হান্স মাগ্নুস এন্সেন্সবার্গার: একটি বিলম্বিত প্রয়াণলেখ

তাঁকে স্মরণ করা, তাঁর জীবন ও কাজ নিয়ে আলাপ করা এই মুহূর্তে আমাদের বৌদ্ধিক সমাজের একান্ত আবশ্যক বলে মনে করি।

আলম খোরশেদআলম খোরশেদ
Published : 12 Dec 2022, 06:27 AM
Updated : 12 Dec 2022, 06:27 AM

কদিন আগে প্রয়াত হয়েছেন বর্তমান বিশ্বের একজন অত্যন্ত শক্তিমান ও দায়বদ্ধ কবি-প্রাবন্ধিক-সম্পাদক-চিন্তক; জার্মানির সর্বজনশ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক হান্স মাগ্নুস এন্সেন্সবার্গার (১১ নভেম্বর ১৯২৯ - ২৪ নভেম্বর ২০২২)। তাঁর মৃত্যুসংবাদটি পেয়ে গভীর বিষাদ ও বেদনাবোধের পাশাপাশি মনে পড়ে গেল, আজ থেকে প্রায় তেত্রিশ বছর আগে, ১৯৮৯ সালে তাঁর ষাট বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে রচিত আমার একটি নাতিদীর্ঘ নিবন্ধের কথা। আমি তখন নিউ ইয়র্কের বাসিন্দা। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার পাশাপাশি বিশ্বসাহিত্যের পাঠে মগ্ন হয়ে থাকি। ‘নিউ ইয়র্কার’ ও ‘আটলান্টিক’ ম্যাগাজিনের গ্রাহক এবং ‘নিউ ইয়র্ক রিভিউ অভ বুকস’ ও ‘ভিলেজ ভয়েস’ পত্রিকার নিয়মিত পাঠক। এগুলোর কোনো একটি সংখ্যা থেকেই সম্ভবত জানতে পেরেছিলাম এন্সেন্সবার্গার সম্পর্কে ও বিশেষ করে তাঁর ষাট বছরে পা দেওয়া বিষয়ে। তখন তাঁর সম্পর্কে আরও পড়াশোনা ও তাঁর কিছু রচনা, বিশেষত কবিতা পাঠ করে তাঁর ওপরে একটি ছোট্ট শ্রদ্ধাবাচক নিবন্ধ লিখে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম দেশে, দৈনিক সংবাদ-এর সাপ্তাহিক সাহিত্যপাতায় প্রকাশিত আমার সাহিত্যবিষয়ক অনিয়মিত কলাম ‘অচেনা অক্ষর’-এর কিস্তি হিসাবে। পরবর্তীকালে আমার সেই কলামসমূহ একই নামে গ্রন্থাকারেও প্রকাশিত হয়েছিল একটি তুলনামূলকভাবে স্বল্পপরিচিত প্রকাশনী থেকে, যে-কারণে বইটির প্রচার-প্রসার বিশেষ হয়নি। তো, সেই নিবন্ধটিই কিঞ্চিৎ ঘষামাজা ও খানিকটা হালনাগাদ করে বিডিনিউজের বিশ্বসাহিত্যমনস্ক পাঠকদের উদ্দেশে নিবেদন করছি, মহান এই লেখকের প্রতি আমার অকৃত্রিম অনুরাগ ও সহৃদয় শ্রদ্ধার্ঘ্যস্বরূপ। উল্লেখ্য, আমার সেই মূল লেখাটির শিরোনাম ছিল, ”এন্সেন্সবার্গার: ছন্দিত প্রতিবাদ”।

”গ্যয়টে, রিলকে, ব্রেখটের দেশ জার্মানিতে এই মুহূর্তে কবিতা লিখছেন বর্তমান বিশ্বের অন্যতম প্রধান একজন কবি, হান্স মাগ্নুস এন্সেন্সবার্গার, এবছর যাঁর ষাট বছর পূর্ণ হবে। কিন্তু বয়স তাঁকে শারীরিক, মানসিক কোনোভাবেই কাবু করতে পারেনি। ১৯৫৭ সালে আটাশ বছর বয়সে In Defence of the Wolves কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে যে রাগী কবি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন তিনি, অদ্যাবধি তাঁর সেই পরিচয়ে চিড় ধরেনি। যে অফুরন্ত প্রাণশক্তি নিয়ে তাঁর আবির্ভাব জার্মানির সাহিত্যাঙ্গনে সেই শক্তির পূর্ণ ব্যবহার তিনি করে যাচ্ছেন দুহাতে লিখে। মাগ্নুস শুধু কবিই নন, একজন সাহসী প্রাবন্ধিক, সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী, অনলস অনুবাদক, তন্নিষ্ঠ সম্পাদক এমনকি একটি উপন্যাসেরও জনক। তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে তাই সমালোচক জন সাইমন যথার্থই বলেন: “Renaissance men are in short supply these days. Rare indeed is the writer who can hold his own as poet, translator, critic, playwright, polemist, anthologist and editor of two remarkable and very different periodicals. But Hans Magnus Enzensberger is all of those things.”

এই প্রকৃত রেনেসাঁ-পুরুষ এন্সেন্সবার্গারের জন্ম কাউফবুরেন-এ, বেড়ে ওঠেন ন্যুরেমবার্গে। কৈশোরে যুদ্ধকালীন বাধ্যতামূলক সেনাপ্রশিক্ষণ গ্রহণ, মার্কিন সৈন্যদের দোভাষীর কাজ এবং তৎকালীন সব জার্মান কিশোরের মতো চোরাচালানিতে সহায়তা করে কাটে তাঁর অস্থির, দিশেহারা কৈশোর। কিন্তু যুদ্ধের পর তাঁর জীবনধারা পালটে যায়। তিনি র্এলান্গেন, হামবুর্গ ও প্যারিসের সরবোর্ন প্রভৃতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করে ১৯৫৫ সালে সাহিত্যে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর স্বাভাবিকভাবেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার জীবন বেছে নিয়ে নির্বিঘ্নে বিশুদ্ধ সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করতে পারতেন। কিন্তু স্বভাবত প্রতিষ্ঠানবিরোধী মানুষ মাগ্নুস বেছে নিলেন স্বাধীন সাহিত্যকর্মীর জীবন, যাতে করে তিনি তাঁর অপর দায়, সমাজবদলের কাজেও সমান অবদান রাখতে পারেন। প্রথম কাব্যগ্রন্থেই তাঁর এই সমাজসচেতনতা ও প্রতিবাদী রূপটি চোখে পড়েছিল সবার। এতে তিনি উৎপীড়ক সমাজের কর্ণধার শক্তিমান Wolf দের কথাই শুধু শোনান না, যেসব Lamb-এর দল তার প্রতিবাদ না করে অবনত মস্তকে মেনে নেয় সব অন্যায় ও পীড়ন, তাদেরকেও তীব্র কষাঘাত করেন। এ তো গেল কবিতার বক্তব্যের দিক, আঙ্গিকেও যে তিনি তুমুল এক বিপ্লব সাধন করেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ Language of the Country (১৯৬০) তে, যেখানে মিথ, ফোকলোর, বিজ্ঞান, রাজনৈতিক শ্লোগান, বিজ্ঞাপনী কৌশল, পান, প্যারোডি মিশিয়ে এক অভিনব মন্তাজের সৃষ্টি করেন তিনি। ফলে যুবসমাজে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তবে মাগ্নুস তাঁর লেখাকে কখনোই দুর্বোধ্য করে তোলেননি, মূলত তিনি ছন্দমিলে নিপুণ,  হাইনের সহজিয়া ঘরানারই কবি; তবে তাঁর নিজের ভাষ্য অনুযায়ী চেতনার দিক থেকে তিনি ব্রেখটের অনুসারী। তাই তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ Braille (১৯৬৪) এর কবিতাসমূহকে তিনি স্পষ্টভাষায় রাজনৈতিক কবিতা বলে আখ্যায়িত করেন, যে-রাজনীতি তাঁর ভাষায়,  “Creeps in, as it were, through the cracks of words.”

ইতোমধ্যে পর্যটনপ্রিয়, বিশ্ববোধের কবি এন্সেন্সবার্গার, ইতালি, নরওয়ে ও যুক্তরাষ্ট্রে কাটিয়ে এসেছেন কিছুকাল এবং পশ্চিম বার্লিনে থিতু হয়েছেন। নিজে একটি প্রকাশনাও খুলেছেন। লিখছেন জ্বালাময়ী প্রবন্ধ, যার প্রথম সংকলন The Consciousness Industry বেরোয় ১৯৬৪ সালে, যা পড়ে বিখ্যাত দার্শনিক টি. এইচ এডর্নো তাঁকে জার্মানির সমালোচনা সাহিত্যের সত্যিকার প্রতিনিধি হিসেবে বরণ করে নিয়েছিলেন। এই সংকলনের দুয়েকটি প্রবন্ধের শিরোনাম, যেমন The Industrialization of mind; Poetry and Politics; Tourists of the revolution ইত্যাদি থেকেই মাগ্নুসের মানসক্ষেত্রের কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যতে পারে। শোষণহীন সমাজের প্রবক্তা মাগ্নুস গভীর আগ্রহ নিয়ে চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করেছিলেন। এমনকি পরে একসময় কাস্ট্রোর অভাবনীয় সফল বিপ্লবে উদ্বেল হয়ে তিনি কিউবায় চলে যান এবং সেখানে প্রায় বৎসরাধিককাল বসবাস করেন। এই অভিজ্ঞতার আলোকেই তিনি পরবর্তীকালে রচনা করেন ডকুড্রামা  The Havana Trial এবং স্প্যানিশ বিপ্লবের বিখ্যাত বীর বুয়েনাভেন্তুরা দুরুত্তির জীবনী অবলম্বনে প্রামাণ্য উপন্যাস, The Short Summer of an Anarchist । ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয় তাঁর আরওকিছু বই, যেমন প্রবন্ধগ্রন্থ Politics and Crime এবং কবিতা সংকলন Poems for People Who Don’t Read Poems। পাশাপাশি জার্মানির সর্বাধিক সম্মানিত প্রগতিশীল সাহিত্যপত্রিকা Kursbuch-এর সম্পাদনার কাজও চালিয়ে যান তিনি।

এই পত্রিকাতে তৃতীয়বিশ্বের রাজনীতি থেকে শুরু করে গভীর দার্শনিক রচনা নিয়মিত প্রকাশিত হতো এবং জার্মানির বড় বড় লেখকেরা লিখতেন। ১৯৬৭তে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু মেয়াদ শেষ হবার আগেই ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসনের প্রতিবাদে কাজে ইস্তফা দিয়ে দেশে ফিরে আসেন। এ উপলক্ষ্যে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এ  যে খোলা চিঠিটি লিখেছিলেন তিনি, তা একজন সচেতন শিল্পীর সাহস ও দায়িত্ববোধের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে। নরওয়ের অদূরবর্তী ছোট একটি দ্বীপে কিছুকাল কাটিয়ে তিনি ফিরে আসেন পশ্চিম বার্লিনে। কিন্তু ১৯৮০ সালে এন্সেন্সবার্গার,Trans Atlantic পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব নেবার পর থেকে ম্যুনিখেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এরই মধ্যে অনুবাদ করেছেন দুহাতে। বিশেষত চিলে ও পেরুর সাম্যবাদী কবি পাবলো নেরুদা ও সেসার বায়েহোর কবিতাকে জার্মান ভাষাভাষীদের কাছে পরিচিত ও প্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদান রাখেন। মৌলিক কবিতার স্রোতও বন্ধ হয়নি তাঁর, সত্তরের শেষপাদে বেরিয়েছে অসাধারণ ও অভিনব এক কাব্যগ্রন্থ Mausoleum: Thirty Seven Ballads from the History of Progress, যার ভাষা ও বিষয়, গ্রন্থভুক্ত একটি কবিতার পংক্তি উদ্ধৃত করে বলা যায়, expressive and inspired with lofty feelings। তাঁর সাম্প্রতিক কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতায় নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে এন্সেন্সবার্গার লেখেন, Well now as concerns the seventies/I can express myself with brevity। তবে বলাই বাহুল্য, তাঁর বহুমাত্রিক জীবন ও বিপুল কর্ম বিষয়ে লেখার জন্য এই সংক্ষিপ্ত পরিসরটুকু মোটেও যথেষ্ট নয়।

হান্স মাগনুস এন্সেন্সবার্গার এর মতো এমন একজন আপাদমস্তক মগ্ন, লিপ্ত ও কর্মমুখর সাহিত্যসাধক ও সৈনিক এই যুগে ক্রমেই বিলীয়মান হয়ে আসছে। তাই তাঁকে স্মরণ করা, তাঁর জীবন ও কাজ নিয়ে আলাপ করা এই মুহূর্তে আমাদের বৌদ্ধিক সমাজের একান্ত আবশ্যক বলে মনে করি। আমাদের সৌভাগ্য, আজ থেকে বহুবৎসর পূর্বেই আমাদের এক পূর্বসূরি লেখক, অধ্যাপক ও অনুবাদক শ্রদ্ধেয় মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৩৮-২০২০) তাঁকে বাঙালি পাঠকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, কবিতা যারা পড়ে না তাদের জন্য কবিতা শিরোনামে তাঁর জগদ্বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ Poems for People Who Don’t Read Poems অনুবাদ করে। আমরা আশা করব, তাঁর এই মহতী দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে নবীন, প্রবীণ আরও অনেকেই এগিয়ে আসবেন সদ্যপ্রয়াত এন্সেন্সবার্গারের সর্বমোট সত্তরটির মতো গ্রন্থের মধ্য থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাব্যগ্রন্থ, প্রবন্ধসংকলন, উপন্যাস, নাটক, স্মৃতিকথা, সাক্ষাৎকার ইত্যাদি অনুবাদের কাজে। হান্স মাগনুস এন্সেন্সবার্গার, আপামর বাঙালি পাঠকদের পক্ষ থেকে আপনাকে জানাই গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।