'আ মরি বাংলা ভাষা'র রূপ দর্শন

ধর্মীয় গোঁড়ামিজনিত কারণে বাংলাকে বহুবার বহুলোক অত্যাচার নির্যাতন করেছেন। বাংলার তাতে কচু হয়েছে।

সেঁজুতি জাহানসেঁজুতি জাহান
Published : 20 Feb 2024, 06:22 PM
Updated : 20 Feb 2024, 06:22 PM

বিয়ের অনুষ্ঠানে অভ্যর্থনার সময় আমার এক ননদের শাশুড়িমা এসেছিলেন আমার শ্বশুরবাড়িতে। একদিন আমি একটা ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছি, ভদ্রমহিলা আমাকে পেছন থেকে বলছেন,  'বৌ চাই চাই'। ভদ্রমহিলা কী চাচ্ছেন জিজ্ঞেস করছি দেখে আমার শ্বশুরবাড়ির মেয়েরা মিলে বেশ মজা করছিলো। 

পরে আমার শাশুড়িমা বুঝিয়ে বললেন এই 'চাই' মানে 'দেখা'। এবং তাঁর লক্ষ্যবস্তু আমি নই, আমাকে মাড়িয়ে অন্য কিছু। তাই তিনি 'বৌ চাই চাই' করছিলেন। আমাদের এলাকায় এই কথা বলা হতো 'বৌ দেখি সরোতো' -এই ধরনের বাক্যের মধ্যে দিয়ে। 

আমাদের এলাকার ভাষাকে কিছুটা প্রমিতের কাছাকাছি মনে হলেও অনেক বাক্য, ভঙ্গি আছে যার সঙ্গে আপোষহীন প্রমিতাচারীরা কিছুতেই যুক্ত হতে পারবেন না।  যেমন: 'ফ্যাৎ কইরে চইলে আয়', 'আউনরোক্কো দে তলায়ে গেছে দ্যাশ'। প্রমিতাচারীদের কিছুতেই বোঝার কথা নয়। তবু আমরা বলি নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময়। যেরকম আমার ননদের শাশুড়িরা বলেন।

উপর্যুক্ত ঘটনায় দুটি বিষয় স্পষ্ট।  

এক. অধিক জনগোষ্ঠীর কাছে প্রচলিত ভাষার শক্তি সংখ্যা লঘুদের থেকে বেশি।

দুই. যে ভাষা যতো বেশি মানুষের মুখে চলে সে ভাষার শক্তি ততো বেশি।

এই জন্যই দেখেন না ইংরেজির কতো দাপট?

আজকাল প্রমিত বা মান বাংলা আর আঞ্চলিক বা মাতৃভাষা নিয়ে ব্যাপক ও দুর্ভাগ্যজনক লড়াই হতে দেখি চারপাশে।

আবার 'রাষ্ট্রভাষা'কে অনেকেই 'মাতৃভাষা' বিবেচনা করে আরেক প্রস্থ বিতণ্ডা করে বেড়ায়। যেগুলোর কোনোপ্রকার প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে হয় না।

প্রমিত বা মান বাংলা হচ্ছে  রাষ্ট্রের সবাই বোঝে এমন একটা ভাষা। সবার যোগাযোগের একটি মাধ্যম। যেমন: আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজি। অন্যদিকে বাংলাকে মাতৃভাষা বলা যায় স্রেফ উর্দুর সাপেক্ষে। এখন কেউ কেউ মহিষের শিং দুলিয়ে দুলিয়ে এসে বলতেই পারেন বাংলার কারণে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের প্রস্তাব পাস হয় ২০১০ সালে, এখানে উর্দু আসলো কীভাবে? 

হ্যাঁ আসলো এবং আসবেই। কেননা আসমান থেকে কোনো ভাষা নাজিল হয় না। এমনকি বাইবেল আর কুরআনকেও মানুষের মধ্যে চর্চিত বহুদিনের প্রতিষ্ঠিত ভাষার মধ্যেই ঢুকতে হয়েছিলো। আঁৎকা নতুন কোনো সাংকেতিক ভাষায় এগুলো নাজিল হয়নি। এমনকি হলিউডের 'অ্যারাইভাল' মুভিতে প্রদর্শিত এলিয়েনদের মতো পাঠানো নতুন কোনো সাংকেতিক হরফও কেউ ওইসকল পবিত্র ওহির সঙ্গে পাননি। ফলে মানুষের ভাষার অতীতটা জানা এবং বোঝা জরুরি। তাতে ভাষার মর্যাদা রক্ষা করা যায়। ভাষার মর্যাদা রক্ষা মানে আবার কেউ যেন মিউটেশনবিহীন শব্দভাণ্ডারকে না বোঝেন। কালস্রোতে শব্দের মিউটেশন হয়, কোনো কোনো শব্দ যুক্ত হয় আবার বাতিল হয়, তাতে ওই ভাষার কিছু যায় আসে না। 

বাংলার ঐতিহ্য ইতিহাসে এক রক্তক্ষয়ী পর্ব রয়েছে, সেটাকে বাদ দেয়া চলবে না। 

১৯৫২ সালের 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা' মানে উর্দু মিডিয়ামের সাপেক্ষে পূর্ব বাংলা প্রদেশের শিক্ষার মাধ্যম হবে মান বাংলা। যেই লড়াইটা এখনও কলকাতায় জারি আছে। আর দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, মাধ্যম হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করার লড়াই এখনো এই বাংলাদেশেও বহাল আছে। এটা একেবারেই ঐতিহাসিক ভাষা-সংস্কৃতির মামলা। আর প্রকৃত 'মাতৃভাষা' হচ্ছে যার যার নিজের অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা।

তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা তাহলে কেন বলা হচ্ছে?

বলাই উচিত। কেননা প্রতিটি ভাষা-গোষ্ঠীর একটা নির্দিষ্ট ও নিজস্ব মান ভাষা থাকবে, থাকতেই হয়। পূর্ব বাংলার মান ভাষা এজন্য প্রমিত বাংলা। এবং গোটা পাকিস্তানের সাপেক্ষে এটা এই অঞ্চলের মাতৃভাষাই। 

তাহলে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল ভাষা হবে মান বাংলা বা প্রমিত বাংলা। রাষ্ট্রের অফিস আদালত এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দাপ্তরিক ভাষা হবে একমাত্র মান বাংলা। কেননা এসবের সঙ্গে ভাষার লিখিত দলিলের ব্যাপার স্যাপার জড়িত, একই সঙ্গে সবাইকে সে ভাষা সমানভাবে বুঝতেও হবে। না হলে একটা দুর্বোধ্য ভাষা দিয়ে আস্ত রাষ্ট্রের কাজ কী করে চলবে? এছাড়া অধিক জনগোষ্ঠীর ভাষা হিসেবে একটি ভাষা প্রতিষ্ঠিত হলে সেটার শক্তির দিকটিও তো লক্ষ করার বিষয় আছে। আমরা একটু চীন, জাপানের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবো সেটা। তাদের রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য একটি মান ভাষা আছে, যেটার গুরুত্ব তারা ইংরেজির দাপটের মুখেও অক্ষুণ্ণ রাখতে পেরেছে। তার মানে এই নয় যে তাদের অঞ্চলভিত্তিক ভাষাগুলোকে তারা বিলুপ্ত করে দিয়েছে। এই ব্যাপারটা আমাদের বোঝা জরুরি যে রাজধানীর মতো একটি দেশের একটি ভাষাও থাকবে। সেটার মর্যাদা রক্ষা করার দায় রাষ্ট্রেরও যেমন থাকে, রাষ্ট্রের প্রতিটি জনগণেরও থাকে।

আমাদের এই প্রমিত বাংলার রাষ্ট্রে চাকমা, মারমা,খাসিয়া, নোয়াখালি, সিলেটি বা বিক্রমপুরের  ভাষায় লোকজন তাদের মনের যাবতীয় আলাপ সালাপ সারে। এটা একান্ত মানুষের বেড়ে ওঠা কালার এন্ড হ্যাবিটেশনের মামলা। এখানে কারো আধিপত্যমূলক হস্তক্ষেপ কাম্য না।

 একটি আনুষ্ঠানিক মঞ্চে লোকে যদি প্রমিত ও অপ্রমিত বা আঞ্চলিক ভাষায় বক্তৃতা করে সেক্ষেত্রেও দোষের কিছু হবে না বলে মনে করি, যদি সেখানকার আম-জনতা বক্তার সংকর ভাষা বুঝে থাকে। যদি না বোঝে তো সেটার দায় নিতান্তই বক্তার, কিছুতেই তার মাতৃভাষা বা আঞ্চলিক ভাষার নয়।

আমাদের এখানে অপ্রমিতে কথা বলাকে বেশ হেয় করে দেখা হয়। অনভিজাত ভাবা হয়। এ জন্য বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ খুব জোর করেই প্রমিতকে মুখের ভাষা করে নিতে চান। অনেক চেষ্টা তদবির করে আয়ত্তও হয়তো করেন। অনেকে পারেন না। শত চেষ্টায়ও তাদের অনায়ত্ত প্রাক-প্রমিত ভাষা শুনলে প্রমথ চৌধুরীর কথা মনে পড়ে। মনে হয় এরা মুখে কালি মাখিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেটাও অবশ্য দোষের নয়। একটু অদ্ভুত লাগে আরকি! মানব-জন্মের তো অদ্ভুতভাবে বিচরণ করবার অধিকার আছে। আছে না? তবে সেটা কিছুতেই ভাষার একটি কাঠামো পদ্ধতির অংশ হয়ে উঠতে পারে না। সুদূরবিস্তৃত শেকড়সমৃদ্ধ ভাষা-বৃক্ষের একটি বিচিত্র রঙের(পড়ুন রঙ্গের) পল্লব হতে পারে বড়োজোর।

ভাষার মূল কাজ কী তাহলে?

ভাষার শুধু মূল কাজ নয় বরং একমাত্র কাজই হচ্ছে যতো সহজে সম্ভব তুলনামূলক অধিক জনগোষ্ঠীকে নিজের কথাটা বোঝানো। না বোঝাতে পারার কষ্ট জীবনের সব থেকে বড়ো কষ্টরে ভাই! মূলত মানুষের জীবনের সংকটগুলোর মূলে রয়েছে 'অপর'কে কথা বোঝাতে না পারার সংকট। এটা মানুষের নিয়তিতে দুর্ভাগ্যের মতো লেপ্টে থাকে।

এর উপরে আবার একটা গোষ্ঠী প্রমিতকেও অকাজের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রতিনিয়ত উঠে পড়ে লেগে যান। নারে ভাই, ভাষা এভাবে জবরদস্তি পন্থায় কখনোই কাজ করে না। পৃথিবীর কোনো ভাষাই করে না।

ভাষা একেবারেই দ্বিপাক্ষিক সঙ্গম-সুখের বিষয়। অর্থাৎ যার যা নাম তাকে তো তা দিয়েই বোঝাতে হবে, নাকি? শরীফকে ডাকতে গিয়ে শরীফার নাম আপনি নিশ্চয়ই নেবেন না। দেখতে শরীফ কিন্তু নাম শরীফা সেক্ষেত্রে হয়তো নেবেন। কিন্তু যার যা নাম তাকে তো সে নামেই ডাকতে হবে, না হলে সে ডাক শুনবে কেন?

ধর্মীয় গোঁড়ামিজনিত কারণে বাংলাকে বহুবার বহুলোক অত্যাচার নির্যাতন করেছেন। বাংলার তাতে কচু হয়েছে। ভাষা এমন এক জিনিস যাকে কোনোদিন কোনো একক সূত্র ধরে টিকিয়ে রাখা যায় না। ভাষার মতো পলিসেন্ট্রিক চরিত্র পৃথিবীর আর কোনো সেক্টরে আপনি পাবেন না। আপনি যদি পবিত্র ইজমের মানুষ হন, মানে সব জায়গায় পাপ-পুণ্য খুঁজে বেড়ান তাহলে ভাষা একটা অত্যন্ত চরিত্রহীন বিষয় হয়ে উঠবে আপনার কাছে। ভাষার পবিত্রতা বলে জগতে কিচ্ছু নাই। তবে এর মানে এই নয় যে, বক্তব্যও অপবিত্র৷ একটি 'বারোভাতারি' ভাষায় লেখা ভক্তিমূলক বক্তব্য কিন্তু মানুষের মধ্যে পবিত্র অনুভূতি জাগাতে পারে।

এটাও ভাষার আলাপে থাকবে, কিন্তু একটি ভিন্ন বিষয় হিসেবে।

ধরুন, আপনি 'চন্দ্র'কে ঠিকঠাক মতো না ডেকে যদি 'চাঁদ' ডাকেন তাতে কোনো সমস্যা নাই। প্রমিত বা অপ্রমিত কোনোটাতেই নাই। কিন্তু 'দরজা' 'জানালা' তো আটকে রেখে আপনি 'চন্দ্র' বা 'চাঁদ ' কোনোটাই দেখতে পারবেন না। পারবেন?

 এখন আপনি যদি মনে করেন আপনি আরবি ফারসি পরিত্যাগ করে বিশুদ্ধ সংস্কৃতপন্থী হয়ে বড়োজোর তদ্ভবরূপে মুগ্ধ হয়ে 'চাঁদ' দেখবেন। কিন্তু সেটার জন্য তো আপনাকে অবশ্যই 'দরজা'(ফারসি শব্দ) দিয়ে বের হতে হবে।  অথবা 'জানালা'(আরবি)টা খুলতে হবে। আরবি ফারসি ব্যবহারের ভয়ে যদি আপনি জানালা দরজা না খুলে 'ঘরে'(বাংলা) বসে থাকতে চান। তাহলেও আপনাকে সেই 'গৃহবন্দী'ই বলবে লোকে। আর কে না জানে 'গৃহ' সংস্কৃত হলেও 'বন্দী' কিন্তু ফারসি শব্দ। আবার সংস্কৃত ও বিদেশি শব্দ পরিত্যাগ করে বিশুদ্ধ ইসলামী ধর্মভাষায় যদি কথা বলতে চান, অর্থাৎ আরবি ফারসি নির্ভর হতে চান সেক্ষেত্রেও  ব্যাপক ঝামেলা। 'আপেল', 'আনারস'(বিজাতীয় ও বিধর্মী শব্দ ব্যবহার না করে) না খেয়ে আপনাকে শুধু 'খেজুর' 'খুরমা', 'আখরোট' খেয়ে থাকতে হবে। ধরুন মৌসুমী রসসর্বস্ব ফলের এই দেশে 'ফজলি'(আরবি 'ফজল' শব্দ থেকে ফজলি এসেছে, ফজল অর্থ পুরস্কার, যদি বলি ফজলি হচ্ছে আমগাছের যত্নের পুরস্কার, ভুল হবে কি?) 'আম'(যার উৎপত্তি সংস্কৃত আম্র থেকে) না খেয়ে শুধু খুরমা খেয়েই মধুমাস পার করতে পারবেন? শুধু 'ফলজি' তো কেউ বলে নারে ভাই। ফজলি আমই তো বলে সবাই।

সুতরাং ভাষার ছুতমার্গ বজায় রাখার কোনো উপায় নাই কিন্তু আপনার হাতে। কারণ, ওই যে বলেছিলাম না, ভাষা হচ্ছে দ্বিপাক্ষিক সঙ্গম-সুখের ব্যাপার। আপনার ইচ্ছাকৃত  উচ্চারিত শব্দের সঙ্গে প্রচলিত শব্দভাণ্ডারের এক ধরনের সঙ্গমই হচ্ছে। সেটা জবরদস্তিমূলক হলে আপনার ভাষার স্বস্তি-সুখ বিয়োজিত হতে বাধ্য।

আবার আরেকটি সংকট দেখছি আজকাল। ভাষার সংক্ষেপায়ন। মানে ধরুন ইয়াং পোলাপান আজকাল ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করছে, আবার ইংরেজি বাংলা মিলিয়ে বা না মিলিয়ে শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপও ব্যবহার করে নিচ্ছে আজকাল। ফেসবুকীয় নানান শব্দ যেমন : নকানো, পোস্টানো, ব্রো., সিস., প্রো., 'কী একটা অবস্থা'কে সংক্ষেপে বলছে 'ক্যাক্টাবস্থা' এরকম ভুরি ভুরি শব্দ ও বাক্যের সংক্ষিপ্তায়ন আমরা হরদম দেখে বেড়াচ্ছি। মুরুব্বিদের চোখে এসব শব্দ চক্ষুশূল হয়ে উঠছে। কিন্তু তাঁরা নিজেরাই কিন্তু নিজেদের বর্তমানকে অতীত(অতি+ইত) করে দিচ্ছেন। তারা পণ করেছেন ছোটোদের সঙ্গে কিছুতেই মতৈক্যে(মত+ঐক্যে) আসবেন না। কেননা এই পৃথিবীতে ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সবাই মনে করেন তাদের শেখার বয়সেই তারা শ্রেষ্ঠটা শিখে নিয়েছেন। 'ভাষা' জগতের ঘূর্ণায়মান একইরকমের নতুন কোনো শিক্ষা তারা গ্রহণ করবেন না। তারাই শ্রেষ্ঠ, ক্ষেত্র বিশেষে সর্বশ্রেষ্ঠ। উরে বাপরে! অথচ নিজেরাই কিন্তু তাদের ভাষার মধ্যে সন্ধি, প্রত্যয় আর সমাসের মাধ্যমে শব্দকে সংক্ষিপ্ত করে দিব্যি তাদের ভাষিক কার্যক্রম চালাচ্ছেন। তারা তাদের নয়ন(নে+অন,সন্ধিবদ্ধ শব্দ)কে একটুও মেলে না ধরে অন্ধ-ডাকাতের(ডাক্ + আইত, প্রত্যয়জাত শব্দ) মতো আচরণ করে বেড়ান। খেয়াল করেন 'অন্ধ-ডাকাত'(কর্মধারয় সমাস)ও কিন্তু সমাসবদ্ধ শব্দ।

তাহলে কী দাঁড়ালো?

শব্দের সংক্ষেপায়ন কিন্তু সবাই যে যার মতো করে চলেছে। আবার মানতেও চাচ্ছে না কেউ। এখন আমি যদি আপনাকে কোনো কিছু 'ট্যাগ' করার জন্য বকা দিতে চাই এবং সেটাকে যদি এভাবে বলি: আমাকে এভাবে 'ট্যাগানোর'(ট্যাগ করার) কারণ কী?  তাহলে কী সমস্যা? এই বাক্যে আমি তো কোনো ভুল পাচ্ছি না। উপরন্তু আমাদের যোগাযোগের বাংলাকে যথেষ্ট স্মার্ট করে তুলেছে।

সংক্ষেপে হোক আর বিস্তারিত হোক, ভাষার কাজ ব্যক্তি বা সমষ্টির কথাটা তার অডিয়েন্সের সামনে সহজ ও বোধগম্য  করা। 

রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'বাংলাভাষার পরিচয়' এর 'ভূমিকা'য় বলছেন-

"ইতিহাসের যে বিপুল পরিবর্তনের শাখা-প্রশাখার মধ্য দিয়ে আদিযাত্রীরা চলে এসেছে তারই প্রভাবে সেই শ্বেতকায় পিঙ্গলকেশ বিপুলশক্তি আরণ্যকদের সঙ্গে এই শ্যামলবর্ণ ক্ষীণ-আয়ু শহরবাসী ইংরেজ রাজত্বের প্রজার সাদৃশ্য ধূসর হয়েছে কালের ধূলিক্ষেপে। কেবল মিল চলে এসেছে একটি নিরবচ্ছিন্ন ভাষার প্রাচীন সূত্রে। সে ভাষায় মাঝে মাঝে নতুন সূত্রের জোড় লেগেছে, কোথাও কোথাও ছিন্ন হয়ে তাতে বেঁধেছে পরবর্তী কালের গ্রন্থি, কোথাও কোথাও অনার্য হাতের ব্যবহারে তার সাদা রঙ মলিন হয়েছে, কিন্তু তার ধারায় ছেদ পড়ে নি। এই ভাষা আজও আপন অঙ্গুলি নির্দেশ করছে বহুদূর পশ্চিমের সেই এক আদিজন্মভূমির দিকে যার নিশ্চিত ঠিকানা কেউ জানে না।"

যে ভাষার ঠিকানা কেউ জানে না সেই ভাষাকে পবিত্র বা শুদ্ধতম রূপ বিচার করে এইসব আজাইরা লড়াই আমরা কেন লড়তে যাবো বলেন দেখি?

আমার প্রায়ই বাংলা একটা শব্দ বানানের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়। সেটা হলো : 'আটঘাট'। আমি 'আঁটসাঁট'-এর সঙ্গে 'আটঘাট' মিলিয়ে ফেলি। তো এরকম সমস্যার সমাধান খুঁজতে গিয়ে শব্দের ইতিহাস খুঁজে পেলাম। পরিচ্ছন্ন হলাম বানান সম্পর্কে। 'আটঘাট' হচ্ছে তবলার আটটি ঘাট টিউনিঙের পরে সুর-সংযোগের পূর্ণ প্রস্তুতি। 'আটঘাট বাঁধা' এখন আর 'আঁটসাঁট' -এর পথে হাঁটে না।

আমরা আটঘাট বেধে বাংলা ভাষা রক্ষার লড়াই করার চেয়ে নিজেদের ভাষায় বিজড়িত বহু শব্দের অতীত ইতিহাস ও ব্যাবহারিক অর্থ সম্পর্কে একটু জানার চেষ্টা করি না। দেখি আমার বাংলাকে আমি কতোটুকু চিনতে পারি!