আনন্দের কলঙ্ক

“ম্যাকাব্রে” একটি অবিচ্ছিন্ন বাঁক পরিবর্তনের ‘জাদু-টোনা খেলার’- বিমূর্তন।

কামালউদ্দিন নীলুকামালউদ্দিন নীলু
Published : 4 March 2024, 08:35 AM
Updated : 4 March 2024, 08:35 AM

অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘রেডিয়াম হসপিটালেট’, অর্থাৎ ক্যান্সার হাসপাতালের ওয়ার্ড নম্বর ৫০১। অপেক্ষায় সুস্থ হয়ে ঘরে ফেরার। অপারেশনের পর পুনরুদ্ধার কক্ষে কয়েক ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে থাকার পর থেকেই এই ওয়ার্ডে একাই আছি। শরীরের উপর দিয়ে ভালোই ধকল গেছে এবং এখনো  যাচ্ছে। প্রতিদিনই সকাল বিকাল নিয়মিত চেক-আপ চলছে। এখনো অবধি সিদ্ধান্ত হয়নি কবে নাগাদ ছুটি মিলবে। বসে বসে নানারকম আবোলতাবোল ভাবনা মগজে ঘুরছে। জীবনের একমাথা থেকে আরেক মাথা- দুঃখ-সুখ, বিচ্ছেদ, আনন্দ, বিচ্ছিন্নতা, একাকি নির্বাসন এইসব জীবনের আখ্যান। এইসব ভাবনা ভাবতে ভাবতে দিন গড়িয়ে রাত, রাত গড়িয়ে সকাল, আবার দিন আবার রাত...। এর বাইরে আর কিছু করবার নেই। যেহেতু এখানকার সবকিছু বাঁধা নিয়মের মধ্যে। ভয়ঙ্কর রকমের নিয়মানুবর্তিতা। মনে পড়ছে ফুকোর প্যানোপটিকন রূপক, ‘আধুনিক শৃঙ্খলামূলক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা’-র কথা । এইসব ভাবতে ভাবতেই মনে হচ্ছিলো আমার নির্দেশিত “ম্যাকাব্রে” নাটকটি ছিল একটা ভ্রান্তি। ইতিহাসের একটি দুঃস্বপ্ন যার মধ্যে থেকে আমি নতুন করে সমকালীন সময় ও স্থানের ভেতর শিল্পকর্মটি সৃষ্টির অন্বেষণে জেগে উঠার চেষ্টা করেছিলাম কয়েকজন সৃজনশীল বন্ধুকে সাথে নিয়ে; গতিশীল, সৃজনশীল এবং সহযোগী প্রকৃতির মতো করে। আমার এই শিল্পকর্মটিঃ স্থাপত্য, সামাজিক তত্ত্ব, রাজনৈতিক অর্থনীতি এবং বিজ্ঞান থেকে ধারণার একটি ক্রস-নিষিক্তকরণ। এটাকে আমি আমার শিল্পকর্মের- ‘আনন্দের কলঙ্ক’ বলে মনে করি, এটা স্বতঃস্ফূর্ততার একটি ভয়ঙ্কর রকমের দুঃসাহসিক কথা এবং কাজ। যেমনটি একটি বৃক্ষ ও পাথর সংবেদনশীল না হয়েও বেঁচে থাকে। আর তাই আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি শিল্পীরা প্রকৃতির ভেতরে শুধু গাছকে পর্যবেক্ষণ করেন না, শিল্পী গাছটিকে শোষিত করে- তার চোখ দিয়ে বারেবারে গাছের অভূতপূর্ব নানা মাত্রার উপস্থিতিতে ফিরে ফিরে দেখার কারণে গাছটি শোষিত হয় বলেই এটা “শিল্প”। যে কারণে অনেকের কাছেই সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটারের প্রযোজিত নাটক “ম্যাকাব্রে” নাট্য শিল্পকর্মটি নান্দনিকতা কান্তিবিদ্যাসম্বন্ধীয় যৌনতার সৌন্দর্যায়ন। আজ আমাকে এই কাজটির অভিজ্ঞতার আলোকে বলতেই হয়, এই নাট্যাভিনয়ের সৌন্দর্যায়নের ভেতরে যৌন সুখের মত সৌন্দর্যদর্শন অভিপ্রায় হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল এর ভাঁজে ভাঁজে, প্রতিটি ভাঁজের অনুভূতিতে। আরো পরিষ্কার বা খোলাখুলি করে যদি বলি তবে বলতেই হয়, হ্যাঁ, এটা একটা নান্দনিক 'তৃপ্তি' যা যৌন তৃপ্তির চেয়ে অনেক বড় ছিল। এটা হচ্ছে শিল্পের স্বতঃস্ফূর্ততার নান্দনিকতা, যা নিজেকে সেক্সুয়ালাইজড হতে দেয়, কারণ আমাদের মনে রাখতে হবে এই মুহুর্তে ক্ষমতার সম্পর্কগুলি যতটা সমান হতে দেওয়া যেতে পারে ততটা দিতে হবে। এটা শিল্পের জন্যে অত্যন্ত জরুরী। এটাকে কোন ভাবেই আটকে রাখা যাবে না। গণতান্ত্রিক প্রেক্ষাপটে, এটা সময়ের একটি বড় দাবি, সেটা যেমন পূর্বে তেমনি পশ্চিমে। সম্ভবত বিশ্ব এটা চাইছে। এটাই আজকের শিল্পের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। যেমনটি ধর্মতত্ত্ববিদ চার্লস হার্টশোর্ন নন্দনতত্ত্বের একটি চিত্র প্রকাশ করেছেন যেখানে তিনি প্রতিটি বস্তুর নান্দনিক জগতের গুণগত মানগুলিকে শ্রেণীবদ্ধ করেছেন। প্রতিটি কথ্য শব্দ, চিত্রকলা, ব্যক্তি, গান, টেবিল, পর্বত; সবকিছু, ছোট, বড়, অসীম, ঘৃণ্য, ক্ষণস্থায়ী, পুরানো, প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম, যাই হোক না কেন সব, সবকিছু। এই ছকটির ভেতর দিয়ে আমাদের চোখে ধরা পড়ে শিল্পের নান্দনিক অভিজ্ঞতা এবং এর অনুমিতর ধারাবাহিকতা। একজন শিল্পীর শিল্পকর্ম আমাদের চোখে ধরা দেয় তার সমস্তটি, অর্থাৎ পূর্ণ রূপ হয়ে, গোটা বস্তুর মোট সংখ্যার একক হয়ে নয়। যদি তা নাই হবে তবে আমাদের নন্দনতত্ত্বের দৈনন্দিন জীবনের গ্রহণ ও বর্জনের বিষয়টি আসবে কেন?                                                                                                                           

আমার কাছে সৌন্দর্যের ল্যান্ডস্কেপ গ্রহণ ও বর্জনের যেকোনো পথই অনুসরণ করতে পারে একে অপরের পরিপূরক বা বিছিন্ন অথবা সংমিশ্রণ হয়ে। আমাদের “ম্যাকাব্রে” শিল্পকর্মটি একটি নান্দনিক পরিমণ্ডলের ধারাবাহিকতা তৈরি করেছিল যার মধ্যে শৃঙ্খলা থাকা সত্যেও একে  অপরের থেকে অত্যন্ত স্বতন্ত্র এবং বিশৃঙ্খল ছিল। এখানে প্রসঙ্গক্রমে বলতেই হয় একমাত্র ক্যান্ডিনস্কিই জানেন; "একটি ‘রেখা’ যা ‘নোটিং’-কে সীমাবদ্ধ করেও কোন ‘কনট্যুর’ বা ‘ফর্ম’ তৈরি করে না, কেন? যেহেতু রেখাটি এক বিন্দু থেকে আরেকটি বিন্দুতে যাবার আগেই ভেঙ্গে পড়ে রূপান্তরকারী বিমূর্তন প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকে”।

“ম্যাকাব্রে” একটি অবিচ্ছিন্ন বাঁক পরিবর্তনের ‘জাদু-টোনা খেলার’- বিমূর্তন। যে বিমূর্তনের রূপ অনেকটাই ক্যান্ডিনস্কির শিল্পকর্মগুলোর মতো কতগুলো টুকরো টুকরোর সংগ্রহ যা অসীম সংখ্যক উপায়ে একসাথে যুক্ত হতে পারার একটা প্রক্রিয়া। যেমনটি ধরে নেওয়া যায় ‘জলের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত একটি মাছ যা মাছ না হয়ে একটি লাইনও হতে পারে’।

ভেতরটা বাইরে আর বাইরেটা ভেতর হয়ে নাটকটি একটা বিশৃঙ্খল(ফর্ম)পটভূমি তৈরি করে নিয়েছিল যেটা শুরু বা শেষ ছাড়াও ছিল জীবন্ত; পাশাপাশি দ্ব্যর্থব্যঞ্জক কিম্বা অনির্ধারিত এবং অস্পষ্ট। যে কারণে “ম্যাকাব্রে”র পারফরমেন্স স্কোরটিতে ছিল ছড়ানো-ছিটানো অনেকগুলি লাইন শক্তভাবে একসাথে টানা দেয়া। এটাই, “ম্যাকাব্রে”র বিমূর্ততা। যার আবাসন মাল্টিডিসিপ্লিনারি ফ্রেমের মধ্যে। যে কারণে “ম্যাকাব্রে” পারফর্মেন্সটি কোন নির্দিষ্ট ‘কনট্যুর’ বা ‘ফর্ম’ তৈরি করেনি এবং করেনি বলেই এটা নিরাকার দ্ব্যর্থবোধক।  

আমাদের এই বিমূর্তকরণের কৌশলের অর্থ কেবল বিষয়বস্তুর নিষ্কাশন করা বা একটা খালি রূপরেখা বা একটি বিশুদ্ধ জ্যামিতিক ফর্ম তৈরি করা ছিলো না, বরং আমি বলব, “ম্যাকাব্রে” হচ্ছে সময় ও স্থানের মধ্যে ফেলে পুরো নাট্যবিষয়ের একটি অন্তঃস্থ যৌগিক প্রক্রিয়া যা ভীষণভাবে অভ্যন্তরীণ। পিয়েরে বোর্দিউ (Pierre Bourdieu)-এর ভাষায় বলতে হয় "চিত্রের প্রতিচ্ছবি" বা “The image of the image”। "ম্যাকাব্রে" প্রযোজনাটি যুক্ত ক্রমাগত নির্মাণ এবং ধ্বংসের সাথে, এটা শিল্পকলা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ইতিহাসের একটি রূপক। এটি বহু-বিষয়ক একটি নাট্যপ্রযোজনা যার কেন্দ্রে বসবাস গ্যেটের ‘রঙ তত্ত্ব’, যে জন্যে আহসান রেজা তুষারের সৃষ্ট শিল্পের সাথে নাসিরুল হক খোকনের ছোট ছোট ছড়ানো ছিটানো আলো, এই দৃশ্যকাব্যের কোল জুড়ে সাদা মঞ্চটি কখনো হয়ে যায় অন্ধকার, কখনো বা হলু্‌দ কালো হয়ে, হয়ে যায় সবু্‌জ, আবার সবুজ কালো হালকা হয়ে, হয়ে যায় নীল, আবার নীল কালো হয়ে, হয়ে যায় কালচে লাল, যা আবার হয়ে যায় কালো লালচে রঙের বেগুনী। এটাই যে সেই গ্যেটের রঙ তত্ত্বের ভাষা, "রঙ প্রকৃতির আত্মার বক্তৃতা"; যা হয়ে উঠেছিল তুষারের নতুন শিল্প নির্মাণের জাদুকরী খেলার উৎস। যে খেলার শুরুটাই শুরু হয় আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের মূল রহস্য- ভর, সময় এবং স্থানকে সাথে নিয়ে একটি বস্তুর বেগের সাথে অন্য বস্তুটির সম্পর্ককে ধরে।    

প্রকৃতপক্ষে, সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটারের নাটক “ম্যাকাব্রে” প্রযোজনাটি শেষ অবধি সার্বজনীন ইতিহাসের ঘটনাগুলির একটি ন্যায়সঙ্গত সমন্বয়। ‘1984’ ইংরেজ লেখক জর্জ অরওয়েলের ডিস্টোপিয়ান উপন্যাসটি ছিল এই নতুন নাট্য বিনির্মাণের উৎস । কারণ উপন্যাসে, অরওয়েল পাঠকদের একটি আভাস দিয়েছিলেন যে সরকার যদি একজন ব্যক্তির জীবনের প্রতিটি বিবরণকে তাদের নিজস্ব ব্যক্তিগত চিন্তার মধ্যে নিয়ন্ত্রণ করে তাহলে কী ঘটবে। একটা যুগ ও সময়য়ের সতর্কতামূলক গল্পের বয়ান। যেটা আমাদের আয়নায় প্রতিফলিত হচ্ছে সর্বত্র সময়ের সাথে সাথে। আমাদের এই প্রযোজনাটি তুলনামুলকভাবে, সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটারের অন্যান্য কাজের তুলনায় ভীষণ রকমের “থিম্যাটিক”। একটা ‘ইউটোপিয়া’ ও ‘ডিস্টোপিয়া’র ভাঙ্গাচোরা আনন্দলোককে খুঁজে বের করা। আমাদের কাজের যাত্রার শুরু এইখানে।    

এই কথাগুলো বলছি সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটারের নাটক “ম্যাকাব্রে”-এর প্রস্তুতিপর্বের সময়কে ধরে। যেহেতু এইসব কথা মিলিয়ে আমাদের “ম্যাকাব্রে” প্রযোজনাটি। এটি একটা দৃশ্যকাব্য। কাজটি ছিল অন্য ধরনের একটা বিভ্রম ও ভ্রান্তির পেছনে ছোটা। কাজটি আমাদের কাছে রূপান্তরিত হয়ে ওঠে একটা নতুন সৃষ্টির উন্মাদনার বিমূর্তকরণের- ‘আনন্দের কলঙ্ক’ হয়ে।

“ম্যাকাব্রে” নির্মাণের অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে হয় এটা হচ্ছে একটা ‘মেশওয়ার্ক’ বা জালের বুনানির গিঁট এবং ‘নেটওয়ার্ক’র ‘নোড’ এবং সংযোগ ও বিয়োজনের রূপান্তর প্রক্রিয়া । এই প্রযোজনার মেধা ও প্রাণ আহসান রেজা তুষার; কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, প্রোজেক্টর, কিংবা ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের ব্যবহারের যে সুযোগ তৈরি হয়েছে তার কোনোকিছুই তিনি বাদ দেননি। এই ক্ষেত্রে নির্দেশকের ‘যুক্তি- তর্ক –গপ্প’, ‘এই প্রযোজনায় প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়ছে প্রগতির অর্থে, সময়কে মাথায় রেখে, ‘পোস্টড্রামাটিক’ কৌশলের রাস্তা খুঁজে নিতে, যেটা ‘উত্তরাধুনিক থিয়েটার’-এর পরবর্তী রূপ- ‘ইন্টারেক্টিভ শিল্প’। যেটা ছিল একটা ‘প্রক্রিয়া’ এবং ‘শিল্প’ হয়ে ওঠার একটা ‘সম্ভাবনা’। শিল্পের মূল্যবোধের একটি সর্বাত্মক নান্দনিক ব্যবস্থা।      

এই কাজটি ছিল আমাদের যৌথ শিল্পকর্ম। ‘যৌথ শিল্পকর্ম’ বলছি এই কারণে যেহেতু এখানে এককের স্থান ছিল শুন্য। আমি এবং আনিকা, আমরা দুইজন ছাড়াও  কাজটির সাথে জুক্ত ছিল রোকেয়া রফিক বেবী, আহসান রেজা তুষার, শাহাদাত হোসেন অপু, নাসিরুল হক খোকন, স্বপন, বাদল ও দীপক। এরা অসম্ভবকে সম্ভব করা সব মানুষ। দুর্দান্ত বিস্ময়কর সব সৃজনী। যদি ভুল না হয় তবে প্রথম মঞ্চস্থের তারিখটা ১৪ অক্টোবর, ২০১৪ । রোকেয়া রফিক বেবী তখন “সিএটি”-এর সেক্রেটারি  জেনারেল। দুর্দান্ত একটা সময় ছিল আমাদের থিয়েটারে। দারুণ কর্মশক্তি, একটা ভয়ংকর রকমের উত্তেজনা। এটা ছিল আমাদের থিয়েটারের গভীর জ্ঞানমতবাদের ভেতরে  প্রবেশের যাত্রা। একটা ঝড়। তুমুল ঝড়। আলোচনার বিষয়ঃ ‘থিয়েটার ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যাবহার ও অপব্যবহার’। একটা তুমুল সংঘর্ষ । তুমুল হট্টগোল ‘থিয়েটার’ পাড়ায়, যেখানে শিল্প আত্ম-প্রতিবর্তিতার সীমা অতিক্রম করে।