বইমেলার বহুমুখীকরণ প্রসঙ্গে প্রকাশনার পঞ্চপাণ্ডব

আমি মনে করি যে মেলার যে উদ্দেশ্য ছিলো, যে চেতনার জায়গা থেকে বইমেলার শুরু, এবং এর সম্প্রসারণ, সেটা এই গত বছর থেকে মনে হচ্ছে হুমকির মধ্যে পড়েছে।--তারিক সুজাত

চিন্তামন তুষারচিন্তামন তুষার
Published : 25 Feb 2024, 12:43 PM
Updated : 25 Feb 2024, 12:43 PM

আবহমান কাল ধরে চলে আসা বাংলার পথপ্রান্তে আয়োজিত মেলাগুলোর কোন কোনটি স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য নিয়েই আজও টিকে আছে। আবার কোন কোনটি লোকজ জীবনের সব অনুষঙ্গ এক আঙ্গিনায় এনে জড়ো করে। কিন্তু স্বতন্ত্র্য হোক আর বারোয়ারি, সব ধরনের মেলার আবশ্যিক অনুষঙ্গ হচ্ছে বিচিত্র ও মুখরোচক খাবার।

নগর জীবনও মেলার ঢেউয়ে উত্তাল। পক্ষ, উপলক্ষ বুঝে বৈশাখী মেলা, বাণিজ্য মেলা, বৃক্ষমেলা, কারুশিল্পমেলা, হস্তশিল্পমেলা আয়োজন হচ্ছে আকছার। সেসবেও খাবারদাবারের দোকানগুলোতে ভিড় উপচে পড়ে। শুধু বইমেলাতে খাবারের দোকান দেখতেই বইপ্রেমীদের আপত্তি। এই অবস্থাতেও আমরা বইমেলার বহুমুখীকরণের আলাপ তুলতে চাইছি।

এই প্রসঙ্গ নিয়ে আমাদের নবীন-প্রবীন প্রকাশকের বক্তব্য, মতামত জানতে চেয়েছি (অনেকেই এড়িয়ে গেছেন, অনেকে ব্যস্ততা দেখিয়ে কথা বলেননি)। যারা বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশের বইমেলায় অংশ নিয়েছেন। তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে মতামত চেয়েছি— বইমেলাকে আরও কার্যকর ও আকর্ষনীয় করে তোলা যায় কিভাবে?

১. বইমেলার বহুমুখীকরণের উদাহরণ, প্রস্তাবনা, ঢাকা প্রেক্ষাপটে সম্ভাবনা সম্পর্কে আপনার মতামত কি?

২. বিদেশের বইমেলাগুলোর চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য কি?

৩. কোনদিকটিকে অভিনব মনে হয়েছে, কোনটিকে বাংলাদেশে উপস্থাপন করা যায় নতুনত্ব এবং উপকারী পদক্ষেপ হিসেবে?

৪. আপনার প্রস্তাবনা কী হবে, কিভাবে সেটি উপস্থাপন করা হবে, প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে?

আহমেদ মাহমুদুল হক, প্রকাশক- মাওলা ব্রাদার্স

সেভাবে বলতে গেলে, আমার মনে পড়ে ফ্রান্সের গুরমন্ড ইন্টারন্যাশল–এর আয়োজিত ওয়ার্ল্ড কুকবুক বইমেলা। প্যারিসের সেই বইমেলায় শুধু রান্না বিষয়ক বই প্রদর্শন হয়। সেখানে যাদের বই প্রদর্শিত হয়, তাদের অনেকের রান্না করারও ব্যবস্থা থাকে। আমি সেখানে গিয়েছিলাম ২০১২ সালে। মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত সিদ্দিকা কবীরের লেখা “রান্না খাদ্য পুষ্টি” বইটি ২০১১ সালে গুরমন্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিল। দুঃখজনক যে তার কিছুদিন আগে লেখক সিদ্দিকা কবীরের মৃত্যু হয়। সে বছর তিনটি বই পুরস্কৃত হয়েছিল; আমাদের ‘রান্না খাদ্য পুষ্টি’ বইটি পুরষ্কৃত হয়েছিল ‘ইজি রেসিপিজ’ ক্যাটাগরিতে। এটা বাংলাদেশের জন্য একটা বড় সম্মান।

আমার আরো মনে পড়ে লন্ডন বইমেলার কথা। হংকংয়ের শিশুদের বইমেলা দেখে চমৎকৃত হয়েছি। কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা অনেকটা আমাদের একুশের বইমেলার মতো লেগেছে; তবে সেটা আন্তর্জাতিক বইমেলা হওয়ায় অনেক বিদেশী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানেরও অংশগ্রহণ থাকে। আর মেলার মাঠে সাহিত্য–সংস্কৃতি বিষয়ক নানা আয়োজন আমাদের তুলনায় বেশি হয়।

একেক দেশের বইমেলা বৈশিষ্ট্যে একেকরকম বলে মনে হয়েছ। যেমন, লন্ডনের বইমেলায় বইয়ের কপিরাইট বিক্রি হয়; হংকংয়ের শিশুদের বইমেলায় বইয়ের তুলনায় শিক্ষা উপকরণ আর খেলনার আধিক্য ও আড়ম্বর দেখে চমৎকৃত হয়েছি। আর বইমেলা নিয়ে যে উৎসাহ–উদ্দীপনা আমাদের দেশে দেখা যায়, কলকাতা বইমেলায়ও সেরকম মনে হয়েছে। সেখানে একটা উৎসবের আমেজ সব সময় লেগে থাকে। সারা শহরে সাড়া পড়ে যায়, প্রচুর মানুষ বইমেলায় যায়, লাইন ধরে দাঁড়িয়ে বই কেনে।

দেখুন, বিদেশকে অনুসরণ বা অনুকরণ করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি, প্রকাশনা শিল্পের কতকগুলো স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে। আমাদের বইমেলা একটা জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। এক মাস ধরে বইমেলা পৃথিবীর আর কোনো দেশে অনুষ্ঠিত হয় বলে আমাদের জানা নেই। অনেক দেশের বইমেলার আয়োজন করে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো, হয়তো সরকারের সঙ্গে বইমেলার কোনো সম্পর্কই থাকে না। কিন্তু আমাদের বইমেলার আয়োজক ও ব্যবস্থাপক কর্তৃপক্ষ হচ্ছে আমাদের অন্যতম জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি। স্বয়ং সরকার প্রধান এই বইমেলা উদ্বোধন করেন। এসব বিবেচনায় আমি আমাদের একুশের বইমেলাকে বই নিয়ে একটি অনন্য জাতীয় আয়োজন হিসেবে দেখি। তা ছাড়া এই বইমেলা অনুষ্ঠিত হয় ফেব্রুয়ারি মাসে, এটা আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনের একটি জাতীয় স্মারক।

তবে বিদেশি বইমেলাগুলো থেকে যদি নতুন কিছু আমাদের বইমেলায় যুক্ত করা যায়, তাতে আপত্তির কিছু নেই। আমি মনে করি আমাদের বইমেলার ব্যবস্থাপনা আরো ভালো করার সুযোগ আছে। বইয়ের বিক্রি বাড়ানোর লক্ষ্যে কী করা যায়, কীভাবে লেখক–পাঠকের মধ্যে যোগাযোগ ও মতবিনিময় বাড়ানো যায়––এসবও ভেবে দেখার বিষয়।

বইমেলার সঙ্গে মুদ্রণশিল্পকে সংযুক্ত করা যেতে পারে। তাদের নানা সামগ্রী বিকিকিনির পাশাপাশি—দুর্লভ বা অপ্রচলিত নানা যন্ত্রপাতি শুধু প্রর্দশনের উদ্দেশ্যে আনা যেতে পারে। এর ফলে ছাপাখানার সংস্কৃতির পাশাপাশি ইতিহাস জানা যাবে, আবার নতুন সামগ্রীও দেখতে পারবে।

মনিরুল হক, স্বত্বাধিকারী- অনন্যা প্রকাশনী

পৃথিবীর আর সব বইমেলা যেমন হয়, বাংলাদেশের বইমেলা তেমনভাবে হয় না। আমাদের বইমেলার আদল, আমেজ সম্পূর্ণ ভিন্ন। পৃথিবীতে একমাসব্যাপী কোনো বইমেলা হয় বলে আমার জানা নাই। ইউরোপ, আমেরিকা, লন্ডনের বইমেলা দুই, তিন বা বড়জোর চারদিনের। পাশেই পশ্চিমবঙ্গে হয় বারো দিন। ‍আবার অধিকাংশ বইমেলা হয় ইনডোরে। কাজেই তাদের সঙ্গে তুলনা চলে না। তাই আমাদের বইমেলাকে কিভাবে উন্নত করতে পারি, সে বিষয়ে কথা বলতে পারি। যেমন- আগামী বছরের বইমেলার স্থান নিয়ে একটা অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এজন্য আমি বইমেলার স্থায়ী একটা জায়গা চাই। বইমেলার জন্য সবদিক বিবেচনাপ্রসূত একটা স্থায়ী কাঠামো চাই, যেটি বছর বছর নতুন নতুন নিয়মের ভোগান্তি বাড়াবে না। আর যেহেতু ডিজিটাল থেকে স্মার্ট বাংলাদেশের পথে এগুচ্ছি আমরা, সেদিকেও নজর দিতে হবে। বইমেলার প্রচারণার জন্য সারা ঢাকা শহরকে ব্যানার, ফেস্টুন দিয়ে মুড়িয়ে দেয়া উচিত ছিলো। আরও আছে— জার্মানির বইমেলায় অংশগ্রহণকারীদের একটা কার্ড দিয়ে দেওয়া হয়, সেই কার্ড দেখিয়ে তারা ফ্রিতে জার্মান শহর ঘুরতে পারে, পশ্চিমবঙ্গে একশ গাড়ি দেয়া হয়। এইরকম কিছু উদ্যোগ নিলে আমাদের এই প্রাঙ্গণের জন্য ভালো হবে।

তারিক সুজাত, গ্রাফিক্স ডিজাইনার, কবি ও প্রকাশক- জার্নিম্যান বুকস

আমি বর্তমান নয় কিছুটা অতীত থেকে কথা শুরু করতে চাই। আজ আমরা যে বইমেলা প্রাঙ্গনে বসে কথা বলছি, আমাদের পিছনে স্বাধীনতা স্তম্ভ এবং এটি হচ্ছে সোহরাওয়ার্দি উদ্যান। যখন বইমেলা সম্প্রসারিত হলো বাংলা একাডেমি চত্বর থেকে, তখন সবার মধ্যে একটা চিন্তা এবং উদ্বেগ ছিলো—এতো বড় পরিসরে মেলা চলে যাচ্ছে, এই মেলায় কি সেই পরিমাণ লোক সমাগম হবে? এতো পরিমাণ পাঠক বা দর্শনার্থি কি আসবে? আজকে কতোগুলো বছর পার হয়ে, যারা আমরা প্রকাশক বা প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত—লেখক বা বইপ্রেমী—তাদের মধ্যে নতুন একটা উদ্বেগ লক্ষ্য করছি- আসলে কি আমরা এমন একটি বইমেলা চেয়েছিলাম? আমরা অমর একুশে বইমেলা সম্পর্কে যখন কোনো কথা বলতে চাই বা বলার প্রসঙ্গ আসে—লেখক হিসেবে হোক বা প্রকাশক হিসেবে হোক—আমরা একটু সতর্ক থাকি। কারণ এটা আমাদের এমন একটা চেতনার এবং স্পর্শকাতর জায়গা, কিছু বলতে গেলে আমরা সতর্ক থাকি যে আমরা কী বলবো? সত্য বলতে আমরা অনেক সময় পিছিয়ে যাই। কিন্তু আমি মনে করি যে মেলার যে উদ্দেশ্য ছিলো, যে চেতনার জায়গা থেকে বইমেলার শুরু, এবং এর সম্প্রসারণ, সেটা এই গত বছর থেকে মনে হচ্ছে হুমকির মধ্যে পড়েছে। আমরা দেখছি যে, মেলা মূলধারার প্রকাশক, লেখকদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। আমাদের দেশে তো নানান মেলা হয়—বৃক্ষ মেলা, রপ্তানি মেলা—সেগুলোতে ঢুকতে গেটপাস লাগে বা টিকিট লাগে। আমরা দেখেছি যে, সারারাত জেগে আমরা উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসবে যাচ্ছি, অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করে সেখানে ঢুকতে হয়। এখন অনলাইন সবার হাতের ‍মুঠোয়, আর এসব এমন হাইটেক কিছু না। তাই এমন একটা রেজিস্ট্রেশন ব্যাবস্থা যদি থাকে, তাহলে কিন্তু ওই যারা প্রকৃত বইপ্রেমী তারা নাম বা মোবাইল নাম্বার দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করবে। তখন কিন্তু আমি আগে থেকেই জানতে পারবো যে মেলায় কারা আসবে, কতোজন আসবে এবং আমাদেরও সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নেয়ায় সুবিধা হবে। আর সেসব তথ্য আমাদের কাছে থাকছে, বাংলা একডেমির কাছে থাকছে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের কাছেও থাকছে। আবার বইমেলায় কী কী হচ্ছে সবকিছু জানা ও জানানো যাবে। আজকে আমাদের সৌভাগ্য যে, আমাদের প্রচলিত যেসব মিডিয়া আছে—পত্রিকা, টেলিভিশন, অনলাইন পোর্টাল—তারা মাসব্যাপি একটা বিশাল প্রচারণা চালায় মেলাকে কেন্দ্র করে। লেখক, প্রকাশক, পাঠক সবাই লাভবান হয়। আজ যদি আমাকে টাকা খরচ করে এই প্রচারণা সু্বিধা নিতে হতো, তাহলে যে বিশাল অংক বহন করতে হতো, তা আমরা পারতাম না। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে বইমেলার সময় দেখেছি, মেলা শুরুর পরদিন একটা বড় কাভারেজ ছাড়া আর তেমন কিছু চোখে পড়ে না। কোলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মিডিয়ায় তেমন উচ্ছ্বাস আমি দেখিনি।

আমার অভিজ্ঞতা হয়েছে, ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা, গোথেনবার্গ বইমেলা, দুবাই বা শারজাহ বইমেলায় অংশগ্রহণের। সেসবের আলোকে আমি এবার বইয়ের বিপননের প্রসঙ্গ নিয়ে বলতে চাই। আসলে এখন একুশ শুধু আমাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এর একটা বিশ্ব পরিপ্রেক্ষিত তৈরী হয়েছে। আজ আমাদের একুশ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপিত হচ্ছে পৃথিবীব্যাপী। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের যারা সাহিত্য পড়ে তাদের কাছে ভিনদেশী ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার প্রতি আগ্রহ তৈরী হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা তাদের কাছে কিভাবে পৌঁছাবো?

আমি সৌভাগ্যবান যে আমার বাবা (তোফাজ্জল হোসেন) একজন ভাষা সংগ্রামী। ভাষা সংগ্রামে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি একুশে পদক পেয়েছিলেন। একুশের প্রথম সংকলন, যেটি হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদনা করেছিলেন—সেখানে দুটি গান ছিলো—আবদুল গাফফার চৌধুরীর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফ্রেব্রুয়ারি’ এবং ‘রক্ত শপথে আজিকে আমরা তোমারে স্মরণ করি’, এটি ছিলো আমার বাবার লেখা। প্রথমে এ গান ‍দুটি সুরারোপ করেছিলেন, আবদুল লতিফ। পরে জগন্নাথ কলেজের এক অনুষ্ঠানের জন্য আমার বাবা এবং তার বন্ধু সৈয়দ হোসেন দ্বিতীয় সুরটি করিয়ে এনেছিলেন আলতাফ মাহমুদের কাছ থেকে। আমার বাবার প্রসঙ্গ তোলার কারণ হচ্ছে, যেদিন আমাদের ‘একুশ’ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেল, সেদিন তিনি আমায় বলেছিলেন, তোমরা যারা সাহিত্য করো বা সাহিত্যের সঙ্গে জড়িত, তাদের জন্য একটা নতুন দিগন্ত খুলে গেলো। এখন তোমরা সেটা কতোটা উদ্ধার করতে পারবা!

গোথেনবার্গ বইমেলায় গিয়ে দেখেছি, সুইডিস সমসাময়িক এবং ধ্রুপদী লেখকদের লেখা যারা অনুবাদ করছে তাদের সুইডিস একাডেমি আমন্ত্রণ করে নিয়ে যায়। আমি যে বছর গেলাম, সে বছর পৃথিবীর সাইত্রিশ দেশের প্রতিনিধি নিয়ে সুইডিশ আর্ট কাউন্সিল একটা ফেলোশিপ প্রোগ্রাম করেছিল। আমার সাথে তাদের মেলামেশার সুযোগ হলো। কেউ উত্তর আমেরিকা থেকে, কেউ আফ্রিকা থেকে, কেউ ইউরোপের পূর্ব প্রান্ত থেকে এসেছে। তারা সবাই সুইডিস ভাষার সাহিত্য পৃথিবীর অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ করে। আমরা জানি, আমেরিকান ক্লিনটন বি সিলি থেকে আরম্ভ করে ফ্রান্সের ফ্রাঁস ভট্টাচার্যরা নিজেদের তাগিদে এবং জাপান, প্রাগে বসে আরও অনেকে বাংলার সাহিত্য অনুবাদ করছেন। এখন পৃথিবীর অনেকগুলো দেশে, বহু গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়, যেমন- শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়, হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাগের চার্লস বিশ্বাবিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ আছে। তারা বাংলা পড়ায় এবং নিজেদের তাগিদে বাংলা সাহিত্যের অনেক লেখা অনুবাদ করে। আমাদের দরকার তাদের একটা উপযুক্ত ও কার্যকর ডাটাবেইস তৈরি করা। আমি বিশ্বাস করি, গত কয়েক দশকে আমাদের যেসব সাহিত্য রচিত হয়েছে তার অনেকগুলো আন্তর্জাতিক মানের। কিন্তু সেসব বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার জন্য যে সঠিক অনুবাদ ও বই নির্মাণের যে গুণগত মান—সেগুলো আমরা সুনির্দিষ্টভাবে ধরতে পারিনি।

আমার বাবা যে বললেন, সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত খুলে গেল। তোমরা কতোটুকু ধরতে পারবা, সেটা নির্ভর করবে তোমাদের উপর।

আমাদের অমর একুশে বইমেলার একটা দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, আমাদের মেলার প্রস্তুতি শুরু হয় দুই বা তিন মাস আগে। বাংলা একাডেমি বইমেলা হচ্ছে, পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ষ সময়ের বইমেলা। মাসব্যাপী বইমেলা ব্যাবস্থাপনার একটা বিশাল হ্যাপা আছে। শুধু আইনশৃঙ্খলার দিক না। আরও অন্যান্য বিষয় আছে। এখন যদি প্রশ্ন ওঠে, প্রকৃত পাঠক-ক্রেতারা বইয়ের দোকান পর্যন্ত আসতে পারছে না— তখন শুনতে কেমন লাগবে! আমি তো এমন কোনো ক্রাউডকে ডেকে আনবো না, যারা বইয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত না। এখন মেলার যে উদ্দেশ্য এবং গাম্ভীর্য, সেটা মেলার অনুষ্ঠানমালার মাধ্যমে যদি আনতে না পারি, লেখকরা যদি উদ্বুদ্ধ না হয়, তাহলে কিভাবে হবে! আমি মনে করি যে, আগামীতে আমাদের ভাবতে হবে—মাসের প্রতি সাতদিন করে যদি বইমেলা ধরি, তিনদিন রাখি সবার জন্য উন্মুক্ত, বাকি চারদিনে একদিন আসবেন যারা লেখক, লাইব্রেরিয়ান, গবেষকরা। অথবা দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় তাদের জন্য সংরক্ষিত থাকতে পারে। তখন তারা একটু নিরিবিলি তাদের প্রয়োজনীয় বা কাঙ্ক্ষিত বইগুলো খুঁজতে পারবেন, দেখেশুনে নিতে পারবেন। এখন কিন্তু রাষ্ট্রীয় ও বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠান তাদের প্রয়োজনে বই কেনে। আমাদের বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও কিন্তু কম না, তাদেরও নানা ধরণের বইয়ের প্রয়োজন। এখন বিষয় হচ্ছে, কোনটি তাদের প্রয়োজন মেটাতে পারে বা কোনটি থেকে কোনটি বই হিসেবে তাদের জন্য অধিক উপযোগী, সেসবের কিন্তু কোনো দিকনির্দেশনা তারা পান না বা কেউ কোনো ক্যাটালগ তৈরীর কাজ করেন না। আমরা মেলা শেষে একটা রিপোর্ট দেই যে, চার বা পাঁচ হাজার বই বেরিয়েছে, শত কোটি বিকিয়েছে বলি। আমি মনে করি যে, এই সংখ্যাটা বিবেচনার প্রধান বিষয় না। দেখতে হবে গুণগতমান, বিষয়বৈচিত্র্য, তথ্যসমৃদ্ধতা বা বিষয়ের গভীরতায় পৌঁছানো বইয়ের সংখ্যা, ভালো বইয়ের সংখ্যা আদৌ কতো! সে হিসেব আমরা রাখি না, করিও না। আমরা যেসব আন্তর্জাতিক বইমেলায় অংশ নিই, যেমন- ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় আমাদের যে প্যাভিলিয়নে স্টল থাকে, সেটা শুধু বই প্রদর্শনের জন্য। বিটুবি বিজনেসের জন্য নির্ধারিত। কেউ আসবে-দেখবে, বইয়ের মান, দাম সম্পর্কে ধারণা নিবে। কিন্তু আমরা যদি আমাদের ভাষার সাহিত্যর আন্তর্জাতিকীকরণ চাই, আমাদের ভাষার সাহিত্য যদি অন্য দেশের প্রকাশনীর হাতে তুলে দিতে চাই—স্বত্ব বিক্রির মাধ্যমে—তখন আমাকে একটা ক্যাটালগ তৈরী করতে হবে। কয়েকটি মাত্র বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ছাড়া, এমনকি বাংলা একাডেমিও রাইট ক্যাটালগ তৈরী করতে পারেনি। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র একটি ক্যাটালগ মুদ্রণের কাজ গত বছর শুরু করেছে, আমি মনে করি সেটা যথেষ্ট নয়। বেশি দূরে যাবো না, ভারতের যে ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, তারা কিভাবে তাদের দেশের লেখকদের বিশ্বের বইমেলায় প্রমোট করে? তারা ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট বা সাহিত্য আকাদেমি, তাদের একজন লেখকের বই নিজেদের প্রাদেশিক বিশ-পঁচিশ ভাষায় অনুবাদ করে। আবার আন্তর্জাতিক অনেক ভাষাতেও অনুবাদের উদ্যোগ নেয়। আমাদের একটা সীমাবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে—আমরা অনুবাদ বলতে ভাবি, বড়জোড় বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ। কিন্তু এখন ভাবতে হবে পৃথিবীর মোস্ট টকড ভাষাগুলো নিয়ে। আমরা যদি ম্যান্ডারিন বা স্প্যানিশ ভাষার কথা ভাবি, বিশাল একটা বাজার সেসবের। ওইসব জায়গায় আমরা কখনো হাত দেইনি, পুরোপুরি অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে। ওই জায়গা ধরার জন্য আমাদের প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিকল্পনা নেয়া, সঙ্গে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতারও দরকার আছে।

প্রকাশকরা নানা সময়ে দাবি তোলে প্রকাশনাকে ‘শিল্প’ ঘোষণা করার। আমিও বলি, এটা অবশ্যই একটা শিল্প। আমি মনে করি, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) প্রতি বছর যে বিভিন্ন দেশে মেলা আয়োজন করে, সেখানে বই প্রদর্শনীর ব্যবস্থা রাখা দরকার। যেখানে কুটির শিল্প, তৈরী পোষাক, খাদ্য সামগ্রী যাচ্ছে, সেখানে অবশ্যই বইয়ের প্রদর্শনী হওয়া উচিত। আমরা সবসময় বলি, আমাদের মূল হচ্ছে ভাষা ও সংস্কৃতি। তাহলে আমাদের ভাষার বই কেন থাকবে না?

আরেকটা কথা, প্রযুক্তিক্ষেত্রে আমরা অনেক এগিয়ে গেছি। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে যাত্রা শুরু করেছিলেন, সেই ধাপ অতিক্রম করে আমরা এখন স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে যাচ্ছি। কিন্তু আমি এখনও আমাদের বইয়ের সংজ্ঞা বদলাতে পারিনি। বই বলতে আমি যদি শুধু মুদ্রিত বইকেই পরিচয় করিয়ে দেই, ইবুক-অডিওবুকসকে বই বলে স্বীকার না করি, তবে বইয়ের জগতকে আমি সীমাবদ্ধ করে নিচ্ছি। ডিজিটাল থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে এটা একটা বড় বাধা।

অপরদিকে, বাণিজ্যক্ষেত্রে যে অসাম্য—বইমেলায় স্টল পেতে হলে একজন নবীন প্রকাশককে কমপক্ষে পঁচিশটি বই প্রকাশনার মধ্য দিয়ে আসতে হবে। পঁচিশটি বই প্রকাশ করতে আমি যদি গড় বিনিয়োগ ধরি পঞ্চাশ হাজার টাকা, তবে তাকে বারো লাখ টাকা পুঁজি লগ্নী করতে হবে। সঙ্গে তার একটা অফিস, দুইজন লোকবল, কম্পিউটার নিয়ে আরো আট বা দশ লাখ টাকা খরচ করতে হবে। আমার কথা হচ্ছে, কেন একজন তরুণ প্রকাশককে বিশ লাখ টাকা পুঁজি বিনিয়োগ করে আসতে হবে? আজ সরকার যেসব বই কিনছে তার পাঁচ বা দশ শতাংশ যদি ইবুক বা অডিওবুক কেনে, তাতে একজন তরুণ প্রকাশক দুই থেকে তিন লাখ টাকা খরচ করে কাজ চালিয়ে নিতে পারবে।

এইসব সীমাবদ্ধতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।

আমি এখন আমার প্রকাশনীর যে প্যাভিলিয়নে বসে কথা বলছি, এখানে আমাদের প্রায় তিনশো বই আছে। আমি গোড়া থেকেই ননফিকশন বই প্রকাশ করি। তিরিশ বছর আগে আমি ক্যারিয়ার শুরু করেছিলাম গ্রাফিক্স ডিজাইনার হিসেবে। আর গেল দশ বছর ধরে আমি নিয়মিত প্রকাশনীতে সময় দিচ্ছি। এর পেছনে কিছু ঘটনা আছে। বাবার কথা আগেই বলেছি, আমার স্ত্রী নাজনীন হক মিমিও একজন জিজাইনার। আমার বয়োজ্যেষ্ঠ এবং অগ্রজ লেখক—আমি স্মরণ করি কবি বেলাল চৌধুরী, কবি রবিউল হুসাইন, ভারতের কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত—তারা আমাকে উদ্ধুদ্ধ করতে গিয়ে বলেছিলেন, তুমি আমাদের দেশের প্রকাশনী শিল্পের জন্য কাজ করো। তারা আমার প্রকাশনী শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা, তিরিশ বছর দেশি-বিদেশী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করা সম্পর্কে জানতো। তাদের কথা রাখতে, যেসব বিষয়ে কম বই বেরিয়েছে আমি সেগুলো নিয়ে কাজ করছি। আমার চেষ্টা ছিলো, বইয়ের বিষয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে এবং মানানসই ও গুণমান তৈরী করা। আপনি হয়তো লক্ষ্য করেছেন আমাদের বইগুলো নান্দনিক এবং শিল্পের দিকে এগিয়েছে। আমি মনে করি, বই একটা নির্মাণের বিষয়। বই নির্মাণ করতে তার বিষয়বস্তুকে ধারণ করে একটা নান্দনিক উপস্থাপনাকে নির্বাচন করে পাঠকের কাছে পৌঁছাতে চাই। গ্রাফিক্স ডিজাইনকে বলা হয়, আর্ট অফ কমিউনিকেশন। একজন গ্রাফিক্স ডিজাইনার হিসেবে গোড়া থেকে সব শিখতে হয়েছে আমাকে। আমার যিনি অডিয়েন্স তিনি প্রথম দৃষ্টিতেই আমি কী বিষয় নিয়ে কাজ করেছি সেটা বই পড়ার আগেই বাইরে থেকে বুঝতে পারে যেন। যখন শিশুদের বই নিয়ে কাজ করতে হবে, তখন সেটা ভিন্ন মেজাজের হবে। যখন আমি একটা কবিতার বই নিয়ে কাজ করবো বা একটা ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস কিংবা একটা নিরেট ইতিহাসের বই অথবা একটা দর্শনের বই—প্রত্যেকটা বইয়ের আলাদা বিষয়কে অনুধাবন করে তার মেজাজকে উপস্থাপন করতে হয়। আমার মনে হয়, এটা আমরা কিছুটা হলেও স্পর্শ করতে পেরেছি বলে পাঠকদের কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়া পেয়েছি। বাংলাদেশে, এমনকি আমরা যখন আন্তর্জাতিক বইমেলায় অংশগ্রহণ করি- সেই ফ্রাঙ্কফুর্ট, গোথেনবার্গ থেকে শুরু করে কোলকাতা পর্যন্ত—আমরা খুব ভালো রেসপন্স পেয়েছি।

আপনি শুরুতে যে কথা তুললেন, আমরা যদি মেলাকে আরও সমৃদ্ধ করতে চাই, সেটা আমরা কিভাবে করতে পারি?

আমি বলবো, আগামী বছর যে মেলা হবে—এই মেলা শেষ হবে সপ্তাখানেকের মধ্যে—আগামী সপ্তাদুয়েকের মধ্যে তার পরিকল্পনা যেন গ্রহণ করি। মেলায় যারা প্রকাশক হিসেবে কাজ করছেন, লেখক হিসেবে কাজ করছেন, তারা তাদের পরিশ্রমের, মেধার যে ফসল এই মেলা থেকে সর্বোচ্চটা যেন বুঝে পায়। আর, একজন পাঠক যেন মেলায় প্রবেশ করে তার কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ পায়, একটি ভালো বই খুঁজে পেতে তাকে যেন অনেক কাঠখর পোড়াতে না হয়। সেই ধরণের উদ্যোগ আমাদের নিতে হবে।

বিশেষ একটি বিষয় হচ্ছে ছাপার কাগজ, সেটি নিয়েও বলতে কিছু চাই। আমরা যে বই ছাপি, তার সিংহভাগ—এই বইমেলায় যত বই ছাপা হয়েছ—হোয়াইট প্রিন্টিং পেপারে। বই ছাপার যে কাগজ (সারা পৃথিবীতে যে কাগজে বই ছাপায়) সেই কাগজ আমরা উৎপাদন করি না, গুটিকয়েকজন আমদানি করেন। দাম আকাশচুম্বী। প্রকাশকদের নাগালের বাইরে। লাইট ওয়েট পেপার বলা হয় সেটিকে। খুব দ্রুত আমাদের যে সব কাগজকলের সক্ষমতা আছে, তাদের এই পেপার উৎপাদন করতে হবে। তা না হলে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে আমরা যেতে পারবো না। আমাদের প্রবাসী বাংলাদেশীর সংখ্যা এক কোটির উপরে। পৃথিবীর নানান প্রান্তে তারা ছড়িয়ে আছে। শুধু বাংলা ভাষাভাষীদের উদ্যোগেই লন্ডনে, টরোন্টোতে, নিউ ইয়র্কে, মেলবোর্নে, সিডনিতে বাংলা ব্ইয়ের মেলা হচ্ছে। কিন্তু আমরা যখন আমাদের বইগুলো পাঠাই, তার বহনখরচ অনেক বেশি পড়ে যায়। অথচ পশ্চিমবঙ্গের একটি বই এর চেয়ে কম খরচে পৌঁছায়। কারণ তাদের পাঁচশো পৃষ্ঠার বইয়ের ওজনের তুলনায় আমাদের বইয়ের ওজন প্রায় দ্বিগুণ। এটা লাইট ওয়েট পেপার ব্যবহারের কারণে হচ্ছে। আমাদের অনেক ক্ষেত্রে ভালো নীতিমালা আছে। আমি নিজে সংবাদপত্র শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। আমরা দৈনিক সংবাদপত্র ছাপার জন্য যে পরিমাণ দেশীয় কাগজ ব্যবহার করি তার সমপরিমাণ বিদেশী কাগজ শুল্ক ছাড়া আমদানি করতে পারি। ঠিক এই প্রণোদনা বা লাইট ওয়েট পেপার আমদানিতে সুবিধা হয় এমন কোনো নীতি গ্রহণ করতে পারে বই প্রকাশকদের জন্য। আবার দেশীয় কলগুলো যেন লাইট ওয়েট পেপার উৎপাদনে আগ্রহী হয়, সেজন্য কোনো বিশেষ সুবিধা ঘোষণা করতে পারে। সেই কাগজ যেসব দেশীয় প্রকাশকরা ব্যবহার করবে আবার বিশেষ মূল্যছাড় পাবে, এইরকম ঘোষণা দিয়ে যদি একটা ইন্ডাষ্ট্রি গড়ে তুলতে পারে। সবার মঙ্গল হবে তাতে।

একটা দিকে বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, বছরের প্রথমদিন প্রায় তেত্রিশ কোটি বই বিদ্যালয় পর্যায়ে বিনামূল্যে বিতরণে সাফল্য অর্জন করেছে আমাদের সরকার। এ বইগুলো শতভাগ এদেশেই মুদ্রণ হচ্ছে, এর জন্য বিশাল একটা ইন্ডাষ্ট্রি দাড়িয়ে গেছে। কিন্তু এই প্রেসগুলোর প্রোডাকশন ইউনিট বছরের মাত্র পাঁচ মাস কাজে থাকে। বাকি সাত মাস তারা বেকার, কোনো কাজ নেই তাদের। আমরা কিন্তু এটাতে সম্ভাবনার জায়গাটায় সুযোগ নিতে পারি। এখন পৃথিবীর নামীদামী সংস্থাগুলোর হেড অফিস বসছে ভারতের বোম্বে বা দিল্লিতে। সেখান থেকে তারা শুধু ভারতের জন্য বই ছাপছে তা না, ভারতে ছাপিয়ে সেসব বই পুরো দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যে পাঠাচ্ছে। আমাদের দেশে বাইরের বইগুলো যে ইউরোপ থেকে ছেপে আসছে তা না, এগুলো ছাপা হচ্ছে ভারতে। আমরা তৈরী পোশাকের ক্ষেত্রে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহ্ত্তম রপ্তানিকারক যেভাবে হয়েছি, আমাদের ক্রাফটস বা অন্যান্য নিজস্ব পণ্য দিয়ে জায়গা করে নিয়েছি। তেমনিভাবে বইয়ের বাজার নিয়েও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অগ্রসর হতে পারি। কারণ সাত মাস এমনিতে কাজ থাকে না, অপরদিকে যদি উপযুক্ত বন্ড সুবিধা পাওয়া যায়—আমার বিশ্বাস ভারত, চীনের চেয়ে কম খরচে আমাদের দেশে বই মুদ্রণ করে বাইরে পাঠাতে পারবো। এক্ষেত্রে যদি উদাহরণ খোঁজা হয়, আমি নিজেই তার উদাহরণ। আমার যে প্রকাশনা সংস্থা ও প্রিন্টিং প্রেস সেখান থেকে আমার সুইডিস বন্ধু প্রকাশকের বই ছাপা হচ্ছে সুইডেনের জন্য। তাই আমার মনে হয় যে, একটা সুষ্ঠু প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে সবাই মিলে যদি চেষ্টা করি, তবে ভালো একটা কিছু হবে।

আমাদের সীমাবদ্ধতার আরেকটি দিক নিয়ে বলি, আমাদের মধ্যে জ্ঞান বিনিময় প্রসঙ্গ (নলেজ শেয়ারিং)— ভালো কিছু বাইরে কোথাও দেখে এসেছে সেটা অন্যদের কাছে গোপন করি। বোধহয় ভাবি, আমি একা একা করে একাই বড় হবো। আমি বিশ্বাস করি, একা বড় হওয়া যায় না। ব্যাবস্থাপনার উপর দু’হাজার ছয় সালে জাপানিজ একটা ট্রেনিং আছে আমার। সেখানে আমি দেখেছি, শিল্পের ক্ষেত্রে জাপান যে আজ শিখরে গেছে, তারা পঞ্চাশ ষাটের দশক থেকে জ্ঞান বিনিময়ের উপর দারুণ জোর দিয়ে কাজ করছে। যে যেই ইন্ডাস্ট্রির, বিদেশ থেকে নতুন কিছু শিখে এসে সে তার বন্ধু বা সহকর্মীদের সঙ্গে সেই জ্ঞান ভাগ করে নেয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশের প্রকাশকদের মাঝে এই মানসিকতা কম দেখা যায়। আমি মনে করি, আমরা সম্মিলিতভাবে কাজ করলে যখন উন্নত ইন্ডাষ্ট্রি প্রতিষ্ঠা হবে, তাতে আমাদের সবারই লাভ হবে।

বাংলা একাডেমি মূলত একটি গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান। তার মূল কাজ গবেষণা এবং প্রকাশনা। আজ বছরের একটি মাস চলে যায় তাদের এই মেলার ব্যাবস্থাপনা করতে। এটা তাদের জন্য বাড়তি পরিশ্রম। এতে তাদের মূল কাজ কিছুটা হলেও ব্যাহত হচ্ছে। আমাদের প্রকাশকদের যে সংস্থা—আগামী দিনে মেলাটি যেন আরও সুষ্ঠুভাবে আয়োজন করতে পারে সে লক্ষ্যে কাজ করতে পারে। আমি যে আগেই বললাম, আমাদের মেলা চলাকালে যেসব বিদেশী প্রকাশক আসেন, যারা বাংলা বইয়ের ব্যাপারে আগ্রহী, এমনকি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যারা তাদের সাহিত্যের অনুবাদের জন্য গ্রান্ট দেয়, সেই গ্রান্ট নিয়ে যারা আসতে চায় তাদের নিয়ে বাংলা একাডেমি চত্বরে এক বছর আগে প্রচারণা চালিয়ে, প্রথম দিকে কোনো অংশগ্রহণ খরচ না নিয়েই শুধু প্রচারণার উদ্দেশ্যে বর্ধিত মেলা আয়োজন করা সম্ভব। চাইনিজ, সুইডিস, অ্যারাবিয়ান ছাড়াও আরও অনেক দেশ তাদের সাহিত্যের অনুবাদের জন্য গ্রান্ট দেয়। আমার দেশের কোনো অনুবাদক সেই সুযোগ নিতে পারে, তার অনুবাদের জন্য উদ্দিষ্ট ভাষার সরকার যখন খরচ দিয়েই দিচ্ছে, তাতে বই ছাপার অন্তত পঞ্চাশ ভাগ খরচ কমে যায়। এতে কিন্তু উভয়বিধ লাভ, দেশের সাহিত্য বিদেশে যাচ্ছে আবার বিদেশের সাহিত্য দেশে আসছে। এর জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা নিতে হবে। একটা বইমেলা করলাম, সেখানে কতো বই বেরুলো, কতো লোক এলো—এসব নিয়ে আত্মতৃপ্তির মধ্যে থাকলাম—তার কথা বলবো না। বইমেলাকে একটা ভিন্ন স্তরে নিয়ে যাওয়ার জন্য নীতিমালা তৈরী করতে হবে। আবার পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ শুধু নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞদের মতামতও নিতে হবে। আমরা দেখেছি, মুখচেনাদের নিয়ে পরিকল্পনা করা হয়। যে যেই বিষয়ে অভিজ্ঞ—দেশে শুধু নয়, তারা দেশের বাইরেও ছড়িয়ে আছে। গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক বইমেলার সঙ্গে তারা সম্পৃক্ত—তাদের ডাকতে হবে। ন্যাশনাল বুক ট্রাস্টের কথা বলেছি। আমি দেখেছি, ওই প্রতিষ্ঠান থেকে দশ বছর আগে অবসর নিয়েছে, তাদেরকেও নিয়ে যায় পৃথিবীর অন্যান্য দেশে। কারণ তারা ওই ট্রেডের মানুষদের চেনে। তাদের ব্যাক্তিগত যোগাযোগ, সুনাম ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগায়। আমরাও সেটা করতে পারি, বিগত দিনে যারা বাংলা একাডেমি, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে কাজ করেছে, আমাদের অগ্রজ প্রকাশক যারা আছেন, নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়ে যারা নতুন প্রকাশকদের ঋদ্ধ করতে সক্ষম, তাদেরও আমাদের সম্পৃক্ত করতে হবে। তাদের মতের মূল্যায়ন করতে হবে। তবেই আমরা সঠিক, সুন্দর এবং দিনশেষে সবার জন্য লাভজনক একটি মেলা আয়োজন করতে পারবো। কারণ ট্রেড হিসেবে একে টিকে থাকতে হবে।

আমি দেখেছি, অনেক মেধাবী ছেলেমেয়ে এই প্রকাশনা শিল্পে যুক্ত হচ্ছে। তাদের জন্য অনেক সহজ পেশা ছিলো, সেখানে না গিয়ে তারা এই পরিশ্রমের পেশায় থিতু হচ্ছে। তারা প্রচুর পরিশ্রম করছে, তাদের কিন্তু উৎসাহ দেয়া দরকার এই পেশায় দাড়ানোর জন্য। এই বই ব্যাবসা কিন্তু অন্য পাঁচটা ব্যাবসার মতো না। এই দেশের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, সাহিত্যকে আরো একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তারা নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করছে। তাই এটাকে অন্য ব্যাবসার সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা ভুল হবে। এটা শুধু সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কাজ না—দ্রুত এরসঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিদেশ প্রচার উইং, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো সবাইকে সম্পৃক্ত হতে হবে। আমি দেখেছি, ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় তাদের পর্যটন মন্ত্রণালয়ও ভূমিকা নেয় এবং অংশগ্রহণ করে। কেননা বইয়ের পাশাপাশি আমার বাকি সবকিছুকেই তুলে ধরার মোক্ষম সুযোগ এটা।

আমরা বাংলাদেশ আজকে সেই পর্যায়ে এসে গেছি। আমার মনে হয়, আগামী দিনে দেশের ভিতরে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেসব বইমেলা করতে যাচ্ছি, সেগুলোকে সম্পূর্ণ নতুন চিন্তাভাবনা থেকে নতুনভাবে সাজাতে হবে।

একটা মেলা হলো, দলবেঁধে দেখতে গেলাম আর ফিরলাম খালি হাতে--এরকম হলে চলবে না। আমরা যেন সেখান থেকে সর্বোচ্চটা নিয়ে আসতে পরি, তা নিশ্চিত করতে হবে। সেখানে দশটা বা বিশটা বইয়ের যেন স্বত্ব বিক্রি করতে পারি, আবার পঞ্চাশটা বইয়ের যেন স্বত্ব কিনতে পারি। আবার দেশের ভিতরে যেসব মেলা আয়োজন করছি, সেখানে মেলা প্রাঙ্গন শুধু না, যেখানে সেমিনার-সিম্পোজিয়াম হচ্ছে বা পাঠের আসর হচ্ছে কিংবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছে—সেখানেও যেন লোক গমগম করে। আর কী হচ্ছে, সেটা মানুষকে সঠিকভাবে জানাতে হবে।

আমি আগেই বলেছি— প্রকাশনার শিল্পের সঙ্গে যুক্ত কমবেশি আমরা সবাই এই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি— আমরা সম্মিলিতভাবে একত্রিত হয়ে কাজ করতে পারছি না। সম্মিলিতভাবে কাজ করতে আমাদের প্রকাশকদের যেমন ভূমিকা আছে, তাদের সঙ্গে এর স্টেক হোল্ডার— মন্ত্রণালয়, একাডেমি, গ্রন্থকেন্দ্র—তাদের নিয়ে যেন একটা সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করি। আমার মনে হয়, এর মাধ্যমে আমরা আমাদের প্রকাশনা শিল্পকে একটা ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যেতে পারবো। তবে সেই পরিকল্পনা এখনই নিতে হবে, ওই নভেম্বর বা ডিসেম্বর মাসে গিয়ে নিলে ফলাফল ভালো আসবে না। আমরা এই মেলা শেষ করেই মার্চ-এপ্রিল থেকেই যেন পরের মেলার পরিকল্পনা করতে বসতে পারি, সেই মনোভাব নিয়ে আমাদের এগোতে হবে।

বইয়ের কাগজ, কালি, বাঁধাইয়ের উপকরণ, যন্ত্রপাতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেতে এবং নতুন পণ্য সম্পর্কে জানতে এরকম একটি মেলার দরকার আছে। আমার মতে, সেটাকে এই বইমেলাতেই যুক্ত হতে হবে না। তাদের জন্য বছরের অন্য সময়ে সাত বা দশদিনের আলাদা আর একটা মেলা হতে পারে। একটা বইকে সুদৃশ্য করতে কী কী উপকরণ দরকার, কোন যন্ত্রপাতি পাওয়া যায়—তার সব কিন্তু আমরা জানি না বা নতুন কিছু এলে সে বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকা হয়ে ওঠে না। তাই বৃহৎ স্বার্থে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সহায়তা নিয়ে করা যায়। সেটা যে বাংলা একাডেমি চত্বরে হতে হবে এমন কোনো কথা নাই। তবে বইমেলার সঙ্গে যুক্ত যারা তাদের সহায়তা নিতে পারে মেলার উদ্দেশ্য সফল করতে। এতে ইন্ডাষ্ট্রি আরও বেশি উপকৃত হবে।

জসিম উদ্দিন, স্বত্বাধিকারী- কথাপ্রকাশ

আমাকে আসলে আহত করে একটা বিষয়—আপনি তুলনামূলক যে বিষয় জানতে চাইছেন—আমাদের এখানে যেসব বই প্রকাশ হয়, তার নব্বই শতাংশই মৌসুমী বই। সেখান থেকে আপনি আসলে কি শিখবেন? আমি একজন প্রকাশক, আমি যদি বইয়ের ব্যবসাকে পুঁজি করে পেশাদারিত্ব মনোভাব নিয়ে না আসি—তবে আমার এই জায়গায় আসার দরকার নেই। আমি লবণ বা অন্য কিছুর ব্যবসা করতে পারি। প্রকাশনার ব্যবসার উদ্দেশ্যই হচ্ছে, আপনি সেবামূলক কাজ করবেন, এবং এর স্থায়ীকরণে কাজ করবেন। দেশের জন্য কাজ করবেন, জনগণের জন্য কাজ করবেন। ব্যবসার পাশাপাশি শিক্ষার বিষয়াদিও থাকবে। আপনি অন্য দেশের বইগুলো দেখেন, সেই বইগুলো যখন বের হয়—যদি বইটা বের হয় দু’হাজার সালে, এখন দু’হাজার চব্বিশ সাল চলছে, এই সময়ে এসেও সেই বইয়ের প্রচারও কম নেই, বিক্রিও কম নেই। কিন্তু আমাদের দেশের লেখকরা হুট করে একটা বই বের করেন, হুট করেই কয়েক হাজার বিক্রি শেষে পরের বছর আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এই যে একটা ওঠানামার ব্যাপার—আমরা যদি প্রকৃত প্রকাশক হই—এখানে আমাদের প্রকাশকদের দৃষ্টি দিতে হবে। মেলায় এমন ধরনের বই প্রদর্শন করা থেকে বিরত থাকার আহবান থাকবে প্রকাশকদের প্রতি। বলবো, তোমরা এটা অন্যভাবে বিক্রি করো। এই যে মেলায় যারা আসে, তাদের আটানব্বই শতাংশ লোক মেলাকে ডিস্টার্ব করতে আসে। ওইসব লোক বই কিনতে আসে না। এতে মূল বা স্থায়ী যে পাঠক, তারা মেলায় ঢুকতে পারে না। কারণ তারা এসে বই দেখতে পারছে না। একটা বই দেখতে আপনাকে সময় দিতে হবে।

আরেকটা কষ্টের বিষয়, আমাদের পাশের দেশেই, যে কোলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তক মেলা হয়—সেখানে চাপা এবং সংকীর্ণ জায়গায় আমাদের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে চারফুট জায়গা বরাদ্দ করে। সেই চারফুট জায়গায় আপনি কিভাবে বই প্রদর্শন করবেন আর বিক্রি করবেন! এই কার্পণ্য থেকে মুক্তি পেলে আমরা কোলকাতায় প্রচুর বই বিক্রি করতে পারি। এই অবস্থা দেখে আমি কোলকাতায় কথাপ্রকাশের একটা শাখা খুলেছি- কথাপ্রকাশ ঢাকা বুকস নামে। এটা কোলকাতায় বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এতে কোলকাতার যারা সিরিয়াস পাঠক আছেন, তারা বাংলাদেশের বই পাচ্ছেন।

পরবর্তীতে যে বিষয়টি নিয়ে বলবো, সেটি হচ্ছে মেলার সময়। এই বইমেলা যে পুরো একমাস ধরে হচ্ছে, এতে কিন্তু প্রকাশকদের লোকসান হচ্ছে। কেননা, অনেক বই প্রকাশ করতে হয় অনুরোধ রাখার দায়ে। অনেক লেখক এসে ধরে বসেন, মেলার সময় অনেক আছে, রেডি বই, শুধু ছেপে বের করবেন—এইসব বলে তারা তাদের বই গিলতে বাধ্য করেন আমাদের। কিন্তু এই বই কতোটা বিক্রি হচ্ছে? এই বইয়ের পেছনে লেখকের বিনিয়োগ আছে—এটা গোপনীয় বা প্রকাশ্য যাই বলেন—নতুন লেখকরা নিজেদের টাকা খরচ করে বই বের করতেই পারে। কিন্তু তারও একটা সীমা থাকা দরকার। এদিকে আবার দেখেন, যেখানে এডিটিংয়ের জন্য হয়তো বিশ হাজার খরচ অথচ আমি নিয়েছি লাখ টাকা! একজন লেখক টাকা উপার্জন করে সেটা খরচ করছে, তার শখ পূরণ করতে। তাকে কিন্তু বোঝান খুব সহজ, যে ভাই আমি আপনার বইটা এ বছর নিলাম কিন্তু আমি বইটা এ বছর করবো না। আমার নিজের থাকুক বা বাইরের সম্পাদনা প্রতিষ্ঠান থেকে—আমাদের দেশে কিন্তু কয়েকটি সম্পাদনা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে—বইটার সম্পাদনা করি। পঁচিশ হাজার টাকা খরচ হবে, তার অর্ধেক আমি দেই বাকিটা আপনি দেন। তারপর, বই বিক্রি হলে না হয় রয়েলিটির বিষয়টা দেখা যাবে। এইভাবেও কিন্তু একটা বই স্থায়ী করা যায়। কিন্তু ওই যে যাচাই বাছাই ছাড়া বই বের হয়, দীর্ঘ সময় থাকায় অনেকে সেই সুযোগ নিচ্ছে। এতে একটা ভাসমান বাজার তৈরী হচ্ছে ঠিকই কিন্তু তার কোনো ভিত্তি নেই। এইজন্য বলতে চাই, আটাশ উনত্রিশ দিনের মেলাকে যদি পনেরো দিনে করে মেলার সময়টাকে যদি কমিয়ে দেয়া হয় তাহলে ভালো হয়। এখন শুরু হয় দুপুর তিনটায়, সেটা এগারোটা করা যায়—এখন ফেব্রুয়ারি পুরো মাসে যদি বিক্রি হয় পঞ্চাশ কোটি টাকা, আমি মনে করি সেটা দের’শ কোটি টাকা বিক্রি হওয়া সম্ভব। কারণ, কয়েকটি শ্রেণীকে আমরা বইমেলায় পাই না, এই সময়ের কারণে।

একটা হচ্ছে যারা গবেষক, শিক্ষক, শিক্ষানুরাগী- সারা বছর ঘুরে ঘুরে তাদের বই কেনা হয়ে ওঠে না। তারা ব্ইমেলায় দেখেশুনে বই কেনার সুযোগ পায়। মেলা শুরু হয় দুপুর তিনটায় শেষ হয় রাত নয়টায়, এই সময়ে ওই ভাসমান লোকগুলো ঢোকে। তাদের ভিড়ে বই কিনতে পারেন না তারা। সকাল এগারোটায় শুরু হলে, লম্বা একটা সময় নিয়ে পছন্দের বা বাছাই করে বই কিনতে পারবেন অনেকে। এটা হওয়া দরকার।

পৃথিবীর যে কয়টা দেশে আমি মেলায় অংশ নিয়েছি, তাদের সবগুলো সকাল এগারোটায় শুরু হয়, এটা একদম ফিক্সড।

কোলকাতায় দেখেন—বাংলা ভাষার সবচেয়ে বড় মেলা হচ্ছে বাংলাদেশে, দ্বিতীয় অবস্থানে রাখছি কোলকাতাকে। তবে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলা বইমেলা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে কোলকাতা—সেখানে বইমেলা হয় তেরো দিনের, উদ্বোধনের দিন বাদ দিলে বারো দিন। দু’হাজার দশ সাল থেকে দেখছি, তাদের মেলা বারো দিনের হচ্ছে। কোনোদিনই পনেরো বা বিশ দিনের মেলা হয়নি। এরপরও তাদের বিক্রি কি কম হচ্ছে, তা কিন্তু না। কারণ তাদের প্রস্তুতি অনেক আগে থেকে নেয়া। মজার বিষয় হচ্ছে, মেলার এক বা দুই তারিখে—ওদের মেলা শুরু হয় সাধারণত জানুয়ারির শেষ বুধবার। এবার যদিও এগিয়ে আনা হয়েছে কোনো কারণে। তবে শেষ বুধবার থেকে শুরু হয়ে তেরোতম দিনে শেষ হয় মেলা। তাদের কোটি কোটি টাকা বিক্রি হয়। আবারও বলছি, তার কারণ তাদের দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি। আগেই নেয়া পরিকল্পনা। আর আমাদের মেলার প্রস্তুতি শুরু হয়, দুই মাস আগে।

আমাদের মেলার সময়সূচীর কারণে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী-পাঠকরা বাদ পড়ে যাচ্ছে। এক হচ্ছে তাদের ক্লাস থাকে, না হয় প্রতি বছর কোনো না কোনোভাবে এসএসসি পরীক্ষার তারিখ পড়ে। একটা পরিবারের যদি একজনও পরীক্ষার্থী থাকে, ওই পুরো পরিবারকে আমরা মেলায় পাচ্ছি না। এরকম হাজার হাজার পরিবার মেলা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই পরীক্ষা যদি মার্চ বা জানুয়ারি মাসে করে, এমন কোনো সমস্য হয় না। সরকার কতো কিছু পরিবর্তন করতে পারে! কিন্তু একটা দেশের মাঝে জ্ঞানকে ছড়িয়ে দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে বইমেলা—একটা পরীক্ষার জন্য কতোগুলো পরিবার দেখেন আসতে পারছে না সেখানে। একটা বাচ্চা শিুশু বই কিনতে পারে না।

আবার বিশ্ববিদ্যালয়কেও কিন্তু আমরা ধরতে পারি না। আমাদের মেলার পাশেই বিশাল একটা বিশ্ববিদ্যালয়, তাদের কখনো কখনো দুই ক্লাসের মাঝে বিরতি থাকে তিন ঘন্টা। ওই সময়ে তারা মেলায় ঢু মারতে পারে। কিন্তু তখন তো মেলার দ্বার বন্ধ থাকে। ফলে তাদেরও ধরতে পারছি না আমরা।

তাই আবারও বলছি, মেলার দিনের দৈর্ঘ্য কমিয়ে খোলার সময় বাড়িয়ে দেয়া হোক। এতে বিদ্যালয় পড়ুয়া, পরীক্ষার্থীদের পরিবারকে পাবো মেলায়।

আমাদের একটা বড় সমস্যা এখন মিডিয়াকে নিয়ে। প্রিন্ট মিডিয়া আস্তে আস্তে কমে গেছে, সেখানে যে বিজ্ঞাপন দেয়া যেত সেই সুযোগ কমে যাচ্ছে। আর প্রিন্ট মিডিয়া এখন অনেকে বাসায় রাখেও না। তাই পাঠকরা নতুন বই সম্পর্কে জানতে পারছে না। ফলে বইয়ের প্রচারণা খরচটা—সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বা অনলাইন পোর্টালে—কম রেখে যদি একটু সুযোগ করে দেয়, তাতে করে ঘরে বসে বই বাছাই করে মেলায় এসে বই কিনে পাঠকরা সময় বাঁচাতে পারে, সঠিক বইটিও কিনতে পারে। পাঠক হয়তো শুধু এসে নেড়েচেড়ে দেখবে যে, বইয়ের নামের সঙ্গে অন্যান্য দিকের কতোটুকু সামঞ্জস্য আছে, তা নিশ্চিত হয়ে বইটি কিনে নিতে পারে সহজে। এখন এই ভীড়ের মধ্যে হুড়োহুড়ি করে কয়টা বাছাই করবেন আর কয়টা বই-ইবা কিনবেন!

তাহলে দেখেন, কয়েকটা শ্রেণী বাদ পড়ে যাচ্ছে বই কেনার অবারিত মেলা থেকে।

এক হচ্ছে, একটা শ্রেণী বই সম্পর্কে জানতে পারছে না। এর জন্য দায়ী গণমাধ্যম। কারণ তারা ওই জায়গাটাকে এমনভাবে ধরে রেখেছে যে, তাদের ব্যবসাই করতে হবে। কেন রে ভাই, তোমরা তো সারা বছরই ব্যবসা করো। একটা মাস জনদাবীর প্রেক্ষিতে সেবার কাজ করো না, অসুবিধা কী! টাকা নাও—দিতে চাই আমরা—তবে একটু কমিয়ে দেওয়ার সুযোগ করে দাও।

দেশের যারা প্রথম সারির দৈনিক এক মাসের জন্য দুইটা পাতা ছেড়ে দাও না। কারো বড় করে নয় সবাই ছোট ছোট করে বিজ্ঞাপন দিক। বইয়ের নাম, লেখক, প্রকাশক সম্পর্কে জানাই আমরা। এতে অন্তত প্রচার তো হল। আবার অনলাইন মিডিয়া যারা আছেন, তারা একটা কলাম করে দিতে পারে। কিন্তু তারা তাদের নির্ধারিত রেট চার্ট নিয়ে বসে আছে। একটা বই বের করতে যে টাকা খরচ হয়, সেই পরিমাণ বই কি আমাদের দেশে বিক্রি হয়? হয় না। এজন্য আমরা বইমুখী হচ্ছি না। আর যেদিকে মুখ ঘুরিয়েছি সেটা একদম সাময়িক সময়ের জন্য।

আরেকটা বিষয় হচ্ছে, এই মেলা হচ্ছে একটা সম্ভাবনার জায়গা। আমরা সারাবছর অনলাইনে বই বিক্রির হিসাব নিই, দেখতে পাই কতোজন অনলাইনে বই কিনছে। তাই এই টেকনোলজি কতোটা আর্শিবাদ আর কতোটা অভিশাপ, সবাই আমরা ভালো করেই বুঝি।

বলতে পারবেন, আমরা কয়টা বইয়ের বিজ্ঞাপন দেখি। কিংবা বইয়ের লিস্ট দেখতে ফেইসবুক ঘাঁটি। আমরা তো অন্য জিনিস বেশি দেখি।

এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য, আমাদের গণমাধ্যমকে আরও বেশি কাজ করা দরকার। একজন গণমাধ্যমের লোক হিসেবে, আপনার হয়তো খারাপ লাগতে পারে। কিন্তু আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, তারা যথেষ্ট ভূমিকা রাখছে না।

তাদের প্রচার-প্রচারণা নিয়ে কিন্তু বলিনি। বলেছি তারা আমাদের প্রচার-প্রচারণার সুযোগ দিতে কার্পণ্য করছে বা দরাজ দিলে হাত বাড়াচ্ছে না। আরেকটা কথা বলি, গণমাধ্যম কি শুধু ফেব্রুয়ারি মাসে বইমেলার জন্যই সবটুকু ঢেলে দেবে? কেন? তাহলে আমরা যে সারাবছর বই বের করছি, সে খবর পাঠককে জানাবো কিভাবে? তারা তো সারা বছর করতেই পারে, বই নিয়ে কোনো অনুষ্ঠান, সমালোচনা অনুষ্ঠান, নতুন বইয়ের পরিচিতিমূলক অনুষ্ঠান। বিষয়টা হলো, আপনাকে প্রকাশকদের গুরুত্ব দিতে হবে। আপনি একটা মাসে মাত্র দুজন প্রকাশকের সাক্ষাতকার নেন, তাদের আদ্যোপান্ত জানানোর উদ্দেশ্যে প্রশ্নের মাধ্যমে তাদের তুলে ধরেন। দেখুন না, প্রতি মাসে দুজন, প্রতি বছরে কতোজন হয়? এতো ভালো প্রকাশক কিন্তু নেই, পাবেনও না। তাদের থেকে যে সমস্ত কিছু জেনে গেলেন, এর মানে কিন্তু আপনার মাধ্যমে জনগণ জানতে পারছে। এই কাজটা আমাদের গণমাধ্যম করতে রাজী না। ফেব্রুয়ারি মাস আসলেই একেকজন প্রকাশকের দাম বেড়ে যায়, একটা ইস্যু হয়ে দাড়ায় তারা। স্পটলাইটে চলে আসে। যেন বিষয়টা গতবাঁধা এমন—ফেব্রুয়ারি আসলেই বইয়ের কথা বলতে হবে, রমজান আসলে রোজা রাখতে হবে, পূজো শুরু হলে তার ঘণ্টাধ্বনি সবাইকে শোনাতে হবে—এই যে উৎসবকেন্দ্রিক প্রচারণা—কিন্তু বইয়ের প্রচারণা কোনো উৎসবকেন্দ্রিক হওয়া উচিত না। বইয়ের প্রচারণা সবসময়ের জন্য হওয়া উচিত। উৎসব হবে বই কেনার জন্য, প্রচার হবে সারা বছরের জন্য। তবেই আমাদের বইয়ের ব্যবসা টেকসই হবে, এবং ভালো বই পাঠকরা সহজে খুঁজে পাবে। যেটা যার প্রয়োজন, সেটা হাত বাড়াতেই মিলে যাবে।

এটা হলো, দেশ বিদেশ দেখা সাপেক্ষে আমার ব্যাক্তিগত মতামত। জানি না, এর কতোটুকু কার্যকরা হওয়ার সম্ভাবনা রাখে।

আমার জোর দাবী হচ্ছে, সকাল এগারোটায় মেলা হওয়াটা খুবই জরুরী, খুবই জরুরী, খুবই জরুরী। কারণ সময়ের ফ্যারে পড়ে বিশাল সংখ্যার পাঠকশ্রেণী আমরা হারাচ্ছি। অনেকে বলেন, বিক্রি হবে না। আমি বলবো, একবার করে দেখুন না। প্রকাশকদের অনেকেই সন্দিহান। আমি বলি, আরে ভাই করে দেখি না একবার। আমার বিশ্বাস দারুণ বিক্রি হবে।

ষড়ৈশ্বর্য মুহম্মদ, লেখক, সাংবাদিক ও প্রকাশক- উজান প্রকাশন

আগে আমরা একটু দেখে নিই একুশে বইমেলায় কী কী হয়। সাধারণ প্রকাশকরা নিজেদের প্রকাশনার বইয়ের প্রদর্শনী ও বিক্রয়ের জন্য বইমেলায় স্টল নেন। এর বাইরে আলোচনা, বইয়ের মোড়ক উন্মোচন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থাকে বইমেলায়। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে মূল মঞ্চে থাকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং আলোচনা। মুক্তমঞ্চেও থাকে সংগীত ও সাংস্কৃতিক আয়োজন। বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের জন্য মঞ্চ থাকে, থাকে ‘লেখক বলছি’ মঞ্চ। এসবের বাইরে বইপড়া প্রতিযোগিতাসহ বই ও পাঠভিত্তিক আরো অনেক আয়োজন থাকতে পারে বইমেলায়।

আমাদের বইমেলায় বিদেশি কোনো প্যাভিলিয়ন নেই। আলাদাভাবে আন্তর্জাতিক কোনো বইমেলাও নেই। ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলাটিও তো আর এখন হয় না। কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায়ও ২৫ থেকে ২৬টি দেশের প্যাভিলিয়ন থাকে প্রতিবছর। এ ধরনের একটি ব্যবস্থা বাংলাদেশের বইমেলায় থাকা দরকার কিংবা আলাদা একটি আন্তর্জাতিক বইমেলা থাকা দরকার। ভারতীয় বাংলা প্রকাশনাগুলোর বইমেলায় অংশগ্রহণ নিয়ে বোধহয় আমাদের প্রকাশকদের একটা অস্বস্তি আছে। এক্ষেত্রে ভারতের প্রকাশনাগুলোকে আলাদা আলাদাভাবে বরাদ্দ না দিয়ে অন্য দেশগুলোকে যেভাবে প্যাভিলিয়ন দেওয়া হয় তেমন করে ভারতকেও একটি প্যাভিলিয়ন দেওয়া যেতে পারে।

আমাদের বইমেলা একটা গণসংশ্লিষ্ট উৎসব। প্রতিদিন বহু মানুষ বইমেলায় ঘুরতে আসে। বইমেলায় ক্রেতা ১০ শতাংশ, দর্শনার্থী ৯০ শতাংশ। যে কারণে এটিকে বহুমুখী করার সুযোগ তো নানাভাবেই আছে। এই প্রক্রিয়ার মূল লক্ষ্য হতে হবে পাঠক ও ক্রেতা-দর্শনার্থীরা। দর্শনার্থীদের জন্য যত সামান্যই হোক একটা প্রবেশ ফি থাকতে পারে। আয়োজক কর্তৃপক্ষ বইমেলার সময় একটি অনলাইন পোর্টাল চালু রাখতে পারে যেখান থেকে বইমেলার সব বই ক্রেতারা অর্ডার করতে পারবে কিংবা কিনতে পারবে। বই ভিত্তিক কোনো অনলাইন প্রতিষ্ঠানকেও এ সংক্রান্ত কাজ দিতে পারে। বাংলাদেশের বাইরের বাংলাভাষাভাষি পাঠক ও ক্রেতা আকর্ষণের জন্য উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

বইমেলা বহুমুখীকরণের জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এগুনো দরকার। আগামীতে বইমেলা কোথায় হবে তা নিয়ে একটা অনিশ্চিয়তা আছে। সেই অনিশ্চয়তা দূর করে এখন থেকেই ঘোষণা থাকা দরকার যে আগামীতে একুশে বইমেলাটি কোথায় হবে।

বাংলাদেশের বাইরে ভারতের কিছু বইমেলায় গিয়েছি। এর বাইরে কোথাও যাওয়া হয়নি। আমাদের একুশে বইমেলার সঙ্গে কলকাতা কিংবা ভারতের অন্যান্য বইমেলার একটা সাদৃশ্য আছে। আমাদের বইমেলার আয়োজন থাকে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক। যাদের নিজস্ব প্রকাশনা আছে তারাই কেবল এতে অংশ নিতে পারে।

ফ্রাঙ্কফুর্ট, আবুধাবি কিংবা বুক এক্সপো আমেরিকার মতো নয় আমাদের বইমেলা। আমাদের বইমেলার একটা বড় দিক হচ্ছে এখানে ছোট প্রকাশকদের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে। লিটল ম্যাগাজিনগুলোর জন্যও একটা বেশ বড় পরিসর আছে আমাদের বইমেলায়। কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলার মতোই আমাদের বইমেলাটি সাধারণ পাঠক ও ক্রেতামুখী। ফ্রাঙ্কফুর্টের মতো মেলাগুলো প্রকাশক, এজেন্ট, লেখক ও অনুবাদকদের মধ্যে লাইসেন্স, চুক্তি, কপিরাইট এবং বইয়ের প্রদর্শনীর ওপর জোর দেয়। আমাদের জোর কিন্তু সাধারণ ক্রেতার ওপর। আমাদের বইমেলাটি একমাস ধরে চলে, এদিক থেকে এই বইমেলা সারাবিশ্বেই অনন্য। ফ্রাঙ্কফুর্ট, লন্ডন, হংকং, আবুধাবী, মেক্সিকোর গুয়াদালাহারা ইত্যাদি বইমেলার মতো আমাদের বইমেলারও কিন্তু নিজস্ব ঐতিহ্য ও বৈশিষ্ট্য আছে। ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার যেমন ৫০০ বছরের একটা ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি আছে। আমাদের বইমেলার ঐতিহ্য ও বৈশিষ্ট্যগুলো চিহ্নিত করে এটির স্বকীয়তা অক্ষুণ্ন রেখে সৌকর্য আরো বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

বুক এক্সপো আমেরিকা (বিইএ) আয়োজন করা হয় প্রতিবছর গ্রীষ্মের শুরুতে। এক এক বছর এক এক বড় শহরে থাকে এই বইমেলার আয়োজন। আগে থেকেই ঘোষণা থাকে পরের বছর বইমেলাটি কোন শহরে হবে। আমাদের এখানেও কিন্তু প্রকারান্তরে এই ধরনের আয়োজন আছে। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র বইমেলার আয়োজন করে। এ বছরও বিভাগীয় শহরগুলোতে এই আয়োজন ছিল। বিভাগীয় শহর এবং জেলা ও উপজেলায় বইমেলার আয়োজন থাকা দরকার এবং এই আয়োজনগুলোকে সফল করে তোলার উদ্যোগ থাকা দরকার। দেখা যায় যে, একুশে বইমেলার বাইরে আমাদের বিভাগীয় বইমেলাগুলোতে ক্রেতা ও দর্শনার্থী খুব একটা থাকে না। কেন থাকে না, কেন তারা আকৃষ্ট হয় না, তা খতিয়ে দেখা আয়োজকদের জন্য জরুরি। এক্ষেত্রে একটা উদাহরণ দিতে চাই। গত বছর কক্সবাজারের একেবারে প্রান্তিক উপজেলা চকোরিয়ায় বর্ষা মৌসুমে স্থানীয়ভাবে উদ্যোগ নিয়ে ছোট পরিসরে একটি বইমেলা হলো। পাঁচ লাখের কম লোকের বসবাস এই উপজেলায়। সাত দিনের বইমেলায় স্থানীয় প্রশাসন পালাক্রমে একদিন করে স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের বইমেলায় ঘোরার সুযোগ করে দিল। শিশুকিশোররা অভিভাবক ও শিক্ষকদের নির্দেশনার বাইরে থেকে বইমেলায় নিজের পছন্দমতো বই দেখল এবং কিনল। বইমেলাটির কথা বলার কারণ, স্থানীয় প্রশাসন, স্থানীয় সাংসদ এবং অন্যান্য জনপ্রতিনিধিদের আন্তরিকতার কারণে ওই বইমেলাটি সফল ছিল। আমরা দেখব, এ রকম স্থানীয় উদ্যোগ ও আন্তরিকতায় ছোট ছোট বইমেলাগুলো সফল হচ্ছে। আমার মনে হয়, এভাবে স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের লোকজন, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করে উদ্যোগ নিলে তাদের সবার আন্তরিকতায় যেকোনো বইমেলাকে সফল করে তোলা যায়।

এখানে একটি কথা বলতে চাই। বাইরের অভিজ্ঞতা সবসময় যে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে কাজে লাগবে তেমন নয়। ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার চুক্তি স্বাক্ষর এবং কপিরাইট শেয়ারের বিষয় আমাদের কিন্ত খুব একটা কাজে লাগবে না। বরং দেশের ভেতরের অভিজ্ঞতা অনেক বেশি ফলপ্রসূ হতে পারে। আমাদের সংস্কৃতি এবং আমাদের মানুষের প্রবণতাগুলো বিবেচনায় নিয়ে সে অনুযায়ী মানুষকে বইয়ের দিকে আকর্ষণের জন্য উদ্যোগ নেওয়া বেশি জরুরি। সেজন্য বইমেলার ব্যাপারে, বইয়ের ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলার জন্যও সেভাবেই ভাবা দরকার এবং উদ্যোগ নেওয়া দরকার।

আমাদের বইমেলায় জঙ্গিবাদ এবং উস্কানিমূলক কোনো বইপত্র ঢুকছে কি না সেটি তদারকির একটা ব্যবস্থা কিন্তু পরোক্ষভাবে হলেও আছে। একইভাবে খুব প্রয়োজনীয় এবং উল্লেখযোগ্য বইগুলোর ওপর বিশেষ আলোকপাতের একটা ব্যবস্থাও থাকা দরকার। প্রয়োজনে বাংলা একাডেমির ভেতরকার বিষয় বিশেষজ্ঞ কিংবা বাইরের সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের সহায়তা নিয়ে উল্লেখযোগ্য বই বাছাইয়ের একটি ব্যবস্থা রাখা দরকার। যেটি প্রতিদিনের বা পরের দিনের বইমেলায় বিশেষভাবে জানান দেওয়া হবে। বইমেলায় সেরা স্টলের জন্য পুরস্কারের একটি ব্যবস্থা আছে, কিন্তু বিষয় বিবেচনায় সেরা বইগুলো বাছাই করার কোনো ব্যবস্থা নেই। প্রতি বছর এই যে হাজার পাঁচেক বই বের হচ্ছে তার থেকে অন্তত একশ কিংবা ৫০০ বইয়ের একটি তালিকা করা হোক। একেবারে সংক্ষিপ্ত তালিকার দরকার নেই। তালিকা একটু বড়ই হোক। এমনকি সম্ভব হলে মেলার সবচেয়ে জনপ্রিয় বইগুলোরও তালিকা হতে পারে।

বইমেলায় একটা বই ও পাণ্ডুলিপিভিত্তিক অস্থায়ী জাদুঘর থাকা দরকার। যেখানে নানা দেশের নানা ভাষার প্রাচীন বইপত্র ও লেখাজোকার নিদর্শন থাকবে। সারা বিশ্বে বিখ্যাত লেখক ও পণ্ডিতদের ওপর নানা ধরনের আলোকপাত থাকবে। তাদের হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি, আমাদের লেখকদের পাণ্ডুলিপি এবং নানা কিছু সেখানে প্রদর্শনের ব্যবস্থা থাকবে। বাংলা ভাষার উদ্ভব ও বিকাশ, বাংলা লিপির উদ্ভব ও বিকাশ, বাংলা ভাষার বিবর্তনের ধারাবাহিকতা, বাংলার ভাব ও জ্ঞানসম্পদের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সেখানে নানা উপস্থাপনা ও প্রদর্শনী থাকবে।

বইমেলায় এই সময়ের নানা ক্ষেত্রে সেলিব্রিটিদের জীবন বদলে দেওয়া বই নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনার ব্যবস্থা থাকতে পারে। যেখান থেকে শিশুকিশোর ও তরুণরা উৎসাহ পাবে।

বাংলাদেশের বইকে কীভাবে বিশ্বের বই করে তোলা যায়, কীভাবে বইমেলাকে সারা বিশ্বের মানুষের কাছে আগ্রহী করে তোলা যায়, বাংলাদেশের বাইরে বাংলাভাষার পাঠকদের আমাদের বইমেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা এবং তাদের কাছে আমাদের বই পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা জরুরি। সে বিষয়েও ভাবা দরকার।