ছেলেবেলায় ঈদের অনুষঙ্গ হিসেবে মুরুব্বি ও গুরুজনদের সালাম করে সালামি নেওয়ার চল ছিল, এখন দ্বিতীয়টির চল অক্ষুণ্ন আছে, ইদানীং ডিজিটাল সালামিও চালু হয়েছে।
Published : 31 Mar 2025, 12:19 AM
ঈদ আমাদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। অবশ্য আমি বাঙালি মুসলমানের কথা ভেবেই বলছি। বাঙালি মুসলমানের জীবনে যে-কটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হতে পারে যা উৎসবের আমেজ নিয়ে আসে তার মধ্যে দুটি ঈদ অবশ্যই পড়ে। জন্মোৎসব এবং বিবাহোৎসব অপর দুটি আনন্দঘন মুহূর্ত। এছাড়া জাতীয় দুয়েকটি ব্যাপারও অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। বর্তমানে অবশ্য নববর্ষ অন্যতম একটি ব্যাপার হিসেবে যুক্ত হয়েছে।
বৃহত্তর পটভূমিতে মুসলমানদের কথা ভাবলে ধর্মীয়ভাবেই ঈদদ্বয় আমাদের প্রধান ধর্মোৎসবের অন্তর্ভুক্ত। এ সম্পর্কে যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। দুটি ঈদ - ঈদুল ফিতর (রোজার ঈদ) এবং ঈদুল আযহা (কোরবানীর ঈদ) - আমাদের ধর্মীয় জীবনে যথেষ্ট গুরুত্ববহ। প্রথমটি এক মাস সিয়াম সাধনা শেষে আনন্দের এক দারুন আবহ সৃষ্টি করে। একথা বলা যেতে পারে, যে-মানুষটি এক মাস যাবৎ দিবাভাগে খানাপিনা বন্ধ রেখে এবং রাত্রিকালে দীর্ঘ নামাজ আদায় করেন, নিয়মিতভাবে করেন, তার জন্য ৩০ দিন পর এই যে আনন্দের অবারিত সুযোগ, সেটা উৎসবের উপযুক্ত বৈকি। বলা হয়ে থাকে, ঈদের আনন্দ তাঁর জন্যই যেন খুব বেশি অন্তর্গত আনন্দের বিষয়। বকরি ঈদে আমরা পশু কোরবানীর মাধ্যমে মনের পশুকে জলাঞ্জলি দেবার সাধনা করি। কিন্তু আনন্দের মাত্রা যেন রোজার ঈদেই বেশি অনুভূত হয়। আমাদের প্রিয় নবিজী কীভাবে ঈদ পালন করতেন, সে-বিষয়ে একাধিক রেওয়াতে বর্ণনা আছে। আমরা জেনেছি, ঈদ মুসলমানদের জন্য কী এক আশ্চর্য ও বিশুদ্ধ আনন্দের অনুষঙ্গ বয়ে আনে। কাজী নজরুলের সেই অমর গান আমাদের আজও আনন্দিত করে -
আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমন হাত মেলাও হাতে,
তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।।
বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ’র কথা যদি বলি, ঈদ উম্মাহর জন্য এক বিশেষ উপহার। যে-দেশটিতেই মুসলমান আছে, সেখানকার মুসলিম নারী-পুরুষই ঈদের আনন্দে অবগাহন করেন। এবং এই আনন্দোৎসবটি নানা ভাষার নানা সংস্কৃতির মানুষকে এক ছাতার তলে নিয়ে আসে, এবং সম্ভবত শুধু ঐ দিনটিতেই। আপনি অন্য সময়ে ভারতীয় ও পাকিস্তানী, বাঙালি ও ইরাকি, মাগরেবের বা ইন্দোনেশিয়ার মানুষকে একই আনন্দে অন্য কোনোদিনই একত্রে সমভাবে আন্দোলিত হতে দেখবেন না, কেবল এই ঈদের দিনটি ছাড়া। উম্মাহ’র রাজনীতির জন্য তাই ঈদের গুরুত্ব কিন্তু রয়েই যায়। এবং সেটা অন্যেরা কিন্তু ব্যবহারও করে। কিন্তু এই গুরুত্বটা আমরা বোধহয় আধুনিক কালে সেভাবে ব্যবহার করতে পারিনি। এর অন্তত একটি উদাহরণ আমরা দিতে পারি। ঈদের দিন নির্বাচন করা নিয়ে আমাদের মতদ্বৈততা আছে। এটা আমরা বিশ্বভ্রাতৃত্বের নিরিখে একইদিনে পালন করার সিদ্ধান্ত নিতে পারি, আবার আমাদের ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা ও বিস্তার এবং জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত মেনে ভৌগোলিক বাস্তবতার সাথে তাল মিলিয়েও একাধিক সময়-বলয়ে নিতে পারি। কিন্তু এটা নিয়ে আমরা বিতর্ক করতে পছন্দ করি, এমনকি এ-বিষয়ে জাতীয় সিদ্ধান্তও আমরা মানতে চাই না।
ছেলেবেলায় ঈদের অনুষঙ্গ হিসেবে মুরুব্বি ও গুরুজনদের সালাম করে সালামি নেওয়ার চল ছিল, এখন দ্বিতীয়টির চল অক্ষুণ্ন আছে, ইদানীং ডিজিটাল সালামিও চালু হয়েছে। ঈদ উপলক্ষ্যে বাসায় বাসায় ফিরনি-সেমাই গোস্ত-রুটি খাওয়ার চল ছিল। এখনও আছে, তবে ঢাকার যান্ত্রিক জীবনে প্রতিবেশীদের বাসায় খাবার পাঠানোর চল সম্ভবত অনেক কমে এসেছে। ঈদ উপলক্ষ্যে প্লেট-ভর্তি সুস্বাদু মিষ্টান্ন আসার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। অবশ্যই পাশের বাসার আন্টির সেমাইটি বেশি খেয়ে ফেললে মায়ের বকুনি নির্ধারিত ছিল - ‘কি বাসারটা ভাল লাগে না, আন্টিরটা ভাল লাগে!’ এই প্রতিবেশী-কেন্দ্রিকতার পরিবর্তে ঢাকার জীবনে একটি অধুনা-অনুষঙ্গ যুক্ত হয়েছে - ‘চল ঈদের সন্ধ্যায় জিসি’তে বসি, কিংবা ‘ধানমন্ডি দুইয়ের নর্থ-এন্ডে আসতে পারবি?’ ফলে পশ কফিশপগুলোতে আপনি ঈদের দিন ও তার দুয়েকদিন পর পর্যন্ত বসবার টেবিলই পাবেন না। এটা স্বাভাবিক আরবান কালচার, কিন্তু এর ফলে আমরা নিকটতম প্রতিবেশিতাকে বন্ধুত্ব দিয়ে প্রতিস্থাপন করছি। দুটোই ভাল, দুটোই স্বাভাবিক সামাজিকতার নির্দেশক, কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে সামাজিক বলয়কে আমরা কিছুটা ক্ষুণ্ন ও সীমিত করে ফেলছি না কি!
ঈদ অবশ্যই একটি প্রধান বাণিজ্যিক আকর্ষণও বটে। ঈদ উপলক্ষ্যে ‘শপিং ক্রেইজ’ বলা বাহুল্য ‘আরব্য-রজনী’র বাগদাদে যেমন ছিল, মোঘল আমলেও ছিল, আজও আছে। নিত্যনতুন পোশাকের বাহুল্য, আমদানী-রপ্তানী, রোজার মাসের খাবার-দাবারের কালিনারি ইন্ডাস্ট্রি, মলগুলোতে উপচে পড়া ভিড়, তারাবির নামাজ পড়া ধর্মপ্রাণ মুসল্লীদের কষ্ট-লাঘবে বিদ্যুতের সরবরাহ নিশ্চিতে জ্বালানি-ক্রয়, সেমাই বিক্রয়ের ধুম, এবং সেইসাথে নকল খাদ্যপণ্যের বিরুদ্ধে সমানতালে ভোক্তাধিকারিক অভিযান পরিচালনা, ঈদযাত্রা-কেন্দ্রিক ট্রান্সপোর্ট-সেক্টর কেন্দ্রিক ব্যবসা, কোরবানীর পশু ব্যবসা, মাঠের ইজারা, - এসবই ঈদ-কেন্দ্রিক বিপুল আর্থনীতিক কর্মকাণ্ডের ইশারা। আমি নিশ্চিত, ঈদ আমাদের জিডিপি’তে একটা বড় উপাংশের সরবরাহ করে, অর্থনীতিবিদরা সেই হিসাব দেবেন।
ঈদের সাহিত্য বিষয়ক কড়চা না-বললে সাহিত্য-সম্পাদক আমাকে দু-কথা শোনাতে পারেন। ‘পূজাসংখ্যার’ আদলে আমাদেরও ‘ঈদসংখ্যা’ হয়, অর্থাৎ নাম-জানা-আছে এমন প্রায় সকল পত্রিকাই তাদের বিশেষ ঈদসংখ্যা প্রকাশ করে থাকে। এটা নিয়ে একটা বড় সাহিত্যিক তোড়জোর শুরু হয়। কোন সম্পাদক কত বড় ক্ষমতাশালী এবং একই সাথে রুচিবান তা বোঝাতে তিনি তাঁর পত্রিকায় তত বেশী সংখ্যক বড়-লেখক ছোট-লেখকের সমাবেশ ঘটিয়ে থাকেন। প্রতিটি ঈদসংখ্যার আবার প্রধান চালিকাশক্তি হল মোটা স্পন্সর সংগ্রহ। যে-পত্রিকা যত বেশি নামীদামী (এর সাথে কাটতির কোনো যোগ নেই) এবং ‘রুচির সম্পদে’ বলীয়ান, তাঁদের স্পন্সরও তেমনি বলিষ্ঠ হন। অনেক সময়ে স্পন্সরের অভাবে উৎসাহী সম্পাদককে হতে হয় ব্যর্থ মনোরথ। প্রসঙ্গত বলে রাখি, একবার আমার একটি লেখা সম্পাদক বাদ দিয়েছিলেন স্পন্সরের বিজ্ঞাপনের পাতা বাড়াতে হবে এই অজুহাতে। পুরোপুরি বাদ। পরে দেখি, শুক্রবারের সাময়িকীতে ছেপে অভিমান লাঘবের চেষ্টা করেছেন। মনে মনে বলেছিলাম, ‘দেখিস একদিন আমরাও’ ইত্যাদি, এখন আমি আর তেমন কোনো ঈদসংখ্যায় লিখি না, আসলে কেউ বলেও না। এখন ঈদসংখ্যা আসলে কজন পড়ে সেটা একটা রহস্য বটে, কিন্তু এহ বাহ্য, দুটো জিনিস খুব ঘটা করে হয়। প্রথমত, একই লেখক হয়ত তিনটি পৃথক পত্রিকার ঈদসংখ্যায় লিখেছেন, কিন্তু পাঠক আর কয়টি সংগ্রহ করবেন? এবং সবচেয়ে মজার কথা, আজকাল ঈদসংখ্যায় উপন্যাসের ড্রাফট প্রকাশের চল উঠেছে। এই ‘ড্রাফট’ পরবর্তী বছরের বইমেলায় ‘ফাইনাল’ হয়ে বই আকারে প্রকাশিত হবেন। এটা কিন্তু একটি মজার ও কৌতূহলোদ্দীপক প্রপঞ্চ! সাহিত্যের ক্রনিকলার যারা আছেন ব্যাপারটা খেয়াল করবেন। দ্বিতীয়ত, ঈদসংখ্যার প্রকাশ উপলক্ষ্যে জম্পেশ ইফতার সমাবেশ ঘটে। এটাও আমাদের জিডিপি’তে হয়ত কিছু যোগ করে, যদি পার্টিগুলি ঢাকা ক্লাবে হয়ে থাকে, ফলে এর আর্থিনীতিক প্রভাব নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল কে কোন পার্টিতে ডাক পেল আর কে পেল না সেটি একটি সাহিত্যিক তাৎপর্য বহন করে। অবশ্য এর প্রভাবটি বিউপনিবেশায়নের প্রত্যক্ষ ফলাফল নাকি চাহিদা-যোগানের আর্থনীতিক সম্পর্ক মেনে হয় নতুবা ভাষিক রাজনীতির নয়া-বন্দোবস্তের অধীনে নাকি পারস্পরিক গাত্রকণ্ডূয়নের অনবদ্য জটিল ম্যাথমেটিকস অনুসরণ করে হয় সে আমি বলতে পারব না। কিন্তু কিছু একটা ঘটে এবং তার উপলক্ষ্য ঈদ।
এই যে এত সব জটিল প্রপঞ্চকে এক করে ফেলেছে সে একমাত্র ‘ঈদ’-এর কারণেই ঘটেছে। উম্মাহ, সিয়াম সাধনা, আনন্দ, গ্লোরিয়া জিনস, জিওপলিটিকস, সাহিত্যিক বন্দোবস্তের নয়া ইশারা, সেমাই-পোলাওয়ের রাজনীতি, সেলামির বিবর্তন, জিডিপি গ্রোথ - ঈদ না-থাকলে এর কোনটা হত বলুন? তাও সব একসাথে?
সবাইকে ঈদ মোবারক, ঈদ কাটুক আনন্দদায়ক চিন্তায় ও খাবারে, প্রিয়জনের সান্নিধ্যে। এতসব ‘রাজনীতি’র বাইরে তবু যদি ফুরসত মেলে তো পড়ুন একটি মজাদার বই। অথবা একটি কবিতা।
কুম্ভগুলোর বাক্যালাপের কোনো এক অবসরে
কে যেন দেখল ঈদের চাঁদটি সুদূর দিগন্তরে,
'ওই ত' আওয়াজ - সুরা পেয়ালার এখুনি মিলবে স্বাদ'
মুহূর্তে কলকণ্ঠ সবাই বললো সমস্বরে।।
-- ওমর খৈয়াম, কুজানামা, অনুবাদ সিকানদার আবু জাফর