স্কুলের দিনগুলো: আমার কথাটি ফুরালো

sanjida_khatun
Published : 22 July 2014, 01:54 PM
Updated : 22 July 2014, 01:54 PM

সেজদির শ্বশুরবাড়ির কাহিনি আর একটু বলা যাক। বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল, বরপক্ষ স্কুলের ঘোড়ার গাড়িতে সেজদিকে দেখে পছন্দ করেছিলেন বলে তাড়াহুড়া করে বিয়ে হয়ে গেল। আব্বুর ধারণা ছিল মেয়েদের যেখানেই বিয়ে হোক, তারা মানিয়ে নেবে। পরিবারে পরিবারে সংস্কৃতিতে ভেদ থাকতে পারে, সেসব ভাবেননি।

ফলে বিয়ের পর অজপাড়াগাঁয়ে গিয়ে সেজদি পড়লেন আতান্তরে। রান্নার চালায় শাশুড়িকে সাহায্য করবার মানসে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, শ্বশ্রূমাতা উনুন থেকে একটি হাঁড়ি নামিয়ে একটি মাটির সরা বধুর হাতে দিয়ে বললেন-'গুইরা অ্যারো'। হাবাগোবা সেজদি তার এক বর্ণ বুঝতে না পেরে ঢাকনা হাতে খাড়া দাঁড়িয়ে রইলেন। শাশুড়ি খানিক পরে তাকিয়ে দেখেন ঘোমটা-পরা বউয়ের চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে জল ঝরছে। তাড়াতাড়ি কাউকে ডেকে বউকে ঘরে নিয়ে যেতে বললেন। অনেক পরে সেজদি বুঝেছিলেন যে শাশুড়ি ঢাকনা দিয়ে তরকারির হাঁড়িটা ঢেকে রাখতে বলেছিলেন। 'গুইরা অ্যারো' মানে ঢেকে রাখো। নিতান্ত আঞ্চলিক কথন।

মা কলকাতার মেয়ে বলে আমরা এই বাংলার আঞ্চলিক ভাষা শুনতে অভ্যস্ত ছিলাম না। তবু সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে ঢাকনা দিয়ে কী করতে হবে বুঝতে পারা কঠিন নয়। তবে ওই যে বলেছি সেজদি ছিলেন হাবাগোবা। বই থেকে মুখ তুলে সংসারের কিছু দেখেননি কখনো। পড়তে পড়তে ক্লান্ত হলে উঠে এক রাউন্ড দিয়ে দেখে আসতেন –কোথায় কী খাবার আছে! শুধু দেখা নয় এটা ওটা নিয়ে টপাটপ মুখে ফেলতেন। তাই সেজদির ট্রাংক গুছাবার সময়ে আম্মুরা টিন ভর্তি বিস্কুট আর হালুয়া দিয়ে দিয়েছিলেন। ফিরে এলে দেখা গেল–ওগুলো যেমনকার তেমনি আছে। শ্বশুরালয়ে চরম সংযমের পরিচয় দিয়েছিলেন বটে সেজদি!

এদিকে বিয়ের পরে দুলাভাইয়ের কাছ থেকে কিছু টাকা পেয়ে ইউনিভার্সিটির গেটহাউজে থাকতে যা করতেন সে কী বলব! গেটের বাইরে এটা ওটা নানান খাবার বিক্রি হতো। একবার সেজদি টাকা দিলে ওখান থেকে চিনাবাদামের মুড়কি এনে দিলাম। খেয়ে বেজায় মজা পেয়ে বারবার টাকা দেন আর বারবারই আমরা মুড়কি কিনে আনি। এই করে করে ছোট্ট দোকানের সব মুড়কি শেষ! এই লোভিষ্টি সেজদি কিনা শ্বশুর বাড়ি গিয়ে বাক্স খুলে কোনো কিছু খায়নি!

বিয়েতে শর্ত ছিল–সেজদিকে পড়তে দিতে হবে। কিন্তু ওই পক্ষ তাতে মোটেই আগ্রহী ছিল না। স্ট্রাগ্ল করেই সেজদি বি.এ. অনার্স ক্লাসে পড়ছিলেন। ওঁর দেবরদের একজন ছিলেন, পরে বঙ্গবন্ধুর খুনি, খোন্দকার মোশতাক। এঁর ধ্যানধারণার সঙ্গে আমাদের পরিবারের মিল হবে কী করে। তাই সেজদিকে শেষ অবধি মৃত্যুর পথই দেখতে হয়েছিল।

আমার দু বছরের বড়ো রীণার প্রেম আর বিয়ের কথা লিখে আমার স্কুলজীবনের স্মৃতিচারণা শেষ করি এবার। সে জীবনের শেষ প্রান্তে চলে এসেছি যে!

আব্বুর রাজবাড়িনিবাসী এক ভাইয়ের ছেলে আমাদের ফজলুল হক হল গেটহাউসের বাসায় এসেছিলেন কিছুদিন। শিবপুর ইনজিনিয়ারিং কলেজ থেকে পাশ করে এসেছেন। চলনেবলনে মহা চৌকস। গান গাইতে পারেন, নাচতে পারেন, ছবি আঁকতে পারেন– কী নয়! নজু ভাই বলে ডাকতাম আমরা। বাড়িতে বেশ একটা হৈচৈ পড়ে গেল। সেজদি, রীণা, আমি সবাই মুগ্ধ! রীণাও বেশ ভালো গান গাইত। নজু ভাইকে 'প্রিয়, তোমার খেলাঘরে খেলার সাথি করো মোরে' গান শোনাতে লাগল। সেজদি আর আমি চোখ চাওয়াচাওয়ি করতাম শুনে। নজু ভাইও সে-গান বার বার শুনতে চাইতেন। তারপর রীণাকে ছবি আঁকা শেখানো শুরু করলেন তিনি। আমি তো কোনোকালেই আঁকাআঁকির ধারে কাছে নেই। সেজদি বেচারি আঁকতে গিয়ে মোটেই পাত্তা পেলেন না। আমরা দূর থেকে ব্যাপারটা দেখতে থাকলাম। রীণার জন্মদিনে নজুভাই এক বাক্স মিষ্টি এনে লুকিয়ে রাখলেন, আর সবাইকে নিয়ে খেলা জমালেন। সরু সরু স্লিপে ছড়া লিখে সেগুলোকে নানা জায়গায় লুকালেন। প্রথমে স্লিপ খুঁজে বার করে ছড়ার ইঙ্গিত বুঝে নিয়ে অন্য স্লিপের খোঁজ পেতে হবে। সেজদি আর আমি বেশ এগিয়ে গেলাম। তখন নজু ভাই ইশারা করে করে রীণাকে খোঁজ বলে দিতে লাগলেন। আমরা ক্ষুণ্ন হয়ে খেলা থেকে সরে গেলাম। দোতলার সিঁড়ির নীচের ঘুপচিতে আসল জিনিস আছে, সে কথা নজুভাই রীণাকে প্রায় বলে দিলে রীণাই বাক্স বার করে আনল। যাহোক, খেলাটা বেশ ছিল।

বলাবাহুল্য, এরপর নজু ভাইয়ের সঙ্গে রীণার বিয়ে হয়ে গেল। সেকালেও আমাদের মতন মোটামুটি রক্ষণশীল বাড়িতে এরকম প্রেমের খেলা হয়েছিল– একথা আজকের দিনের মানুষকে বেশ মজা দেবে!
স্কুলের দিনের গল্প এখানেই ফুরালো।

( শেষ কিস্তি)