দুই ডেভিডের গল্প

লীনা দিলরুবালীনা দিলরুবা
Published : 28 May 2023, 03:32 PM
Updated : 28 May 2023, 03:32 PM

‘হে নাস্তিক তুমি আস্তিকের গুরু’

‘তিনি আমাদিগকে হীরক দেন নাই, স্বর্ণ দেন নাই, রজতও দান করেন নাই, কিন্তু তাহার অপেক্ষা সহস্র-কোটি গুণ মূল্যবান বিদ্যারত্ন প্রদান করিয়াছেন। তাহার চেষ্টা দ্বারা আমরা জ্ঞানের আস্বাদ প্রাপ্ত হইয়াছি, এবং তাঁহার চরিত্রের দৃষ্টান্ত দ্বারা দয়া ও সত্য ব্যবহার যে কী মহোপকারী, তাহা পূর্ণরূপে হৃদয়ঙ্গম করিয়াছি।’

উনবিংশ শতাব্দীর মহৎপ্রাণ ব্যক্তিত্ব অক্ষয় কুমার দত্ত ওপরের কথাগুলো বলেছিলেন ডেভিড হেয়ার (১৭৭৫-১৮৪২) সম্পর্কে। ডেভিডের পেশা ছিল ব্যবসা, স্কটল্যান্ডের ঘড়ি-নির্মাতা ডেভিড হেয়ার ১৮০০ সাল থেকে আমৃত্যু ভারতের মায়ায় এই ভূখণ্ডেই কাটিয়ে দিয়েছিলেন।

তাঁর ৪২ বছরের ভারতবাসে ডেভিড হেয়ার শিক্ষাবিস্তারে, প্রচলিত ধর্মের কুসংস্কার দূরীকরণে, শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষায়, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখতে ব্রতী ছিলেন। সার্বিক দিক বিবেচনা করে ইতিহাসবিদেরা হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার নেপথ্য নায়ক ডেভিড হেয়ারকে ভারতীয় উপমহাদেশের ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম যুগের অগ্রদূত বিবেচনা করেন।

হেয়ারের একটি বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত হিন্দু কলেজকে পরিণতির দিকে নিয়ে গিয়েছিল। হিন্দুরা উদ্যোগী হলে কলেজ প্রতিষ্ঠা সহজতর হবে--এই বিবেচনায় তিনি পেছনে থেকে কলেজ প্রতিষ্ঠায় কাজ করেন। আর এভাবেই নাম-খ্যাতি-জনপ্রিয়তা ইত্যাদির প্রতি বৈরাগ্য ডেভিডের প্রকৃত কৃতিত্ব কলকাতায় হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠায় অগোচরে রয়ে যায়।

ডেভিডের উদ্যোগেই এদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ইংরেজি শিক্ষার গোড়াপত্তন হয়েছিল। কলকাতা নগরের রূপ পরিগ্রহ করবার প্রাক্কালে সমাজে আধুনিক শিক্ষায় মনস্ক মানুষের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। পাশ্চাত্যের আধুনিক এবং প্রগতিশীল শিক্ষার সমন্বয়ী বীক্ষা ডেভিড হেয়ারকে পাশ্চাত্য রীতিতে শিক্ষা-প্রসারে ভূমিকা রাখতে উৎসাহিত করেছিল।

মূলত ১৮১৫ সাল থেকে শিক্ষা-প্রসারে তাঁর কর্মপ্রচেষ্টাগুলো সবার দৃষ্টিগোচর হতে শুরু করে। সমাজের আপামর জনসাধারণকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে-- আলোচ্য লক্ষ্য অর্জনে ব্যয়িত সময় যেন কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না-করে এ কারণে ১৮২০ সালের দিকে তিনি ঘড়ির ব্যবসা ত্যাগ করে জনকল্যাণে নিজেকে পুরোপুরি সম্পৃক্ত করেন। ১৮১৮ সালে ‘হেয়ার স্কুল’ স্থাপন ছিল শিক্ষা-প্রসারে ডেভিডের প্রথম প্রশংসনীয় উদ্যোগ।

ডেভিডের উল্লেখযোগ্য কাজের ফিরিস্তি দিতে পূর্বাপর বিবেচনা করেই আলোচনা এগিয়ে নিতে হবে। একসময় এদেশে বাইরের এজেন্সি হাউজগুলো শিক্ষাবিস্তারে অর্থখরচ করে এদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল। এই অনুদানে একসময় ভাটা পড়ে এবং ১৮৩২-৩৩ সালে এজেন্সিগুলো পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেলে সাহায্যভোগী স্কুলগুলো প্রায় অচল হয়ে যায়। ডেভিড হেয়ার স্বউদ্যোগে স্কুলগুলোকে বাঁচিয়ে তুলতে লক্ষ-লক্ষ অর্থ ব্যয় করেন। শুধু তাই নয়, পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে এরপর তিনি বহু বাংলা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

বিদ্যালয় পরিচালনা করতে কেবল অর্থ-সহায়তা যথেষ্ট নয়, দরকার নীতি সহায়তাও। এর অংশ হিসেবে তিনি কলকাতায় ‘স্কুল বুক সোসাইটি’, ‘ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি’র নেপথ্য-নায়ক রূপে আবির্ভূত হন। এসব সংস্থা স্থাপনে দেশীয় হিতৈষী সমাজসেবকদের বেশ কয়েকজনের মুখ্য ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

শিক্ষার নীতি সহায়তার সঙ্গে লেখাপড়ার বাহনও ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। এ-কারণে স্কুল প্রতিষ্ঠায় ডেভিড তাঁর কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ না-রেখে বরং ছাত্র-ছাত্রীরা কোন মাধ্যমে লেখাপড়া করবে শিক্ষার সেই মৌলিক বাহন নিয়েও ভেবেছেন। বাংলা এবং ইংরেজি উভয় ভাষায়ই ছাত্ররা পড়বে-- ডেভিডের উন্নত এবং আধুনিক চিন্তার কারণে উভয় ভাষায় গ্রন্থ রচনায় পদ্ধতি ব্যক্তিদের নিয়োগের পথ প্রসারিত হয়।

কলকাতায় বৈজ্ঞানিক শিক্ষায়ও ডেভিড হেয়ারের ভূমিকা ছিল মূখ্য। ‘কলকাতা মেডিকাল কলেজ’ (১৮৩৫) স্থাপনে ডেভিডের উদ্যোগ শিক্ষাবিস্তারে আরেকটি যুগান্তকারী ঘটনা। এই কলেজের প্রথমদিকের অধিকাংশ ছাত্র ছিল হেয়ার স্কুল এবং হিন্দু কলেজের শিক্ষার্থী।

কেবল শিক্ষাবিস্তারে নয়, কলকাতার সাধারণ মানুষের ভাগ্য-পরিবর্তনে তাঁর কর্মোদ্যোগের তুলনা ছিল না। মরিশাস এবং অন্যান্য দ্বীপে ভারতীয়দের কুলি হিসাবে পাচার করার নেতিবাচক প্রচেষ্টার (১৮৩৮) বিপক্ষে জনমত তৈরি করে কুলিদের স্বার্থ রক্ষায় ‘কুলি মজুর’ আইন চূড়ান্ত করার মানবিক উদ্যোগটি ডেভিড হেয়ারের কারণেই সংগঠিত হয়।

ডেভিডের মৃত্যু (১৮৪২) কলকাতার জনসাধারণের কাছে বিশাল শোকের ঘটনা হিসেবে আবির্ভূত হয়। সেদিন ভারী বৃষ্টিপাত আর শোকে একাকার ছিল কলকাতার পরিবেশ। হেয়ারকে বিদায় জানাতে প্রবল বৃষ্টি উপেক্ষা করে ক্রন্দনরত প্রায় পাঁচ হাজার কলকাতাবাসী তাঁর শবযাত্রার সঙ্গী হয়ে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা করেন।

ডেভিড ছিলেন নাস্তিক, তাই খ্রিস্টান কবরে সমাহিত হবার ইচ্ছে তাঁর ছিল না। আগেই তিনি নিজের কেনা, হিন্দু কলেজের পাশের জায়গাটি কবরের জন্য নির্বাচন করে যান। অবশেষে সেখানেই কলেজ স্কোয়ার প্রাঙ্গণে মানবসেবায় নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিটি অন্তিম শয়নে শায়িত হন।

যে-সড়কের পাশে তাঁর বাড়ি ছিল সেটিকে পরে ‘হেয়ার স্ট্রিট’ নামকরণের উদ্যোগটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। হেয়ার স্কুলে স্থাপিত হয়েছিল ডেভিডের আবক্ষ মূর্তি। আজও এসব চিহ্ন দৃশ্যমান, আজও কলকাতাবাসী আসা-যাওয়ার পথে ঘাড় ফিরিয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ এক মানবের মূর্তি চাক্ষুষ করে, হেয়ার স্ট্রিট দিয়ে হেঁটে যায় হৃদয়ের অনেকটুকু উত্তাপ নিয়ে।

কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর একটি কবিতায় ডেভিড হেয়ারের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে লিখেছিলেন--

হে নাস্তিক

তুমি আস্তিকের গুরু

নাস্তিক ডেভিড হেয়ার নামের মানবপ্রেমী মানুষটি শিক্ষাবিস্তারে এবং জনসেবায় নিমগ্ন থেকে পার্থিব জীবনের এক হিরণ্ময় দিক খুঁজে পেয়েছিলেন। ঈশ্বরের অস্তিত্বে যেমন তিনি বিশ্বাস করেননি তেমনি দাম্পত্য সম্পর্কের প্রথাগত নিয়মও হয়ত তাঁর কাছে মূল্যহীন ছিল। তাই থেকে যান অকৃতদার।

ডেভিড ম্যাক্কাচ্চন (১৯৩০-১৯৭২) নামের এক ব্রিটিশ নাগরিকও বাঙালি সমাজের কাছে আপজনের মতো হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বাংলার মন্দিরস্থাপত্য এবং পটচিত্র বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে বঙ্গসংস্কৃতি রক্ষায় অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। মাত্র ৪১ বছর বয়সে প্রয়াত হয়ে ডেভিড ম্যাক্কাচ্চনও থেকে যান অকৃতদার।

ডেভিড ম্যাক্কাচ্চনের জন্ম ইংল্যান্ডের কভেন্ট্রির এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। কেমব্রিজ-এর ‘যিসাস কলেজ’ থেকে ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, জার্মান ভাষায় স্নাতক এবং কেমব্রিজ থেকেই আধুনিক ভাষাতত্ত্বে স্নাতোকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে পেশাগত জীবনের প্রথমদিকে ডেভিড ম্যাক্কাচ্চন দক্ষিণ ফ্রান্সের দুটো ফরাসি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছিলেন। এরপর ১৯৫৭ সালের দিকে তিনি ভারতে আসেন এবং বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ভারতে ডেভিডের মতো প্রতিভাবান এবং সম্ভাবনাময় ব্রিটিশ নাগরিকের আগমণের কারণ সম্ভবত এই যে, তিনি বিলেতে থাকাকালীন ‘টেগোর সোসাইটি’র একজন উদ্যোক্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তাঁর ছিল অসীম আগ্রহ। কালক্রমে স্বদেশি ভাবনাকে সমুন্নত রেখে স্থাপিত হওয়া ‘যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে’ বুদ্ধদেব বসুর প্ররোচণায় ফরাসি ও জার্মান ভাষা শিক্ষক হিসেবে (১৯৬০) যোগ দেন। ছাত্র পড়াতে গিয়ে ডেভিড ম্যাক্কাচ্চন পদ্ধতিগত রীতি অনুসরণ করতেন।

সত্যজিৎ রায়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ডেভিড ম্যাক্কাচ্চন ইংরেজি ত্রৈমাসিক ‘কোয়েস্ট’-এর সহকারী সম্পাদক ছিলেন। পত্রিকাটি যুগ্মভাবে সম্পাদনা করতেন আবু সয়ীদ আইয়ুব এবং অম্লান দত্ত। কলকাতায় বসবাস করতে গিয়ে একদিকে কলকাতার সারস্বত সমাজের সঙ্গে যেমন তাঁর আত্মীয়তা তৈরি হয় অন্যদিকে অবহেলা আর অনাদরে পড়ে থাকা বাংলার মন্দিরগুলো ডেভিভকে কৌতূহলী করে তোলে। মন্দিরের ফটোগ্রাফিক ডকুমেন্টশনে মানুষের আগ্রহ উসকে দিতে তিনি মন্দির গবেষণার এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। বস্তুত ডেভিড ম্যাক্কাচ্চন মন্দির সম্পর্কে উভয় বাংলার তুলনামূলক আলোচনায় পথিকৃতের ভূমিকাই পালন করেন।

ডেভিডের অনুসন্ধানে উঠে আসে আবহাওয়া, নদী-নালার খাত পরিবর্তন এবং শাসনকেন্দ্র বারবার পরিবর্তনের ফলে পুরাকীর্তিগুলো প্রায় নিশ্চিহ্ণ হয়ে যাবার বিষয়টি।

তাঁর মতে, মধ্যযুগের শেষে মুসলিম বিজয়ের পর বাংলার শিল্পীরা স্থাপত্য নির্মাণে যে-আকৃতি এবং গঠন অনুসরণ করেন এটি উপমহাদেশে আগে কখনো দেখা যায়নি। মধ্যযুগের শেষে মুসলিম বিজয়ের পর মন্দিরগুলো হয়ে পড়ে অবহেলিত। বস্তুত ১৬ শতকের গোড়ার দিকে পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গে মন্দির নির্মাণে এক পুনর্জাগরণ এসেছিল। এই স্থাপত্যগুলো পাল-সেন অভিজাত রীতি থেকে ছিল আলাদা, বাংলার লোকজ ঐতিহ্যকে ধারণ করে গ্রামীণ আদলের সঙ্গে এগুলো যুক্ত হয়।

যেমন, দো-চালা বা বাংলা রীতির মন্দির। বাংলাদেশের খুলনা, ফরিদপুর, পাবনা, যশোর জেলায় এ-মন্দিরের আধিক্য ছিল। বাঁশ এবং দরমার কাজ দিয়ে নির্মিত এসব মন্দিরগাত্রে যেসব নকশা অনুকৃত হয় সেটি পূর্ববঙ্গেরই বৈশিষ্ট্য। পূর্ববঙ্গের আবহাওয়ার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এখানে দো-চালা ঘর নির্মিত হত, সুতরাং এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে মন্দির নির্মাণে স্থাপত্য কল্পনা করবার সময় কারিগররা ঘরকেই কল্পনায় রাখতেন।

পূর্ববঙ্গের মন্দিরের ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণের আরো যেসব নমুনা তিনি হাজির করেন সেসব ছিল-- নবরত্ন ও পঞ্চরত্ন মন্দির, চৌচালা মন্দির, অষ্টকোণ মন্দির ইত্যাদি।

এদিকে পূর্ববাংলার পোড়ামাটির অলংকৃত মসজিদের মধ্যে ফরিদপুর জেলার পাথরাইল মসজিদটি প্রত্নতাত্ত্বিক সংরক্ষণভুক্ত হবার পর প্রাক-মোঘল আমলের নিদর্শন হিসাবে টিকে ছিল বলে ডেভিড জানান। প্রাক মোঘল যুগের আর কোনো মসজিদের অস্তিত্ব ডেভিডের গবেষণায় উঠে আসেনি, বস্তুত এগুলো সংস্কারেরই অযোগ্য হয়ে পড়েছিল। তিনি প্রত্যক্ষ করেন বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদসহ অসংখ্য মসজিদ। প্রত্নখনন করার চেষ্টা করেন এদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য।

মধ্যযুগের শেষভাগে নির্মিত দুই বাংলার মন্দির নিয়ে ম্যাক্কাচ্চন শ্রেণীবিন্যাসের এক দুরূহ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি খুবই মিতব্যয়ী জীবন যাপন করতেন। এই মিতব্যয়িতার মধ্য দিয়ে তিনি যে অর্থ সঞ্চয় করতেন সেটি ব্যয় হত গবেষণার কাজে। টেরাকোটা বা পোড়ামাটির মন্দিরের প্রতি ডেভিডের ছিল গভীর আগ্রহ। টেরাকোটা কাজের সাধারণ পটচিত্র-শিল্পীদের তিনি সবার কাছে পরিচিত করে তোলেন। দরিদ্র এসব শিল্পীর পটচিত্রের মূল্য অন্ধকারেই রয়ে যেত যদি ডেভিড তাঁদের নিয়ে গবেষণা না করতেন। প্রতিভাধর গ্রাম্য শিল্পীরা ডেভিডের মূল্যায়নের মাধ্যমে প্রাদপ্রদীপের আলোয় আসতে সক্ষম হন। নিয়মিত অর্থ সাহায্য করে ডেভিড এদের আপনজনের মতো হয়ে যান। মেদিনীপুর জেলার উত্তরে বাড়ুয়া গ্রামটি ডেভিডের নামের সঙ্গে মিলিয়ে ‘ডেভিড গ্রাম’ রাখা হয়েছিল।

ডেভিড ম্যাক্কাচ্চন দু’বার পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। ১৯৬৪ সালের অক্টোবর-নভেম্বরে তিন সপ্তাহের এক ভ্রমণে তিনি এখানকার মন্দির-মসজিদ, প্রাচীন-অট্টালিকা দেখতে অবিশ্রান্তভাবে ঘুরে বেড়ান। ভ্রমণ শেষে লিখিত Impressions of East Pakistan শিরোনামে The Radical Humanist পত্রিকায় তাঁর যে-নাতিদীর্ঘ রচনাটি প্রকাশ পায় সেখানে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে পূর্ববাংলার মানুষজনের আতিথেয়তার কথা, লোকাচারের কথা, হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মিলেমিশে বসবাসের কথাও উঠে এসেছে। সমাজে ধর্মকে কেন্দ্র করে এক শ্রেণীর সাম্প্রদায়িক মানুষেরা অসহিষ্ণুতার এবং অসংবেদনশীলতার চোরাস্রোতে যেমন গা-ভাসিয়ে চলেছে তেমনি দুই সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষজনের সহজভাবে মেলামেশার চিত্রও দৃশ্যমান ছিল। ডেভিড লেখাটিতে জনসমাজের মাঝে প্রবাহিত হিংসা-বিদ্বেষ এবং সৌহার্দ্য- সম্প্রীতির বিপরীত দুই চিত্র পাশাপাশি তুলে ধরেন।

মন্দির গবেষণার পাশাপাশি ধর্ম, মানুষের আচরণ, ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে ডেভিড ম্যাক্কাচ্চনের লেখালেখিও উল্লেখ করবার মত। এদের মাঝে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রবন্ধটির কথা অনুল্লেখ্য নয় সেটি ‘তুলনামূলক ধর্ম ও সহনশীলতার মনোভাব’ শীর্ষক তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব এবং এর ব্যবহারের গুরুত্ব নির্ণায়ক রচনা। প্রবন্ধটি লিখিত হয় তুলনামূলক ধর্মচর্চা কীভাবে পরমত সহিষ্ণু একটি ‘মন’ অর্জনে সহায়তা করে সেই গূঢ় পদ্ধতিটি আয়ত্তের ধারণাকে উপজীব্য করে। ধর্ম পালনের সঙ্গে ধর্মের তুলনামূলক আলোচনার অসমন্বয় নেই, বরং এই শিক্ষা মানুষের মনকে উদার করে তুলে ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে মানুষের আপেক্ষিক মনোভাবকে গভীরতর করে তুলতে সাহায্য করে।

ধর্মের নামে পৃথিবীতে যেসব অপরাধ ঘটেছে, ধর্মযুদ্ধের নামে যেভাবে নানা ধরনের লুণ্ঠন হয়েছে, সর্বোপরি যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে সেসব মানুষ দ্বারাই সৃষ্ট ছিল। এ-সমস্ত অপঘটনা মনুষ্যসমাজের যুক্তি এবং তুলনামূলক চিন্তারহিত কর্মকাণ্ড। গ্যেটের ফাউস্টের একটি যুক্তিকে সামনে রেখে ডেভিড তাঁর অগ্রসর ভাবনার প্রকাশ ঘটান, যেখানে সবিস্তারে লিখিত ছিল মানুষের মুক্তমন আর মুক্তচিন্তার কথা।

ফাউস্ট বলেছিলেন, ‘সেই ব্যক্তিই মনের মুক্তি রক্ষায় সক্ষম যে জীবনের মতো একেও নতুনভাবে প্রতিমুহূর্তে জয় করে যাবে।’

কথাগুলোকে বিশ্লেষণের উপযুক্ত করে ডেভিড বলেন, মনকে তৈরি করতে হবে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে, চিত্তকে রাখতে হবে দমিত। কোনোভাবে আবেগসর্বস্ব হয়ে সংস্কারের সহজপন্থা অবলম্বন করা যাবে না, যদিও এই পথটি সহজ পথ, কিন্তু শেষপর্যন্ত যুক্তিবোধই নির্দেশ করবে মানুষ এই সহজ পথে হেঁটে যাবে কিনা, আর এসব কারণেই দরকার যুক্তির সসীমতা, যা পার্থিব জীবনেরই পথপ্রদর্শক। এই নিরিখে যৌক্তিকতাকে পৃথিবীতে বাঁচবার সঠিক উপায় হিসেবে গ্রহণ করবার বিকল্প নেই। মানুষ দুঃখ পায় মানুষের কারণে। মানুষের দুঃখ তখনই বাড়ে যখন তারা যুক্তিরহিত হয়। যে-সমস্ত দুঃখ মানুষ ভোগ করে সেটি তাদের কার্যপরম্পরার ফলাফল।

ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ এবং ধর্মীয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গণ্ডির পরিধি যেভাবে বিস্তার লাভ করেছে সেই হতাশার চিত্র তুলে ধরেও বিপ্রতীপ কোণে কিছু সংখ্যক মানুষ যে ধর্ম-নিরপেক্ষ এক উজ্জ্বল শিখার নিচে জড়ো হয়েছেন সেই দৃশ্যকেও তিনি দৃষ্টিগোচর করেন। অতল হতাশার মধ্যেও এই মানুষগুলো আশার সঞ্চার করে কারণ সংখ্যালঘু হলেও এরা গণনার বাইরে নেই।

বাংলার মন্দিরের ওপর বই লেখার স্বপ্ন নিয়ে দুই বছরের ছুটিতে ইংল্যাণ্ডে ফিরে যাবার প্রাক্কালে মাত্র ৪১ বছর বয়সে এক জটিল ভাইরাসে আক্রান্ত হন ডেভিড ম্যাক্কাচ্চন। নিরাময়-অযোগ্য সেই রোগে ভুগে ১৯৭২ সালের মধ্য জানুয়ারিতে নিজের অসমাপ্ত কাজ, হাজারো স্বপ্ন মুলতুবি রেখে তিনি চলে যান জীবনের অন্যপারে। তাঁর মরদেহ সমাহিত হয় কলকাতার ভবানীপুরের অ্যাংলিকান চার্চ কবরখানায়।

ডেভিড ম্যাক্কাচ্চনের মূল বাণী ছিল-- একদিন মানুষ মানুষকে ধর্ম দিয়ে নয়, দেশ দিয়ে নয়, এর ঊর্ধ্বে উঠে বিবেচনা করতে শিখবে। শান্তিনিকেতনের একসময়ের তাঁর আমেরিকান সহকর্মী ট্রয় অর্গান ডেভিড ম্যাক্কাচ্চন সম্পর্কে যা বলেছিলেন এর সারমর্ম দাঁড়ায়, ডেভিড যেমন চাইতেন সেরকমই অনাগত দিনে পৌঁছানোর আগে-- যখন বিভিন্ন দেশের পৃথক সীমা বলতে কিছু থাকবে না-- যখন কেবল মনুষ্যত্ব দিয়েই মানুষ মানুষকে মূল্যায়ন করবে এবং সংস্কৃতি, জাতির মধ্যে বেড়ে ওঠা সমস্ত ভেদরেখা নিশ্চিহ্ণ হয়ে যাবে, সেই সময়ের সিদ্ধ পুরুষদের মতোই এক পুরুষ ছিলেন ডেভিড ম্যাক্কাচ্চন।

এই সিদ্ধ পুরুষটি স্বল্পায়ুর কারণে তাঁর গবেষণা যেমন শেষ করে যেতে পারেননি, তেমনি তাঁর সব ভাবনাও লিখে যেতে পারেননি। তবু তাঁর গবেষণার পরিধি অবলোকন করে, তাঁর রেখে যাওয়া রচনাগুলো বারবার পাঠ করে জীবন সম্পর্কে নির্মোহ বচন, সমাজ-রাষ্ট্র-ব্যক্তি-ধর্ম সম্পর্কে নিরপেক্ষ মনোভাব আত্মস্থ এবং হৃদয়ঙ্গম করা যায় তবেই ডেভিড ম্যাক্কাচ্চনের কাজের ও চিন্তার উপযুক্ত মূল্যায়ন হয়েছে বলে ধরে নেয়া যাবে।

গ্রন্থসূত্র:

১. হিন্দু কলেজ ও উনিশ শতকের বাংলার সমাজ: মনোতোষ চক্রবর্তী

২. বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও বিচ্ছিন্নতাবাদ: অমলেন্দু দে।

৩. বাংলাদেশের মন্দির: ডেভিড ম্যাক্কাচ্চন।

৪. ডেভিড ম্যাক্কাচ্চন: সংকলক- প্রদীপ কর।

৫. ডেভিড ম্যাক্কাচ্চন চর্চা: সম্পাদক-সুরঞ্জন মিদ্দে।