পরশমণি জ্বলে

বাউলকবি ও দার্শনিক জালাল উদ্দীন খাঁর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে লিখেছেন কবি প্রাবন্ধিক গোলাম ফারুক খান

গোলাম ফারুক খানগোলাম ফারুক খান
Published : 30 July 2022, 06:02 PM
Updated : 30 July 2022, 06:02 PM

'...মানুষের ভিতরে মানুষ, পরশমণি জ্বলে --

অন্তরে অনন্ত লীলা, দেখবে আত্মসাধন হলে।

... ... ...

রূপের সিদ্ধি করছে যারা, অধরাকে ধরছে তারা

আপনার ছবি সামনে খাড়া ভেবে কয় জালালে;

সেই আলোকে আঁধার নাশে, তত্ত্বজ্ঞান শিখিলে

আলোক চেয়ে রাস্তা ধর থাকে যদি কর্মফলে।।'

-- জালাল উদ্দীন খাঁ

আজ থেকে ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে শ্রাবণের এই তারিখে প্রায়ান্ধকার, ক্লান্ত সন্ধ্যায় তিনি মরপৃথিবীর বাস ত্যাগ করেন। ফুল-লতাপাতায় ঢাকা নিজের দোতলা টিনের ঘরটিতে শুয়ে তিনি কথা বলছিলেন একজন শিষ্যের সঙ্গে। কথা বলতে বলতে চুপ করে পাশ ফিরে শুলেন। একজন গৃহকর্মী তাঁকে কিছু দিতে এসে ডাক দিলে তিনি সাড়া দিলেন না। হতচকিত গৃহকর্মীর চিৎকারে ছুটে গিয়ে দেখলাম, আমার পিতামহ বাউলকবি ও দার্শনিক জালাল উদ্দীন খাঁ আর আমাদের সঙ্গে নেই। বুঝতে পারলাম, আমাদের পরিবার ও জনপদের জীবনে একটি অধ্যায়ের অবসান ঘটেছে। বুঝতে পারলাম, আমরা যেমন আমাদের বটবৃক্ষসম অভিভাবককে হারিয়েছি, তেমনি আমাদের জনপদ হারিয়েছে সেই মানুষটিকে যিনি তাঁর গানে, কথায়, নিত্যদিনের তত্ত্ববিচারে কাছের ও দূরের মানুষজনের শিল্পতৃষ্ণা ও বুদ্ধিবৃত্তিক এষণাকে তৃপ্ত করার চেষ্টা করতেন। যাঁর সার্বক্ষণিক চেষ্টা ছিল মানুষের ভেতরের মানুষটিকে খুঁজে বের করে তাকে পরশমণি বানিয়ে তোলার, যাতে তার স্পর্শে অন্যরাও পরশমণি হতে পারে। তত্ত্বজ্ঞানের আলোয় আঁধার নাশ করার জন্য যিনি আত্মসাধনের জীবনব্যাপী ব্রত গ্রহণ করেছিলেন।

যখন খুব ছোট ছিলাম তখন পিতামহের হাত ধরেই হাটবাজার, মেলা এবং বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব-অনুষ্ঠানে যেতাম। নৌকায় ঘুরে বেড়াতাম এদিক-সেদিক। বাউলগান আর কবিগান তো বটেই, এ ছাড়াও নানাবিধ পালা-পার্বণ আর গীতরঙ্গের অন্তরঙ্গ পরিচয় পেয়েছি তাঁর সঙ্গে থেকেই। নিজ গ্রামে কিংবা আশেপাশের গ্রামগুলোতে এরকম কোনো উপলক্ষ ঘটলেই নিয়মিত অতিথি হিসাবে তিনি যেতেন আর তাঁর সঙ্গী হতাম আমরা, তাঁর শিশু-পৌত্ররা। তিনিই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন গ্রামীণ সমাজ-সংস্কৃতির বিচিত্র সব দিকের সঙ্গে -- প্রকাশ্য যে জীবনধারা বয়ে চলে তার সঙ্গে তো বটেই, অন্তরালে ও অবতলে কৃষিজীবী আর বৃত্তিজীবী মানুষের আনন্দ-বেদনা, ভাব-ভাবনা এবং সৃজনশীলতার যে কলরোল চলে, তার সঙ্গেও। তিনিই চিনিয়েছিলেন রাতের আকাশের তারা, বাংলাদেশের ছয় ঋতুর রং, প্রাণ ও প্রকৃতির সমারোহে চারদিকে মানুষের বেঁচে থাকার আয়োজন। শৈশবে আমাদের যতটুকু চোখ ফুটেছিল তার অনেকটাই তাঁর অবদান।

আমাদের লোক-ঐতিহ্যে যে সহজ মানুষের কথা বলা হয়েছে, সেরকম একজন সহজ মানুষ ছিলেন জালাল উদ্দীন খাঁ। তাঁর জীবনযাপন ছিল অত্যন্ত সরল, অনাড়ম্বর এবং নিরন্তর আত্ম-সন্ধানমুখি। মানুষের সান্নিধ্যে খুব প্রীত বোধ করতেন। প্রতিদিনই তাঁর কাছে আসতেন হরেক রকম অতিথি। টুপি-আলখাল্লাপরা মৌলানা, কণ্ঠি ও নামাবলিধারী বৈষ্ণব, জটাজুটধারী ফকির-সন্ন্যাসী এবং বেশ কিছু শিষ্য-সাগরেদ ছিলেন তাঁর নিত্যদিনের আলাপের সঙ্গী। তাঁদের সঙ্গে ধর্ম, সমাজ, নীতি-নৈতিকতা, সঙ্গীত ইত্যাদি বিষয়ে শাস্ত্র আর তত্ত্ববিচার করে তাঁর অনেকটা সময় কাটত। বাকি সময় তিনি নিজের ঘরে শুয়ে বুকের নিচে বালিশ চাপা দিয়ে লিখতেন। লিখতে লিখতে মাঝেমাঝে চোখ বন্ধ করে কী জানি ভাবতেন। মাঝেমাঝে গজারি কাঠের খুঁটিতে ঝোলানো দোতারাটি টেনে নিয়ে নিজের লেখা কথাগুলো সুর করে গাইতেন।

দূর-দূরান্ত থেকে আসা অনেক শিষ্য-সাগরেদ মাসের মাসের পর মাস তাঁর নিচের ঘরটিতে থাকতেন। কখনো আবার বেশ নাটকীয় দৃশ্যের অবতারণা হতো। মনে পড়ে, একবার একজন রক্তচক্ষু, উন্মাদপ্রায় মানুষ আমাদের বাড়ির সামনে এসেই 'জালাল বাবা, জালাল বাবা' বলে চিৎকার করতে করতে বর্ষার ভরা পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। পুকুর থেকে তুলে আনা হলে তিনি মাটিতে গড়াতে গড়াতে বৈঠকখানার বারান্দায় বসা জালাল উদ্দীন খাঁর কাছে এসে থামলেন। লোকটির উদ্ভট আচরণ দেখে আমরা শিশুরা খুব ভয় পাচ্ছিলাম। কিন্তু জালাল উদ্দীন খাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলার পর দেখলাম তাঁর ভিন্ন রূপ। তখন তিনি সম্পূর্ণ শান্ত, স্বাভাবিক এক মানুষ। তাঁকে একটি লুঙ্গি দেওয়া হলো এবং কয়েকদিন গুরুর সঙ্গে থেকে তিনি প্রসন্ন মনে ঘরে ফিরে গেলেন।

প্রায়ই আমাদের বাড়িতে বাউলগানের অনুষ্ঠান ও হালকা-জিকির হতো। বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিখ্যাত বাউলগুরুরা এইসব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন। বিশেষভাবে মনে পড়ে উকিল মুনশি, উমেদ আলি, আবদুল মজিদ তালুকদার, প্রভাত সূত্রধর, আবেদ আলি প্রমুখের কথা। উকিল মুনশির কাটাবিচ্ছেদ গান শুনে শ্রোতাদের চোখের জলে বুক ভিজে যেত। আর তর্কপ্রবণ বাউল উমেদ আলি যখন একতারা হাতে মারমুখি ভঙ্গিতে প্রতিপক্ষকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতেন তখন তত্ত্ববিচারের উত্তেজনায় সমাবেশে এক টানটান পরিবেশ সৃষ্টি হত। শেষমেষ মঞ্চে উপস্থিত গৃহকর্তা জালাল উদ্দীন খাঁর ওপর অনেক কূটপ্রশ্ন সমাধানের দায়িত্ব দেওয়া হতো। তখন তিনি একতারা বা দোতারা হাতে উঠে গানের মাধ্যমেই সেইসব প্রশ্নের সমাধান তুলে ধরতেন।

বিশ শতকের বিশ, তিরিশ এবং চল্লিশের দশকে তিনি ময়মনসিংহ ও সিলেটের সমসাময়িক কিংবদন্তিতুল্য বাউলদের সঙ্গে অনেক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন। সেইসব তর্কমুখর, সংগীতসুধাসিক্ত অনুষ্ঠানের রেশ অনেকদিন জনস্মৃতিতে জীবন্ত ছিল। আমরাও ছেলেবেলায় প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে এসব অনুষ্ঠানের কথা শুনেছি। নেত্রকোনা শহরের গৌরীপুর কাছারি, গরুহাট্টা মাঠ এবং হাওর-জনপদের নানা জায়গায় এরকম বড় বড় অনুষ্ঠানগুলি হয়েছে। বিশিষ্ট লোকসংস্কৃতি-গবেষক মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন কাসিমপুরী তাঁর 'বাংলাদেশের লোক-সংগীত পরিচিতি' (বাংলা একাডেমী, ১৯৭৩) বইয়ে জানিয়েছেন, ১৯২১ সালে জালাল উদ্দীন খাঁ ঢাকায় ১৩০ ফরাশগঞ্জ নর্মাল হোস্টেলে 'শুকাইল কমলের কলি নতুন গাছের ডালে/পিয়ার লাগি শরীর কালো ভাসি নয়ন জলে' -- এই গানটি পরিবেশন করে শহরের সংগীতপিপাসু মানুষকে মুগ্ধ করেছিলেন। সিরাজুদ্দীন কাসিমপুরীর ভাষায়: '...যেদিন গানের আসরে এই গান গাহিয়াছিলেন সেই দিন হইতে তাঁহার গানের সুর ঢাকা শহরময় ছড়াইয়া পড়ে। ইহার পর ক্রমে তিনি ঢাকার মুসলিম হলের মিলনায়তনে, নবাব সাহেবের মঞ্জিলে এবং অপরাপর বিশিষ্ট সংগীতপ্রিয় ব্যক্তির বাসস্থানে গান গাহিয়া বেশ স্মরণীয় ও বরণীয় হইয়া পড়েন। তাঁহার গান বহুদিন ঢাকার কুলি-মজুর, গাড়োয়ান এবং বিশিষ্ট গায়কদের মুখে শোনা গিয়াছে।' পঞ্চাশের দশকের শেষদিকে এসে জালাল উদ্দীন খাঁ মঞ্চে উঠে গান গাওয়া ছেড়ে দেন এবং গান রচনা ও তত্ত্বচর্চায় মনোনিবেশ করেন।

আমাদের বাড়িতে যখন গভীর রাতে হালকা-জিকির অনুষ্ঠিত হতো তখন ভাবমগ্ন ফকিরদের আত্মহারা অবস্থা দেখে অবাক হতাম। অনেক ফকির নেচে নেচে জিকির করতে করতে কয়েক মাইল দূরে চলে যেতেন। বিশেষ করে একজনের কথা মনে পড়ে যাঁর নাম ছিল শরিয়ত শাহ ফকির। হালকা শুরুর কিছুক্ষণ পরেই তিনি অদৃশ্য হয়ে যেতেন। অনেক পরে এসে কেউ হয়তো খবর দিত যে, তাঁকে দু-তিন মাইল দূরে কোনো নদীর তীরে কিংবা বনের কিনারে একা একা জিকির করতে দেখা গেছে। শেষরাতে শরিয়ত শাহ ঠিকই ফিরে এসে মূল অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন। সম্ভবত এইসব ভাবোন্মাদ ফকিরের কথা ভেবেই জালাল উদ্দীন খাঁ লিখেছিলেন তাঁর একটি বিখ্যাত গান:

'ভাবের তরঙ্গে, আস আমার সঙ্গে

যদি কারো ভালো লাগে।।

ভাবের কথা কইতে গেলে না আছে তার শেষ

পুত্রকন্যার মাঝে থাক হইয়া নিরুদ্দেশ,

ছাড়িয়ে সন্ন্যাসীর বেশ, মাতাল বৈতাল সাজ আগে।।...

যে বোঝে না ভাবের মরম, তার কপালে ছালি

ঠাঁই চিনিয়া না মাখিলে কাজল হয় যে কালি,

জালাল কয় মোর গুদাম খালি, ভাঙ্গা ঘরে শিয়াল জাগে।।'

জালাল উদ্দীন খাঁর জন্ম ১৮৯৪ সালের ২৫ এপ্রিল এবং প্রয়াণ ১৯৭২ সালের ৩১ জুলাই। তিনি জন্মেছিলেন অবিভক্ত ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোনা মহকুমার আসদহাটি গ্রামে। আর প্রয়াত হন একই এলাকায় তাঁর স্থায়ী বাসস্থান সিংহেরগাঁওয়ে। তিনি পড়াশোনা করেছিলেন নেত্রকোনার ক্লার্কার মিডল মাদ্রাসা, দত্ত হাইস্কুল এবং কেন্দুয়া জয়হরি স্প্রাই ইনস্টিটিউশানে। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় স্বদেশি আন্দোলনের প্রভাবে স্কুলের পড়াশোনা ছেড়ে দেন। কাব্য ও সঙ্গীতের প্রতি আকর্ষণ তিনি মূলত তাঁর সাহিত্যপ্রেমী পিতা সদর উদ্দীন খাঁর কাছ থেকে পেয়েছিলেন। স্কুলে পড়ার সময়ই তাঁর মধ্যে কাব্য ও সংগীতপ্রতিভার স্ফুরণ ঘটে। বিশ শতকের বিশের দশকে পত্নী ইয়াকুতুন্নেসা খানমের অকাল-প্রয়াণের পর সেই ঘটনার অভিঘাতে তিনি সংগীত ও তত্ত্বসাধনায় মনপ্রাণ সঁপে দেন।

কাছেই মদনপুর গ্রামে বাংলার প্রথম সুফি সাধকদের অন্যতম শাহ সুলতান কমরুদ্দিন রুমির মাজারে গিয়ে পির-ফকির-বাউলদের সঙ্গে নিয়মিত সময় কাটাতে থাকেন। কিছুদিন তিনি সিলেটের বিখ্যাত বিথলং আখড়ায় আসাযাওয়া করে সাধুসন্ন্যাসীদের কাছ থেকে লৌকিক ধর্ম ও সাধনপন্থা সম্পর্কে নিবিড় জ্ঞান লাভ করেন। জালাল উদ্দীন খাঁর মানসজগতের বিকাশে আরো একজন মানুষের গভীর প্রভাব ছিল -- তিনি হচ্ছেন চট্টগ্রামের বিখ্যাত সুফি সাধক সৈয়দ আবদুল কুদ্দুস। চিশতিয়া তরিকার এই সাধক পূর্ব ময়মনসিংহ এলাকায় একটি বিশাল ভক্তগোষ্ঠী গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর সাধনরীতিতে হালকা এবং সংগীতের প্রাধান্য থাকায় বিশ শতকের প্রথম দিকে তা পূর্ব ময়মনসিংহের কৃষককুলের ভাবজগতে এক তরঙ্গ-উচ্ছ্বাস সৃষ্টি করে। এই সাধকের কাছ থেকেই জালাল ইসলাম ধর্মের সুফি ভাষ্য সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান লাভ করেন যা তাঁর তত্ত্বভাবনায় নতুন মাত্রা এনে দেয়।

জালাল উদ্দীন খাঁ প্রায় এক হাজার গান লিখেছিলেন। তাৎক্ষণিকভাবে মুখে মুখে রচিত অনেক গান এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। জীবৎকালে তিনি ৬২৮টি গান নিয়ে 'জালালগীতিকা' নামে চার খণ্ড বই বের করেছিলেন। তাঁর প্রয়াণের পর ৭২টি গান নিয়ে 'জালালগীতিকা পঞ্চম খণ্ড' বের হয়। সব বই একত্র করে ৭০২টি গান নিয়ে ২০০৫ সালে যতীন সরকারের সম্পাদনায় 'জালালগীতিকা সমগ্র' প্রকাশিত হয়েছে। জালাল উদ্দীন খাঁর অনেক গান সাধারণ্যে সুপরিচিত এবং আব্বাস উদ্দিন আহমদ, আবদুল আলীমের মতো প্রবাদপ্রতিম শিল্পী এবং আরো অনেকেই এই গানগুলি গেয়েছেন। এসব গানের মধ্যে আছে: 'ও আমার দরদী আগে জানলে তোর ভাঙ্গা নায় আর চড়তাম না,' 'আরে ও ভাটিয়াল গাঙ্গের নাইয়া, ঠাকু ভাইরে কইও আমায় নাইয়র নিতো আইয়া,' 'সেই পাড়ে তোর বসতবাড়ি, এই পাড়ে তোর বাসা,' 'দয়াল মুর্শিদের বাজারে -- কেউ করিছে বেচাকেনা কেহ কাঁদে রাস্তায় পড়ে,' 'আরে ও রঙ্গিলা নায়ের মাঝি -- এই ঘাটে লাগাইয়া নাও নিগুম কথা কইয়া যাও শুনি' ইত্যাদি।

চল্লিশের দশকে 'জালালগীতিকা' প্রথম খণ্ডের ভূমিকা লিখেছিলেন কবি ও লোকসংস্কৃতি-গবেষক রওশন ইজদানী। ভূমিকায় তিনি বলেছিলেন, 'তত্ত্বদর্শনে জালাল সাগরসদৃশ, বিশাল।' আজ এত বছর পর রওশন ইজদানীর মন্তব্যটি একটু পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, জালালের দর্শনে সাগরের ব্যাপ্তি এবং গভীরতা কোনোটিরই অভাব নেই। কারণ এই দর্শন বাংলার দর্শন, কৃষিজীবী ও বৃত্তিজীবী মানুষের যাপিত জীবনের দর্শন। তাতে একেবারে বাংলার মাটির ভেতর থেকে উঠে আসা সম্পদ যেমন আছে, তেমনি বাইরে থেকে আসা ভাবধারাও আছে। ভারতীয় দর্শনের শ্রমণপন্থী ও লোকায়তিক ধারা, বাংলার বৌদ্ধ আর সহজিয়া মত, নাথপন্থা, তন্ত্র, এবং মধ্য এশিয়া থেকে আগত সুফিবাদ -- এই সব কটি চিন্তাধারা জালালের ভাবনায় এসে মিশে গিয়েছে। বাইরের চিন্তাগুলিকেও বাংলার মাটি তার প্রাণের রসে ভিজিয়ে আপন করে নিয়েছে।

কবি তাঁর গানগুলিকে আত্মতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, সংসারতত্ত্ব, সাধনতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব, মাতৃতত্ত্ব, লোকতত্ত্ব, দেশতত্ত্ব, বিরহতত্ত্ব -- এরকম তেরোটি তত্ত্বে সাজিয়েছিলেন। এর বাইরে 'ভাটিয়ালি' পর্যায়েও অনেক হৃদয়স্পর্শী গান রয়েছে। 'দেশতত্ত্বে'র গানগুলিতে প্রাধান্য পেয়েছে সমাজ-সংসারের নানা অসঙ্গতির সমালোচনা। তবে এই তত্ত্বগুলির মধ্যে দেহতত্ত্বই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এর কারণ, বাংলার লৌকিক সাধনায় গোড়া থেকেই দেহতত্ত্বের জায়গাটি খুব বড়। 'যা আছে দেহভাণ্ডে তাই আছে ব্রম্মাণ্ডে' -- এ কথা তো শত শত বছর আগেই বাংলার সাধক বলেছেন। তবে জালাল উদ্দীন খাঁর মতো ভাবুকরা যুগে যুগে এই দেহতত্ত্বের মধ্যে নানা নতুন ধারণা যোগ করেছেন। দেহের মধ্য দিয়ে নিজেকে জানার, নিজের মধ্য দিয়ে অপরকে জানার এবং অপর মানুষের মধ্য দিয়ে পরম সত্তাকে জানার চেষ্টা করেছেন। স্রষ্টা এবং সৃষ্টির মধ্যে সম্পর্ক বোঝার চেষ্টা করেছেন এবং এই দুই সত্তার মধ্যে অভেদ কল্পনা করেছেন।

এই উপলব্ধি থেকেই জালাল উদ্দীন খাঁ উচ্চারণ করেছেন: 'কী ছুরত বানাইলে খোদা রূপ মিশায়ে আপনার,/এই ছুরত দোজখে যাবে যে বলে সে গোনাগার।' তিনি বলেছেন: 'দ্বিলের যখন খুলবে কপাট, দেখবে তবে প্রেমের হাট/মারিফত সিদ্ধের ঘাট, সকলি মানুষের কাছে।।' আরো বলেছেন: 'ন্যায়ে থাক সত্য রাখ, ধর্মরক্ষা তারেই কয়/বিশ্ববোধের ধর্মে দেওয়া মানবত্বের পরিচয়।/মিথ্যাটারে দেও বিসর্জন, সত্য সেবায় রাখ জীবন/হিংসা হতে আপনি আপন থাকবে সরে সব সময়।' সব মরমি সাধকের মতোই তিনি অন্তর আর প্রেমের দৃষ্টিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। ধর্মের খোলসে আটকে না থেকে তার ভেতরের শাঁসটিকে খুঁজে পেতে চেয়েছেন। আর ভেতরের এই শাঁস সত্য, ন্যায়, দয়া, অহিংসা, বিশ্ববোধ দিয়েই তৈরি। এই শাঁসটিকে বুঝতে পারলে মানুষের জাতি, ধর্ম, বর্ণ ইত্যাদি বাহ্যিক পরিচয় নিয়ে এত রক্তক্ষয়ী সংঘাতের প্রয়োজন হয় না। দ্বিধাহীন কণ্ঠে জালাল বলে গিয়েছেন: 'বিচার করলে নাইরে বিভেদ কে হিন্দু কে মুসলমান।/রক্ত মাংস একই বটে সবার ঘটে একই প্রাণ।।' এবং 'একই যদি সবার গোড়া, আছে যখন স্বীকার করা/ভিন্ন করে ভবে কারা দিয়ে গেল বিভেদের জ্ঞান?' তারপর বলেছেন: 'একের বিচার কোথায় গেল, পরম কিসে চিনা হল/জালাল উদ্দীন ঠেকে রইল গাইল শুধু ভাবের গান।' যিনি পরম তিনি তো এক। সবকিছু নানা রূপে সেই একেরই প্রকাশ। আমরা যদি আত্ম-পর বিভেদকে বড় করে তুলি তাহলে কি পরমকে চেনা সম্ভব? একই ধরনের ভাব জালালের অনেক পূর্বসূরির মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছে। মনে করতে পারি, মধ্যযুগের কবি চণ্ডীদাস বলেছিলেন: 'সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।' এগুলিই বাংলার প্রাণের কথা, বাংলার লৌকিক ঐতিহ্যের গভীরতম বাণী। এসব বাণী আমাদের বুঝতে শেখায়, এ দেশের মাটির ভেতর থেকে যুক্তি ও জ্ঞানের যে নিরন্তর প্রবাহ উৎসারিত হয়েছে তা সামান্য নয়।


এই অস্থির সময়ে আমাদের স্বদেশে ও বিদেশে স্বার্থচিন্তা আর ক্ষুদ্রবুদ্ধির প্রভাবে আত্মপরিচয়ের যে ছোট ছোট গণ্ডি টানা হচ্ছে তা ক্রমাগত মানুষকে নৈতিকভাবে খর্ব করছে। একদিকে উদার বিশ্বায়নের ঢাকঢোল বাজছে, অন্যদিকে নিরন্তর কূপমণ্ডুকতা, অনুদারতা এবং নিষ্ঠুরতার চাষাবাদ চলছে। ধর্ম, জাতি, বর্ণ ইত্যাদির দোহাই পেড়ে মানুষের আত্মপরিচয়কে এককেন্দ্রিক ও নিচ্ছিদ্র করার চেষ্টা চলছে। এক পরিচয়কে আরেক পরিচয়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে শুধু রক্ত ঝরানো হচ্ছে। একে বলা হচ্ছে 'অপরায়ণ।' এই 'অপরায়ণে'র বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিষেধক খুঁজতে গিয়েও ভিন্ন পরিচয়ের মানুষকে হামেশা ঘায়েল করা হচ্ছে। অথচ জালাল উদ্দীন খাঁর মতো লোক-বাংলার সাধক-কবিরা যে ভাবসম্পদ রেখে গিয়েছেন সেখানে সব পরিচয়ের মানুষকে নিয়ে আরো সহিষ্ণু, উদার, বৈচিত্র্যপূর্ণ সমাজ-পরিবেশ গড়ে তোলার উপাদান যথেষ্ট রয়েছে। এই ভাবসম্পদ থেকে কিছু আলোকরেখা খুঁজে নিতে পারলে তা আমাদের চলার পথকে অনেক সুগম করবে। আজকের দিনে জালাল উদ্দীন খাঁর মহৎ ভাবনা ও উচ্চারণগুলি স্মরণ করে তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।