Published : 10 Apr 2024, 09:56 PM
‘থ্রি-বডি প্রবলেম’ নামের নেটফ্লিক্স সিরিজটির প্রথম সিজন শেষ করলাম। খুবই সুন্দর নির্মাণ। চীনা লেখক লিউ সিশিনের বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞান কল্পকাহিনি অবলম্বনে এই সিরিজটি নির্মিত হয়েছে। কাহিনির মূল প্রতিপাদ্য এলিয়েন ইনভেশন বা অপার্থিব বুদ্ধিমত্তার সাথে সংযোগ এবং তৎপরবর্তী জবরদখল। কিন্তু বি-গ্রেড এলিয়েন ইনভেশন জাতীয় চলচ্চিত্র বা কল্পকাহিনি এটি নয়। খুবই সূক্ষ্ম তত্ত্ব-সম্বলিত এবং আধুনিক বৈজ্ঞানিক কাণ্ডজ্ঞানের ভিত্তিতে কাহিনিটি রচিত হয়েছে। সত্যি বলতে কি, এলিয়েন বা বহির্জাগতিক অপার্থিব বুদ্ধিমত্তার সাথে মনুষ্য-সাক্ষাতের যে-কটি শ্রেষ্ঠ গল্প রচিত হয়েছে, তার মধ্যে এটি অন্যতম বলে আমার মনে হয়েছে। এলিয়েন কন্ট্যাক্টের ভিত্তিতে রচিত কল্পকাহিনির মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় আর্থার সি ক্লার্কের রচিত ‘২০০১: আ স্পেস অডিসি’ গল্পটি। এটি চলচ্চিত্রায়িতও হয়েছিল বিখ্যাত চলচ্চিত্র-নির্মাতা স্ট্যানলি কুবরিকের হাতে। সেখানে আমরা দেখি গল্পের মুখ্য চরিত্র ডেভিড বোম্যান নক্ষত্র-শিশুতে রূপান্তরিত হয়। তিনি এক সুপারইন্টেলিজেন্ট এলিয়েন সভ্যতার সাক্ষাত পায় যারা শক্তির মত রূপহীন অবয়বহীন এক বিমূর্ত সত্তা। বহু পূর্ব থেকেই এই সত্তা পৃথিবীতে বুদ্ধিমান সত্তার আবির্ভাব বিষয়ে উন্মুখ ছিল, তার বিভিন্ন মনোলিথ নির্মাণ করে রেখে গেছে। এরা এমন যে মাটি খুড়ে এদের উন্মোচন হলে পরে তারা আকাশের নির্দিষ্ট দিকে উচ্চ-শক্তির মাইক্রোওয়েভ বিকিরণ করে। অর্থাৎ তারা জানান দেয় যে একটি ধীমান সত্তার আবির্ভাব হয়েছে এবং তারা মাটি খুড়ে, বা চাঁদে গিয়ে মনোলিথকে উন্মোচন করার সামর্থ্য অর্জন করেছে। মানুষ তখন এই সংকেতের দিকে ধাবিত হয়। এই সত্তা তাকে পর্যবেক্ষণ করে এবং পরে তাকে নক্ষত্র-শিশুতে রূপান্তরিত করে আত্মীকৃত করে নেয়। দ্বিতীয় যে কল্পগল্পটির কথা বলা দরকার সেটি কার্ল সেগানের ‘কনট্যাক্ট’ গল্পটি, এবং এটিও জোডি ফস্টারের অভিনয়-গুণে অনবদ্য মুভিতে আমরা দেখেছি। সেখানে আমরা দেখেছি, ডঃ এলি অ্যারোওয়ে এক অপার্থিব বুদ্ধিমত্তার সংকেত পেতে থাকেন। সেই সংকেতে পৃথিবীবাসীকে একটা ওয়ার্মহোলের ভেতর দিয়ে যাবার প্রক্রিয়া বলা হয়। যেমন বলা হয়েছে তেমন তেমন করে এলি সেই অপার্থিব বুদ্ধিমত্তার সংস্পর্শে আসেন। তারাও মানুষকে পর্যবেক্ষণ করে, মানুষের স্বপ্নকে বিশ্লেষণ করে তার মনোজগতের হদিস নেয়। এলিয়েনরা এই গল্পেও স্বশরীরে দেখা দেয় না, দেয় এলির স্বপ্নের নায়ক তার পালক-পিতার অবয়বে। তারা এও বলে যে তাদের থেকেও বুদ্ধিমান একটি সত্তার অস্তিত্ব তারা মহাবিশ্বে পেয়েছে। গল্পের টুইস্টে দেখা যায় এই অপার্থিব সত্তা বুদ্ধিতে সেরা হলেও সর্বজ্ঞ নয়। তৃতীয় যে গল্পটির কথা বলতে হয় সেটি ক্রিস্টোফার নোলানের ‘ইন্টারস্টেলার’ মুভি। এখানেও অপার্থিব বুদ্ধিমত্তার সন্ধান পাওয়া যায়, কিন্তু এখানে ধারণা দেওয়া হয় সেই অপার্থিব বুদ্ধিমানরা আসলে মানুষেরই দূর-ভবিষ্য রূপ। সেখানেও এলিয়েনের সরাসরি উপস্থিতি নাই, কিন্তু সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের আশপাশে পাঁচ-মাত্রিক টেসারেক্ট তৈরিকারী এক সত্তার অস্তিত্বের দিকে দৃকপাত করা হয়। এই তিনটি গল্পই বিজ্ঞানের গভীর ভিত্তি অবলম্বনে রচিত হয়েছে। ‘স্টার ওয়ার’ বা ‘স্টারট্রেক’ সিরিজের মত একবগ্গা সায়েন্স ফিকশন এরা নয়। খুব গভীর এবং সূক্ষ্মভাবে বৈজ্ঞানিক ভিতকে কাজে লাগিয়ে কাহিনি রচিত হয়েছে বিধায় গল্প খুব শক্তিশালী মনে হয় এবং এর আবেদনও গভীর হয়।
‘থ্রি-বডি প্রবলেম’ কাহিনিটির বিষয় হচ্ছে প্রায় সোয়া-চার আলোকবর্ষ দূরের একটি অপার্থিব বুদ্ধিমান সত্তার সাথে পৃথিবীর রেডিও-জ্যোতির্বিদের সংযোগ স্থাপিত হয়। এক চৈনিক গবেষক একটি ২৫ মেগাওয়াট রেডিও দুরবিন নিয়ে কাজ করছিলেন। তাঁরা এলিয়েনের সন্ধানে সংকেত পাঠাচ্ছিলেন। যেমন ১৯৬০-এর দশকে SETI-বিজ্ঞানীরা শুরু করেন [১]। যাহোক, মার্কিন সেটি-প্রজেক্টের সমান্তরালে চায়না এই প্রকল্পটি নিয়েছে। তো সেই বিজ্ঞানী ঐ তারা-ব্যবস্থা থেকে একটি ফিরতি বার্তা পান যে তুমি এভাবে সংকেত পাঠিও না, পাঠালে মানবসভ্যতা বিপদে পড়বে। কিন্তু তবু চিনা বিজ্ঞানী ডঃ ইয়ে সংকেত পাঠিয়েই যান। নানান রাজনৈতিক কারণে তিনি খুবই সংক্ষুব্ধ ছিলেন, এবং মনুষ্যত্বের ওপর থেকে তিনি সব আশা হারিয়েছিলেন। তার কয়েক দশক পর হঠাৎ দেখা যায় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায় কর্মরত বিজ্ঞানীরা মারা যাচ্ছেন বা আত্মহত্যা করছেন। দেখা যায়, তাঁদের কাছে কে বা কারা একটি থ্রি-ডি ভিডিও গেম হেডসেট পাঠাচ্ছে। গল্পের প্রোটাগনিস্ট বিজ্ঞানী ডঃ জিন চেং এরকম একটি পান। তিনি ভিডিও গেমটি খেলা শুরু করেন। দেখা যায়, ঐ এলিয়েনরা এই গেম বানিয়েছে এবং তারা তাদের প্রেডিকামেন্ট বোঝানোর জন্য এই ভিডিও গেমটি বানিয়েছে। তাদের সমস্যা হল, তাদের একটি তিন-তারা ব্যবস্থা আছে এবং তাদের গ্রহটি এই নক্ষত্র-ত্রয়ের মধ্যে পড়ে যারপরনাই বিপর্যস্ত। তিনটি তারার লোফালুফিতে পড়ে গ্রহটির ঋতু ভয়ানকভাবে বিপর্যস্ত এবং তাদের সভ্যতা পুনঃপুনঃ ধ্বংসের সম্মুখীন হয়েছে। তবু তারা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে এবং বিজ্ঞানের উঁচু শিখরে পৌঁছেছে। তারা ১১-মাত্রিক কোয়ান্টাম কম্পিউটার বানিয়েছে এবং তার সাহায্যে তারা পৃথিবীকে নজরদারিতে রেখেছে। তারা তাদের গ্রহ থেকে বাঁচতে পৃথিবীর উদ্দেশ্যে নক্ষত্রযাত্রা করেছে। তবে তাদের স্টারশিপ ফ্লিট পৃথিবীতে পৌঁছতে ৪০০ বছর লেগে যাবে। যদিও জ্ঞান-বিজ্ঞানে তারা উন্নত হয়েছে কিন্তু তবু আলোর এক-শতাংশ দ্রুতির বেশি তারা অর্জন করতে পারেনি। কিন্তু তাদের ভয় এই ৪০০ বছরে পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা বৈজ্ঞানিক গবেষণায় তাদেরকে ছাড়িয়ে যাবে। তাই তারা আগেভাগেই সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসেবে পৃথিবীর বিজ্ঞানকে থামিয়ে দিতে চায়। তারা দেখেছে, তাদের গ্রহের বিপর্যস্ততার কারণে তাদের বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ধীর হলেও পৃথিবীর মানুষ ২ লক্ষ বছর আগে যাত্রা শুরু করে, ১০-হাজার বছর আগে কৃষির আবির্ভাব ঘটায় এবং তারপর যন্ত্রসভ্যতায় উন্নীত হবার দুশো বছরের মধ্যে তারা রেডিও সংকেত পাঠানোর ক্ষমতা অর্জন করেছে। এটা অভাবনীয় অগ্রগতি! তাদের ক্ষেত্রে এই অগ্রগতি অত্যন্ত ধীরগতিতে হয়েছে। এখন তারা তাদের ঐ কোয়ান্টাম কম্পিউটার এবং তৎসংলগ্ন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে পৃথিবীতে আধিপত্য বজায় রাখতে চায়। এই আধিপত্য তারা অপার্থিব অলৌকিক সব কার্যক্রম দেখিয়ে পৃথিবীর মানুষকে দমিয়ে রাখতে ব্যবহার করে। ১১-মাত্রিক জগত থেকে তিন-মাত্রার পৃথিবীবাসীর জন্য হলোগ্রাফিক ইল্যুশন তৈরি করা সহজ। তারা অধিদৈবিক অপটিকাল ইল্যুশন ব্যবহার করে পৃথিবীর মানুষকে ভয় দেখায়, তারা মনুষ্যরূপী এজেন্টদের দিয়ে নানা আতঙ্ক ছড়ায়। এই টানাপোড়োনের মধ্য দিয়ে এলিয়েনরা (সান-টি বা ট্রাইসোলারিয়ান) আবিষ্কার করে মানুষের মধ্যে কিছু অন্ধকার ব্যাপার আছে। যেমন মানুষ মিথ্যা বলে, প্রতারণা করে ইত্যাদি। মানুষও বোঝে যে তাদের সকল কার্যকলাপ এলিয়েনদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মনিটর করতে পারলেও মানুষ কী চিন্তা করে বা তাদের এনালগ কার্যাদি এলিয়েনরা আগাম ধরতে পারে না। দেখা যায়, এলিয়েনরা বেশ কিছুটা আগাম ভবিষ্যত বুঝতে পারে। সেজন্য ন্যানোফাইবারের গবেষণা তারা বন্ধ করাতে চায়, কিংবা সল ডুরান্ডকে হত্যা করতে চায়। কারণ ড: ইয়ে মৃত্যুর আগে সলের সাথে কথা বলে গিয়েছিলেন, তাই এলিয়েনরা সন্দেহ করছে যে কোনো গোপন বার্তা নিশ্চয়ই তাকে দেওয়া হয়েছে। ইয়ে এবং ডুরান্ডের সেই কথোপকথনে একটি রূপকধর্মী গল্প ছিল। এখন এই গল্পের মধ্য দিয়ে ডঃ ইয়ে কী বার্তা দিয়ে গিয়েছেন, সেটা এলিয়েনরা বুঝতে চায়। এছাড়া মানুষের ফাইটব্যাকের অসাধারণ সব গল্পও আছে। এর মধ্য দিয়ে সিরিজটির প্রথম পর্ব সমাপ্ত হয়। পরের পর্বগুলি সিশিঙের অন্য দুটি বই অবলম্বনে এগুবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। সেখানে মানুষেরা এলিয়েনদেরকে বলবে যে তোমাদের স্থানাংক আমরা অন্য এলিয়েনদের মাঝেও ছড়িয়ে দেব। এতে আমাদের সান-টি’রা ভয় পেয়ে যাবে। কেননা একটি আইন আছে যে যে-সভ্যতা তার অস্তিত্ব রেডিও সংকেতের মাধ্যমে জানান দিল তো সে তার নিজের ধ্বংস ডেকে আনল, কেননা অন্য অত্যাধুনিক এলিয়েন সভ্যতা এসে তাকে ধ্বংস করে দেবে। তো এইভাবে গল্প ডালপালা মেলেছে।
তিনটি নক্ষত্রের কোলে যদি একটি গ্রহ থাকে তবে সেই গ্রহ ব্যাপক টানাপোড়েনের শিকার হবে। অবশ্য এই টান নক্ষত্র তিনটির ভরের এবং দূরত্বের উপর নির্ভর করে। যদি তিনটি নক্ষত্রের ভর ভিন্ন ভিন্ন হয়, তাহলে এদের যেকোনো দুটি নক্ষত্র একটি জোড়া-তারা ব্যবস্থা বা বাইনারি হিসেবে কাজ করে, এবং তৃতীয়টি দূর থেকে এই যুগ্ম-ব্যবস্থার সাধারণ ভরকেন্দ্রকে ঘিরে ঘুরবে। দূরত্বানুসারে গ্রহটি তখন হয় ঐ যুগ্ম-ভরবিন্দু বা তৃতীয় তারাটিকে ঘিরে ঘুরতে পারে। এমন ক্ষেত্রে যদি সিস্টেম-সংলগ্ন (এক বা একাধিক) গ্রহ থাকে তবে তার কক্ষপথ খুব বেশি কেওটিক বা বিশৃঙ্খল নাও হতে পারে। মোটামুটি সাম্যবস্থা সে পেতে পারে। যেমন সূর্যের সবচেয়ে কাছের তারা-ব্যবস্থা আলফা-সেন্টরি সিস্টেমের কথা বলা যায়। এখানে দুটি তারা – একটির ভর সূর্যের ১.১ গুণ এবং অন্যটির ০.৯ গুণ – পরস্পরকে ঘিরে বাইনারি সিস্টেমের মত ঘোরে। আর তৃতীয় তারাটি, প্রক্সিমা সেন্টরি, এই বাইনারিকে ঘিরে একটু দূর থেকে ঘোরে। ‘থ্রি বডি প্রবলেম’ গল্পে এই সিস্টেমের নাম নেওয়া হয়নি, আর এদের প্রকৃতি ঠিক গল্পোক্ত তিন-তারার মত না-হলেও সূর্যের ৪ আলোকবর্ষের মধ্যে এটিই একমাত্র তিন-তারা বা ট্রিপল স্টার সিস্টেম। আর যদি তিনটি নক্ষত্রই কাছাকাছি ভরের হয় এবং এদের মধ্যে দূরত্ব কম হয় তাহলে এদের কক্ষপথ খুবই জটিল হয়ে যায়। এবং তখন এদের কাছাকাছি যদি কোনো গ্রহ থাকে এবং সে যদি এদের সম্মিলিত মাধ্যাকর্ষণের আওতায় পড়ে, তবে গ্রহটির কক্ষপথ কেওটিক বা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। অর্থাৎ অঙ্কের মাধ্যমে একটি এক্সাক্ট সল্যুশন তো দূর-কি-বাত, এর নিউমেরিকাল সমাধানও করা মুশকিল হয়ে পড়ে। কেননা প্রতিনিয়ত গ্রহের উপর নক্ষত্র-ত্রয়ের আকর্ষণ বদলাতে থাকে, এবং গ্রহের গতি প্রতিমুহূর্তে বদলায়। ফলে ইনিশিয়াল বা বাউন্ডারি শর্তগুলি খুব নিখুঁতভাবে না-জানলে এই গ্রহের গতিপ্রকৃতি কী হবে সেটা জানা খুব মুশকিল হয়ে পড়ে, এমনকি কমপিউটার সিমুলেশনেও। ফলে এটি যেকোনো একটি নক্ষত্রের করাল গ্রাসে পড়তে পারে, ছিটকে দূরে চলে যেতে পারে, অথবা কখনো এ-তারা কখনো ও-তারার আওতায় ঘুরপাক খেতে থাকবে। এই গ্রহের ভবিষ্যত পথ গণনা করা যায় না। উপরন্তু তিনটি তারার কোনোটি যদি অন্তিম দশায় পালসার / নিউট্রন স্টার / ব্ল্যাকহোলের পরিণত হয়, তবে পুরো ব্যাপারটি আরও জটিল হয়ে যায়। ‘থ্রি বডি প্রবলেম’ গল্পে এমনই একটি সিস্টেমের কল্পনা আছে যেখানে নক্ষত্র-ত্রয়ের পাল্লায় পড়ে গ্রহটির ঋতু পরিবর্তনে সাংঘাতিক ব্যত্যয় সৃষ্টি হয়। এতে করে ঐ গ্রহের বুদ্ধিমান সত্তার বিকাশ চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। এমনই একটি সিনারিও সান-টি সভ্যতা ভিডিও গেমের মাধ্যমে মানুষকে দেখাতে চেয়েছে। এখন কথা হল, এমন টালমাতাল কক্ষপথের ভেতরে গ্রহ সৃষ্টি হতে পারে কিনা, হলেও সেখানে প্রাণ-ধারণের উপযুক্ত বাসযোগ্য পরিবেশ থাকবে কিনা সেটা বড় প্রশ্ন। আমরা জানি, বাসযোগ্য পরিবেশ হল এমন শর্ত যার অধীনে কোনো গ্রহ থেকে তার নক্ষত্র ঠিক কত দূরে থাকলে পরে তার পৃষ্ঠে পানি তিন দশাতেই থাকতে পারে সেটা জানা দরকার। যদি গ্রহ ঐ দূরত্বের বাইরে থাকে তবে সেখানে প্রাণের উদ্ভব ও বিকাশ মুশকিল। এই দূরত্ব নক্ষত্রের ভর-বর্ণালি ইত্যাদির উপর নির্ভর করে। তাহলে খুব জোরালো সম্ভাবনা আছে যে গল্পোক্ত তিন-তারা-সিস্টেমের যে-রূপ দেখা যাচ্ছে সেখানে প্রাণ-বান্ধব গ্রহের উদ্ভবই সম্ভব নয়। তাহলে এ সভ্যতা ঐ গ্রহে এলো কী করে? সম্ভবত গ্রহটি অন্যত্র দূরে ছিল, যেখানে প্রাণবান্ধব শর্ত বজায় ছিল। তারপর গ্রহগতির কোনো দুর্বিপাকে সে এসে এই ট্রিপল-সিস্টেমের গ্রাসে পড়েছে। অজস্র এক্সোপ্লানেটের আবিষ্কারের ফলে আমরা দেখেছি, বাহ্য সৌরজগৎগুলি কী পরিমাণ ডাইনামিক ইন্সটাবিলিটিতে ভোগে। সেখানে গ্রহগুলি এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে, তবে সেটা মিলিয়ন বছরের স্কেলে। আরও একটি কথা বলা দরকার। একদল গ্রহ-বিজ্ঞানী তত্ত্ব দিয়েছেন, অপার্থিব বুদ্ধিমত্তা বিকাশে অনেকগুলি বাধা থাকে, যার মধ্যে একটি বাধা হল সময় [১]। মহাবিশ্বের সৃজনের পর থেকে ভারী নক্ষত্রের অভ্যন্তরে ক্রমান্বয়ে ভারী মৌল সংশ্লেষিত হয়ে চলেছে। ফলে এভাবে আমরা হাইড্রোজেন থেকে ক্রমে ক্রমে লোহা, ক্যালশিয়াম, আয়োডিন, ইউরেনিয়াম ইত্যাদি পেয়েছি। এখন বুদ্ধিমান প্রাণ ধারণ করতে হলে গ্রহকে প্রাণবান্ধব অঞ্চলের ভেতর থাকতে তো হবেই, উপরন্তু গ্রহের পৃষ্ঠে ঐ সব ভারী মৌলের প্রাচুর্যও থাকতে হবে। এটা নিশ্চিত করতে হলে যে প্রোটো-প্লানেটারি ডিস্ক থেকে গ্রহ তৈরি হয়েছে সেটাতে ভারী মৌলের অনুপাত বিশ্লেষণ করতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই এটা আমরা নির্ণয় করতে পারি সেন্ট্রাল নক্ষত্রের বয়স এবং বর্ণালি থেকে। আমাদের সূর্য একটি তৃতীয় প্রজন্মের মাঝারি বামন তারা। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিগ ব্যাং থেকে ১০/১১ বিলিয়ন বছর অতিবাহিত না-হলে অমন ভারী মৌল বিশিষ্ট নক্ষত্র পাওয়া যায় না। ফলে যদি কোনো গ্রহে বুদ্ধিমান সত্তা বিকশিত হয় তবে তার বয়স পৃথিবীর মতই হবে। ভারী মৌলের উপস্থিতি ছাড়া সভ্যতা হবে না। ফলে থ্রি বডি গল্পের অপার্থিব সত্তা মানুষের সভ্যতার চেয়ে খুব বেশি প্রাচীন হওয়া সম্ভব নয়। এর নাম ‘গেইয়ান বটলনেক’ [১]। এছাড়াও গ্রহে বুদ্ধিমান সত্তা বিকশিত হবার আরও অনেক ক্রাইটেরিয়া আছে [১]।
আবার আমরা দেখি, অত্যাধুনিক এবং অগ্রগামী গবেষণায় প্রাপ্ত ১১-মাত্রিক কোয়ান্টাম কমপিউটার প্রয়োগ করে সান-টি সভ্যতা সীমিত ক্ষেত্রে আগাম ভবিষ্যত জানতে পারছে। আমরা দেখি, তারা নির্দিষ্ট কিছু গবেষণা, যেমন ন্যানোফাইবার, বন্ধ করতে চাইছে। নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তিত্বকে হত্যা করতে সচেষ্ট, কেননা ভবিষ্যতে তারা তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হবে। এটা যদি সম্ভব হত, তাহলে তারা আগেই বুঝত পৃথিবী তাদের জন্য উপযুক্ত গন্তব্য হবে কিনা। সত্যি বলতে কি, এত জ্ঞানী সভ্যতা এতদিন ধরে আর কোনো সংকেত না পেয়ে কেবল পৃথিবীর সংকেত পেয়ে রওয়ানা দিল – সেটা ভাবতে কষ্ট লাগে। তারা তো আগেই মহাজাগতিক সার্ভে করে জেনে ফেলবে যে তাদের নাক্ষত্রিক পাড়া-প্রতিবেশী কেমন! গল্পের পটভূমিতে এটা ঠিক খাপ খায় না। তাছাড়া কিছু প্লানেটারি বিধির কথা এই গল্পে বলা হয়েছে। যেমন কোনো এলিয়েন সভ্যতা যদি নিজের অবস্থান জানান দেয় তবে অচিরেই অন্য আরো উন্নততর এলিয়েন সভ্যতা তার ধ্বংস সূচিত করে। কারণ উচ্চতর সভ্যতা নিম্নতর সভ্যতাকে নিয়ে গবেষণা করতে চাইবে। সে বুঝতে চাইবে এর বুদ্ধির উৎস কী ইত্যাদি। এটা একটা আরোহী লজিক এবং মূলত কলোনিয়াল যুগের প্রবণতা বিশ্লেষণ করে এই বিধি প্রণীত হয়েছে। যে-বন্দর বেশি জাকজমকের তার প্রতি বর্বরদের লোভ তত বেশি। এই প্রবণতারই গ্রহগত সম্প্রসারণ ঐ বিধি। আমার মনে হয়না এমন কিছু কাজ করবে। মোট কথা, আমাদের গ্যালাক্সিতেই এমন অপার্থিব বুদ্ধিমত্তা থাকার সম্ভাবনা খুবই কম- এমনটি বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে [১]। আমাদের নিকটতম মহাজাগতিক পরিবেশ বুদ্ধিমত্তা-বান্ধব নয়। এখানে বুদ্ধিমত্তা থাকলে আমরা টের পেতাম এতদিনে। মনে রাখতে হবে, ১৯৬০-এর দশক থেকেই SETI প্রোগ্রামের মাধ্যমে সংকেত প্রেরণ চলছে। আরও একটি জিনিস মনে রাখতে হবে, যদি কখনো কোনো এলিয়েন শিপ বা প্রোব বা উড়ন্ত চাকির খবর পাওয়া যায়, সেগুলো অবশ্যই যান্ত্রিক হবে, অর্থাৎ কোনো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-জারিত এ.আই. চালিত হবে। কেননা মহাকাশে দূরত্ব এত বিশাল যে যতই বুদ্ধিমান হউক না কেন, এই দূরত্বের অত্যাচার থেকে কেউ বাঁচতে পারবে না। তাই মহাকাশে অনুসন্ধান চালাতে হলে যেকোনো এলিয়েন প্রথমে এ.আই. চালিত নভোযান পাঠাবে। আর যেকোনো এ.আই. পাবার অর্থই হল তার স্রষ্টা কোনো বুদ্ধিমান বায়োলজিকাল সত্তা।
এলিয়েন ইনভেশন বা এলিয়েন কনট্যাক্ট জাতীয় যেসকল চলচ্চিত্র বা বই পড়েছি, তন্মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ক্লার্কের ‘স্পেস অডিসি’, সেগানের ‘কনট্যাক্ট’, নোলানের পরিচালিত ‘ইন্টারস্টেলার’ এর পরই আমি ‘থ্রি বডি প্রবলেম’কে রাখব। প্রথমটি নক্ষত্রশিশুর আইডিয়া নিয়ে আসে যার মাধ্যমে সংযোগ স্থাপিত হয়, দ্বিতীয়টি স্বপ্নের মাধ্যমে অর্থাৎ ব্রেইন-স্ক্যানের মাধ্যমে সংযোগের কথা বলেছে, তৃতীয়টি পঞ্চমাত্রিক জগতে টেসারেক্টের মাধ্যমে ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটার মডুলেশনের মাধ্যমে যোগাযোগের কথা বলে। আরও অন্যান্য আইডিয়ার ভেতরে প্রথম গল্পটি সর্বপ্রথম কমপিউটারের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কথা বলে এবং তার মানসিক যাতনার কথাও প্রকাশ্যে আনে। সেখানে একটি ‘হিউরিস্টিক অ্যালগোরিদম’ বা আধুনিক ভাষায় মেশিন লার্নিং দ্বারা পরিচালিত কমপিউটার কীভাবে অন্তর্দ্বন্দ্বে পতিত হয়ে (HAL complex) হন্তারক হয়ে ওঠে সেই সম্ভাবনাও ব্যক্ত হয়েছে। ‘থ্রি বডি প্রবলেম’ কোয়ান্টাম কমপিউটার পরিচালিত এ.আই. এবং ভিডিও গেমের মাধ্যমে যোগাযোগের কথা বলে। প্রতিটি গল্পই অনবদ্য সূক্ষ্মতায় অপার্থিব সংযোগকে মানবীয় অভিজ্ঞতার বর্গের ভেতরে নিয়ে এসেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই গ্রহান্তরিত মোডটি ভাল লেগেছে।
সূত্র:
[১] ‘এলিয়েনের সন্ধানে’, ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী, প্রথমা, ২০২২।
[২] এখানে আমরা ড্যানিয়েল ক্লেপনার ও রবার্ট কোলেনকোও-এর ‘মেকানিকস’, ১৯৭৩ এর ট্রিটমেন্ট উল্লেখ করেছি। তবে সমতুল্য ট্রিটমেন্ট পাওয়া যাবে হারবার্ট গোল্ডস্টাইনের জগৎবিখ্যাত ‘ক্লাসিকাল মেকানিকস’, দ্বিতীয় সং, ১৯৮০, তৃতীয় অধ্যায়, কিংবা এর সহজ রূপ এ. এম. হারুন-অর-রশীদের ‘চিরায়ত বলবিদ্যা’, বাংলা একাডেমি, ১৯৮৯ থেকেও পাওয়া যাবে।
[৩] উইকিপিডিয়া, “টু বডি প্রবলেম”, “থ্রি বডি প্রবলেম”।