই ছবির দক্ষতার সাক্ষী দিচ্ছে তার 'মা ও শিশু' নামের উডকাট প্রিন্ট। আছে একটা দুর্ভিক্ষ-চিত্র। এই চিত্রমালাই ভারতশিল্পে নতুন মুক্তি এনেছে; বিষয় বিবেচনা ও শিল্পভাষার নিরীক্ষা, উভয় ক্ষেত্রেই। দুর্ভিক্ষপীড়িত হাড্ডিসার মানুষ আঁকা মানে শুধু মানুষটি আঁকা নয়; বিপন্ন মানবতাকে দ্রষ্টব্য করে তোলা।

শুধু কলাকৈবল্যে দক্ষতা অর্জন নয়, আরও এক গভীর মমতায় মানুষকে ভাল না বাসলে এ ছবির জন্ম হয় না। শিল্পাচার্যের দুর্ভিক্ষের ছবি আসলে একটা নির্মম কালের বেষ্টনে মানুষী অস্তিত্বের রূঢ় জ্যামিতিক প্রকাশ। এতটা স্বচ্ছতায় আমরা এর আগে শিল্প দেখে সময়, ইতিহাস ও নিষ্ঠুরতাকে পাঠ করতে পারিনি। একাত্তরের যুদ্ধদিনে জয়নুলকে আক্রান্ত করে রাখত একটি দৃশ্য। তিনি ভাবতেন, কোনো সরলা কিশোরিকে পাকিস্তানের পশু সৈনিকেরা ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ধর্ষিতা কিশোরি-বাংলার আর্তনাদ শুনে তুলি হাতে নিয়ে বসেছেন শিল্পী। এঁকেছেন মুখরেখা মুছে-যাওয়া এক নারীমুখ। এ দেশের চিত্রশিল্পে এই ছবিটি ঐতিহাসিক গুরুত্বে সমৃদ্ধ।

কামরুল হাসান

নিজেকে পটুয়া বলতে দ্বিধা বোধ করেননি; কেননা তার জীবনদর্শনই তো লোকশিল্পীদের মত সমষ্টির মধ্যে বেঁচে থাকা। জীবনের সূচনাপ্রহর থেকে পটুয়া ডাকপ্রিয় কামরুল হাসান
লোকদর্শনের পিদিম জ্বালিয়েছেন ব্রতচারি আন্দোলনের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে। সেই থেকে শাশ্বত বাংলা, উৎপীড়িত সমকাল আর বিপরীত মেরুর নারীর অস্তিত্বের দেশে চালনা করেছেন নতুন শৈল্পিক অভিযান। একদিকে বাংলার লোককলার শৈলী আর অন্যদিকে ব্রাক-পিকাসোর কিউবিজম, এ দুইয়ের নান্দনিক মিলনের সূত্র আবিষ্কার করেছেন কামরুল হাসান। তবে পূর্ব-পশ্চিমের এই মিলনস্রোত নিশ্চিতভাবে অনেক ছবিতে ত্রিবেণিসঙ্গম তৈরি করেছে। লোকশিল্প, কিউবিজম ও ভারতীয় মূর্তিকলা ও অজন্তাশৈল্প্রীসূত যে ধ্রুপদী ভাষা, এই তিনের মিলন ঘটিয়ে বাংলার চিত্রপটে যে পটুয়া নামধারী আধুনিক শিল্পীর জন্ম হয়েছে তার সৃষ্টি নিয়ে যে-কোন বৈশ্বিক আয়োজনেই বাংলার শিল্প স্বমহিমায় উপস্থিতি জানান দিতে পারে।

চিত্রকের এ আয়োজনে শিল্পীর একটি লিথোগ্রাফ মানুষের প্রতি শিল্পীর যে দায়বদ্ধতা থাকে তা সকরুণ ভাষায় জানান দিচ্ছে। মৃত মানুষের মাংসের লোভে কাক ও শকুন গ্রীবা উড্ডীন করে বসে আছে। মানবতাকে এই বিষাক্ত ছোবল দিয়েছে কে? প্রকৃতি, না মানুষ? যা-ই হোক এই বিধুর কালো পরিসরে মানুষের মৃত্যুকে এঁকে মানবতার প্রতি কামরুল নিবিড় মমতা প্রকাশ করেছেন। রোমশ কালো গরুটি তার লোককলা ও কিউবিক ভাষায় পরিবৃত। হয়তো তা নন্দী, তাতে পুরাণ আছে, তাই মুখ তার নীল। হয়তো নন্দী নয়,এ ষাঁড়ের রূপে নীল আর লাল যোগে মেলাতে চেয়েছেন শিল্পী শুধু শিল্পেরই কোনো সমীকরণ। 'দুই নারী' ছবিটি ভাষার পরিচর্যার কারণে ও বিষয়ের গৌরবে বিশদ বিশ্লেষণ দাবি করে। পাশাপাশি দুই নারী; নারীর দুই রূপ: সরলা-কল্যাণী-মমতাময়ী আর উদ্ভিন্ন-যৌবনা-কামিনী। এক রূপে প্রীতি আর অন্য রূপে পুরুষের কামনার দৃষ্টিপাত। কামরুলের নারী অবলোকনের দ্বান্দ্বিক ভাষ্য বোঝার জন্য এ ছবি মোক্ষম উদাহরণ।

সফিউদ্দিন আহমেদ

সব শিল্পীরই বস্তু-পৃথিবীকে অন্তর্ভেদি দৃষ্টিতে আবিষ্কার করার প্রবণতা আছে। শিল্পগুরু সফিউদ্দিনের ছবিতে এ অবলোকন বিশেষ ভাষা পেয়েছে। প্রতিফলিত ও বিকিরিত আলোয় বস্তুর নানা কৌণিক রূপ চক্ষুগ্রাহ্য হয় এবং এতে স্বভাবতই নানা রেখার বিচিত্র জালও তৈরি হয়। প্রকৃতির মধ্যে আলো ও অন্ধকারের দোলাচলে যে পথ তৈরি হয় তার ভেতর দৃষ্টি চালনা করেছেন দেশের ছাপচিত্রের পথিকৃৎ শিল্পী সফিউদ্দিন। শুরুটা হয়েছিল বনচ্ছায়ায় সাঁওতাল জীবনের স্রোত এঁকে। কাঠের বুক কেটে আলোর জাল-জালিকায় একটা নৈসর্গিক পরিধিকে শিল্পী পরিস্ফুট করেছিলেন সে সব চিত্রে। তাই তখনই অর্জিত হয়েছে তার সম্মান ও স্বীকৃতি। এ পুরোধা শিল্পী ১৯৪৫ সালে লাভ করেছেন একাডেমি প্রেসিডেন্ট স্বর্ণপদক, কলিকাতার একাডেমি অফ ফাইন আর্ট থেকে। ১৯৪৬ সালে "ভিউ অফ শান্তি নিকেতন" শিরোনামে ড্রাই পয়েন্ট মাধ্যমে "বিহার হ্যারেল্ড" স্বর্ণপদক লাভ করেন ভারতের পাটনা আর্ট কাউন্সিল থেকে। ১৯৪৭ সালে সর্বভারতীয় প্রদর্শনীতে উড এনগ্রেভিং এ সাদা কালো ক্যাটাগরীতে "সাঁওতাল রমণী" শিরোনামে প্রথম পুরষ্কার এবং "হার্টস ইন দ্যা সান" শিরোনামে তেল রং মাধ্যমে আঁকা পেইন্টিং এর জন্য দ্বারভাঙ্গা মহারাজার স্বর্ণপদক লাভ করেন। তারপর যখন সেই অভিজ্ঞ চোখ তার গুনটানারত মাল্লাদের এঁকেছে অথবা কায়িক শ্রমে নিষ্ঠ অন্য জীবন ও জীবিকা দেখাতে চেয়েছে, তখনও উপরিতলের চোখচেনা রূপ না দেখে আমরা সেখানে দেখেছি কালোর ভিতর আলোর উৎসারণ।

জাল, জল, মাছ, বিশেষত মাছের চোখ ও দুয়েকটি উদ্ভিজ্জ অনুষঙ্গে সফিউদ্দিনের কাজে একটা হারমনি বা সুরসাম্য রচিত হয়। কখনও বা শল্য চিকিৎসকের মত যেন তার দৃষ্টি। তিনি ব্যবচ্ছেদের নৈপুন্য আয়ত্ত করেছেন। তাই সূর্যমুখি ফুলের বাইরের রূপ প্রদর্শন না করে বরং অন্তর্গত সংগঠনটা তিনি দেখিয়েছেন। মাছের গড়ন বা মীনসদৃশ মানুষী চোখটাই যেন এ শিল্পীর নিরীক্ষার বিষয়। আঁখি-তারাকে তিনি নানাভাবে পরিমাপ করেন। অনুভূতির অভিঘাতের খবরটা চোখের ভাষায় প্রকাশ পায়–এ সত্যকে জানাতে চেয়েছেন তিনি। চোখের আত্মজীবনী আঁকতে আঁকতে দুঃসহ ঘটনায় আক্রান্ত হয়ে নিজেকেই এঁকে ফেলেন তিনি। তার 'স্মৃতি-৭১' ছবিটিতে দেখি শিল্পী নিজেই অশ্রুপ্লাবিত অথবা নিজস্ব অশ্রুঝর্নার মধ্যে নিজেকে তিনি সমর্পণ করে রেখেছেন। অশ্রুময় এ আত্মপ্রতিকৃতিতে সফিউদ্দিনের আত্মজৈবনিক বৃত্তান্ত চোখের জলের ফোটায় আর অবয়ব নির্দেশিত রেখায় স্বচ্ছ গ্রাফিক্সে দুঃখের সঙ্গীত শোনাচ্ছে।

মোহাম্মদ কিবরিয়া

মনের মধ্যে বেশির ভাগ অনুভব ব্যাখ্যাতীত। চিন্তা দানা বাঁধে, ভাবনা ছড়িয়ে যায়। মনোভূমির এই বিধুর মানচিত্র পাথরের অন্তর্বয়নের মধ্যে যে অনিঃশেষ বিন্দুর বিচিত্র ভ্রমণ রয়েছে তা দিয়ে নিরূপণ করেছেন মোহাম্মদ কিবরিয়া। আমরা অনুভূতিকে সীমায়িত করতে পারি না। অনুভবের অন্তহীন উদগীরণের মধ্যে বেঁচে থাকতে হয়। কিবরিয়ার ছবি অনির্বচনীয় মন্ময়ধর্মিতার স্মারক। কখনো যেন বা তা অবচেতনের আঁধার। ধূসরতার রূপ পরিস্ফুটনে তার সৃজন-আবেগ তৃপ্তি পায় বা মুক্তি লাভ করে। অনির্ণেয়কে নির্মাণ করতে হলে আশ্রয় নিতে হয় ফর্মে, ফর্মের মধ্যকার রেখার কূটাভাস, বিন্দুর বুনট অর্থাৎ টেক্সচারে।

ঝাঁঝরা ফোঁপরা পাথর টুকরা, মাটির চেহারা ও নানা আয়তনের বস্তুভারের কথা আমাদের মনে হয় তার ছবি দেখে। যেন তিনি কালো ধূসর গড়নে নিজের এপিটাফ রচনা করেছেন। মনের একটা মথিত অবস্থার ঘন-ব্যঞ্জনা জন্ম নেয় তার স্পেসে। কখনো দুই প্রস্থ গড়ন শুধুই ভারসাম্যের কথা বলে। এই ভারসাম্যই তো শিল্পীর মন, শিল্পে বেঁচে থাকা জীবন। ভারী কালো গড়ন ভেদ করে এক টুকরো সাদা আলো উন্মুক্ত করে দিয়ে বিরচন বা কম্পোজিশনের গাণিতিক মীমাংসা এবং তা একই সঙ্গে বেঁচে থাকার ইশারা। কিবরিয়ার ছবির ভাষা বিমূর্ত, কিন্তু তা নিবিড়ভাবে আত্মজৈবনিক। তার নিজের মনেরই সান্ধ্যভাষা।

আমিনুল ইসলাম

মানুষ, প্রকৃতি, মাটি, জল, কোনো কিছুরই স্পষ্ট রূপ নেই। আমাদের চোখের সামনে আছে শুধু চিহ্ন; প্রতীক, মুদ্রা। এগুলোর বিলিবন্টনের হিসেব ক্ষণে ক্ষণে বদলায়।

আমিনুল ইসলাম নিরন্তর পরিবর্তনশীল দৃশ্যমানবতায় যে ডিজাইনের বা বিন্যাসের অপার সম্ভাবনা আছে তা জানাতে চেয়েছেন। নিসর্গের সাদৃশ্যকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন না করে বর্ণপ্রস্থের বুনটে দৃষ্টিনন্দন বিমূর্ত শৈলীতে পারমিতা প্রকাশ করেছেন আমিনুল। প্রকৃতি ও মানুষের অভিন্নাত্মার সম্পর্কও তার কম্পোজিশনে বিশেষভাবে দেখার বিষয়।

রশিদ চৌধুরী

রশিদ চৌধুরী লোককলার রং-রূপ-রেখা নিরীক্ষায় নিরীক্ষায় পরিশোধিত করেছেন। তার ছবিতে বর্ণ-ফলক ও অগ্নিময় বর্ণশিখা সমবেত সঙ্গীতের কলরোল শোনায়।

ঘনিষ্ঠ চোখে তাকালে আমরা সেই অগ্নিময় উত্থিত কম্পোজিশনে আবিষ্কার করি লোককলার নকশা, নারী দেহের ব্রীড়া ও ভঙ্গি এবং প্রকৃতি ও আরও অনেক প্রাণিকূলের ক্ষীণ আভাস। রশিদ চৌধুরীর ছবি যেন তারই মনের সৃজনশীলতার ঝড়ো-মুদ্রা।

মুর্তজা বশীর

সব ছবিই প্রকাশ ও অপ্রকাশের বোঝা-পড়া। রং ও রংহীনতার দ্বান্দ্বিক ভাষ্য। শূন্যতা অন্বেষণ অথবা শূন্যতার মধ্যে পরম কাউকে লাভ করা–এই ভাবনাকে যেন গ্রাফ এঁকে জানান দিয়েছেন মুর্তজা বশীর।

মুর্তজা মূর্ত যা তাকে মেনে নেন না সাদা চোখে। তারও জমিনে গড়নের গতিময় মুদ্রা প্রভাসিত। তারও অন্বিষ্ট বস্তুর অথবা নিজ অস্তিত্বের ভেতরটার রূপ উন্মোচন। বিন্দুর বুনটে অথবা জ্যামিতির জটিল হিসেবে নিজেকে পরখ করে দেখার শৈল্পিক অভিযানেরই তিনি যাত্রিক।

আব্দুর রাজ্জাক

ভূদৃশ্য আর মানুষের মুখ বহুকাল প্রিয় বিষয় ছিল আব্দুর রাজ্জাকের। ড্রইংয়ের ক্ষমতা দেখিয়ে তিনি আমাদের শিল্পের ইতিহাসে স্থায়ী আসন লাভ করেছেন। টর্নেডোতে লন্ডভন্ড প্রকৃতি, মানুষ ও পশুপাখির মৃত রূপ এঁকে তিনি সেই দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।

এ ছবি দেখলে একজন মনোযোগী দর্শকের মনে পড়ে যাবে জয়নুল আবেদিনের মনপুরা'র দৃশ্যাবলি। তবুও রাজ্জাক স্বাতন্ত্র্যের দাবিদার। এ ছবিতে তার নিজস্ব অনুভব অনূদিত হয়েছে। সতীর্থদের মত বিমূর্ত সাগরের নাবিক হয়ে আবিস্কার করেছেন বর্ণরঙিন দেশ। জ্যামিতি একটু বেশি পরিস্ফুট হলেও পরিণামে তার কাজ ইম্প্রেশনিজম।

সমরজিৎ রায় চৌধুরী

সমরজিৎ রায় চৌধুরী ইতিবোধের রঙিন ডাঙ্গায় ভেড়ান তার তরী। প্রধানত একটা উৎসবী আবহ তৈরি হয় তার কাজে। এই রূপসীবাংলায় তো মানুষের জীবন যাত্রায় ও ঋতুর আবর্তে কেবলই রঙের খেলা।

প্রাত্যহিক কর্মেও সুখ, পালা-পার্বণেও আনন্দ;জীবন কোথাও বিষন্ন দিন কাটায় না। এ শিল্পীর স্পেসে বর্ণরঙিন কৌণিক গড়ন গাটছড়ার মত ভেসে থাকে। অনেক রঙের ঘুড়ি যেন ওড়ে শিল্পীর মনের আকাশে। কখনো মনে হয় এই নদীমাতৃক বর্ণরঙিন দেশটা সতত সমরজিতের মনোদর্পণে রূপের আলেখ্য রচনা করে চলেছে।

রফিকুন নবী

সাম্প্রতিক সময়ে রফিকুন নবীর শিল্পচর্চায় বড় রকমের পরিবর্তন এসেছে। শিল্পী জীবনের উদয় পর্বে দেশের নদী-নিসর্গের সজীব সরস সংবেদিতা রূপায়িত করেছে তার তুলি। চিরন্তন বাংলার রূপ আকার পাশাপাশি 'টোকাই' নামের এক শিশু-চরিত্রের আবির্ভাব ঘটিয়েছেন তার চিত্র জমিনে। এই শিশু-কুশীলব সহজাত মনের খেয়ালে চলমান কালের বিচিত্র অসঙ্গতিকে ঠাট্টার ছলে বিদ্রুপ করে। টোকাই কখনো বা আনন্দে মেতে থেকেছে নিজেরই খেয়াল-খুশিতে। শিল্পী নবীর মনের গভীরে বিরাজ করে এই বুদ্ধিদীপ্ত বালক। একি তারই অন্য রূপ? হয়তো তাই। গ্রীসে গিয়ে ছাপচিত্রে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার পর রফিকুন নবী আরও পরিশীলিত হন। আবারও প্রকৃত ও খেয়ালী মনের বিবরণ শিল্পায়িত করেন তিনি। কিন্তু বছর কয়েক হয় বড় বড় ক্যানভাসে অনেক মানুষের মিতালি, মানুষ ও পশুর সহবস্থান, ঘর-গেরস্থালির নানা বিষয় তিনি অ্যাক্রিলিকে আঁকছেন।

মিহি বর্ণপর্দায় জমিন রচনা করে তার ওপর জমিয়েছেন অনেক মানুষের সংঘবদ্ধতার রূপ। কর্মিষ্ঠ মানুষ ও পশুর রূপায়ণে তিনি গ্রহণ করেছেন দৃঢ় ফর্ম। তার ছবিতে জীবনের গ্লানি নেই। শ্রমী মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে যে সংঘবদ্ধতার সুখ আছে তা-ই নবীর অন্বেষণ। স্নেহ, প্রীতি, বন্ধুতা, এসব তার শিল্পে অন্তর্লীন হয়ে আছে। বিজড়িত এই সব মানুষী ও অন্য প্রাণির রূপগুলো বাস্তববাদ অনুসারী নয়; কিছুটা শৈলীকৃত। জ্যামিতিকে গুরুত্ব দিয়েছেন শিল্পী মানুষ ও প্রাণিকুলের সম্পর্কের সূত্রকে জোরাল করার তাগিদ থেকে। এই সম্পর্কসূত্র আমাদের মেক্সিকোর বিখ্যাত ম্যুরালিষ্টদের কাজের কথা মনে করিয়ে দিতে পারে। যদিও রফিকুন নবী নিজস্বতায় উজ্জ্বল। এ ছবি তার দীর্ঘ পথ চলারই নতুন উদ্ভাবন।

মনিরুল ইসলাম

মনিরুল ইসলামও বিষন্নতার পথ মাড়ান না। জীবন তার কখনো অবসন্ন হয়ে পড়েনা। যদিও সংবেদনশীল সব মানুষই একা; একা তার মনোভূমে, অবলম্বনহীন তার নিজের আকাশে। তবুও চোখ খুললেই দেখা যায় প্রকৃতির রঙিন প্রসারণ। ভেসে আসে রং, রেখা মেঘের মতন।

প্রশস্ত শূন্যতার মধ্যে নীল, লাল, হলুদ, সবুজ, রাগিনীর মত বেজে যায়। নীলাভ জমিনে এক টিপ গাঢ় নীল, এক ছোপ হলুদ অথবা একটা ললিত গড়নের উপস্থিতি সেই শূন্যতাকে সঙ্গীতমুখর করে তোলে। আমার মনে হয়, মনিরুলের ছবি যত না দৃশ্যগ্রাহ্য, তার চেয়ে বেশি তার দাবি কানের কাছে। মনিরুল ইসলামের ছবি গান গায়। সেই গান শরৎ ঋতুর। ওই যে বিশাল শূন্যতা তা স্নিগ্ধতা অনুভব করার প্রয়োজনে।