দেশে দেশে ঈদ-উল-আজহা

মোস্তাক শরীফমোস্তাক শরীফ
Published : 9 July 2022, 04:35 PM
Updated : 9 July 2022, 04:35 PM


ইসলাম ধর্মের সবচেয়ে বড় দুই উৎসবের একটি ঈদ-উল-আযহা, আমাদের দেশে যেটি কুরবানির ঈদ নামেই বেশি পরিচিত। ইসলামি বর্ষপঞ্জির সর্বশেষ বা দ্বাদশ মাস জিলহজ্ব-এর দশম দিনে এই উৎসব সারা বিশ্বের পালন করা হয়। ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের অন্যতম-পবিত্র হজ্ব পালনের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ায় এ উৎসব ভিন্ন এক তাৎপর্য বহন করে।

ঈদ-উল-আযহা বা কুরবানির ঈদের উৎপত্তির কাহিনী সর্বজনবিদিত। আল্লাহর প্রতি হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর আনুগত্য ও আত্মনিবেদনের পরীক্ষা নেয়ার জন্য তাঁর ওপর নির্দেশ আসে পৃথিবীতে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় যা তাকে উৎসর্গ করার জন্য। হজরত ইব্রাহীম (আঃ) সিদ্ধান্ত নিলেন প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আঃ)-কে কুরবানি করবেন। একেবারে শেষ মুহূর্তে আল্লাহর নির্দেশে ইসমাইল (আঃ)-এর পরিবর্তে একটি মেষ কুরবানি হয়ে যায়। আল্লাহর প্রতি হজরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর সর্বোচ্চ আনুগত্যের স্মারক হিসেবে সামর্থ্যবান মুসলিমদের ওপর পশু কুরবানির নির্দেশ আসে, ঈদ-উল-আজহার অন্যতম প্রধান ধর্মীয় আচারও এটিই।

পৃথিবীর যে প্রান্তেই ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা আছেন, নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী পশু কুরবানির মাধ্যমে দিনটি পালন করেন তাঁরা। পশু কুরবানির পর্বটি পালন করতে হবে ঈদের নামাজের পর। ১০ থেকে ১২ জিলহজ্ব-এই তিনদিনের যেকোনো দিন পশু কুরবানি করা যেতে পারে। পশুটি হতে হবে ভেড়া, মেষ, ছাগল, গরু, ষাঁড় বা উট।



ইয়েমেনের রাজধানী সানা-র এক বাসিন্দা কুরবানির জন্য পশু কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।

বিশ্বজুড়ে ঈদ-উল-আজহা পালনের অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে দরিদ্রদের মধ্যে মাংস বিতরণ, প্রিয়জনদের আপ্যায়ন করা ও উপহার বিনিময়। হজরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে আল্লাহর জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের ইচ্ছার কথাই মুসলিমরা জানান দেন এ উৎসব পালনের মাধ্যমে। কুরবানির মাংস তিনটি সমান ভাগে ভাগ করে এক অংশ নিজের ও পরিবারের জন্য, এক অংশ আত্মীয়স্বজনের জন্য ও বাকি অংশ দরিদ্র মানুষদের মধ্যে বিতরণ করতে হয়।
উপমহাদেশের তিন দেশ-বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে মোটামুটি একই আবহে পালিত হয় এই ঈদ। পশু কুরবানির পর্বটি বাদ দিলে উপমহাদেশীয় সংস্কৃতির অন্যতম একটি অনুষঙ্গ হচ্ছে ঈদ উপলক্ষ্যে নতুন পোশাক পরা, মেয়েরা হাতে মেহেদির নকশা করা এবং সুস্বাদু বিভিন্ন খাবার রান্না করা, যার মধ্যে বিরিয়ানি, ভূনা মাংস, কাবাব ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।


ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ-এর আর রাহমা মসজিদে ঈদ-উল-আজহা উপলক্ষ্যে শিশুদের মধ্যে বেলুন বিতরণ করা হয়।

বিশ্বের অন্যতম মুসলিমপ্রধান দেশ তুরস্কে ঈদ-উল-আজহা 'কুরবান বাইরামি' নামে পরিচিত। সেদেশে চার থেকে পাঁচ দিনের সরকারি ছুটি থাকে এ উপলক্ষ্যে। তুরস্কের যে পশুটি সর্বাধিক কুরবানি করা হয় সেটি হচ্ছে ছাগল। ঈদের দিন পশু কুরবানির নানা আচার অনুষ্ঠানে ব্যস্ত থাকলেও তার পরদিন আত্মী-পরিজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে করেন তুর্কিরা। গল্পগুজবে গোটা রাত কাবার করে দেয়াও স্বাভাবিক ব্যাপার। বাচ্চারা রঙিন পোশাক পরে রাস্তায় রাস্তায় আনন্দ করে। প্রতি বাড়িতেই মাংস রান্না হয়, অতিথি আপ্যায়নের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে সম্পর্ককে ঝালাই করা ও তিক্ততা ভুলে যাওয়ার উপলক্ষ্য এনে দেয় এই ঈদ।

অন্যান্য মুসলিম দেশের মতো ইরানেও জাঁকজমকের মধ্য দিয়ে পালিত হয় এই ঈদ। মাংসের মজার মজার সব পদ রান্না এ ঈদের অন্যতম আচারের মধ্যে পড়ে। এসব খাবারের মধ্যে ইরানীদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে কাবাব ও হালিম। মাংসের এসব পদ ছাড়াও বাগালি (সব্জির তরকারি) ও সজ্বি-পোলাও-ও ইরানিরা পছন্দ করে। আত্মীয়, বন্ধুবান্ধবের বাড়ি যাওয়া এবং গল্পগুজবে সময় কাটানো ইরানিদেরও বেশ প্রিয়। এসময় একজন আরেকজনকে 'হালাল' করার-অর্থাৎ কোনো অপরাধ করে থাকলে ক্ষমা করে দেয়ার অনুরোধ জানায়। ঈদ-উল-আজহা উপলক্ষ্যে সাধ্যমত সৎ কাজ করার চেষ্টা করে ইরানিরা।


আইভরি কোস্ট-এর রাজধানী আবিদজানে ঈদ-উল-আজহার নামাজে এক শিশু

মিশরে এই ঈদ 'ইদ এল-কিবির' নামে পরিচিত। ঈদ-উল-ফিতর-এর চেয়ে মিশরে ঈদ-উল-আজহার তাৎপর্য বেশি বলে ধরা হয়। ঈদের নামাজ ও পশু কুরবানি ছাড়াও আত্মীস্বজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা এবং বড় আকারে পারিবারিক পুনর্মিলনী করা মিশরীয় সমাজের বৈশিষ্ট্য। ঈদের দিন বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা করে 'কল সানা ওয়া ইন্তা তায়িব' কথাটি উচ্চারণ করেন মিশরীয়রা, যার মানে, 'আপনি প্রতি বছর ভালো থাকুন।' মিশরীয়রা কুরবানির মাংস বিতরণকে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। ধনী ব্যক্তি ও দাতব্য সংস্থাগুলো দরিদ্রদের মধ্যে প্রচুর মাংস বিতরণ করেন।

বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ইন্দোনেশিয়া কুরবানির মাংসকে কেন্দ্র করে বড় বড় ভোজ আয়োজনের জন্য বিখ্যাত। যে দুটো খাবার সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় সেগুলো হচ্ছে 'সেইত কাম্বিং' আর 'গুলাই কাম্বিং', দুটোই ছাগলের মাংস দিয়ে তৈরি। ঈদের নামাজ পড়া বা কুরবানি করার পাশাপাশি আত্মীস্বজনের সঙ্গে সম্ভাষণ বিনিময় ও একত্রে সময় কাটান ইন্দোনেশীয় মুসলিমরা। ঈদের ক'দিন আগে থেকে জাকার্তার রাস্তায় রাস্তায় গরু আর ছাগলের খোঁয়াড় দেখা যায়, যেখান থেকে মানুষ তাঁদের পছন্দমত পশু কিনে নিয়ে যান। পার্শ্ববর্তী দেশ মালয়েশিয়ায় ঈদ-উল-আজহা 'হারি রায়া কুরবান' নামে পরিচিত।