বিশ্ব-বাঙালি নজরুল

প্রেমহীনতাই গুণহীনতা -- এমন বিশ্বাস নিয়েই বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বেঁচে ছিলেন।

সেঁজুতি জাহানসেঁজুতি জাহান
Published : 25 May 2023, 03:36 AM
Updated : 25 May 2023, 03:36 AM

বাঙালির জাতীয় জীবনে রবীন্দ্রনাথকে যদি ধরা হয় বটবৃক্ষ তাহলে নজরুল সেই বৃক্ষের শাখায় বয়ে যাওয়া মৃদু অথবা ঝড়ো হাওয়া, রোদ ও বৃষ্টি। রবীন্দ্রনাথ সম্ভ্রান্ত জমিদারের সন্তান। ভিক্টোরিয়ান আর্ট কালচারের মধ্যে দিয়ে বেড়ে ওঠা পরিণত মানুষ। বুদ্ধি দীপ্ত, ধীর এবং প্রাজ্ঞ। প্রাজ্ঞ বলতে কেবল জ্ঞানের কচকচানি ও কবচানি বোঝায় না। অধীত জ্ঞান ও বাস্তবতার সমন্বয়ে যার বুদ্ধি দীপ্যমান হয় তাকেই প্রাজ্ঞজন বলে। তুলনামূলক দরিদ্র আর পোড় খাওয়া মানুষ নজরুল। সংস্কৃতি ও জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ তাঁকেও করে তুলেছিল প্রাজ্ঞজন। রবীন্দ্রনাথের মতো সোনার চামচ তাঁর মুখে ছিল না। তবু শিল্প সাহিত্য ও জ্ঞানের প্রতি অগাধ আগ্রহ এই দুইজনকে করে তুলেছে কালোত্তীর্ণ।

তবে আজকের স্মার্ট,  ডিজিটাল, সার্টিফিকেট সর্বস্ব গোল্ডেন এ প্লাস জমানার সাপেক্ষে তাঁদেরকে নিঃসন্দেহে অকৃতকার্য বলতেই পারে আজকের প্রজন্ম। কিন্ত প্রাজ্ঞ-জীবনে তাঁদের কাছে ধারে কে যেতে পেরেছে ? 

রবীন্দ্রনাথ ‘স্কুল পালানো ছাত্র’ হওয়ায় স্কুলের কারিকুলাম বা মাস্টার মশাইদের শিক্ষার্থী-বান্ধব করে তোলার জন্য আজীবন লেগে থেকেছেন। সাহিত্য করেছেন কেবল আত্মতুষ্টির জন্য নয়, সাহিত্য করার মাধ্যমে জনকল্যাণের প্রতি তাঁর ছিল অসীম ভূমিকা। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সার্বিক উন্নয়ন তাঁর সাহিত্য ও জ্ঞানজগতের মূল উদ্দেশ্য ছিল। মাত্র ১৭ বছর বয়সে বাংলা উচ্চারণের নিয়ম সাব্যস্ত করে ফেলেছিলেন ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তীব্র আগ্রহের কারণেই। নব্য লেখকদের পাতার পর পাতা পড়ে পড়ে তাদের সাহিত্য ও জ্ঞানচর্চার তরিকা বাতলে দিয়েছেন। বই পড়ার জন্য, গবেষণা করার জন্য প্রতিনিয়ত আর্থিক ও সামাজিক সহযোগিতা দিয়ে গেছেন।

প্রেসিডেন্সি কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও আমাদের অতি পরিচিত জগদীশচন্দ্র বসু শিক্ষা ছুটি নিয়ে বিলেতে গবেষণার জন্য গেলে, তাঁর গবেষণা কাজ অর্থ ও ছুটির অভাবে যেন কোনোভাবেই বিঘ্নিত না হয় সেজন্য অর্থ ও ছুটির জন্য খুব ব্যতিব্যস্ত হয়ে কার্যকরী ভূমিকা পালন করেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি ত্রিপুরার মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্যের শরণাপন্ন হয়ে দশ হাজার টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করে দেন। রবীন্দ্রনাথ জগদীশচন্দ্র বসুকে পত্রে লিখছেন: “তোমার কাছে জ্ঞানের পন্থা ভিক্ষা করিতেছি – আর কোনো পথ ভারতবর্ষের পথ নহে – তপস্যার পথ, সাধনার পথ আমাদের।” ( প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্র জীবন কথা, পৃ-৪৫,)

ভারতবর্ষের সব ধরনের পশ্চাৎপদতাকে যেকোনো মূল্যে দূর করার জন্য তাঁর ভেতরে সব সময় একধরনের হাহুতাশ পরিলক্ষিত হয়েছে। ‘সভ্যতার সংকট’, ‘শিক্ষা’, ‘রাশিয়ার চিঠি’, ‘আত্মপরিচয়’ প্রভৃতি প্রবন্ধে লেখক বেশ সবিস্তারে ভারতবর্ষের আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে নিজেদের জীবনাচার ও শিক্ষাচারকে প্রায় সব অর্থেই ‘সহজ’ করার জন্য বলেছেন।

রবীন্দ্রনাথ তথাকথিত ‘সভ্যতা’কে ‘সদাচার’ বলে বাঙালির ইউরোপীয় দাসবৃত্তির চরম ও করুণ ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করেছেন, পাতার পর পাতা লিখেছেন। এমনকি জীবনের ৮০ বছরে উপনীত হয়ে আত্মখেদ জাহির করেছেন বিভিন্ন লেখায়। দুঃখজনক হলেও সত্য সেই ‘সভ্যতার সংকট’কে আমরা জিনেটিক্যালি বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি আমাদের ঐতিহাসিক সমাজ ব্যবস্থার নিয়মিত গতিধারায়।

ইউরোপের দাসবৃত্তির প্রতিবাদ নজরুলও করেছেন। তবে তাঁর তরিকা একটু ভিন্ন। রবীন্দ্রনাথ যেখানে ধীর স্থিরভাবে প্রবন্ধের মাধ্যমে প্রতিবাদ করে গেছেন, নজরুল প্রতিবাদ করেছেন গতিময়তা দিয়ে। তিনি বিদ্রোহী হয়ে উঠেছেন তাঁর প্রতি শব্দে ও অবস্থানে। রবীন্দ্রনাথের মতো তিনিও মানব প্রেমের কথা বলেছেন, সকল প্রকার অবিচার ও অপ্রেমের বিরুদ্ধে  বিদ্রোহী হতে বলেছেন।

প্রেমহীনতাই গুণহীনতা -- এমন বিশ্বাস  নিয়েই বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বেঁচে ছিলেন।

যুগে যুগে প্রেমের ভাষা ও সুর যারা বোঝে না; হিংসা, ঘৃণা, বৈষম্যের ঘানিকে যারা যত্ন করে থাকে তাদের বিরুদ্ধেই কবির অবস্থান।

এই অবস্থান এমনকি কখনো কখনো পক্ষপাতদুষ্ট  ভগবান বা ঈশ্বরের বিপক্ষেও।

ঈশ্বরের সৃষ্টি যদি সবাই হয়, তাহলে এক ঈশ্বরের পৃথিবীতে কেন এতো বৈষম্য?

কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর 'বিদ্রোহী' কবিতায় অপ্রেমজনিত সকল প্রকার অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ, নিপীড়ন, অসাম্যের প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করেছেন। প্রেমহীন সমাজ, ইতিহাসের জুলুমকে চিহ্নিত করতে তিনি উল্লেখ করেছেন বিভিন্ন পৌরাণিক চরিত্র ও ঘটনাকে।

যেকোনো প্রকার জুলুমের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে গেলে নিরীহ প্রেম নয়, বরং প্রবল বলশালী শক্তি ও ক্ষমতার প্রয়োজন। অহিংস আন্দোলনের মতো নরম ব্যাপারে কবি আর নাই, তিনি নেতাজি সুভাষচন্দ্রের দলে নাম লিখিয়েছেন। ফলে কবি তাঁর রাজনীতি সচেতন মনন ও কাব্য-শক্তির ধার বোঝাতে কবিতায় সংযোজন করেছেন নটরাজ, ধূর্জটি, জমদগ্নি, কৃষ্ণ, পিনাকপাণি, দুর্বাসা, বিশ্বামিত্র, ভীম, পরশুরাম, বিষ্ণু, বাসুকি, বলরাম, অর্ফিয়াস, জিব্রাইল, ইস্রাফিল চরিত্রগুলোকে।

এমন অনেক চরিত্র আছে যে চরিত্রগুলো মূলত একটি চরিত্রই, কিন্তু স্থান-ভেদে তাদের বীরোচিত ঘটনার প্রেক্ষিতে তাদের ভিন্ন ভিন্ন নাম হয়েছে। কবি সেইসব বীরদের বিভিন্ন নামের ঘটনাগুলোকে তাঁর কবিতা-শক্তির বাহক করেছেন।

যেমন: মহাদেব শিবের 'পিনাকপাণি', 'ধূর্জটি' বা 'নটরাজ' নামগুলো কেবল নামের বৈচিত্র্য সাধনের জন্যই নেননি, নিয়েছেন নামগুলোর কার্য-ক্ষমতার প্রেক্ষাপটগুলো।

২০২১ সালের ডিসেম্বরে তাঁর 'বিদ্রোহী' কবিতাটি জন্মের শতবর্ষে পদার্পণ করেছে। ২০২২ সালের ৬ জানুয়ারি কবিতাটি 'বিজলী' পত্রিকায় প্রকাশের ১০০ বছর পূর্ণ করেছে।

'বিদ্রোহী'কে এখনকার দিনের ভাষায় বলা যায় অনেকটা ভাইরাল কবিতা। এই কবিতা প্রকাশিত হবার আগে 'বিজলী' পত্রিকা তেমন একটা বিক্রি হতো না। কিন্তু বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশের পরপরই পত্রিকাটির প্রায় ২৯ হাজার কপি বিক্রি হয়েছিল। এবং আজও কবিতাটি সমাজ রাষ্ট্র ও সময়ের সঙ্গে ভীষণ রকমের প্রাসঙ্গিক। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে কবিতাটি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ কোটি বাঙালিকে পাকিস্তানের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রণোদিত করেছিল। যার ফলশ্রুতিতে এই বিদ্রোহী কবিকে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদা দেন আমাদের বঙ্গবন্ধু।

'বিদ্রোহী' কবিতাটি আজকের ভাষায় একটি ভাইরাল কবিতা। কিন্তু এই কবিতার শক্তি কবির আজন্ম কাব্য ও রাজনীতি সচেতন মনোবৃত্তির ফল। কেবল পারস্য সাহিত্য বিশেষ করে ওমর খৈয়ামের কবিতা পড়বার জন্য তিনি ফারসি শিখেছিলেন। ভাবা যায়! শুধু কবিতা পড়া এবং বোঝার জন্য একটি ভাষা শিখেছিলেন তিনি। যেখানে আজকের দিনে ভাষা শেখা হয় একমাত্র উন্নত জীবিকার আশায়! 

আবার প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইংল্যান্ডের পক্ষে যুদ্ধে যাবার জন্য ট্রেনিং করার সূত্র ধরে তিনি বিদেশি সাহিত্য, ইতিহাসও দেদারসে পড়েছেন। সাথে ছিল ভারতীয় পুরাণ, ইতিহাস ও রাজনীতি সম্পর্কে গভীর ধারণা।

এতো এতো প্রস্তুতির পর তিনিই একমাত্র কবি, যিনি মাত্র এক রাতের মধ্যে ১৪৮ লাইনের একটি কবিতা লিখে ফেলার ক্ষমতা রাখেন। বর্তমানে কবিতাটির ১৪১টি পঙক্তি পঠিত হয়।

কিন্তু আফসোস, যে 'অপর' বা ব্রিটিশ সরকারের জুলুমের বিরুদ্ধে সর্বব্যাপী সবারই সোচ্চার হয়ে ওঠার কথা, 'বিদ্রোহী' কবিতাটি যেখানে গোটা ভারতবর্ষের আত্মার কথা হয়ে ওঠার কথা, সেই কবিতাটিই কবির কাছের বা স্বজনদের কাছে বিষ-বৃক্ষ হিসেবে ধরা দিল।

কবিতাটি প্রকাশের প্রতিক্রিয়া হিসেবে নানা মহলের কবি সাহিত্যিকদের ব্যাঙ্গাত্মক,প্যারোডি কবিতা ও লেখা ছাপানোর ধুম পড়ে গেল।

গোলাম মোস্তফা তখন ব্যঙ্গ করে 'নিয়ন্ত্রিত' কবিতা লেখেন:

 ''ওগো বীর!

সংযত কর, সংহত কর, উন্নত তব শির!

'বিদ্রোহী' শুনে  হাসি পায়!

বাঁধন-হারার কাঁদন কাঁদিয়া বিদ্রোহী হতে সাধ যায়?

সেকি সাজেরে পাগল সাজে তোর?

আপনার পায়ে দাঁড়াবার মতো কতটুকু আছে জোর?"

এমন অজস্র ব্যাঙ্গ ও সমালোচনার তোপের মুখে রবীন্দ্রনাথকেও কম পড়তে হয়নি। আমরা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কথা জানি। তিনি রবীন্দ্রনাথকে দুই চোখে দেখতে পারতেন না। কিন্তু আফসোস, এখন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গানকেই নতুন প্রজন্ম রবীন্দ্রনাথের গান ভেবে ভুল করে। এটা ডি এল রায় সাহেবের জন্য যথেষ্ট মনযন্ত্রণার হবার কথা ছিল। ভাগ্যিস তিনি এখন বেঁচে নাই।

রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল তাঁদের ব্যক্তি জীবনে যতো যন্ত্রণাই ভোগ করুন না কেন, তাঁরা তাঁদের আত্মগত গুণ ও জ্ঞানের আওতায় গোটা বাঙালি জাতিকে আবদ্ধ করতে পেরেছেন।

আজ বাংলাদেশ রাষ্ট্র কিন্তু তাঁদের জন্ম-জয়ন্তী উদযাপনের মধ্য দিয়ে বাঙালির আটপৌরে, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক জীবনাঙ্গনে তাঁদের গুরুত্বকে অনুধাবন করার সর্বাত্মক সুযোগ করে দিয়েছে।