আর তরপর, আমি অতি উৎসাহী হয়ে ওই ভাবনাটাই ভাবলাম যে ওই বিস্ফোরণে জায়গাটার আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।
Published : 30 Mar 2025, 11:19 PM
ভাষান্তর :(জাপানী থেকে ইংরেজী) Robert Ulmer
বাংলা অনুবাদ: মণিকা চক্রবর্তী।
কাজি মতোজিরো (ফেব্রুয়ারী ১৭, ১৯০১-- মার্চ ২৪, ১৯৩২) একজন বিখ্যাত জাপানি লেখক যিনি তার গল্পগুলিকে কাব্যিকতার সঙ্গে লেখার জন্য বিখ্যাত। তাঁর বিখ্যাত গল্পগুলি যেমন লেমন, ইন অ্যা ক্যাসেল টাউন, উইন্টার ডেইস, বিনিথ দ্যা চেরী ট্রিজ। তাঁর গল্পগুলো প্রশংসা পেয়েছিল, ইয়াসুনারী কাওয়াবাতা ও উকিও মিশিমার মতো বিখ্যাত লেখকদের দ্বারা। গল্পগুলিতে রয়েছে তাঁর নিজস্ব পর্যবেক্ষণ ও বর্ণনার তীব্র শক্তি।
একটা অশুভ ভর যেন আমার চেতনার উপর চেপে বসেছে। এই অনুভুতিটা ঠিক অস্বস্তি বা অবসাদ নয়, বরং মনে হচ্ছিল রাতের পর রাত মদ খাওয়ার পর শরীরে যে মাথা ঘোরানোর ভাব হয়,অনেকটা সেরকম ভাবের মধ্যে আছি। যক্ষা বা স্নায়ুর ক্লান্তিকে আমি এর জন্য দায়ী করতে পারছি না। এমনকি আমার হাড় হিম করা ঋণও এর জন্য দায়ী না। এটি একটা অবর্ণনীয় ভার যা দলা পেকে চেপে বসে আছে। আমি যে এত ভালবাসি গান ও কবিতা,ওটা আমাকে তা থেকেও দূরে সরিয়ে দিয়েছে--যদি বাইরে কোথাও যেতাম, মন খারাপ মুহূর্তে কাউকে বললে কেউ একজন হয়তো আমাকে রেকর্ড বাজিয়ে শোনাত, এখন দেখছি কয়েকটা লাইন শোনার পর উঠে যেতে হচ্ছে,আর ভাল লাগছে না। আমি শুধু সীমাহীন সময় ধরে রাস্তায় ভেসে বেড়াচ্ছি।
দারিদ্র্য মেশানো সৌন্দর্য্য যেসব জায়গায় আছে, আমি তাদের প্রতি আকর্ষণ বোধ করতাম। জরাজীর্ণ চারপাশের এলাকা আমার খুব পছন্দের ছিল, কিন্তু সরকারি রাস্তার মতো বড় রাস্তাগুলিতে আমি কোনো আকর্ষণ খুঁজে পেতাম না। বরং কাপড় চোপড় ঝুলে থাকা নোংরা গলিতে যেখানে আবর্জনাগুলো যেখানে সেখানে ছড়িয়ে আছে সেগুলিই আমার ভাল লাগত। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে সেসব নোংরা ঘরগুলিকে আর তার পাশের রাস্তাগুলিকে দেখা যায় সেগুলিই আমাকে আনন্দ দেয়। যেসব ভগ্ন বাড়িগুলির মাটির দেয়াল ভেঙে পড়ছে আর যেগুলিকে বাতাস ও বৃষ্টি আবার মাটিতে পরিণত করবে, সেখানে প্রাণশক্তির পরিচয় বহন করে গাছগাছরাগুলি আর মাঝেমাঝে দেখা যায় সেখানে সূর্যমুখী বা কলাবতী ফুটেছে।
কখনও কখনও যখন আমি ওই রাস্তা ধরে হাঁটতাম,আমি কল্পনা করতাম যে আমি কিয়োটো থেকে অনেক দূর কোনো শহরে গিয়েছি, সেন্ডাই বা নাগাসাকিতে যেখানে কেউ আমাকে চেনে না। এটা হতে হবে শান্ত এক নিবিড় শহর। ঘরটি হতে হবে আয়তনে বড় আর শূন্য। সুন্দর বিছানা পাতা, মশারীর গন্ধ ভরা, আর আমি মাড় দেয়া গ্রীষ্মের কিমানো পরে আছি। কোনো ভাবনাচিন্তা না করে আমি সেখানে একমাস কাটিয়ে দিতে পারছি। আমি যখন চিন্তার গভীরে ঢুকে পড়ি, আমার মনে হতো যে আমি একটি জায়গাকে আরেকটি জায়গায় পরিণত করতে পারি। আমি ঠিক আমার মনের মধ্যে সেই চিত্রটিকে বসিয়ে দিতে পারতাম। আমার জরাজীর্ণতার চারপাশে আমি আরোপ করতে পারতাম মনের নানা রঙ। শুধুমাত্র তখনি আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলার মজাটা পেতাম।
আমি আরও আনন্দ পেতাম বাজি ফোটানোর বাজির প্যাকেটগুলির দিকে তাকিয়ে থাকতে। বাজিগুলি পাওয়া যেত ডোরাকাটা লাল, গোলাপি, সোনালি, আর নীল বান্ডিলের মধ্যে, আর যাদের নামগুলি ছিল ‘সানজি মন্দিরের কক্ষচ্যুত তারা’ ফুলের যুদ্ধ, শুকনো প্যাম্পাস, কোনটি আবার ইঁদুর বাজি যেগুলি রাখা ছিল বাক্সের মধ্যে। আমার মধ্যে এ জিনিসগুলির একটি অদ্ভুত রকমের আবেদন ছিল।
আমার কাছে খুব প্রিয় ছিল রঙিন কাঁচ-- প্রিয় ছিল পুঁতির মালা, আর যে মার্বেলগুলোর মধ্যে খোদাই করা ছিল মাছ ও ফুলের ছবি, সেই মার্বেলগুলো। মার্বেলগুলো মুখের মধ্যে রেখে দিতে আমার খুব ভাল লাগত, খুবই স্বাদ লাগত, আর এদের মধ্যে কেমন যেন একটা ঠান্ডা ভাব আছে। শিশু হিসাবে আমার বাবা-মা আমার এসব আচরণের জন্য খুব বকাঝকা করত। কিন্তু এখন যখন আমি বড় হয়ে গেছি ছোটবেলার সেই স্মৃতিগৃলি আমার কাছে খুব প্রিয়, সব মিলিয়ে কবিতার মতো হয়ে ওঠা সেইসব চেতনাগুলি, যেসব হারিয়ে যাওয়া সতেজ অনুভুতিগুলি আমি আমার মুখের মধ্যে অনুভব করতাম।
যাবতীয় কথাগুলো থেকে আপনারা যা বুঝলেন তা হল,আমি সাংঘাতিকভাবে নিঃস্ব ছিলাম। তবু এইসব ছোট ছোট জিনিসগুলো আমার হৃদয়কে ছুঁয়ে যেত, আর তখন এইসব জিনিসগুলো যে কিনতাম, তা ছিল প্রয়োজনীয় বিলাসিতা। কিছু পয়সা লাগত ঠিকই আর বিষয়টা যদিও আড়ম্বরপূর্ণ ছিল, কিন্তু সেগুলি ছিল দেখার মতো সুন্দর, যা আমার ভিতরের মনটাকে উদ্দীপিত করে তুলত। সংক্ষপে বলতে গেলে বলতে হয়, সান্তনা যোগাতো।
যখন আমি ভাল একটা অবস্থায় এলাম, আমার খুব ভাল লাগত মারুজেনের মতো ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে সময় কাটাতে। যার প্রতিটি তাক বিদেশ থেকে আমদানিকৃত জিনিসে ভরে আছে। লাল ও হলুদ রঙের বোতলে নানা রঙের পারফিউম ও তেলগুলো দেখতাম। পীতাভ ও রঙওঠা সুগন্ধী যুক্ত ফ্লাস্কগুলো যা সুন্দর শৈলিতে কাঁচ দিয়ে খোদাই করা ছিল। ছিল সিগারেট টানার পাইপগুলো, পকেটে রাখার ছুরি, সাবান আর তামাক। একঘন্টা ধরে সূক্ষভাবে বাছাইয়ের পর আমি সবচেয়ে ভাল মানের একটিমাত্র দামী পেন্সিল কিনতাম। কিন্তু যাইহোক মারুজেন আমার কাছে হয়ে উঠল অত্যাচারী শ্বাসরোধকারী একটা জায়গা। বইগুলি, ছাত্ররা, ক্যাশিয়ার সবাই যেন আমার কাছ থেকে ঋণ সংগ্রহের জন্য তাড়া করে বেড়াচ্ছে।
একদিন সকালে আমি আমার একজন বন্ধুর ঘরে ছিলাম- এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাচ্ছি, তো বন্ধুটি আমাকে তার বাড়িটিতে একা রেখে স্কুলে গেল, ফলে ঘুরে বেড়ানো ছাড়া আমার আর কোনো পথ রইল না। কী যেন আমায় তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল এক গলি থেকে আরেক গলিতে, এভাবে তাড়িত হতে হতে আমি একটি মিষ্টির দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তারপর আমি নিজেকে নিয়ে গেলাম একটি গ্রোসারীতে, যেখানে আমি সময় কাটাতাম শুকনা মাছ আর টাফু রাখার জায়গাটিতে। তারপর আমি ঘুরতে ঘুরতে গেলাম টেরামাচি থেকে নিজো এভিনিউতে, শেষপর্যন্ত এসে থামলাম সবুজশাকসব্জী বিক্রি হবার গ্রোসারির সামনে।
আমার মনে হয় এই জায়গাটিকে আপনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া ভাল, যেহেতু সব দোকানের মধ্যে এটি আমার সবচেয়ে প্রিয়। বাইরের দিক থেকে দেখতে দোকানটির তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই,কিন্তু এর মধ্যে এমন কিছু বিশেষ সৌন্দর্য্য আছে যা অন্যান্য জায়গার চেয়ে একে বেশি আকর্ষণীয় করে তোলে। কালো কাঠের ছোট ছোট কুচি করা কোনাচে তাকে ফলগুলি সুন্দরভাবে রাখা আছে। এমনভাবে তাদের রাখা হয়েছে যেন,তারা আয়তন ও রঙ নিয়ে সময় ও স্থানের মধ্যে নিথর হয়ে আছে। যেন ঔজ্জ্বল্যের চঞ্চলতা নিয়ে গ্রীক পুরানের মেডুসার চেহারার মতো পাথরে পরিণত হয়ে আছে। এই দোকানের মধ্যে সবুজ সব্জীগুলো উপরের ধাপে সজ্জিত। গাজরের পাতাগুলি ছিল উজ্জ্বল চকচকে আর সীম ও অ্যারারুটগুলো-- ছিটানো জলের পুঁতিগুলোর কারণে চকচক করছিল।
প্রদর্শনের জনালা থেকে আলো এসে পড়ার কারণে, রাত্রিবেলায় এদের দেখতে দারুণ সুন্দর লাগত। টোকিও ও ওসাকার মতো প্রতিপক্ষ বড় শহরের বড় বড় গলির চেয়ে টেরামাচির গলিটা অনেক বেশি প্রাণবন্ত ও নির্মল। তবুও এই অঞ্চলের একটি বিশেষ দোকান অদ্ভুতভাবে অন্ধকার। হুম, এটি সত্যি যে নিজু অ্যাভেনিউর এক অনুজ্জ্বল কোনায় এটির স্থান। কিন্তু এটা আসলে ব্যাখ্যাতীত কেন যে টেরামাচির প্রতিবেশি হয়েও এত কম আলো এখানে থাকবে। যদি এই জায়গায় আরেকটু উজ্জ্বল আলো থাকত তাহলে তা আমাকে আরও মুগ্ধ করত কিনা, তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। দোকানটির সামিয়ানা উঁচিয়ে ছিল তেমনভাবে যেন টুপির সামনের অংশ মুখোশের মত ঢেকে রাখে চোখগুলোকে। (এটা কোনো কাব্যিক অতিরঞ্জন নয়-এই দোকানটি দেখলেই আপনার চিৎকার করে বলার ইচ্ছা হবে যে ‘নীচু করে টুপি নামানো এৗ দোকানটির দিকে তাকাও। ’ পাশে এমন কোনো আলো নেই যে তার সঙ্গে টক্কর দেবে, এবং উপরে একেবারেই অন্ধকার। সামিয়ানার নীচে যে সব বৈদ্যুতিক বাল্বগুলোর সারি ধরে ঝুলানো, তারা পণ্যগুলিকে গ্রীষ্মের উজ্জ্বল একঝলক বৃষ্টির মতো উজ্জ্বল আলোতে স্নান করাচ্ছে। রাস্তা থেকে যখন দেখি আঢাকা আলোর বাল্বগুলোকে, তারা সর্পিল আলোগুলোকে পাঠায় আমার চোখের গর্তে। আর দ্বিতীয় তলার জানলা থেকে দেখা রাস্তার উল্টোদিকের কফিশপের কথা যদি বলি তাও আমাকে প্রাণিত করে যা আসলে টেরামাচিতে তেমনকোনো দোকান না থাকার কারণে।
আজ এই বিশেষ দিনে আমি যে কাজ করি না, সেরকম একটা কাজ করলাম, কিছু একটা কিনলাম সেখান থেকে। সেখানে একটা বিরল জিনিস বিক্রি হচ্ছিল, তা হচ্ছে লেবু। অবশ্য ব্যাপারটা এমন না যে লেবুটা এসব অভিনব দোকানে পাওয়া যায় না, কিন্তু এই দোকানটি সাধারণ দোকানের তুলনায় বেশি অভিনব নয়, তাই লেবুটা যে এখানে বিক্রি হয় তা নয়, আমি কখনও বিক্রি হতে দেখিনি। আর লেবুগুলো যে আমি কী রকম আকাঙ্খা করি, তাদের রঙের জন্য, যেন রঙের টিউব থেকে চাপ খেয়ে বের হওয়া হলদে সবুজের শক্ত দলা যারা দেখতে একেবারে খুব সুন্দর একটি সুতাকাটার টাকুর মতো। আমি ভাবলাম যে একটি কিনি। তারপর আবার আমি কিয়োটোর রাস্তায় হাঁটতে বেরিয়ে গেলাম। অনেকক্ষণ ধরে হাঁটলাম। আমার খুব ভাল লাগতে লাগল। ওটা কিনার সঙ্গে সঙ্গে মনে হতে লাগল আমার উপর চেপে থাকা অশুভ শক্তিটা অনেকটা হাল্কা হয়ে গেছে। যদিও এটা অসঙ্গত ও স্ববিরোধী ,কিন্তু ব্যাপারটা খুব সত্যি যে আমার মনের ভিতর বসে থাকা বিষণ্ণতাটা একটি ফল কিনতে না কিনতেই সরে গেল। মানুষের আত্মিক ব্যাপারগুলি কী অদ্ভুত!
লেবুর ঠান্ডা ভাবটি ছিল বর্ণনাতীত। ঐ সময় আমার যক্ষা রোগটা এতই খারাপ অবস্থায় ছিল যে আমার সব সময় জ্বর জ্বর ভাব থাকত। আমি দেখলাম আমার বন্ধু ও পরিচিতজনদের হাতটি ধরলেই আমি বুঝাতে পারতাম আমি কতটা অসুস্থ, কারণ আমার হাত ছিল জ্বরের কারণে অনেক গরম। সম্ভবত এই তাপের কারণে আমার মনে হতে লাগল লেবুর ঠান্ডা ভাবটি চুইয়ে চুইয়ে আমার হাতের ভিতর দিয়ে আমার পুরো শরীরটাকে সতেজ করে দিত।
আমি বারবার ফলটাকে আমার নাকের কাছে নিয়ে আসছিলাম ওর গন্ধটা পাবার জন্য। এটির আসল প্রজাতিটি সম্ভবত ক্যালিফোর্নিয়ার। চায়না থেকে প্রকাশিত একটি ক্লাসিক বই যার নাম ‘দ্যা ফ্রুট মারচেন্ট ’ সেখানে এটির একটি ছবি আছে। আমি স্কুলে থাকতে বইটি পড়েছিলাম। মনে পড়ছে যেখানে লেবুটা সম্বন্ধে বলা আছে‘নাকের মধ্যে গন্ধটা ঢুকিয়েই ছাড়বে’ গন্ধটি এমন। সত্যিই, যখন আমি জোরে শ্বাস টেনে নিলাম আর এর সৌরভ যখন আমার ফুসফুসের ভিতর ঢুকল মনে হল যেন একটা উষ্ণ রক্তপ্রবাহ আমার শরীরের ভিতর দিয়ে বয়ে গেল আর আমি যেন খুঁজে পেলাম এক নতুন জীবন। আমার মনে পড়ে না,আমি কখনও এত গভীরভাবে নিঃশ্বাস নিতে পেরেছি।
এই যে সামান্য একটু ঠান্ডা আর আমি যে তার সংবেদনটুকু অনুভব করেছিলাম আমার শরীরে, আমার মনে হচ্ছিল এই আকৃতি, গঠনবিন্যাস এই গন্ধ যেন আমি বহুদিন থেকে খুঁজেছিলাম। আমার খুব অদ্ভুত লাগছিল বিষয়টা। আমার এটা পর্যন্ত মনে হয়েছিল যে ছাদের উপর থেকে চেঁচিয়ে সবাইকে জানাই।
আমার পদক্ষেপগুলো অনেক বেশি প্রাণবন্ত এখন। আমি খুব উত্তেজিত অবস্থায় হাঁটছি খুব গর্বের সঙ্গে ,কখনও যেন নিজেকে দেখছি খুব সুন্দর পোশাক পরা একজন কবির মতো প্রশস্ত রাস্তায় হেঁটে বেড়াচ্ছি। লেবুটাকে হাতে নিয়ে ময়লা রুমালটার সামনে রেখে আমি খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম,তারপর আমার চাদরের সামনে রেখে তার রঙটা কিভাবে ফুটে উঠে তা দেখার চেষ্টা করলাম। তারপর এটাকে হাতে নিয়ে এর নিখুঁত পরিপূর্ণতা দেখে চিৎকার করে কাঁদলাম। আমি যখন খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত হচ্ছিলাম সঠিক ওজন ও সবকিছু মিলিয়ে পরিপূর্ণ সুন্দর ও ভাল কিছুকে, তখন এই জিনিসটির পূর্ণতা আমাকে ভয়ঙ্কর আবোলতাবোলভাবে তাড়িত করছিল। সবকিছু মিলিয়ে আমি যেন সুখের আশীর্বাদ পেলাম।
আমি কেমন করে এখানে পৌঁছলাম আমি নিজেও বলতে পারছি না, কিন্তু হঠাৎ করে আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম মারুজেন ডিপার্টমেন্ট স্টোরের সামনে। আমি যদিও ডিপার্টমেন্ট স্টোরটাকে এড়িয়ে যাচ্ছিলাম,তবু এই সময় ভিতরে যাবনা এমন কোনো দৃঢ় মানসিক অবস্থা আমার ভিতরে কাজ করেনি। চেষ্টা করা যাক ভেবে আমি দৃঢ়তার সাথে দরজা ঢেলে ভিতরে ঢুকে পড়লাম।
তারপরেও কী কারণে যেন আমার হৃদয়ের ভিতরে যে ভাললাগার বোধটা কাজ করছিল তা যেন ভিতরে ঢুকার সঙ্গে সঙ্গে উবে গেল। সারি সারি সাজানো পারফিউম আর সিগারেটগুলো আমাকে আর আকর্ষণ করতে পারল না। আমি অনুভব করছিলাম, আমার ভিতরের বিষণœতা আবার মাথা তুলছে। ভাবলাম ,আমি যে এতটা দীর্ঘ পথ হেঁটে এসেছি,এটা কী সেজন্য হতে পারে। যেখানে ছবি আঁকার বইয়ের সম্ভার ছিল ,আমি সেখানে চলে গেলাম। আমার শরীরে কী এতটা শক্তি আছে এই ভারী ভারী বইগুলো হাতে তুলে নেবার? যাই হোক, আমি একটার পর একটা বই নীচে নামাতে লাগলাম আর খুলে দেখতে লাগলাম। বইগুলো যে উল্টে পাল্টে দেখে একেবারে গভীরে গিয়ে দেখব এমন কোনো আকাঙ্ক্ষা আমার ছিল না। মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমি একটির পর একটি বই নামাচ্ছিলাম আর একপলক ওদের দিকে দেখছিলাম, আর সেগুলি যথাস্থানে না রেখেই পরবর্তী তাকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। এর চেয়ে বেশি কিছু করতে আমি যেন পেরে উঠছিলাম না। শেষ বইটি যেটি আমি হাতে নিয়েছিলাম সেটি আমার প্রিয় একটি বই। শেষ বইটি যা আমি পছন্দ করে দেখলাম, তা ছিল আমার খুব প্রিয়। বিখ্যাত অঙ্কন শিল্পী ইনরেজের কাজগুলির সোনালী বর্ণের একটি বৃহৎ সঙ্কলন। হুম, এটাই ছিল সবগুলির চেয়ে ভারী। কী বিরক্তিকর! এইযে আমি একের পর এক বইয়ের স্তুপ বানালাম, তাতে আমি আমার হাতগুলোতে দীর্ঘক্ষণ একটা অবশতা টের পাচ্ছিলাম। এরই মধ্যে আমার বিষণ্ণতা পূর্ণশক্তিতে ফিরে এল।
অতীতে, খুব আরামে আয়েশে এ্ইসব বইয়ের পাতাগুলি আমি উল্টে যেতাম। মজা করে অনুভব করতাম এক অদ্ভুত বৈপরীত্য- চমৎকার ইলাশট্রেশানকে ঘিরে থাকা ম্যাড়মেড়ে চারপাশের মধ্যে। কেন ওরা আমাকে আর আকর্ষণ করছে না?
হঠাৎ মনে হল আমার কিমানোর হাতায় গোঁজা লেবুটির কথা। এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রঙের প্রাচুর্য্যরে মধ্যে একে রেখে দিলে কী হবে?
একটু আগের উত্তেজনার বুদবুদটা আমার মধ্যে আবার ফিরে এল। আমি বইগুলিকে একটির উপর একটি করে সাজিয়ে টাওয়ার বানালাম,রূঢভাবে ভেঙে ফেললাম,তারপর ছুড়ে ফেললাম। শেল্ফ থেকে নতুন বই আনলাম, সরিয়ে ফেললাম, অন্য বই এর মধ্যে আবার দিলাম,এভাবে যেন একটা স্বপ্নের সৌধ নির্মাণ করলাম,প্রথমে লাল রঙের, পরে নীল।
শেষ পর্যন্ত এটা শেষ হল। আমার হৃদয়টা খুব কাঁপছিল, কিন্তু তাকে যথাসাধ্য নিয়ন্ত্রণ করে লেবুটাকে সাবধানে রেখে দিলাম সেই সৌধের চুড়ার উপর।ওটা ওখানে মানিয়ে গেল দারুনভাবে।
আমার এইসব হাতের কাজ যা আমি নীরবে ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন করলাম, লেবুটা যেন সমস্ত বিক্ষুব্ধ রঙকে শুষে নিয়ে তার সুতাকাটার টাকুর আকৃতির ভিতর নিয়ে গেল। মারুজেন ডিপার্টমেন্ট স্টোরের একটি বাসি গন্ধ অদ্ভুতভাবে কেন যেন শুধু এই জায়গাটিতে ছেয়ে ছিল। আমি ওখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম ওই চুড়াটার দিকে তাকিয়ে।
হঠাৎ করে একটি বিদঘুটে আইডিয়া যেন আমাকে কাঁপিয়ে গেল। লেবুটাকে যেখানে রেখেছি, সেখানে রেখে আমি কেন নির্দোষভাবে বেরিয়ে যাই না?
একটা সুড়সুড়ি দেয়া অনুভব হঠাৎ করেই আমার মধ্যে বাসা বাঁধল। করব এটা? কেন করব না? আমি আস্তে করে বিল্ডিং থেকে বের হয়ে এলাম।
রাস্তায় আসার পর সুড়সুড়ির অনুভবটা আমাকে হাসিয়ে মারল। কী অদ্ভুত রকমের খলনায়ক আমি যে একটা বিস্ফোরণোন্মুখ টিকটিক শব্দকারি সোনালী উজ্জ্বল বোমা মারুজেনের শেল্ফে রেখে এসেছি। এই বোমাটা যদি হঠাৎ করে দশ মিনিট সময়ের মধ্যে আঁকাআঁকির বইয়ের জায়গাটায় প্রচন্ডভাবে বিস্ফোরিত হয়ে পড়ে! কেমন হবে বিষয়টি!
আর তরপর, আমি অতি উৎসাহী হয়ে ওই ভাবনাটাই ভাবলাম যে ওই বিস্ফোরণে জায়গাটার আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। শুধমাত্র পড়ে থাকবে কিছু ছাইয়ের গাদা।
কিউগুকোর রাস্তা ধরে আমি হাঁটছিলাম, রাস্তার পাশে সারিবদ্ধভাবে সাজানো ছিল অদ্ভুত হাস্যোদ্দীপক রঙিন চলমান ছবির পোষ্টারগুলি।