কবি তাপস গায়েনের অনুবাদ ও ভূমিকায় অস্ট্রিয়ার অন্যতম প্রধান কবি
Published : 08 Jan 2024, 07:13 PM
“একাকীত্বের জীবন যা দুঃখময়, যা নির্জনতায় আপাত শান্ত, কিন্তু অতলে অস্থির, তাই যেন তীব্র কবিতা হয়ে উঠেছে; নৈঃশব্দ্যের মধ্যে প্রকাশের তীব্র উন্মোচন থাকা সত্ত্বেও এমনই এক যন্ত্রণাময় জীবন তাঁর, অবরুদ্ধ গোলক যেন, যা কোনোভাবেই যৌক্তিক অনুভবে শব্দকে দেখতে আগ্রহী নয়”— কবি গেয়র্ক ট্রাকলের কবিতা পড়ে চিন্তার এই বৈভব রেখে গেছেন ঔপন্যাসিক টমাস ম্যান। মাত্র সাতাশ বছরে মারা যাবেন এই কবি অতিরিক্ত কোকেন সেবনের ফলে, কিন্তু মৃত্যুর আগে অন্তিম কবিতায় আত্মপ্রতিকৃতি উৎকীর্ণ করে যাবেন এই বাক্যত্রয়ে —"…দেখ, একটি ভীরু নৌকা ডুবে যায়/ নক্ষত্রসমূহের নীচে/ রাতের নীরব অবয়ব ।” [বিলাপ, গেয়র্ক ট্রাকল, ভাষান্তরঃ রাজু আলাউদ্দিন] এই সেই কবিতা যেখানে মুখরসত্তা, যা ভাষার মধ্যে ব্যাপ্ত, অবলোকন করে চলছে তার অনুচ্চ-সত্তাকে; এ-যেন মহাবিশ্বের সেই অবস্থান, যখন রাত গভীর, যখন কিছুই প্রকাশিত নয়, যখন ভাষার মধ্যে দিয়ে আমরা মুখর হয়ে উঠতে পারিনি। নীরবতা তো মৃত্যুরই সমাঙ্গ, আর ভাষা হলো যৌনতার, মুখরতার, এবং পরিব্যাপ্তির। অন্যার্থে, ট্রাকলের কবিতা প্রচলিত লজিকের অনুবর্তী নয়, বরং ভাষার পশ্চাতে মনোজগতের যে উৎসারণ থাকে, যা শুধুমাত্র শব্দচিন্তার মধ্যেই বাহিত নয়, বরং তা তাঁর কবিতা পরিক্রমায় হয়ে উঠেছে স্বপ্ন এবং স্কিৎজোফ্রেনিয়ার এক জগৎ, যা সাধারণ বুদ্ধির অগম্য!
অল্প বয়স থেকেই ট্রাকল ছিলেন নির্জন, শান্ত, এবং মৃদুভাষী; কিন্তু কথা বললে তা হয়ে উঠত আত্মগত এবং প্রত্যাদেশমূলক, যখন তাঁর দৃষ্টি হয়ে উঠত বহু দূরগামী। কোনো এক বন্ধুর কাছে বলেছেন যে তিনি মানুষের মুখাবয়বের দিকে তাকাতেন না, তাদের অবয়বের কোন ধারণা ছিল না তাঁর। আরেক বন্ধুর কাছে স্বীকারোক্তি করেছেন যে কুড়ি বছর অবধি জল ছাড়া আর কোন পরিবেশ এবং পরিপার্শ্বকে দেখেননি তিনি। আট বছর বয়সে তিনি পুকুরে বহুদূর অবধি হেঁটে গেছেন স্বেচ্ছামৃত্যুর নিমিত্তে, মদ্যপানে আসক্ত হয়ে উঠেছেন পনের বছর বয়স থেকে, আর এর সাথে যোগ হয়েছে স্কুলে পড়াশোনার ব্যর্থতা! মায়ের মাদকাসক্তি, পরিবারের প্রাত্যহিকতা থেকে অব্যাহতি নিয়ে এন্টিকে ব্যস্ত এই নারী মায়ের ভালোবাসা দিতে অপারগ ছিলেন ট্রাকলকে।
মানবিক সম্পর্কে তাঁর দ্বিতীয় ব্যর্থতা ছোট বোন গ্রেটার সাথে, যাকে তিনি কৈশোরে জেনেছেন, “সবচে সুন্দরী, সবচে বড় শিল্পী, সবচে ব্যতিক্রমী নারী” আর এই বোনকে নিয়ে তাঁর সারাজীবনের দোলাচল, এবং তাঁর কবি জীবনের নির্মিতির কারণ এবং ধ্বংস; এবং “বিলাপ” কবিতায় তাঁকেই সম্বোধন করেছেন, “হে নিখিল বেদনার বোন” হিসেবে! বোনের সাথে রীতি-বহির্ভূত সম্পর্ক, বোনের অকাল মৃত্যু— এসবই তাঁর মনোবিকলনের অন্যতম প্রধান কারণ হয়ত; তাঁর এই মানসিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক বিপর্যয় তাঁর “মিথিক সত্তা” নির্মাণে তাঁকে বাধাগ্রস্থ করেছে! সাহিত্য সমালোচক মেরী জেইনাস কারিক বলেন, “কবি উইলিয়াম ব্লেকের মতো কবি গেয়র্গ ট্রাকল আপনাকে নিয়ে নিজস্ব কোনো সুসংহত মীথ গড়ে তুলতে পারেননি। ট্রাকলের কবিতায় নেই কোন সুসংহত প্রতীক; যা আছে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আভাসিত, দোলাচলপূর্ণ, অসম্পূর্ণ এবং বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে জটাগ্রস্থ ।” কার্ল গুস্তাভ ইয়ুঙ্গের মতে, “অবচেতন এবং সচেতন, এই দুইয়ের সমন্বয়ে মৌলিক প্রতীকের জন্ম নেয়, বৈপরীত্যকে ধারণ করেই এই নান্দনিক কাঠামো এক ‘অবিভাজ্য সত্তা’ যেন।” কিন্তু ট্রাকলের প্রতীকসমূহ এসব কিছুর বিপ্রতীপ অবস্থানে দাঁড়িয়ে বিভাজিত এবং পরিশেষে বিক্ষিপ্ত। ১
ট্রাকলের কবিতায় শব্দকে ঘিরে থাকে এক ধরনের নৈঃশব্দ্য এবং শূন্যতা ; তাঁর কবিতায় অবচেতনের দিকে যে ঝোঁক— যা স্বপ্ন, মানসিক বৈকল্য, এবং ভাষার প্রতিস্থাপন (ট্রান্সফারেন্স) মধ্য দিয়ে অর্জন সম্ভব—তাই তাঁর কবিতায় অভীষ্ট হয়ে উঠেছে। তাঁর কবিতার অনিঃশেষ বুদ্বুদ, যা শব্দ এবং বাক্যের লজিক দিয়ে শাসিত নয়, অর্থাৎ ভাষা তাঁর কাছে আরোপিত নয়, বরং আবিস্কারের বিষয় হয়ে উঠেছে। যে শব্দসমূহ তাঁর সত্তার অনিঃশেষ বুদ্বুদকে ধারণ করে না, তাঁকে তিনি তাঁর অভিধান থেকে বহিষ্কার করেছেন ।
সাহিত্য সমালোচকরা ট্রাকলের কবিতার গঠনশৈলীর বাঁকপরিবর্তন লক্ষ্য করে তাঁর সংক্ষিপ্ত সৃজনশীল কালকে তিনটি পর্যায়ে বিন্যস্ত করেছেন। তাঁর কবিতার প্রথম পর্ব (১৯০৯-১৯১১ খ্রি.) যা কবিতার সুরধ্বনি দিয়ে শাসিত। ছন্দ, এবং বিশেষ করে অনুপ্রাস— যা কবিতার উপরিকাঠামো, যা অনেক কাব্য সমালোচক মনে করেন—কবিতার গাম্ভীর্যকে ক্ষুণ্ণ করে, কিন্তু কবির কাছে দাবি করে পরিমিতি এবং শৃঙ্খলা। যদিও এক চিঠিতে ট্রাকল বলেছেন, “পূর্ণ সচেতনতা, যা কিনা প্রাণীকূলের ইন্দ্রিয়প্রবণতাজাত তা নিয়ে বাস করা আমার জন্য ভয়ঙ্কর। আমি আমার মধ্যে ভীষণ সম্ভাবনাকে অনুভব করেছি, গন্ধ পেয়েছি, রক্তের মধ্যে শুনেছি পিশাচের চিৎকার…কী এক অসম্ভব দুঃস্বপ্ন!” এই দ্বৈরথে ছন্দ আর মিল তাঁকে দিয়েছে আপাত সুস্থিরতা, যদিও তা একার্থে অবদমন এবং বাস্তবতা থেকে পলায়নমাত্র। সত্তার বিভাজন যা ভাষার বিভাজনের মধ্য দিয়ে মূর্ত, যা স্বপ্ন এবং দুঃস্বপ্ন হয়ে উপস্থিত তাঁর কবিতায়, এবং এই দুঃস্বপ্নকে তিনি তাড়িয়ে ফিরেছেন সারা জীবন। এই অবদমন কখনো কখনো ফিরে এসেছে দুঃশ্চিন্তা হয়ে, দূরবর্তীভাবে ইন্দ্রিয়প্রবণতা হয়ে, যা আমরা লক্ষ্য করি তাঁর ‘দ্য র্যাট’ কবিতায়। পরবর্তীকালে এই অবদমন, এই দুঃশ্চিন্তা হয়ে উঠেছে ভূতুড়ে, অনির্ণীত, ঘূর্ণায়মান এক অলীক সত্তা। অবদমন, অবদমনে ব্যর্থতা, অলীক সত্তার পুনঃপৌনিক আবির্ভাব, পরিশেষে অসংজ্ঞায়িত, ভূতুড়ে, বীভৎস সত্তা তাঁর কবিতা-প্রকৃতির মৌল বিষয় হয়ে উঠেছে।
ট্রাকলের দ্বিতীয় অধ্যায় (১৯১২-১৯১৪ খ্রি.), যা তাঁর সবচে সৃজনশীল কাল, যেই অধ্যায়ের কবিতাকর্মকে অনুসরণ করে টাইমস লিটারেরি সাপ্লিমেণ্ট’র রিভিয়ুয়ার তাঁকে জার্মান কবিতায় গুটিকয়েক মহা্রথীর একজন হিসেবে মান্য করেছেন। এই সেই কাল, যখন ট্রাকল বিস্তৃত বাস্তবতার প্রতিস্থাপন নির্মাণ করবেন এবং তার ধ্বংস লক্ষ্য করে যাবেন। তিনি যে চিহ্ন এবং চিহ্নায়ক তাঁর কবিতায় ব্যবহার করেছেন, তাকে দার্শনিক ভীটগেন্সটাইন প্রচলিত কাঠামোর বহির্ভূত হিসেবে শনাক্ত করেছেন, এবং মনে করছেন যে ট্রাকলের ব্যবহৃত শব্দগুলো প্রকৃতপ্রস্তাবে মুক্ত এবং নিয়মকানুনবিহীন। সেই কারণেই, তাঁর শব্দসমূহ দিয়ে তিনি যা শনাক্ত করতে চান, তা প্রতিভাত হয়ে উঠে না। ট্রাকলের কবিতায় শব্দগুলো, যা মূলত নির্জনতা অভিমুখী, বয়ে নিয়ে চলছে আনুভূমিক এবং লম্বিক মাত্রা। আনুভূমিকতল হল সেই মাত্রা যেখানে ভাষা বুৎপত্তিগতভাবে, সামাজিকভাবে, এবং পৌরাণিক অনিবার্যতায় প্রচলিত অর্থ এবং অন্বয় দিয়ে বাধিত; আনুভূমিকতলে, ট্রাকলের কবিতা দ্বিধান্বিত, অনির্দিষ্ট, বহুবিধ অর্থের অভিমুখী। অন্যদিকে, লম্বিকভূমিতে, ট্রাকলের কবিতা অনির্দিষ্ট নয়, তবে দ্বৈরথপূর্ণ, পরস্পরবিরোধী প্রবণতায় পূর্ণ। সে কারণে, আনুভূমিকতলে ট্রাকলের কাব্যবিচার এক অর্থে একটি অসম্পূর্ণ প্রয়াস; অন্যদিকে, ট্রাকলের একান্ত নিজস্ব শব্দগুলোও অন্যসব শব্দের সাথে একইভাবে সম্পর্কায়িত নয়। যেমন, ‘সিলভার (রৌপ)’ তাঁর কবিতায় ‘অপরাধ’ এবং ‘অপরাধহীনতা’ এই দুইকেই নির্দেশ করে। অর্থাৎ, শব্দ তার দ্বৈততাকে অতিক্রম করে চলছে অসংজ্ঞায়িত এক বলয়ে, যেখানে তাঁর একান্ত শব্দগুলোও প্রতিটি কবিতার জন্য ভিন্ন ভিন্ন অর্থ নিয়ে হাজির হবে। ট্রাকলের কবিতায় নির্দ্দিষ্ট কোনো অর্থ নিয়ে হাজির না হলেও এক বা একাধিক অনুভূতি নিয়ে উপস্থিত। সেকারণে, দার্শনিক হাইডেগার বলেন, “ট্রাকলের কবিতায় দ্বৈরথপূর্ণবোধ অনিশ্চিত অনির্দিষ্টতায় বিভাজিত নয়।” শব্দরাশির অর্থ এবং অর্থহীনতার মধ্যে দিয়ে আসাযাওয়া, চূড়ান্তভাবে শব্দের অনির্দিষ্ট অর্থ এবং অসংজ্ঞায়িত অবস্থান প্রকৃতপ্রস্তাবে উন্মাদ-দশার এক উৎসরণমাত্র। তবু, এই কথা মান্য করেও আমরা বলতে চাই যে এইখানে ট্রাকলের কবিতা নিয়ে হাইডেগারের চিন্তা অনেক বেশী প্রনিধাণযোগ্য।
কবিজীবনের প্রথম পর্বে তাঁর সাথে পরিপার্শ্বের সংঘাত থেকে জন্ম নিয়েছে বিভাজিত চিত্রের, পরবর্তী জীবনে ভেদ ঘটেছে তাঁর সুরসত্তা, তাঁর সত্যরূপ সত্তার সাথে। “আমি” সত্তা উবে গিয়ে ক্রমে হয়েছে অবাস্তব সত্তা, ভূতুড়ে সত্তা, এবং পরিশেষে কিম্ভুতকিমাকার সত্তা। এই পর্বে তিনি লিখেছেন তাঁর দীর্ঘরূপী সত্তা নিয়ে; লিখেছেন দুর্দান্ত সব কবিতা” ‘হেলিয়ান’, ‘এলিস’, ‘ক্যাসপার হাউসার সং’, ‘সেবাষ্টিয়ান ইন ড্রিম।’ এইসবই তাঁর সত্তার অভিক্ষেপ, এক বায়বীয় বাস্তবতা, এবং একইসাথে তিনি এইসব অতিবিস্তৃত সত্তার দর্শক। এইখানে তিনি নিজেকে দেখেন ‘অন্ধকার একজন,’ ‘অসুস্থ একজন,’ ‘অপেক্ষমাণ একজন,’ ‘মৃত একজন,’ ইত্যাদি রূপে, অর্থাৎ, তাঁর সত্তার বিভাজিত রূপ, যাকে তিনি কোনোভাবেই জড়ো করে একত্রে করতে পারছেন না। এইসব সত্তা অতীত এবং বর্তমানের মধ্যে, বর্তমান এবং সময়হীন কালের মধ্যে, রঙের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গতিশীল। এইসবই শেষাবধি থেকে গেছে তাঁর আয়ত্তের বাইরে। মুকুরে প্রতিফলিত হয়ে তিনি নিজেকে দেখেন বিভাজিত, নিজেকে দেখেন পশুর মুখাকৃতিতে এবং একইসাথে দেবদূতের অবয়বে।
ট্রাকলের অন্তিম পর্বের (১৯১৪ খ্রি) কয়েকটি কবিতা, যা তাঁকে তাঁর দ্বিতীয় পর্যায়ের কাব্যকর্ম থেকে পৃথক, প্রাতিস্বিক করে তোলে, কারণ এই পর্বে তাঁর কবিতার ভাষা অনেকটাই স্কিৎজোফ্রেনিক, যা কোনোভাবেই ড্রিম ল্যাংগুয়েজের মতো নয় । স্কিৎজোফ্রেনিক ল্যাংগুয়েজ এবং ড্রিম ল্যাংগুয়েজ—উভয়ই অবচেতন মনের কাজ, যা কি না প্রাথমিক মানসিক প্রক্রিয়া। এই পর্বে জগৎ এবং কবিসত্তা উভয়ই শব্দের মধ্যে লীন হয়ে আছে। অর্থাৎ, শব্দ যখন বস্তুকে প্রতিস্থাপন করে, তখন ভাষার কাজ হারিয়ে যায়। এটি একটি জটিল প্রক্রিয়া, যা বিস্তৃত আলোচনার দাবি রাখে, যার অব্যাহতি দেয়া হলো এখানে। শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা স্বপ্নের মতোই সত্তার অবচেতনকে প্রধান করে তোলে, এবং এমনকি কখনো কখনো তাকে গুহ্যজ্ঞান হিসেবে প্রতিভাত করে। যেমন, ট্রাকলের অসামান্য পঙক্তি, “হে হৃদয়, বরফ হীমায়িত শুভ্রতায় তুমি দ্যুতি ছড়াও” শেষাবধি নান্দনিক অভিজ্ঞতার অংশ হয়ে ওঠে, যা ভাষার প্রচলিত লজিকের পূর্ববর্তী। যদিও এই জ্ঞান ভাষার প্রতীকী প্রবাহ নির্মাণ করে না, তবুও মানসিক রোগ এবং বৈকল্যকে একটি প্যাটার্নে বাঁধতে সাহায্য করে। সকল মহৎ শিল্প, শেষাবধি, ভাষার মধ্যেই বাহিত; সেই কারণে, ট্রাকলের কবিতাও বিচিত্রগামী ভাষার অশেষ প্রবাহ যেন, এবং কখনো কখনো ভাষার অগ্রেও দাঁড়িয়ে থাকে। ঠিক এই কারণেই কী ট্রাকলকে আমি অতল উৎসের কবি হিসেবে জেনেছি!
আমার অনুবাদে গেয়র্ক ট্রাকলের কিছু কবিতা এখানে সন্নিবেশিত হলো ২.৩
মিউজিক ইন দ্য মিরাবেল
একটি ঝর্না গান করে। দ্যুতিময় শাদা, শান্ত মেঘ
ঝুলে আছে মৃদু নীলে। অতি ধীরে সঞ্চরণরত,
নিঃশ্চুপ এইসব মানুষ-মানুষীরা ঘুরে বেড়ায়
সন্ধ্যার এইক্ষণে পুরানো বাগান জুড়ে।
আমাদের পূর্বপুরুষদের শাদা পাথর হয়ে গেছে ধূসর
এক ঝাঁক পাখি পার্কের কিনার ধরে উড়ে যায় অদৃশ্যতায়
ফন, এক কিম্ভুত দেবতা, মৃত চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে স্থির
আবছায়া অন্ধকারে দ্রুতই সে যেন হারিয়ে যায়
প্রাচীন বৃক্ষ থেকে বিবর্ণ ধূসরতায় ঝরে পড়ে গাছের বাকল
খোলা জানালা জুড়ে ঘূর্ণায়মান, স্খলিত, এবং ধাবমান
উনুনের কম্পমান আগুন জন্ম দেয় অজস্র প্রেতাত্মার
যারা পাক খায়, পরিবর্তিত হয়ে হারিয়ে যায়
এক আগন্তুক, সম্পূর্ণই শাদা, প্রবেশ করে গৃহে
ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন কড়িডোরে বাঁধা আছে মাষ্টিফ ডগ
সন্তর্পণে এক গৃহ পরিচারিকা নির্বাপিত করে গেছে
শেষ প্রদীপের আলো
রাতজুড়ে সোনাটার শব্দ কানে গুঞ্জরিত হয়ে
ব্যাপ্ত হতে ভালোবাসে।
ইংরেজী ভাষান্তরঃ মাইকেল হামবার্গার ২
বালক এলিসের প্রতি
এলিস, অন্ধকার অরণ্যে যখন ডাকে কালোপাখি
তখন হবে তোমার পতন
তোমার ওষ্ঠাধার পান করছে পাথুরে-ঝর্ণার শান্ত-নীল জল
যখন তোমার কপাল থেকে ঝরে মৃদু রক্তপাত
স্মৃতি বয়ে আনে সুপ্রাচীন রূপকথা
এবং কালো পাখিদের উড্ডয়নের বিষাদ্গাথা
তদুপরি তুমি হাঁটো আলতো পায়ে রাতের গভীরে
পরিপক্ক রক্তিম আঙুর ঝুলে থাকে, যখন তুমি
প্রসারিত কর তোমার সুন্দর কমনীয় হাত নম্র নীলে
একটি কাঁটার ঝোপ শব্দ করে ওঠে
কোথায় তোমার চাঁদের মতো চোখ?
হে এলিস, তোমার মৃত্যু হলো কতোদিন?
তোমার শরীর যেন হায়াসিন্থ
যেখানে এক সন্ন্যাসী ডুবিয়ে দিয়েছে তাঁর মোমের আঙ্গুল।
আমাদের নীরবতা কালো গহ্বর এক
ক্খনো ক্খনো একটি শান্ত প্রাণি বেরিয়ে আসে
এবং অতিধীরে নিমীলিত করে তার ভারী চোখের পাতা
তোমার কপালে ঝরে পড়ে কালো শিশির,
যেন পতিত নক্ষত্রের শেষ স্বর্ণরেণু
সর্বপ্রাণ
বিষণ্ণ, অসম সহযাত্রী— এই নারী ও পুরুষ,
অস্বচ্ছ আলোয় প্রজ্জ্বলিত কবরের উপরে
আজ তারা ছিটিয়ে দিচ্ছে লাল, নীল ফুল
মৃত্যুর ঠিক আগ পর্যন্ত তারা হেঁটে যাচ্ছে পাপেটের মতো
এবং কীভাবে তারা ভয় এবং নম্রতায় প্রতীয়মান হচ্ছে
কালো ঝোপঝাড়ের পিছনে দণ্ডায়মান আবছায়া যেন
যারা জন্মায়নি তারা ছড়ায় নৈরাশ্য হেমন্ত বাতাসে
এবং দ্বিধাগ্রস্থ আলো ধাবমান এলোমেলোভাবে
প্রেমিকের সন্তাপ বৃক্ষের শাখায় ছড়ায় শ্বাসপ্রশ্বাস
সেইখানে মা ও শিশুর মৃতদেহ পচে অবিরল
জীবিতদের নাচ অলীক মনে হয়, এবং তা’
অবিশ্বাস্যভাবে ব্যাপ্ত হতে থাকে সন্ধ্যার বাতাসে
ঝঞ্জাবিক্ষুদ্ধময় তাদের জীবন, পরিত্যক্ত প্লেগে পূর্ণ
ঈশ্বর যেন সহায় হন নারীদের যন্ত্রণা আর দোজখের ব্যাপারে
আর আছে মৃত্যুকে ঘিরে আশাহীন বিলাপ
আর যে আছে নির্জন একাকী সে ঘুরে বেড়ায় নক্ষত্রের জগতে
হেলিয়ান
[এক]
সত্তার নির্জন মুহূর্তে
সুর্যের মধ্যে হেঁটে যাওয়া আনন্দের
গ্রীষ্মের হলুদ দেয়ালে
পদযাত্রা ঘাসের মধ্যে ফিসফিস করে; তথাপি,
দেবতা প্যানের পুত্র ধূসর মার্বেলের মধ্যে ঘুমিয়ে আছে
সন্ধ্যার ব্যালকনিতে বাদামি মদে আমরা মাতাল হয়ে উঠি
পাতার গভীরে একটি পীচ উজ্জ্বলতায় রঙিন হয়ে ওঠে
আনন্দময় হাসির মধ্যে জেগে আছে শান্ত সোনাটার সুর
রাত্রির স্থিরতা সুন্দর
একটি অন্ধকার মাঠে
আমরা ভীড় করি রাখাল আর শাদা নক্ষত্রের কাছে
যখন হেমন্ত আসে, তখন
ফলের বাগানে শান্ত সমাহিত উজ্জ্বলতা ভর করে
লাল দেয়ালের উপরে আমরা ইতস্তত হেঁটে যাই, আর
আমাদের বৃত্তায়িত চোখ পাখিদের উড়ে যাওয়া দেখে
সন্ধ্যায়, শাদা জল প্রজ্জ্বলিত ভস্মপাত্রে ডুবে যেতে থাকে
পত্রহীন শাখায় আকাশ গম্ভীর
একজন কৃষক তাঁর অমলিন হাতে রুটি আর মদ নিয়ে গৃহে ফেরে
রৌদ্রোজ্জ্বল পাত্রে ফল পেকে ওঠে গভীর প্রত্যয়ে
কী গম্ভীর তাদের অবয়ব, প্রিয় যারা চলে গেছেন গ্রহান্তরে!
তথাপি আমাদের আত্মা তাঁদের অনুধ্যানে আহ্লাদিত হয়ে উঠে [অসমাপ্ত]
ক্যাসপার হাউসার সং
সে সত্যি ভালোবাসত পাহাড়িয়া পথ,
গানের কালোপাখি, আহ্লাদিত সবুজের প্রান্তর, আর
রক্তিমাভ সূর্য যা গেছে অস্ত পাহাড়ের ঢাল বেয়ে।
প্রকৃতই সে গাছের ছায়ায় বাস করত,
এবং তাঁর মুখাবয়ব ছিল অমলিন, শুভ্র
ঈশ্বর তাঁর হৃদয়ে জ্বেলে দিলেন শান্ত আগুন: হে মানব!
সন্ধ্যায়, তাঁর নির্জন পদক্ষেপ দেখেছে নগরীকে
তাঁর মুখাবয়ব জানিয়েছে অন্ধ অভিযোগ;
আমি হতে চাই অশ্বারোহী বাহিনীর একজন
কিন্তু তাঁকে অনুসরণ করেছে ঝোপঝাড় আর পশু-প্রাণি,
বাড়িঘর আর শাদা মানুষের গোধূলির বাগান
এবং তাঁর খুনি খুঁজে ফিরেছে তাঁকে
কী মধুর এই বসন্ত, গ্রীষ্ম, আর হেমন্ত
ধার্মিকদের পাশ কাটিয়ে, তাঁর পদক্ষেপ
সাপ্নিকদের অন্ধকার কুঠুরি পেরিয়ে
রাতের গভীরে, তিনি রয়ে গেলেন নক্ষত্রের সাথে একাকী
দ্যাখেন, কীভাবে তুষার ঝরে পড়ে পত্রহীন গাছের শাখায়,
আর তাঁর খুনির ছায়া অর্ধ-আলোকিত হলের করিডোরে
রৌপ, জন্ম হয়নি এমন নবজাতকের মাথা গেছে ডুবে।
বিশ্রাম ও নির্জনতা
মেষ পালকেরা সূর্যকে শায়িত করেছে নগ্ন অরণ্যে,
আর এক জেলে চুল-বিনুনীর জালে
হিমায়িত পুকুর থেকে চাঁদকে এনেছে তুলে
নীল স্ফটিকে শুয়ে আছে একজন বিবর্ণ মানুষ,
তাঁর মুখাবয়ব ঝুঁকে আছে নক্ষত্রের দিকে
কিংবা তিনি নত করেছেন মাথা বেগুনি ঘুমে
পাখিদের কালো উড্ডয়ন স্পর্শ করে তাঁকে
যিনি ক্রান্তদর্শী, আর নীল ফুলের পবিত্রতাকে;
নিস্তদ্ধতা উজ্জীবিত করে লুপ্ত পৃথিবীকে, বিস্মৃতির দেবদূতীকে
চাঁদের আলোয় ভূতুড়ে পাথরে মুখাবয়ব
অন্ধকারে আচ্ছাদিত হতে থাকে; একজন উজ্জ্বল যুবক হয়েছে
উপস্থিত কোনো এক হেমন্তে— বোনের সম্মুখে, অন্ধ অপরাধে।
বিলাপ
ঘুম আর মৃত্যু, কালো ঈগলেরা
সারারাত মাথার চারিদিকে ঘুরপাক খায়
শাশ্বতের হীমপ্রবাহ
গিলে খাবে মানুষের সোনালী প্রতিমা
তাঁর রক্তিমাভ শরীর
ছিন্নভিন্ন পড়ে আছে ভয়ঙ্কর শৈলশ্রেণীতে
সমুদ্রের বুক জুড়ে
একটি কালো কন্ঠ বিলাপের ধ্বনি
হে নিখিল বেদনার বোন,
দেখ, একটি ভীরু নৌকা ডুবে যায়
নক্ষত্রসমূহের নীচে
রাতের নীরব অবয়ব
[ঋণ স্বীকারঃ কবি এবং অনুবাদক রাজু আলাউদ্দিন এই কবিতাটি অনুবাদ করেছিলেন ১৯৯২ খ্রি। দুই-একটি পঙক্তি ব্যতীত এই কবিতার অনুবাদ কর্মটি মূলত অনুবাদক রাজু আলাউদ্দিনের।] ৪
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী:
[১] Georg Trakl, Marie Jaanus Kurrik, Columbia University Press, New York & London, 1974
[2] Salzburg, Oskar Anrather, Residenz Verlag Press, Salzburg, Vinenna, 1994
[৩] Autumn Sonata, Selected Poems of Georg Trakl (English Translation by Daniel Simko), Moyer Bell Limited, New York, 1989
[৪] গেয়র্ক ট্রাকলের কবিতা, রাজু আলাউদ্দিন অনূদিত, মঙ্গলসন্ধ্যা, ঢাকা, বাংলাদেশ, ১৯৯২