পলাতক জীবনের বাঁকে বাঁকে ( শেষ পর্ব)

muhammad_takiullah
Published : 3 Jan 2017, 05:34 PM
Updated : 3 Jan 2017, 05:34 PM

পাঁচবছর জেলে থাকার পর ১৯৫৫ সালে ছাড়া পেলাম। খাঁচার পাখির গান শেষ হলো। কিন্তু খাঁচা তো ভাঙতে পারিনি। মেহনতি মানুষের মুক্তির সূর্য উঠতে আরও অনেক দেরি। জেল থেকে ছাড়া পাবার পর আবার কমিউনিস্ট পার্টির কাজে জড়িয়ে পড়লাম। আমার মূল কাজ ছিল আগের মতোই। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, কলে কারখানায় শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ে তুলতে সহায়তা করা। ১৯৫৬-৫৮ সালে আমি যুবলীগ কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলাম।

১৯৫৬ সালে পার্টির কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হবে কলকাতায়। আমি এর আগেই পশ্চিমবঙ্গে গেলাম। বশিরহাটের পেয়ারায় আমাদের গ্রামের বাড়িতে। এই বাড়ির সঙ্গে আমার শৈশবের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। এ আমার বাপদাদার ভিটা। এর প্রতি অন্যরকম এক ভালোবাসা অবশ্যই ছিল। তবে আমি সবসময় ঢাকাকেই আমার জন্মভূমি বলে মনে করতাম। দেশবিভাগের কারণে আমার মা তার গ্রামের বাড়িতে আর ফিরতে পারেননি। বিশেষ করে পাসপোর্ট হওয়ার পর। কারণ পাসপোর্টে ছবি থাকবে। সেই ছবি পরপুরুষ দেখবে। আমার মা কঠোরভাবে পর্দা মেনে চলতেন। যদিও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ তার মধ্যে একেবারেই ছিল না। পঞ্চাশের দাঙ্গার সময় বহু হিন্দু পরিবারকে বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন বাবু ও মা।
যা হোক বশিরহাটে থাকার সময় মায়ের কথা খুব মনে পড়তো। আমি ভাবতাম দুই বাংলা বিচ্ছিন্ন হওয়া ঠিক হয়নি। দুই বাংলা একত্রে যদি কনফেডারেশন অফ বেঙ্গল গড়ে তোলা যেত তাহলে বাঙালি জাতি একটি বৃহত্তর দেশের অধিবাসী হয়ে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারতো। দুই বাংলা মিলে কনফেডারেশন গড়ে তোলার স্বপ্ন কিন্তু আমার আজও যায়নি। হয়তো ভবিষ্যতে কোনোদিন তা সম্ভব হবে।

১৯৫৬ সালে অগাস্টে কলকাতায় পার্টির কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হলো। নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি হলো তের জনকে নিয়ে। কমিটিতে ছিলেন নেপাল নাগ, খোকা রায়, মণি সিংহ, সরদার ফজলুল করিম, অনিল মুখার্জি, মোহাম্মদ তোয়াহা, বারীন দত্ত, শহীদুল্লাহ কায়সার এবং অন্যরা।
পশ্চিমবঙ্গে থাকার সময় ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কমরেড মুজাফফর আহমেদ বা কাকাবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ হয়। কাকাবাবু একসময় আমার বাবার বেশ বন্ধু ছিলেন। সেই বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার সময় থেকেই তাদের বন্ধুত্ব। সেসময় কবি নজরুল, কমরেড মোজাফফর ও শহীদুল্লাহ ছিলেন ঘনিষ্ট বন্ধু। সাহিত্য পত্রিকার অফিসে একই ভবনে থাকতেন শহীদুল্লাহ ও নজরুল।
এবার কলকাতায় আসার সময় বাবা আমার হাতে কাকাবাবুর জন্য চিঠি দিয়েছিলেন। সেসময় পশ্চিমবঙ্গের কমরেডদের সঙ্গে আমার বেশ ঘনিষ্টতা হয়। এরমধ্যে জ্যোতি বসুর সঙ্গে বেশি সখ্য গড়ে ওঠে।

বাবুর ইচ্ছা ছিল আমি পশ্চিমবঙ্গেই থেকে যাই। এতে বাপদাদার ভিটায় থাকাও হবে আর আমার জীবনও নিরাপদ থাকবে। কারণ পাকিস্তানের চেয়ে ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেকই ভালো ছিল। বাবু মনে করতেন ঢাকায় ফিরলে আমাকে হয়তো আবার জেলে যেতে হবে কিংবা আবার আত্মগোপনে থাকতে হবে। তিনি আমার কর্মকা- সমর্থন করতেন। কিন্তু সন্তানের প্রতি স্বাভাবিক স্নেহবশত আমার নিরাপত্তার বিষয়টি তাকে খুব চিন্তিত করতো।
কাকাবাবু আমাকে পূর্ব জার্মানিতে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। স্থির হলো আমি প্রথমে কেরালায় ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির একটি সম্মেলনে যোগ দিব। সেখান থেকে বার্লিন পাড়ি দিতে হবে।
কেরালায় সম্মেলনে যোগ দিলাম। তারপরই দেশ থেকে নির্দেশ হলো ফিরতে হবে। সেটা ১৯৫৮ সাল। অক্টোবরে মার্শাল ল' জারি হয়। ২৭ অক্টোবর আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে নিজেকে। এখন যদি দেশে না ফিরি তাহলে হয়তো আরও অনেক বছর ফেরাই যাবে না। এমনকি আমার নাগরিকত্বও হয়তো বাতিল হয়ে যেতে পারে।
ফিরলাম ঢাকায়। পাসপোর্ট সিজ করা হলো। এবং আমাকে নজরবন্দী ঘোষণা করা হলো। বেশ গোপনে পার্টির কাজ চলতে লাগলো। তবে সামরিক শাসনে তা অনেকটা স্তিমিত। যদিও ভিতরে ভিতরে আইয়ুব শাহী শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমা হচ্ছিল এবং অভ্যুত্থানের প্রস্তুতিও চলছিল।
এরই মধ্যে বাবু বিয়ে ঠিক করলেন। প্রস্তাব আনলেন ভাইয়া। তার পরিচিত ডা.করিম যিনি যুবলীগের সদস্য ছিলেন এবং মাওলানা ভাসানীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক তার শ্যালিকা। খান বাহাদুর আফাজউদ্দিন কলকাতায় বাবুর পরিচিত ছিলেন। তারই মেয়ে ফয়জুননেসা খাতুন। খান বাহাদুরের মেয়ে? এরা তো সাধারণত ইংরেজের ধামাধরা ঔপনিবেশিক রুচি আর মূল্যবোধের হয়ে থাকে। এদের তো দেশের মানুষের সঙ্গে, মাটির সঙ্গে কোনো যোগাযোগই নেই। সে সময় বিয়ে করতে হলে পার্টির হাই কমান্ডের অনুমতি নিতে হতো। লিখিত নয় অবশ্যই, তবে মৌখিক। খান বাহাদুরের মেয়ে বলে কিছুটা আপত্তি উঠলেও পরে অনুমতি দেওয়া হলো।

বাড়ির তরফ থেকে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো। বয়সের ব্যবধান প্রায় দশ বছরের। তবে তখনকার দিনে সেটা অস্বাভাবিক ছিল না। এনগেজমেন্টের পর মাস তিনেক সময় নিলাম পরষ্পরের সঙ্গে আলাপ পরিচয়ের জন্য। ১৯৬০ সালের ২৭ জানুয়ারি সংসার জীবনে প্রবেশ করলাম।
আমাদে পারিবারিক একটি প্রেস ছিল। রেঁনেশাস প্রিন্টার্স। এখানে বাবুর বই ছাপা হতো। অন্য অর্ডারি কাজও চলতো। এটি ছিল সদরঘাটে। ১০ নম্বর নর্থব্রুকহল রোডের বাড়িতে। এটা বাবুর কেনা বাড়ি। সেখানে তখন ভাইয়া সপরিবারে থাকতেন ও প্রেস দেখাশোনা করতেন। এই প্রেসেই আমাকে কাজ করতে বললেন বাবু। কারণ কমিউনিস্ট হওয়ায় তখন বাইরের কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি পাওয়া ছিল বেশ কঠিন। বাবু বললেন বিয়ের পর পরিবারের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য আমাকে চাকরি করতে হবে এবং উপার্জন করতে হবে।

আমি তখন স্ত্রীসহ চক বাজারের বাড়িতে থাকতাম। প্রেসে কাজ করতাম। আবার পার্টির কাজও করতাম। পার্টির অনেক বইপত্র ছাপা হতো আমাদের প্রেসেই গোপনে। নববিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে প্রথম দিকে আমি কয়েকটি শ্রমিক মিটিংয়ে গিয়েছিলাম। সেসময় সে জর্জেট শাড়ি পরে ও বেশ সাজগোজ করে মিটিংয়ে যাবার জন্য তৈরি হতো। দেখতে সুন্দর দেখালেও আমি তাকে বলতাম পোশাক পাল্টে সুতির শাড়ি পরার জন্য। আসলে পোশাক পালটে ফেলা সহজ। কিন্তু ভিতরে শ্রেণিবোধ বদলানো অত সহজ নয়। উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংস্কারে আজন্ম লালিত একজন মানুষ তো চট করে নিজেকে বদলে ফেলতে পারে না।

সেসময় থেকে আমার মনে একটি ভাবনা খুব বেশি কাজ করতে থাকে। এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং সাম্যবাদের আদর্শের মধ্যে যে ধারণাগত আকাশ পাতাল ব্যবধান রয়েছে তা নিয়ে আমি গভীরভাবে চিন্তা করতে থাকি। এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা যুবমানসকে কেরানি বা আমলা করে তৈরি করে। সে তখন শোষকের দোসর হয়ে ওঠে। কৃষক কিংবা শ্রমিক পরিবার থেকে একটি ছেলে বা মেয়ে যদি এই শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ওঠে তখন সে আপন সমাজে আর ফিরতে পারে না। তার জন্মগত সমাজের মঙ্গল অমঙ্গলের সঙ্গে তার শিক্ষার আর কোনো মিল থাকে না। তখন সে হয় চাকরি করবে বা ব্যবসা করবে। আর মেয়েরা সিভিল সার্ভেন্টের বউ হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেবে। যদিও সেসময় অনেক নারী প্রথা ও বাধা ভেঙে বেরিয়ে এসেছিলেন কিন্তু সামগ্রিকভাবে বৃহত্তর নারী সমাজ তখনও অন্ধকারেই বন্দী ছিল। আমার মনে পড়তো সাম্যবাদ নারীকে মুক্ত করতে চায় আর ফ্যাসিবাদ চায় তাকে রান্নাঘরে ফেরত পাঠাতে। এই শিক্ষা ব্যবস্থা বদলে ফেলে নারীকে স্বাধীন করতে হবে।

একইভাবে একজন এমএ পাশ ছেলে গ্রামে ফিরে গিয়ে আধুনিক কৃষিখামার গড়তে যাবে না, পারবেও না। সে চাকরি খুঁজবে। পাবে অথবা বেকার হয়ে থাকবে।এই কেরানি তৈরির শিক্ষা ব্যবস্থা দেশের বেকারত্বের ভার বাড়ানো ছাড়া আর কিছুই করতে পারবে না। সমাজ বদলাতে হলে গণমুখী শিক্ষা দরকার। তবে আমাদের এই অর্থনৈতিক কাঠামো না বদলালে তো কিছুই হবে না। উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে শ্রমশক্তির সম্পর্কটাকে সবার আগে অবশ্যই বদলাতে হবে। সেটা বিপ্লবের মাধ্যমে। বেসিক এই স্ট্রাকচারটা বদলানোর পর প্রয়োজন হবে সুপার স্ট্রাকচারগুলো বদলানো। তখন সবচেয়ে জরুরি হলো সাংস্কৃতিক বিপ্লব। এই কাজ সাম্যবাদী সংস্কৃতি কর্মীদের। এজন্য পার্টির সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজন।

যাক, যা বলছিলাম। বিয়ের পর, সবসময় চক বাজারের বাড়িতে না থেকে মাঝে মধ্যে শ্বশুরবাড়িতে মানে ৩ নম্বর সেগুনবাগিচার বাড়িতে থাকতাম। আমার শ্বশুর মারা গিয়েছিলেন ১৯৪৮ সালে। সে বাড়িতে ছিলেন শাশুড়ি ও স্ত্রীর অন্যান্য বোনেরা এবং তাদের একমাত্র ভাই।
১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস।৬ তারিখে আমাকে খুঁজতে পুলিশ এলো চকের বাড়িতে। বাবু তখন মাত্র এশার নামাজ পড়ার জন্য ওযু করেছেন। সেই সময় পুলিশ বাড়িতে ঢুকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে লাগলো আমি কোথায় ইত্যাদি।

বাবুকে জিজ্ঞাসা করাতে তিনি বললেন, আমি সেগুনবাগিচার বাড়িতে আছি। তিনি মিথ্যা কথা বলেননি। বাবু কখনও মিথ্যা বলতেন না।
মাঝরাতে পুলিশ সেগুনবাগিচার বাড়ি ঘিরে ফেললো। বাড়িটা দোতলা। বেশ বড় বাড়ি। পিছনদিকে বিজ্ঞানী ফ্লোরা মজিদদের বাড়ি(যেখানে এখন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর রয়েছে)। ফ্লোরা আমার স্ত্রীর বান্ধবী। পালাতে হলে পাচিল টপকে ওদের বাড়ির ভিতর দিয়েই পালাতে হবে। আমি চট করে উঠে ছাদের সিঁড়ির দিকে এগোলাম। পালাতে হবে। আমার প্রথম সন্তান ইউসুফ আব্বাস উদয় তখন ছোট্ট। সে খাটে ঘুমিয়ে আছে দিব্যি নিশ্চিন্তে।
ছাদের পাঁচিল দিয়ে নেমে পাশের বাড়ি দিয়ে পালানোর কথা ভাবছিলাম। কিন্তু আমার স্ত্রী আমার হাত চেপে ধরলো। বললো, ধরা দাও। কারণ তার ভয়, পালাতে গেলে পুলিশ গুলি করবে এবং সে গুলিতে আমার মৃত্যুও হতে পারে। ছেলের চেহারার দিকে তাকিয়ে আমিও কেমন যেন থমকে গেলাম। জীবনে এই প্রথম মনে হলো ছেলেকে এতিম করা চলবে না। ওর প্রতিও আমার দায়িত্ব রয়েছে।
পুলিশ আমাকে অ্যারেস্ট করে প্রথমে ডিবি অফিস তারপর সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে এক মজার ব্যাপার। দেখি ওখানে আছেন কফিলউদ্দিন চৌধুরী, একে একে আরও এলেন তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, তাজউদ্দিন আহমেদ, শেখ মুজিবুর রহমান, আবুল মনসুর আহম্মদ এবং আরও অনেকে।

আমাকে দেখে সবাই স্বাগত জানালেন। ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের ২৬ নম্বর সেল যেন স্বৈরাচারবিরোধীদের এক মিলনমেলায় পরিণত হলো।
দুতিন দিন পরে একদিন মুজিব ভাই আমাদের সবাইকে গুনে বললেন 'আরে আমরা তো সতেরো জন। জানেন তো সতেরো জন অশ্বারোহী বাংলা জয় করেছিল। বুঝলেন তো আপনারা, আমরাই সেই সতেরো জন। লক্ষণ সেন বা আইয়ুব খান কেউই পালাতে পথ পাবে না।' বঙ্গবন্ধুর এই কথাটা আমাদের মধ্যে নতুন প্রেরণার সৃষ্টি করলো।

আমাদের অ্যারেস্ট করা হয়েছিল কারণ আমরা নাকি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।
জেলে থাকার সময় আমার স্ত্রী আসতেন ছেলেকে নিয়ে। একেবারেই ছোট্ট ছেলে। তার কিছু বোঝার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু আশ্চর্য বিষয় হলো সে আমাকে না দেখে ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়ছিল। তার জ্বর সারছিল না। ডাক্তার ইউসুফ আলি তাকে দেখতেন। তিনি আমাদের পরিবারের পরিচতি ছিলেন। ডাক্তার শফিউল্লাহও তাকে দেখতেন। ডাক্তাররা বলতেন ছেলের বাবা না আসলে এই রোগ সারবে না। ছয় মাসের মতো জেলে থাকতে হয়েছিল। গত বারের পাঁচ বছরের চেয়ে এবারের ছয় মাস বেশি দীর্ঘ মনে হয়েছিল।
আমাকে কুমিল্লা জেলে ট্রান্সফারের কথা চলছিল। বাড়িতে রীতিমতো কান্নাকাটি পড়ে গেল। কারণ ঢাকার বাইরের জেলগুলোর অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। সেখানে বন্দীদের মধ্যে অনেকেই মৃত্যুবরণ করতো নির্যাতনে ও অসুস্থ পরিবেশের কারণে। যেদিন ট্রান্সফার করা হবে তার একদিন আগে আমার তুমুল জ্বর এলো। ফলে ট্রান্সফার করা গেল না। জেলের পুলিশরা বলাবলি করলো 'সি ক্লাস আসামী। ইচ্ছামতো জ্বর আনতে পারে এ লোক।' ঝড়ে বক মরে, ফকিরের কেরামতি বাড়ে টাইপের ঘটনা আরকি।

এর কিছুদিন পর আমি ছাড়া পেলাম। বিষয়টি ছিল অবাক করার মতো। পরে শুনেছিলাম, আমার স্ত্রীর কান্নাকাটি দেখে বাবু নাকি বলেছিলেন 'তোমাকে আর কাঁদতে হবে না, বেলাত ছাড়া পাবে।' তিনি নাকি সারা রাত নামাজ পড়ে দোয়া করেছিলেন।
ব্যাপারটা হয়তো কাকতালীয়। যদিও পরিবারের লোকজনের ধারণা এটি অলৌকিক। পৃথিবীতে অলৌকিক ঘটনা কি আজও ঘটে? কে জানে? আমি সামান্য মানুষ। অতো রহস্য কি আমার জানা আছে?
ষাটের দশকে কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে দুই শিবিরে বিভক্তি শুরু হলো। চীনপন্থী আর মস্কোপন্থী। আমি আজীবন মার্কসপন্থী মানুষ।কার্ল মার্ক্স আমার নেতা। বিভেদটা আমি মানতে পারছিলাম না। কমিউনিস্টদের মধ্যে বিভাজন হবে কেন? তাই ধীরে ধীরে নিজেকে সরিয়ে নিলাম অ্যাকটিভ পলিটিক্স থেকে। যদিও দুই দলেই আমার প্রিয় বন্ধু কমরেডরা ছিলেন।

জেল থেকে বেরিয়ে কোথাও চাকরি পাচ্ছিলাম না। তখন চারিদিকে বন্যা। রেডক্রসের স্বেচ্ছাসেবক হয়ে চলে গেলাম জামালপুর। ভীষণ বন্যা সেখানে। আমার স্ত্রী ও ছেলে সঙ্গে গেল। লোকে দেখে বললো, আপনি কি পাগল নাকি? এই বন্যার মধ্যে বউ আর এতটুকু বাচ্চাকে নিয়ে এসেছেন? কি জবাব দেব? আসলে জেল থেকে বের হবার পর ওরা আমাকে কাছছাড়া করতে চাচ্ছিল না।
রিলিফওয়ার্ক করতে খুব ভালো লাগতো। মনে হতো সরাসরি মানুষের সেবা করতে পারছি।জেলে থাকার সময় তাজউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে আমার বেশ বন্ধুত্ব হয়। তিনি ছিলেন আমার ভায়রাভাই ডা.করিমের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাজউদ্দিন আমাকে বললেন আপনি জুটমিলে চাকরির চেষ্টা করুন। পাট এদেশের সোনালি ফসল। অথচ পাটকলের ব্যবসা মূলত কুক্ষিগত করে রেখেছে অবাঙালিরা। এই ব্যবসাটা শেখার চেষ্টা করুন।
বন্যার প্রকোপ কমলে জামালপুর থেকে ঢাকায় ফিরে আমি ইউনাইটেড জুটমিলে চাকরি নেই। মালিক অবাঙালি। তবে আমার বাবার নাম জানেন। সেসময় আমি ছোট একটি গাড়ি কিনেছিলাম। বেবি অস্টিন। আমার তো সংসারে তেমন কোনো খরচ ছিল না। চক বাজারের বাড়িতে আছি। সংসারে খাবার খরচও দিতে হয় না। পার্টির ওয়েলফেয়ার ফান্ডে টাকা দেওয়া আর নিজেদের হাত খরচ।
সেসময় অ্যাকটিভ পলিটিক্স থেকে সরে যাওয়ায় হাতেও সময় আছে বেশ কিছুটা। তাই সন্ধ্যার পর বাড়িতে বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করলাম। পাড়ার রিকশাচালক, ফেরিওয়ালা, লালুর( আমার ভাই রাজিউল্লাহ) কারখানার শ্রমিক এদের লেখাপড়া শেখানোর কাজ করতাম।
ইউনাইটেড জুটমিলে আমি ছিলাম পারচেজ অফিসার। বিদেশ থেকে জুটমিলের পার্টস আসতো। জুটমিলের সেসব মাল আনার জন্য প্রায়ই চিটাগাং, করাচি, মংলা যেতে হতো। জুটমিলের শ্রমিক কর্মচারীদের নিয়ে ইউনিয়ন গঠনের চেষ্টা চালচ্ছিলাম। আমি যেহেতু অফিসার তাই ইউনিয়নে আমি সরাসরি যোগ দিতে পারবো না। তবে তাদের বুদ্ধি পরামর্শ দিতাম। বিষয়টি মালিকপক্ষের ভালো লাগেনি বলাই বাহুল্য। তারা বলতো তুমি অফিসার মানুষ। তোমার বাড়ি গাড়ি সবই তো আছে। এইসব ছোটলোকের সঙ্গে তোমার এত 'মিলঝুল' কেন? আমি বলতাম আমি নিজেকে ওদের একজন বলেই মনে করি। ওরাও তাই মনে করে। আর ছোটলোক-বড়লোক এসব ফালতু কথা আমার সামনে বলবেন না।
সেসময় আমি চকবাজারের বাড়িতেই থাকতাম। ওই বাড়িতে গাড়ি রাখার জায়গা ছিল না। তাই শ্বশুর বাড়ি মানে সেগুনবাগিচায় গাড়ি রাখতাম। আমার ছেলেও বড় হচ্ছিল। একটা ঘরে জায়গা হওয়া মুশকিল। বাবু তাই আমাকে বললেন, আলুর বাজারের বাড়িতে চলে যেতে। ১৯৬৭ সালের দিকে আমি আলুর বাজারের বাড়িতে চলে এলাম। এই ঠিকানা বদলের কারণেই ৭১ সালে আল বদরের হাত থেকে বেঁচে যাই। সে গল্প না হয় পরে শোনাবো।

আমার বাবা ছিলেন জীবনে ছায়াবৃক্ষ। সব সময় তিনি আমাদের স্নেহ ও দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, দিয়েছেন নির্ভরতা। ১৯৬৮ সালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সেরিব্রাল হেমারেজ। শেষ যে বইটা তিনি পড়ছিলেন সেটা হলো অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ। সুনীতি কুমারের। এটা জানতে পারলাম একটা বিষয় দেখে। বইটাতে খবরের কাগজ দিয়ে মলাট দেয়া ছিল। সেই খবরের কাগজের তারিখ হচ্ছে যেদিন তিনি অসুস্থ হন তার আগের দিনের।

বাবুকে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে যখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তখন মা বলছিলেন আমার দোষত্রুটি মাফ করে দিও। তোমার সঙ্গে এই বাড়িতে তো আর আমার দেখা হবে না।' মায়ের এমন কথা শুনে অনেকেই সেদিন বিরক্ত হয়েছিল। কারণ অসুস্থ মানুষকে একি কথা। তারা বোঝেনি মা নিজের কথা বলছেন। মা তখন দিব্যি সুস্থ। বাবু হাসপাতালে যাবার কিছুদিন পর ২৬ জুলাই আমার মা মারা যান। রাতের বেলা। ঘুমের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক হয়। তার নয় ছেলে-মেয়ের কারো সঙ্গে মৃত্যুর আগে কোনো কথা হয়নি, দেখা হয়নি।
আমার মা ছিলেন পরিবারের প্রধান স্তম্ভ। শুধু নিজের ছেলেমেয়ে নয়, আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশী সকলেরই বিপদের আশ্রয় ছিলেন মা। তাঁর মৃত্যুতে পাড়ার ভিক্ষুকরাও কেঁদেছে। তিনি প্রচুর দান করতেন। গরীব দুঃখী সকলের জন্যই তার দরজা ছিল সব সময় খোলা। মা একটা কথা প্রায়ই বলতেন। 'হাতরথ থাকতে থাকতে যেন দেুনিয়া থেকে যেতে পারি। কারও উপর যেন নির্ভর করতে না হয়।' আরও বলতেন 'দোয়া করো তোমাদের বাবুর আগে যেন আমি যেতে পারি।' তাঁর সে ইচ্ছা পূরণ হযেছিল। কারও উপর তাকে নির্ভর করতে হয়নি কারও সেবা নিতে হয়নি। স্বামীর আগেই তিনি চলে যেতে পেরেছিলেন।

বাবুকে মায়ের মৃত্যুর কথা জানানো হলো। তাঁকে যখন হাসপাতাল থেকে আনা হলো ততোক্ষণে মায়ের মরদেহ মসজিদে নেওয়া হয়েছে জানাজার জন্য। বাবু জানাজায় গেলেন। অনেকে বললো শেষ দেখার জন্য মায়ের মুখের কাফন সরানো হোক। কিন্তু বাবু মানা করলেন। বললেন, 'তিনি সারাজীবন কঠোরভাবে পর্দায় বিশ্বাস করেছেন। আজ এত লোকের সামনে আর তার মুখের কাপড় নাই বা সরানো হলো।' দু'জনের শেষ দেখা সত্যিই আর বেগম বাজারের বাড়িতে হলো না। মায়ের কবর হলো বাবুপুরায় নীলক্ষেতের কবরস্থানে আমার দাদীর কবের পাশে।
বাবু প্রায় এক বছর ধরে হাসপাতালে। আমার ভাই লালু তারে দেখাশোনা করছে খুবই যত্নের সঙ্গে। মেজভাবীও খুবই সেবাযত্ন করছে। আমরা সকলেই তখন চিন্তিত ও বাবুর জন্য উদ্বিগ্ন। তার ছাত্র ও সহকর্মীরাও প্রায় প্রতিদিনই আসছেন।
বেশ কয়েকদিন অফিসে নিয়মিত যেতে পারিনি। তবে কাজ এবং দায়িত্ব ঠিকইপালন করেছি। এর মধ্যে একদিন অবাঙালি মালিক ডেকে একটু কটু কথা শোনালেন।বললাম, বাবার অসুখ তাই ঠিক সময়ে অফিসে আসতে পারছি না। মালিক বললেন, আমার বাবারও তো অসুখ। আমি তো নিয়মিত অফিস করি।
কথাটার মধ্যে একটা বাঁকা ইঙ্গিত ছিল। মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। বললাম আপনার বাবাকে কে চেনে? আমার বাবাকে দেশশুদ্ধু মানুষ চেনে। তার অসুস্থতা মানে জাতীয় বিষয়্।
সেদিনই চাকরি ছেড়ে দিলাম। এর মাস খানেক পর আমি জনতা জুটমিলে যোগ দেই। সেটা ছিল বাঙালি মালিকানাধীন। এই জুটমিলের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিলেন আমার বাবা ১৯৬৭ সালে।
১৯৬৯ সালের ১৩ জুলাই বাবু মারা গেলেন। বাবু তার কবর স্থির করে রেখেছিলেন বাবুপুরায় মা ও স্ত্রীর পাশে। কিন্তু তিনি তো শুধু পরিবারের সদস্য ছিলেন না। তিনি ছিলেন বাঙালি জাতির কৃতি সন্তান। তাঁর ছাত্র, ভক্তরা সকলেই শোকে ভেঙে পড়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেসময় দাবি তোলেন যে ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কবর হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে যেখানে কেটেছে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিনগুলো।ছাত্রজনতার দাবীর মুখে সেই সিদ্ধান্তই বাস্তবায়িত হয়। কার্জন হলের পাশে মুসা খান নামে প্রাচীন মসজিদের আঙিনায় সমাহিত করা হয় তাঁকে। ছাত্রাবাসটিরও নামকরণ করা হয় শহীদুল্লাহ হল। যে বিশ্ববিদ্যালয় ছিল তার প্রিয় কর্মক্ষেত্র যে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তিনি নিজের জন্মভূমি ছেড়ে চলে এসেছিলেন যেখানে ছিল তার প্রিয় সহকর্মী ছাত্ররা যার অদূরেই রয়েছে তার মানস প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি সেই প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে আছেন জ্ঞানতাপস ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ।

মা এবং বাবু নেই। পরিবারের ভরণ পোষণ আমার উপরেই। দায়িত্ববান পিতা ও স্বামী হয়ে চাকরি করছিলাম জনতা জুটমিলে। তবে সবসময় ভাবতাম পরিবারের পাশাপাশি সমাজের জন্যও কিছু করার আছে। জুটমিলের শ্রমিকদের দাবি দাওয়া নিয়ে সব সময় চেষ্টা করতাম তাদের পক্ষ হয়ে কিছু করার। এদিকে সারা দেশ তখন গণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ছিল। এই বিক্ষোভে ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী আসাদ শহীদ হলেন। বাঙালি জাতির মুক্তির দাবী ধীরে ধীরে সমগ্র জনগণের দাবীতে পরিণত হলো। তখন মুক্তিযুদ্ধই ছিল একমাত্র পথ। কারণ দেশ স্বাধীন হওয়া প্রয়োজন। আর সেই সঙ্গে প্রয়োজন বিপ্লবের যাতে মেহনতি মানুষেরও মুক্তি ঘটে।
১৯৭০ সালে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণঝড় আঘাত হানে দেশের উপকূলে। অন্যান্য দেশ থেকে যা রিলিফ আসে তার অনেকটাই চলে যায় পশ্চিম পাকিস্তানে। স্হানীয়ভাবে একটা দল গঠন করে রিলিফ দিতে চলে যাই উপকূলীয় অঞ্চলে। জনতা জুটমিল থেকেও ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে যাই। তবে এবার আর স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। কারণ আমার বাড়িতে তখন দুটি ছোট শিশু। ছেলে এবং মেয়ে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। আমার মেয়ে তখন এক বছরের শিশু। এইটুকু বাচ্চাকে নিয়ে ঢাকা ছেড়ে কোথায় কোনদিকে যাবো? আমার স্ত্রীও অসুস্থ। অতিরিক্ত টেনশনে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তার আচরণগত সমস্যার সূত্রপাত হয় তখন থেকেই। ওদের নিয়ে বাড়ি ছেড়ে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আবার এদের রেখে যাব কার কাছে? বিশেষ করে স্ত্রীর অসুস্থতা ছিল বাড়ি ছেড়ে যেতে না পারার প্রধান কারণ।

সেসময়ও আমার অন্যান্য কমরেডদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। বিশেষ করে শহীদুল্লাহ কায়সারের সঙ্গে। দেশের ভবিষ্যত, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রায়ই আলাপ করতাম। বিশেষ করে এ সময় পার্টির কর্তব্য নিয়ে। ছাত্র ইউনিয়নের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। কমিউনিস্ট পার্টিরও অনেকে যোগ দিয়েছিলেন। কারণ আমরা জানতাম এটি জনযুদ্ধই ছিল, কোনোভাবেই 'দুই কুকুরের লড়াই' নয়। কারণ পাকিস্তানী বাহিনী তো নির্বিচারে গণহত্যা চালাচ্ছিল। সেখানে প্রতিরোধ ছাড়া উপায় ছিল না।হয় যুদ্ধ নইলে সপরিবারে মৃত্যু্। আমি অফিসে যেতাম না। বাড়িতেই বসে থাকতাম। ছা্ত্রইউনিয়নের কিছু ছেলে যারা যুদ্ধে গিয়েছিল এবং ঢাকায় গেরিলা অপারেশন চালাতো তারা খুব গোপনে কখনও কখনও আসতো। তাদের কিছু গোপন কাগজ এবং অস্ত্র হয়তো জমা রাখলো। আমি সেগুলো পানির ট্যাংকের ভিতর রাখতাম। তখন পলিথিন এত সহজলভ্য ছিল না্ সেগুলো শিশু মেয়ের অয়েলক্লথে মুড়িয়ে রাখা হতো। দেয়ালের সুইচবোর্ডের ভিতর রাখতাম টাকা ও স্ত্রীর সোনার গয়না। যেকোনো সময় বাড়ি ছাড়ার জন্য আমরা কিছুটা প্রস্তুতি অবশ্য নিয়েছিলাম। কাপড় এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ ও টিনের দুধ একটা সুটকেসে গুছিয়ে রাখা হয়েছিল।
ডিসেম্বরের ১ তারিখে জনতা জুটমিলে মিলিটারি আসে। তারা শ্রমিক ও কর্মচারীদের মিলের পুকুরের কাছে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মারে। ৬০ জনের বেশি লোকের মৃত্যু হয়। আমার যে সহকর্মীরা বেঁচে গিয়েছিলেন তাদের কাছ থেকে পরে শুনেছি খুনের নেতৃত্ব দেয় পাকিস্তানি মেজর আরিফ। ডিসেম্বরের ৩ তারিখে মতিঝিলের আল্লাহওয়ালা ভবনে শহীদুল্লাহ কায়সারের সঙ্গে আমার দেখা হয়। সেদিন তার খুব তাড়া ছিল। লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে দুজন কথা বলি। তাকে জনতা জুটমিলের ঘটনা জানালাম। বললো, 'এটা নিয়ে আমরা এই সপ্তাহেই বসবো। তুমি তৈরি থাক। একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আর মেজর আরিফসহ অন্যান্য শয়তানদের নামগুলো মনে রাখো। আরও বেশ কিছু জরুরি কথা আছে। অনেক গোপন খবরও রয়েছে।'

সেটাই তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা। ১৬ই ডিসেম্বর সকালে বিজয়ের খবরে আনন্দে আত্মহারা হয়ে আমি ও আমার ছেলে মিলে একটি পতাকা বানালাম। স্ত্রীর সবুজ শাড়ি আর মেয়ের লাল জামা কেটে পতাকা বানালো হলো। আমার মেয়েকে কোলে নিযে বাড়ির সামনে পতাকা উড়ানো হলো। এরই মধ্যে আমার ভাই লালু এলো আমাদের আলুবাজারের বাড়িতে হন্তদন্ত হয়ে। বলে 'বেলাতভাই কি বেঁচে আছে?' তার কাছ থেকে জানলাম ১৪ এবং ১৫ মানে গত রাতেও চকবাজারের বাড়িতে আমাকে খুঁজতে কয়েকজন লোক এসেছিল। লালুর সঙ্গে তাদের কথা হয়। লালু তাদের বলে বেলাত ভাইযের খোঁজ আমরা পাচ্ছি না গত দুই সপ্তাহ ধরে। তিনি জনতা জুটমিলে চাকরি করতেন। আমরা শুনেছি তিনি মিলিটারির গুলিতে মারা গেছেন'। লালুর মুখে শুনলাম আমার কমরেডদের অনেকেই নিখোঁজ। এরপর পরই আমাদের চেনা পার্টির কয়েকজন সমর্থক বাড়িতে আসেন এবং জানান শহীদুল্লাহ কায়সারকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রাযের বাজার, বসিলার বিল, কাটাসুর এসব জায়গায় নাকি অনেক মানুষের লাশ পড়ে আছে। স্ত্রীর নিষেধ ও কান্না অগ্রাহ্য করে আমি আমার কালো অস্টিন গাড়িতে করে ছুটে বেরিয়ে গেলাম শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে।

রায়ের বাজার, কাটাসুর, বসিলার বিল। শত শত মৃতদেহ। বিকৃত,উলংগ শবের ভিড়ে আমি খুঁজতে লাগলাম আমার বন্ধু, আমার কমরেড আমার সহযোদ্ধাকে। মৃতদেহগুলো দেখছিলাম। প্রতিটি দেহের উপর সীমাহীন নির্যাতনের চিহ্ন। কারও হৃদপিণ্ড উপরে নেওয়া, কারও চোখ উপরে নেওয়া, কারও পেট, বুক ছিন্নভিন্ন। কতখানি পিশাচ ও হিংস্র হলে মানুষের উপর এমন নির্যাতন চালানো সম্ভব। আমার শরীর হিম হয়ে আসছিল আতংকে। যদি আমি চক বাজারের বাড়িতে থাকতাম তাহলে আমারও স্থান হতো এই শবদেহের ভিতর। আলুবাজারের নতুন বাড়ির ঠিকানা কেউ তেমন জানতো না। আর জুটমিলের সেই গণহত্যার ঘটনার কারণেই ঘাতকরা ভেবে নিয়েছিল আমি মৃত। আমি ভাবতে পারছিলাম না আলবদর, আল শামসের ঘাতকরা শহীদুল্লাহ কায়সারের উপরও এমনধারা নির্যাতন চালিয়েছে। পিশাচের দল আমার বন্ধুর দেহের উপর নির্যাতন চালাচ্ছে, তাকে হত্যা করছে এ কথাগুলো যত ভাবছিলাম, সেই মৃতদেহগুলো দেখছিলাম, নিজেকে ও বন্ধুকে সেখানে কল্পনা করছিলাম আমি ক্রমশ চেতনা হারিয়ে ফেলছিলাম। ঘাতকের দল আমার প্রিয় ও শ্রেষ্ঠ বন্ধুকে হত্যা করেছে এটা আমি মেনে নিতে পারছিলাম না। আমি দুই হাত দিয়ে মৃতদেহ উল্টে উল্টে পাগলের মতো তাকে খুঁজছিলাম। অবশেষে ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে আমি সেই লাশের স্তূপের পাশেই বসে পড়ি ও চেতনা হারিয়ে ফেলি। আমার সঙ্গে যারা এসেছিলেন তারা আমাকে ধরে নিয়ে আসেন বাড়িতে। এরপর দীর্ঘদিন আমি অসুস্থ ছিলাম। জ্বর এসে গিয়েছিল। কিছু খেতে পারতাম না। অ্যাসিডিটি ও বমি। সুস্থ হতে অনেক সময় লেগেছিল।

শহীদুল্লাহ কায়সার ছিলেন আমার সারা জীবনের বিশ্বস্ত বন্ধু, কমরেড। তার মৃত্যু মানে যেন আমার অস্তিত্বের একটি অংশের মৃত্যু।
আমরা আমাদের তারুণ্য উৎসর্গ করেছিলাম মানুষের মুক্তির জন্য, সাম্যবাদের জন্য,বৈষম্যহীন বিশ্বের জন্য। সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে মানব সমাজ যত স্বপ্ন দেখেছে, যত আদর্শ নির্মাণ করেছে যত মহৎ চিন্তা করেছে তার মধ্যে মহত্তম হলো সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্ন। এর চেয়ে মহত্তম চিন্তা মানবজাতির ইতিহাসে আর কখনও ছিল না। স্পার্টাকাস থেকে শুরু করে আজও পর্যন্ত মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে যুগে যুগে দেশে যারা আত্মত্যাগ করেছেন তাদের মৃত্যু নেই। আমার কমরেডও সেই মুক্তিকামী মানুষের মিছিলের একজন হয়ে চিরদিন আমার স্মৃতিতে অমর হয়ে আছেন। আমার স্মৃতিতে আরও অমর হযে আছেন তেভাগা আন্দোলন, হাজং বিদ্রোহ, খাপড়া ওয়ার্ড এর শহীদরা। এবং আমার সাথী বন্ধু কমরেডরা। আজ বলতে চাই তোমাদের আত্মত্যাগ বৃথা হয়নি। মানবজাতির মুক্তির মিছিলে তোমরা সব সময়ই অমর হয়ে আছ। তোমরা চিরদিন বেঁচে থাকবে সাম্যবাদের মহৎ আদর্শের মধ্যে।