তিনটি বিদেশি কবিতা

রাকিবুল হাসানের অনুবাদে এডগার এলেন পো, সিলভিয়া প্লাথ ও পাবলো নেরুদার কবিতা

রাকিবুল হাসানরাকিবুল হাসান
Published : 17 March 2023, 02:17 PM
Updated : 17 March 2023, 02:17 PM

একা

এডগার এলেন পো

শৈশব থেকে আমি ছিলাম না

অন্যরা যেমন ছিল—আমি দেখিনি

অন্যরা যেমনটি দেখেছে—আমি জাগাতে পারিনি

আমার অনুরাগ, তুচ্ছ ঝর্ণা থেকে-

একই ধারা থেকে আমি নিইনি

আমার দুঃখ--আমি জাগাতে পারিনি

একই সুরে আমার হৃদয়কে আনন্দে--

আর আমি যা ভালবাসতাম - আমি একাই ভালবাসতাম -

তারপর—আমার শৈশবে—

সবচেয়ে ঝড়ো জীবনের প্রভাতে -

ভালো আর মন্দের গভীর কুয়ো থেকে উৎসারিত

সে রহস্য আমাকে এখনো বেঁধে রাখে

প্রবল জলস্রোত বা ঝর্ণা থেকে-

পাহাড়ের লাল চূড়া থেকে-

সূর্য থেকে - যা আমার চারপাশে ঘোরে

শরতের সোনালি আভায়-

আকাশে বিদ্যুৎচ্ছটা থেকে-

যখন আমার পাশ দিয়ে উড়ে গেল-

বজ্রপাত এবং ঝড় থেকে-

আর মেঘ থেকে - যা আমার চোখে

দানা বেঁধেছে (যখন আকাশের বাকি অংশ ছিলো নীল)

দৈত্যের মতো।

পাগলিনীর প্রেমগান

সিলভিয়া প্ল্যাথ

আমি চোখ বুজলেই সমস্ত পৃথিবী হারায় প্রাণ;

চোখ মেলে তাকাতেই আবার জন্মায় সব,  ফিরে প্রাণ।

(মনে হয়, তোমার অস্তিত্ব আমার মস্তিষ্কে।)

নীল এবং লাল রঙা তারাগুলো নেচে বেড়ায়,

আর আঁধারে অবাধে ছুটে বেড়ায় :

আমি চোখ বুজলেই সমস্ত পৃথিবী হারায় প্রাণ।

আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম- তুমি আমায় কামে বশীভূত  করেছিলে

আর চন্দ্রাহত গান শুনিয়েছিলে, দিয়েছিলে চুম্বন বদ্ধ উন্মাদের মতো।

(মনে হয়, তোমার অস্তিত্ব আমার মস্তিষ্কে।)

ঈশ্বর আকাশ থেকে নেমে আসে, নরকের আগুন ম্লান  হয়ে যায়:

সেরাফিম এবং শয়তানের অনুসারীরা পালিয়ে যায়:

আমি চোখ বুজলেই সমস্ত পৃথিবী হারায় প্রাণ;

তুমি যেভাবে বলেছিলে, আমি ভেবেছিলাম, তুমি আসবে ফিরে,

কিন্তু আমি বুড়ো হয়েছি, তোমার নামও ভুলে গেছি।

(মনে হয়, তোমার অস্তিত্ব আমার মস্তিষ্কে।)

আমার বরং  কোকিলকে ভালোবাসা উচিত ছিল;

অন্তত বসন্ত এলে সে আবার ফিরে আসে, শুনায় গান।

আমি চোখ বুজলেই সমস্ত পৃথিবী হারায় প্রাণ;

চোখ মেলে তাকাতেই আবার জন্মায় সব,  ফিরে প্রাণ।

(মনে হয়, তোমার অস্তিত্ব আমার মস্তিষ্কে।)

আজ নিশিতে, আমি লিখে দিতে পারি দুঃসহ দুঃখের পংক্তিমালা 

পাবলো নেরুদা

আজ নিশিতে, আমি লিখে দিতে পারি দুঃসহ দুঃখের পংক্তিমালা। 

যেমন লিখতে পারি, ‘বিমর্ষ রাতে

দূরের বেদনাসিক্ত নীল তারারা থরথর করে কাঁপে।'

রাতের বাতাস আকাশে ঘুরেঘুরে গান করে। 

আজ নিশিতে, আমি লিখে দিতে পারি দুঃসহ  দুঃখের পংক্তিমালা।

আমি তাঁকে ভালোবাসতাম, আর কখনও সখনও সেও আমায় ভালোবাসত। 

এমন অনেক রাত কেটেছে - সে আমার বাহুডোরে 

অসীম আকাশের নীচে সহস্র চুম্বনে সিক্ত করেছি তারে।

কখনও সখনও সে আমায় ভালোবাসত, আর আমিও তাকে ভালোবাসতাম।

তার গাঢ় দুই স্থির চোখ কে না ভালোবেসে পারে?

আজ নিশিতে, আমি লিখে দিতে পারি দুর্বিনীত দুঃখের পংক্তিমালা।

যখন ভাবি- সে আমার  নেই, যখন অনুভব করি- আমি তাকে হারিয়েছি

তখন দীর্ঘ নিশী তাকে ছাড়া অন্তহীন মহাকাল মনে হয়।

আর সবুজ মাঠের বুকে যেমন করে শিশির নেমে আসে, 

তেমনি কাব্যের খরস্রোতা নদী বয়ে যায় আমার হৃদয়ে।

আমার ভালোবাসা তাকে ধরে রাখতে পারেনি-তাতে কি এসে যায়।

বিমর্ষ রাত, আর সে আমার পাশে নেই।

দূরে কেউ গান গাইছে। দূরে।

আমার আত্মা অতৃপ্ত, তাকে হারিয়েছে বলে।

আমার দৃষ্টি তার অন্বেষায়, যেন তার কাছে যেতে চায়।

আমার হৃদয় তাকে খোঁজে, আর সে আমার পাশে নেই।

সে রাতেও আমরা দেখেছিলাম চারপাশ তারার আলোয় 

শুধু আমরা আর আগের মতো নেই।

আমি তাকে আর ভালোবাসি না, আমি জানি, কিন্তু আমি তাকে কীভাবে যে ভালোবাসতাম।

আমার সুর তার হৃদয় ছুঁতে বাতাসকে করেছিলো মিনতি।

অন্যের। সে অন্যের হবে। আমার চুম্বনগুলোর মত অতীত-

তার কন্ঠস্বর। তার উজ্জ্বল দেহ। তার অথৈ দু’চোখ।

আমি তাকে আর ভালোবাসি না, আমি নিশ্চিত, তবে হয়তো আমি তাকে ভালোবাসি।

প্রেমের সময় হ্রস্ব যদিও, বিস্মৃতি খুব দীর্ঘ।

কারণ এমন অনেক রাত কেটেছে - সে আমার বাহুডোরে

আমার আত্মা অতৃপ্ত, তাকে হারিয়েছে বলে।

যদিও সে আমাকে কষ্ট দিয়েছে, এটাই হোক তার দেয়া শেষ ব্যথা 

আর এটাই তাঁর জন্য লেখা আমার শেষ কবিতা।