কার্লোস ফুয়েন্তেস-এর ‘কাফকা’

ফ্রাঞ্জ কাফকাকে নিয়ে ফুয়েন্তেসের এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল তার A to Z নামক বইটিতে। সেখান থেকে কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক মোস্তাক শরীফ বাংলা ভাষায় তর্জমা করেছেন।

মোস্তাক শরীফমোস্তাক শরীফ
Published : 6 June 2023, 06:34 AM
Updated : 6 June 2023, 06:34 AM

‘কাফকা পড়েছ তুমি?’ মিলান কুন্ডেরা জিজ্ঞেস করে আমাকে।

‘অবশ্যই,’ আমি বলি। ‘আমার কাছে বিশ শতকের অবশ্যপাঠ্য লেখক সে।’

অবজ্ঞাভরে হাসে কুন্ডেরা। ‘তুমি কি জার্মান ভাষায় পড়েছ কাফকাকে?”

‘না।’

‘তাহলে কাফকাকে তুমি পড়োনি।’

কাফকার অনুবাদ-অসম্ভব জার্মান ভাষা বিষয়ে কুন্ডেরার বিজ্ঞমতের একটিমাত্র ব্যতিক্রম আছে, সেটি হলো মিগুয়েল সিয়েঞ্জ-এর অনুবাদ। এমনই অসাধারণ এটি, আমার বন্ধু মিলান কুন্ডেরার বক্রোক্তিও এর ক্ষেত্রে খাটবে বলে মনে হয় না।

কাফকা হচ্ছে ভয়ংকর বিশ শতকের মৌলিকতম লেখক। যে সময়ে আমরা বাস করি কাফকাকে ছাড়া সেটিকে কখনোই বুঝে উঠতে পারব না। নৈতিক ও বৌদ্ধিক সাহস নিয়ে পিয়েত্রো সিতাতি অভাবনীয় একটি বিষয় ভেবেছেন: ‘দ্য ট্রায়াল’-এ কাফকার জোসেফ কে বাস্তবেই অপরাধী। অর্থাৎ কিনা, আপাতদৃষ্টিতে যাকে শিকার বলে মনে হয় সে মোটেই নিরপরাধ নয়।  সিতাতি কিন্তু কাফকার বহুস্তরবিশিষ্ট জীবনকে উপেক্ষা করেননি, যে জীবনে আছে পিতার সঙ্গে, ইহুদী ধর্মের সঙ্গে, প্রাগের বুর্জোয়া পেশাজীবী জীবনের সঙ্গে, নিজের শহরের সঙ্গে, স্তরে স্তরে বিন্যস্ত তাঁর সম্পর্ক। শেষে তিনি মন্তব্য করেছেন, মুক্ত পতঙ্গ হওয়ার চেয়ে বরং উৎসর্গীকৃত সন্তান হতেই পছন্দ করত গ্রেগর সামসা। সামসা সেই আইজাক, মেটামরফসিসে যার উৎসর্গ স্বর্গদূত বা ঈশ্বরের হস্তক্ষেপে বাধাগ্রস্ত হয়নি।

‘এল দানঞ’ (ক্ষতি) উপন্যাসে মেক্সিকান লেখক সেয়ালতিয়েল আলাত্রিস্তে এমন এক কাফকার গল্প বলেছেন যে তার মায়ের খুব ন্যাওটা, যে মা পুত্রের সাহিত্যপ্রতিভার স্ফূরণ ঘটানোর জন্য সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে নিজের ক্যারিয়ারকে বিসর্জন দিয়েছিলেন।

শিকার নিজেই অপরাধী বলে যে ফয়সালাটি সিতাতি দিলেন সেটি যতই মর্মপীড়াদায়ক হোক, এটিকে ন্যায়সঙ্গতই মনে হয় যখন আমাদের দিয়ে তিনি উপলব্ধি করান যে ক্ষমতা আপাতদৃষ্টিতে অস্তিত্বশীল মনে হলেও বাস্তবে তা নয়। ক্ষমতার শিকারেরা এমন একটি শক্তির উৎসারণ ঘটায়, ক্ষমতা ছাড়া যেটি অস্তিত্বশীল হতো না।

উলঙ্গ সম্রাটকে আমরা পোশাক পরাই।

ক্ষমতার ভূতকে আমরা ক্ষমতার শরীরে রূপান্তরিত করি।

প্রকৃত ক্ষমতা আর ক্ষমতার মিথ-এর মধ্যে যে ভারসাম্যহীনতা সেটিই স্রেফ চোখে আঙ্গুল দিয়ে  দেখিয়েছেন কাফকা। আর এখান থেকেই উদ্ভূত হয় একটি প্রশ্ন: ক্ষমতা যদি তার নিজের কল্পকাহিনীকে বাস্তবে রূপ দিতে পারে, সংস্কৃতি কীভাবে তার নিজের বাস্তবতাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলবে? কেবল আত্মমাত্রিকতাই কি যথেষ্ট?

চিলীয় দার্শনিক মার্টিন হপেনহেইন মনে করেন কাফকার ‘দিনলিপি’ তাঁর উপন্যাসকে দিয়েছে আত্মবাদী এক অনুরণন। কাফকার উপন্যাসে কোনো অভ্যন্তরীণতা নেই। অন্যদিকে ‘দিনলিপি’ হচ্ছে বহিস্থ আবেগের অভ্যন্তরীণ এক আবেদন। উপন্যাসের মুখ্য চরিত্রগুলোর যুক্তিবাদের নায়ক হিসেবে আবির্ভুত হওয়ার মতোই, দুটো জিনিসের একে অন্যকে পূর্ণতাদানের এ এক বিরক্তিকর প্রচেষ্টা। যুক্তির ডামাডোলে অকিঞ্চিৎকর হয়ে পড়াই নায়কদের দুঃখ-দুর্দশার কারণ, যদিও যে যুক্তিগুলো তাদের অকিঞ্চিৎকর করে তুলল সেগুলো তাদের বোধগম্য নয়। ফলত, তাদের যুক্তিবাদ হচ্ছে অপৃথকীকৃত এক পদ্ধতির গহ্বরে নিজেদের হারিয়ে ফেলা এবং সামজিক মিথস্ক্রিয়াকে আনুষ্ঠানিকতা দেওয়ার যে প্রক্রিয়া সেখানে নিজেদের বহিরাগত হিসেবে অনুভব করা।

এখান থেকেই আমরা ব্যক্তি ও ক্ষমতার মধ্যে যে সম্পর্ক, কাফকার হাতে তার অসাধারণ বিনির্মাণ ও মঞ্চায়ন দেখি। গত একশো বছরে এমন প্রাঞ্জল, এমন গোলমেলে, এমন সমসাময়িক লেখা আর কেউ লেখেননি। হপেনহাইমের ভাষ্যমতে, কাফকার দুনিয়ার বাসিন্দা হচ্ছে এক পরজীবী যে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই পরজীবীদের দুনিয়াকে সবার সামনে উন্মুক্ত করে দেয়। কাফকার নায়কের একটাই সাধ: ক্ষমতার হাতে সমর্পিত হওয়া। তবে ক্ষমতার কাছে নিজেকে সমর্পণের মাধ্যমে অনিচ্ছাকৃতভাবেই সে ক্ষমতার মুখোশে আঁচড় বসায়। যে ভিত্তির ওপর ক্ষমতা দাঁড়িয়ে সেটিকে সবার সামনে উলঙ্গ করে দেয়। তখন এটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে ক্ষমতার টিকে থাকার জোর তার বুদ্ধির ওপর নয়, আনাড়িপনার ওপর নির্ভর করে।

কাফকার পৃথিবীতে কোনো সভাসদ বা অন্য কেউ সম্রাটের পোশাক খুলে নেয় না। ক্ষমতা-পদ্ধতি যেসব কৌশলকে প্রয়োগ করে সেগুলো অনুধাবনের ব্যাপারে প্রজাদের অক্ষমতাই ক্ষমতার নগ্নতাকে প্রকাশ্য করে দেয়। সাহিত্যিক হিসেবে কাফকার শক্তিমত্তার রহস্য হচ্ছে, তাঁর গল্প উপন্যাসে এমন এক ক্ষমতার বর্ণনা আছে যেটি ঐ গল্প বা উপন্যাসের নিজের কল্পকাহিনীকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে। ‘দ্য ট্রায়াল’ ও ‘দ্য ক্যাসল’-এ ক্ষমতাকাঠামোয় এমন একটি শূন্যতার কথা কাফকা বলেছেন যেটি নিজেকে নিপুণ-পরিপূর্ণতায় উপস্থাপন করে। ক্ষমতাপদ্ধতিকে আত্মসাৎকারী মিথ্যাটির বিষয়ে আমরা সচেতন হই, অথচ এটিকে মিথ্যা বলে জানার পরও তার ভানভনিতা আমাদের পীড়িত করে। কাফকার গল্পে ক্ষমতা তার শক্তি দেখায় বাস্তবে অস্তিত্বশীল না হলেও বাস্তবতার এক প্রতিভাস ধারণ করার মাধ্যমে। ‘দ্য ক্যাসল’-এর কর্তৃপক্ষ সবসময়ই অক্ষত থেকে যায় কারণ আগাগোড়াই স্রেফ একটা সম্ভাবনা। ফলে ক্ষমতার যে শিকার (যেমন, জোসেফ কে, ভূমি জরিপকারী ‘কে’), সে এমন একটি ক্ষমতা-পদ্ধতির কথা কল্পনা করে যেটি তার অনুপস্থিতির সঙ্গে সমানুপাতিক। ক্ষমতাশৃঙ্খলের নিয়মই হচ্ছে সেই অনিশ্চয়তা যেটি এর প্রয়োগের মধ্যে অনুভব করা যায়।

১৯২৪-এ তাঁর মৃত্যুর সময় ফ্রাঞ্জ কাফকার জানার উপায় ছিল না, তাঁর মৃত্যুর দশ বছরের মধ্যেই ক্ষমতার যে নারকীয় রূপের কথা তিনি বলেছেন সেটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা হয়ে যাবে। গেস্টাপো অথবা এনকেভিডি যখন কোনো যৌক্তিকতা কিংবা অজুহাত ছাড়াই মধ্যরাতে হাজির হয় শিকারকে আটক করার জন্য, তারা আসলে আটক করে কাফকাকেই। ১৯৩৭ সালে কমরেড কমান্ডার আই ভি কোভালেভ নিজের দায়িত্ব বুঝে নিতে মিনস্কে হাজির হয়ে নিজেকে আবিষ্কার করেন শূন্য একটি অফিসে। এ শূন্যতার কারণ, তাঁর পূর্বসুরি ও তার কর্মচারিরা বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে স্ট্যালিনের হাতে নিহত হয়েছে। এর চেয়ে বেশি কাফকাসুলভ কী হতে পারে! নিয়তির পরিহাস, স্টালিনের পরবর্তী শিকারের চেয়ারে বসলেন কোভালেভ এবং সে শিকার তিনি নিজেই। স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের সময় ‘ইজভেস্তিয়া’ পত্রিকার সাংবাদিক মিখাইল কল্ৎসভ একইরকম কাফকাসুলভ ভঙ্গিতে ঘোষণা করলেন, স্টালিন যদি তাঁকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে ঘোষণা করেন তাহলে অভিযোগ ভিত্তিহীন হলেও তিনি এটি বিশ্বাস করবেন। সেই কল্ৎসভই স্টালিনের গুপ্ত পুলিশ বাহিনীর হাতে গ্রেফতার ও নিহত হলেন স্রেফ একনায়কের ঠিক করে দেওয়া গ্রেফতারের কোটা পূরণের জন্য, যদিও তারা জানত যে তারা নিজেরাই পরিণত হবে স্টালিনীয় উন্মাদনার পরবর্তী শিকারে।

একথা মানতে হবে যে কাফকা কোনো রাজনীতি-বিশ্লেষক ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন লেখক। এর মানে হচ্ছে, রাজনীতির ইতিহাসে যা-ই ঘটুক না কেন, ব্যক্তিগত ইতিহাস আর কল্পনার রাজ্যে সন্দেহ, অন্ধতা, দোদুল্যমানতা ও বীরত্বের নীরব সব নাটক একটিমাত্র কক্ষ, একটি অফিস, একটি বিছানায় সংঘটিত হতে পারে, যা পূর্ণতা দেয় ক্ষমতার প্রয়োগকে। ‘মেটামরফসিস’-এ গ্রেগর সামসা পোকায় পরিণত হয় কেবল তার বাবার কাছ থেকে পালানোর জন্য নয়; তার ব্যবস্থাপক, ব্যবসা, আমলাতন্ত্র সব কিছুর কাছ থেকেই পালানোর জন্য। হপেনহেইন বিচক্ষণতার সঙ্গে দেখিয়েছেন, পোকা সামসা স্রেফ একটি পোকা নয়, সে তখনও চিন্তাশীল। তার বিবেক তার শরীরকে একটি পর্দা হিসেবে ব্যবহার করছে, আবার প্রতি মুহূর্তে সেটিকে বন্দীও করে রেখেছে। এতে কিছুটা প্রহসনের ছোঁয়া থাকলেও আমরা বুঝি যে, প্রহসনের মূল ব্যাপারটাই হচ্ছে আমাদেরকে প্রেক্ষাপটের বাইরে নিয়ে যাওয়া এবং বিশ্ব ও আমাদের মধ্যে একটা ব্যবধান তৈরি করা। এই ব্যবধানটি তখন পরস্পরের মধ্যে হয়ে যায় একটি যোগসূত্র। হপেনহেইন দেখিয়েছেন, এর মানে হচ্ছে, প্রহসন নিজেই এবং নিজের ভেতরে এক ধরনের রূপান্তর। আইন উন্মাদ হতে পারে, তবে তবু সে আইন। সামসা, জোসেফ কে ও ভূমি জরিপকারীকে তাদের বাধ্যবাধকতাগুলো পূরণ করতে বাধা দেয় অন্তহীন অনেক বাধ্যবাধকতা, এবং এ কারণেই তাদের মুখোমুখি হতে হয় শাস্তির।

ক্ষমতা বিশ শতকে পৃথিবীতে যে বিভীষিকা ডেকে এনেছে ফ্রাঞ্জ কাফকা তাকে দিয়েছেন একটি চেহারা। এ কারণে কাফকাকে একুশ শতকে ক্ষমতার পয়গম্বরও বলা যেতে পারে। হিটলারের অসউইৎ্জ আর স্টালিনের গুলাগে ক্ষমতা বড্ড বেশি দৃশ্যমান হয়ে ধরা দিয়েছিল। আজকের দিনে ক্ষমতা শিখে গেছে কীভাবে অদৃশ্য থাকতে হয়। যে বাস্তবতার ওপর সে নির্ভর করে তা হচ্ছে, শিকার নিজেই ক্ষমতার হাতে তুলে দেবে প্রয়োজনীয় সব ক্ষমতা।