এইটুকু বুঝি যে ওমর আলী কবিতাকে মিছিল করতে পাঠাননি, রাজপথে স্লোগান দিতে পাঠাননি।
Published : 13 Oct 2022, 10:12 PM
এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি,
আইভি লতার মতো সে নাকি সরল, হাসি মাখা;
সে নাকি স্নানের পরে ভিজে চুল শুকায় রোদ্দুরে,
রূপ তার এদেশের মাটি দিয়ে যেন পটে আঁকা।
সে শুধু অবাক হয়ে চেয়ে থাকে হরিণীর মতো
মায়াবী উজ্জ্বল দুটি চোখে, তার সমস্ত শরীরে
এদেশেরই কোন এক নদীর জোয়ার বাঁধভাঙা;
হালকা লতার মতো শাড়ি তার দেহ থাকে ঘিরে।
সে চায় ভালবাসার উপহার সন্তানের মুখ,
এক হাতে আঁতুরে শিশু, অন্য হাতে রান্নার উনুন,
সে তার সংসার খুবই মনে প্রাণে পছন্দ করেছে;
ঘরের লোকের মন্দ আশংকায় সে বড় করুণ।
সাজানো গোছানো আর সারল্যের ছবি রাশি রাশি
ফোটে তার যত্নে গড়া সংসারের আনাচে-কানাচে,
এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর এ ব্যাপারে খ্যাতি;
কর্মঠ পুরুষ সেই সংসারের চতুষ্পার্শ্বে আছে।
[এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি, ১৯৬০]
ওমর আলী মানেই, আমার কাছে, শুদ্ধ সরল অতল গভীরতা।
প্রথম বাক্যেই চূড়ান্ত মতামত জানিয়ে দিলে আর আলোচনার কিছু থাকে না। আসলেই তো প্রকৃত কবিতা নিয়ে আলোচনার কিছু নেই। আলোচনা সম্ভবও নয়। প্যারিসে বিশ্ব কবিতা কংগ্রেসে কবিতা নিয়ে বলতে উঠে বরিস পাস্তেরনাক বলেছিলেন-- ‘কবিতার আসন সবসময় সর্বোচ্চ গিরিচূড়ায়’-- আল্পস থেকেও অনেক উঁচুতে। অথচ কবিতার উৎস আমাদের পায়ের তলায় ঘাসের মধ্যে, শুধু কাউকে মাথা নিচু করে দেখতে হবে আর মাটি থেকে তুলে নিতে হবে। এই বিষয়টি এতই সরল যে সভায় আলোচনা করার মতো নয়।’
সভায় তো বটেই, কাগজের পাতায় বা কম্পিউটারের কী-বোর্ডেও আলোচনা করার মতো নয়।
তাহলে কী করা হয়?
আসলে ওমর আলীর কবিতার আলোচনার নামে নিজের অনুভূতি জানানো যেতে পারে। আর কবিতা পাঠের সময় তা সহৃদয়হৃদয়বেদ্যতার সাথে যেভাবে মোলায়েম আরামদায়ক পোশাকের মতো আমাকে জড়িয়ে ধরে, সেই ছোঁয়ায় আচ্ছন্নতার কথা বলা যেতে পারে। কবিতা পড়তে গিয়ে আমি কোনো একটি ছবি দেখেছি, কিন্তু তা আলোছায়ার খেলায় এতই অস্পষ্ট যার বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়।
ওমর আলী আমার কাছে একটি অত্যাশ্চর্য উদাহরণ--বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে। জীবনভর কবিতাযাপন অনেকেই করেছেন। কিন্তু সার্বিকভাবে কবিতাযাপন? আর কেউ কি আছেন ওমর আলীর মতো? তাঁর আগে, সমকালে, পরে? বাংলাদেশে এমন কোনো কবি আছেন যাকে বিএনপি-আওয়ামী লীগের রাজনীতি স্পর্শ করেনি? বাম বা ডানের রাজনীতি স্পর্শ করেনি? কেউ-ই পারেননি পাশ কাটাতে। কিন্তু ওমর আলী পেরেছেন। রাজনীতিটাকে রাজনীতির খেলোয়াড়দের হাতে ছেড়ে দিয়ে তিনি কবিতাতেই ডুবে থেকেছেন।
এমনকি সাহিত্য বা কবিতার যে রাজনীতি আছে, যা বাইরের রাজনীতির মতোই নোংরা, তা থেকেও তিনি নিজেকে সরিয়ে রেখেছেন আমৃত্যু। কেমন করে পারলেন তিনি? সমকালের কোনো কবি সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে চাইতেন না। করেনই নি বলা চলে। প্রতিক্রিয়া হিসাবে তাঁকেও যে অন্যরা আলোচনার বাইরে রাখবেন, নৈঃশব্দের ষড়যন্ত্রের শিকার হবেন তিনি, (এবং হয়েছেনও তাই)-- এসব নিয়েও কখনো বিন্দুমাত্র ভেবেছেন বলে মনে হয় না। কবিরা কত রকমের সম্মেলন-সমাবেশ-দল-উপদল গঠন করেন, ওমর আলীকে কেউ কোনো গ্রুপে টানতে পারেনি।
কিভাবে পারলেন তিনি?
আন্দাজ করতে পারি, তাঁর এই সক্ষমতার পেছনে ছিল কবিতা ছাড়া বাকি সবকিছুর প্রতি নির্লিপ্ততা।
তিনি তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে। তখন এস্টাবলিশমেন্ট তৈরি হতে শুরু করেছে এই বঙ্গভূমিতে। পাকিস্তান সরকার নিজেদের অনুগত কবিদল তৈরি করছে, আদমজী এবং আরো কিছু প্রতিষ্ঠান তাদের পুরস্কৃত করছে, পরিপোষণ করছে। বিপরীতে নতুনভাবে সংগঠিত হচ্ছে রাগী, সমাজপরিবর্তনকামী লেখক-কবির দলও। আরো একটি দল ছিল। তারা কলাকৈবল্যবাদী। শিল্পের জন্য শিল্প আন্দোলন। কিন্তু ওমর আলী কোথাও নেই। তারপরেও তিনি এইদেশের একজন অপরিহার্য কবি। কীভাবে করতে পারলেন তিনি এই অসাধ্যসাধন?
০২.
একদিন একটি লোক এসে বললো, “পারো?’
বললাম, ‘কি?’
‘একটি নারীর ছবি এঁকে দিতে,’ সে বললো আরো,
‘সে আকৃতি
অদ্ভুত সুন্দরী, দৃপ্ত, নিষ্ঠুর ভঙ্গিতে
পেতে চাই নিখুঁত ছবিতে।’
‘কেন?’ আমি বললাম শুনে।
সে বললো, ‘আমি সেটা পোড়াবো আগুনে।’
[‘একদিন একটি লোক’, এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি, ১৯৬০]
অন্যতম একটি কারণ, তিনি চিরকাল নির্ভর করেছেন, আস্থা রেখেছেন বাঙালির চিরায়ত আখ্যানের ওপর।
হাজার বছর বয়সী একটি জাতির আখ্যান আসলে সেই জাতির সত্যিকারের প্রাণস্পন্দন। সেই প্রাণস্পন্দন কোনোদিনই লুপ্ত হয়নি বাঙালির। সমাজের ওপর তলার মানুষকে আপাতদৃষ্টিতে সবকিছুর নিয়ন্ত্রক মনে হলেও জাতিকে ধারণ করে রাখে অন্ত্যবাসী কর্মীসমাজ। ইউরোপীয় শিক্ষা তথা সাহিত্য-সংস্কৃতির আগ্রাসন সেই তলা পর্যন্ত পৌঁছুতে পারেনি। আবার তারও আগে তুর্কী আগ্রাসনও এই পর্যন্ত শেকড় বিছাতে পারেনি। ব্রিটিশ যুগে শরীয়তপন্থীদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি আমাদের অনেক ঋণ। কিন্তু এই শরিয়া আন্দোলনও পরাজিত হয়েছে প্রকৃতিনিষ্ঠ বাঙালির আখ্যানকাব্যের শরীরে ফাটল ধরাতে। শেষ পর্যন্তও বাঙালির আখ্যান তাই ধর্মনিরপেক্ষই থেকে গেছে, এবং গড়ে দিয়েছে আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত। ধর্মনিরপেক্ষতার চাইতেও শক্তিশালী একটি ধারা রয়েছে বাঙালির আখ্যানের। সেটি হচ্ছে সর্বধর্মের সমন্বয়বাদী আখ্যান। পৃথিবীর ইতিহাসে এর কোনো তুলনা পাওয়া যাবে না। বাঙালি তার মাটিতে আশ্রয় দিয়েছে আর্যদের, শক-হুন-মোগলদের, পাঠানদের, বৌদ্ধ-জৈনদের, তুর্কী-ইরানী-আরবীয়দের। তাদের দিয়েছে নিজের থালার অন্ন-ব্যঞ্জনের ভাগ, নিজের সংস্কৃতির সাথে মিলিয়ে নিয়েছে তাদের, নিজের ধর্মপরায়ণতার সাথে সাংঘর্ষিক হতে দেয়নি অতিথিদের ধর্মবিশ্বাসকে। তাই সকল ধর্মবিশ্বাসের বাইরের আবরণটিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে খুঁজে নিতে হয়েছে ভেতরের অন্তর্নিহিত আদর্শটিকে। সেখান থেকে যেসব অভিন্ন উপাদান সংগৃহীত হয়েছে-- যেমন সকল মানুষের প্রতি ভালোবাসা, প্রকৃতির সাথে সহাবস্থান, অন্যের ধর্মাচরণে বাধা না দেওয়া, নির্বাণ বা প্রশান্তির জন্য ধর্ম-অবলম্বন-- এই সবগুলিকে নিয়ে তৈরি করেছে অভিন্ন ধর্মবিশ্বাসের কথকতা-কাব্য-পাঁচালী-পুঁথি। বিভেদের বিভ্রান্তি এসেছে কখনও কখনও, কিন্তু সমন্বয়ের সাফল্যই শেষকথা। আর আছে ভালোবাসা। ব্যক্তির জন্য ভালোবাসা, কৌমের জন্য ভালোবাসা, যে কাছে আসছে তার জন্যই ভালোবাসা, বৃক্ষের জন্য, বৃষ্টির জন্য, পিঁপড়ের জন্য, পাখির জন্য, মাছের জন্য, গায়ে পরশ বুলিয়ে বয়ে যাওয়া ঝিরঝিরে বাতাসের জন্য, প্রাণদায়ী বৃষ্টির জন্য, বিপাকে পড়া শত্রুর জন্যও, আর সর্বোপরি গর্ভধারিণী এবং হৃদয়ধারিণী মায়েদের জন্য। লিখিত হয়নি এইসব আখ্যান। রচিত হয়েছে কৌমের কোনো প্রাজ্ঞ বৃদ্ধ বা তরুণের মুখে, সঞ্চিত এবং পরিশীলিত হয়েছে বুকের মধ্যে, তারপর সঞ্চারিত হয়েছে মুখের বয়ান হিসাবে আরেকজনের কাছে, পরবর্তী জন ধারণ করেছে সেই আখ্যানকে, পুষে রেখেছে বুকের মধ্যে, তারপর ছড়িয়ে দিয়েছে পর্যটনে গিয়ে, পশুশিকারে গিয়ে, মৎস্যশিকারে গিয়ে, কৃষিক্ষেত্রে গিয়ে, ‘জলকে চল’তে গিয়ে, নাইয়রে গিয়ে। মুখে মুখে সৃষ্টি, বুকে বুকে সঞ্চয়ন, বুকে বুকে বহন, মুখে মুখে সঞ্চালন-- এই প্রক্রিয়ায় হাজার বছর ধরে সৃষ্টি হয়েছে এবং বাহিত হয়ে এসেছে বাঙালির আখ্যান। বিদেশী আগ্রাসন পারেনি এইসব আখ্যান বন্ধ করতে, উপনিবেশিকতা পারেনি এসবের প্রবাহ রুদ্ধ করতে। মধ্যবিত্ত এবং ওপরের তলার বাঙালির একটা অংশ শাসকের সাথে তাল মিলিয়ে ইংরেজ হতে চেয়েছে, পাঞ্জাবি হতে চেয়েছে, তুর্কী হতে চেয়েছে, পারসী হতে চেয়েছে, আরবী হতে চেয়েছে। কিন্তু আবহমান বাঙালিত্ব রয়ে গেছে সেই আগের জায়গাতেই অনড়, অপাপবিদ্ধ। বাঙালির সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছে এই আগ্রাসী এবং ভিখারি মানসিকতার বাইরে বসেই। সেই সংস্কৃতি শেষ পর্যন্ত পুষ্টি জুগিয়েছে বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে। চিরায়ত আখ্যানের সাথে যুক্ত হয়েছে বাঙালির মুক্তির আখ্যান।
ওমর আলীর কবিতা এই আখ্যানগুলিকে ধারণ তো করেছেই, সেইসাথে এগিয়ে নিয়ে গেছে আরো দূরে। ভবিষ্যতের বাঙালি পথচলার দিশা খুঁজে পাবে অন্য কয়েকজনের সাথে ওমর আলীর কবিতা থেকেও।
০৩.
অরণ্যের মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে একলা দুপুরে
দেখলাম, একটি লোক বসে আছে দূরে
একটি গাছের নীচে, যত্ন সহকারে
কি যেন দেখছে তার হাত দুটো নেড়ে বারে বারে।
পরনে ছিন্ন বেশ, এলামেলো দীর্ঘ চুল বিশুষ্ক, মাথায়,
অস্থির পুরুষ এক মনে হলো, আমাকে দেখেই ইশারায়
ডাকলো নিজের কাছে আদেশের মতো।
নিকটে গেলাম আমি, দেখলাম, সে পরীক্ষারত
মৃত মানুষের শাদা হাত, পা, মাথার হাড় নিয়ে,
সবুজ ঘাসের পরে রাখলো সাজিয়ে।
বললো, “কবরে শুয়ে ছিল এই রূপবতী নারী,
সে যদি জীবিত হয়, অমি তাকে ফিরে পেতে পারি।”
[‘অরণ্যে একটি লোক’, অরণ্যে একটি লোক, ১৯৬৬]
কবির সাথে দেখা করার সৌভাগ্য একবারই ঘটেছিল এই রচনাকারের। দীর্ঘ সময় তিনি দিয়েছিলেন। আর পুরোটা সময় কথা বলেছেন কেবল কবিতা নিয়েই।
তাঁর সাথে তাঁর বাড়িতে যাওয়ার সময় দেখলাম খেয়ানৌকার মাঝি কবির সম্মানে কোনো টাকা নেন না। একদিনের জন্য নয়, কবির প্রতি এটি তাঁর স্থায়ী সম্মান জানানোর পদ্ধতি। হয়তো কোনোদিন তিনি কবির কোনো কবিতা পাঠ করেননি। কিন্তু কবিকে নিজের এলাকার গর্ব বলে ভাবতে পারার মতো মানসিকতা অর্জন করতে পেরেছেন এই খেয়ামাঝি। এতবড় প্রাপ্তি বাংলাদেশের আর কোনো কবির আছে?
কথা উঠেছিল নানা ধরনের কবিতা নিয়ে। বিপ্লবী কবিতার কথাও। তিনি বলেছিলেন, কবিতার বিপ্লব তো আলাদা জিনিস। কেমন আলাদা? তাঁর বক্তব্যের সারাংশ উপস্থাপন করলে এইরকম দাঁড়ায়--
যথেচ্ছ এবং অপরিণামদর্শী ব্যবহারে সমস্ত ঔজ্জ্বল্য ক্ষইয়ে ফেলা একটি শব্দ-- বিপ্লব। এই শব্দটি তার অন্তর্নিহিত দ্যোতনা ও চেতনা হারিয়েছে তথাকথিত ভঙ্গি ও স্লোগানসর্বস্ব রাজনীতিবিদদের হাতে ব্যাভিচারী প্রয়োগের মাধ্যমে। আজ শব্দটি পরিগণিত হচ্ছে শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক পরিভাষা হিসাবে। অথচ বিপ্লব হচ্ছে মানবজাতির গৌরবোজ্জ্বল অগ্রযাত্রার এক-একটি মাইলফলকের স্মারকচিহ্ন। মানবজাতির আবহমান পথ-পরিক্রমায় যতগুলি নতুন নতুন দরোজা উন্মোচিত হয়েছে, বিসর্পিল এই অগ্রযাত্রা যতগুলি মোড় পরিবর্তন করেছে, এবং ভবিষ্যতে করবে, সেই সবগুলি দরোজার উন্মোচন এবং মোড় পরিবর্তনই এক-একটি বিপ্লব। তাই ‘ বিপ্লবী’-- এই অভিধার চাইতে মৌলিক এবং গৌরবময় শিরোভূষণ আর কিছুই হতে পারে না।
দীর্ঘদিন থেকে আমরা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও গ্রন্থে, সভা ও সমাবেশে কারণে-অকারণে অহরহ উচ্চারিত হতে শুনছি ও দেখছি বিপ্লব শব্দটি। বিশেষভাবে লক্ষণীয়, এক ধরনের কবি ও কবিতার ক্ষেত্রে শব্দটি প্রয়োগ করা হচ্ছে। ভাবলে অবাক হতে হয়, তথাকথিত রাজনৈতিক কর্মীরা যেমন অপপ্রয়োগ ঘটাচ্ছেন ‘ বিপ্লব’ শব্দটির, বর্তমানের অনেক কবিতাকর্মী ও কাব্য-সমালোচকও সেই একইভাবে অর্বাচীন প্রয়োগ ঘটিয়ে চলেছেন শব্দটির। যাকে বিপ্লবী কবিতা হিসাবে অহরহ ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে, বিশেষায়িত করা হচ্ছে, তা বড়জোর সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বক্তব্য, প্রতিবাদী চেতনা ও স্লোগানধর্মী কবিতা হিসাবে আখ্যায়িত হবার যোগ্য। এই ধরনের কবিতা অধিকাংশই শিল্পমানবর্জিত। কোনো-কোনোটি শিল্পমান অর্জন করলেও তাকে ভালো কবিতা বলা যেতে পারে। কিন্তু এই জাতীয় কবিতা কখনোই শিল্পের ইতিহাসে বিপ্লবী কবিতা হিসাবে চিহ্নিত হতে পারে না।
তাহলে বিপ্লবী কবিতা আমরা কাকে বলব? কাকে বলব কবিতায় বিপ্লব?
মানবসভ্যতার একটি অঙ্গ বা উপাদান হিসাবে গ্রহণ করলেও নিঃসন্দেহে বলা চলে, মানবসভ্যতার সাথে কবিতার একটি দ্বান্ধিক সম্পর্ক বিদ্যমান। এরা একে অপরের পরিপোষক এবং পরিগ্রাহক। এই দুইয়ের গতিপথ কখনো অভিন্ন, কখনো সমান্তরাল, কখনো সামনে-পেছনে প্রবহমান। অর্থাৎ মানবসভ্যতার মতো কবিতাও চলিষ্ণু। তার নিজস্ব গতিপথ রয়েছে। আর গতিপথ রয়েছে বলেই গতিবৈচিত্র্য ও গতিপরিবর্তনও রয়েছে। সেই কারণেই জীবনের মতোই, জীবন্ত সবকিছুর মতোই কবিতারও রয়েছে বিবর্তন, এবং কোনো কোনো ঐতিহাসিক প্রয়োজনেও মুহূর্তে কবিতায় ঘটে যায় বিপ্লবও। বিবর্তন যেখানে নিয়মবদ্ধ অথচ দৃঢ়পায়ে অমোঘ নিয়তির মতো বর্তমানকে টেনে নিয়ে চলে ভবিষ্যতের দিকে, বিপ্লব সেখানে প্রচণ্ড উন্মাদনা এবং ‘সুশৃঙ্খল বিশৃঙ্খলা’র মাধ্যমে ভবিষ্যতকে টেনে এনে বসিয়ে দেয় বর্তমানের জায়গায়। উল্লেখ্য, বিপ্লবের প্রয়োজন হয় তখনই যখন বিদ্যমান পরিস্থিতি আর মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও প্রয়োজনকে মেটাতে সক্ষম হয় না। অর্থাৎ যখন বিদ্যমান পরিস্থিতি থাকে মানুষের প্রয়োজন এবং আকাঙ্ক্ষার তুলনায় অনেক বেশি পশ্চাৎপদ অবস্থায়। অন্যকথায়, স্থবিরতার পলি যখন বিবর্তনের নাব্যতা দিয়ে অপসারণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে, তখনই ত্রাণকর্তার ভূমিকায় আবির্ভূত হতে হয় বিপ্লব। অবশ্যই বিপ্লবের সফল সংঘটনের জন্য দুইটি অপরিহার্য শর্ত পূর্ণ হতে হবে। একটি হচ্ছে-- বিপ্লব আবশ্যক বা বিপ্লব অপরিহার্য, এরূপ একটি প্রত্যাশাপূর্ণ পারিপার্শ্বিক চাহিদার উপস্থিতি। যাকে এককথায় বলা যেতে পারে বিপ্লবী পরিস্থিতি বা অবজেকটিভ কন্ডিশন। অন্যটি হচ্ছে বিপ্লবের সফল সংঘটন, তাকে রক্ষা ও সংহত করার মতো মেধা-মনন-কর্মক্ষমতার সমন্বিত শক্তি বা সাবজেকটিভ ফোর্স। এই দুই শর্তের সম্মিলন না ঘটলে বিপ্লব সংঘটন অসম্ভব। প্রথম শর্তের অনুপস্থিতিতে দ্বিতীয় শর্ত অর্থাৎ বিপ্লবী শক্তির প্রয়োগ হঠকারিতায় পর্যবসিত হয়। অন্যপক্ষে দ্বিতীয় শর্তের অনুপস্থিতিতে প্রথম শর্ত হচ্ছে ফসলহীন বন্ধ্যাজমি। কাজেই বিপ্লব হচ্ছে চাহিদা এবং যথোপযুক্ত শক্তির প্রস্তুতির শুভ সম্মিলনের ফসল। এই মৌলসূত্রকে বিবেচনায় রেখে আমরা আমাদের কবিতায় সংঘটিত বিপ্লবগুলিকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করতে পারি। একই সাথে চিহ্নিত করতে পারি বিপ্লবী কবিতাকেও।
আগেই উল্লেখিত হয়েছে যে কবিতার একটি গতিপথ আছে। পলিবদ্ধতায় নাব্যতা হারানোর আশংকা দেখা দিলে সেই পথকে মোচড় দিয়ে নতুন পথে প্রবাহিত করাই বিপ্লবী কবির কাজ। মূলধারার গতিপথকে নতুনখাতে প্রবাহিত করার পাশাপাশি বিপ্লব খুলে দেয় অসংখ্য নতুন নতুন শাখামুখও। তাহলে যে সমস্ত কবিতা আমাদের কাব্যের গতিপথকে অন্ধচক্র থেকে রক্ষা করে উপহার দিয়েছে নতুন প্রবহমানতা, কিংবা খুলে দিয়েছে অজস্র নতুন পথচলার সম্ভাবনা-- একমাত্র সেইসব কবিতাকেই আমরা বিপ্লবী কবিতা বলে চিহ্নিত করতে পারি অসংশয়ে। আর সেইসব কবিতার স্রষ্টারাই বা জনক-কবিরাই অর্জন করতে পারে বিপ্লবী কবির অভিধা।
কবিতা রচনা বা কবিতার জন্মদানের মুহূর্তে কবি একক ও নিঃসঙ্গ। কিন্তু এই কথাটি শুধুমাত্র বাহ্যিকভাবেই সত্য। বিপরীতে বরং বলা চলে, নিঃসঙ্গ মুহূর্তগুলিতেই একজন সৃষ্টিশীল মানুষ সর্বাধিক সঙ্গী পরিবেষ্টিত থাকেন। তখন তাঁর সাথে থাকে তাঁর অধীত, ইন্দ্রিয়-অতিন্দ্রীয়লব্ধ যাবতীয় সুরের গুঞ্জন ও কাব্যের অনুরণন, যেগুলি তাঁর পূর্বজ ও সমকালীন কবিদের সৃষ্টি, তার সাথে থাকে তাঁর ভাষার কাব্যের ঐতিহ্যের সারাৎসার, থাকে দেশ-কাল-সমাজ-আন্দোলন-রাষ্ট্রকাঠামো-সমাজকাঠামো-দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ। আর থাকে তাঁর অন্তর্দিৃষ্টিতে উপলব্ধ ভবিষ্যতের হাতছানি। অর্থাৎ ঐতিহ্য এবং বর্তমানকে গভীরভাবে অনুধ্যান করে পায়ের নিচের মাটি শক্ত করে গেঁথে তাঁকে সাড়া দিতে হয় ভবিষ্যতের ডাকে। সেই কাজে সফল হলেই মাত্র একজন কবি ঘটাতে পারেন কবিতায় বিপ্লব। এই দুরূহ শৃঙ্গ-আরোহনের সফলতা এত ভুড়ি ভুড়ি সৃষ্টি হয় না যে আমরা যত্রতত্র বিপ্লবী কবিতার অভিধা প্রয়োগ করতে পারি। কাজটি দুরূহ বলেই ভালো বা মানসম্মত কবিতার সংখ্যা নেহায়েৎ কম না হলেও বিপ্লবী কবিতার সংখ্যা হাতে গোণা যায়। পৃথিবীর সবদেশে সবযুগে সবভাষার ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ্য। মালার্মে বহুদিন পর্যন্ত ছিলেন তাঁর পূর্বসূরিদের কাব্যধারার অনুকারী চর্চাকার। কিন্তু যখন তিনি স্থির উপলব্ধিতে উপনীত হলেন যে ‘কবিতা লিখতে হয় আইডিয়া দিয়ে নয়, শব্দ দিয়ে’ তারপরেই তিনি আঙ্গিকগতভাবে কবিতার বিপ্লব সংঘটনের পথ খুঁজে পেয়েছিলেন। আইডিয়া বা বিষয়নির্ভরতার অচলায়তন থেকে মালার্মের হাতে মুক্তি অর্জন করল কবিতা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিজীবনের শুরুতে ছিলেন বিহারীলালের গীতিকবিতার দক্ষ ও সনিষ্ঠ অনুকারক। কিন্তু যেদিন তিনি ময়ূরপুচ্ছের আবরণ সরিয়ে আবিষ্কার করলেন ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ তখন থেকেই তিনি পরিণত হলেন বিপ্লবী এক কাব্যধারার জনক হিসাবে। পরবর্তীতে এই রবীন্দ্রনাথের সর্বগ্রাসী প্রতিভার দ্বারাই বাংলা কবিতার সর্বনাশ ঘটতে যাচ্ছিল। তাঁর সার্বভৌম প্রতিভা এবং তুলনারহিত শ্রমের ফসল হিসাবে জন্ম হলো বাংলা কবিতার এক সুবিশাল মানসহ্রদ। কিন্তু হ্রদ যত বিশালই হোক না কেন, শেষবিচারে তা বদ্ধ এবং গতিহীন। ধারণা করা হয়েছিল, এই রবীন্দ্রহ্রদই বাংলা কবিতার শেষকথা। রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা কবিতায় আর কোনো পথ-পরিবর্তন, এমনকি পথচলারও অবকাশ নেই। এই বদ্ধদশা থেকে বাংলা কবিতাকে মুক্ত করলেন নজরুল-সুধীন দত্ত-বুদ্ধদেব বসু-বিষ্ণু দে-অমিয় চক্রবর্তী, এবং অবশ্যই উচ্চার্য আরেকটি নাম জীবনানন্দ দাশ। এঁরা খুলে দিলেন বাংলা কবিতার নতুন নতুন মুখ। শুধু খুলেই দিলেন না; অক্লান্ত জলসিঞ্চনে নাব্যতা দিলেন সেই গতিপথকে। সেই কারণেই উল্লিখিত কবি-স্রষ্টাদের অনেক কবিতাই বিপ্লবী কবিতার শর্ত পূরণ করে বিপ্লবী অভিধায় চিহ্নিত হবার যোগ্যতা অর্জন করেছে। শেষোক্ত কবিদের পশ্চিমমুখিনতার প্রবণতা দোষাবহ হলেও তাঁদের এই কৃতিত্বের স্বীকৃতি আমাদের দিতেই হবে।
এইসব চিরন্তন কষ্টিপাথরকে পাশ কাটিয়ে আমরা অহরহ এমন সব কবিতাকে বিপ্লবী কবিতার আখ্যা দিয়ে চলেছি, যেগুলো আমাদের মূঢ়তাকেই সর্বাংশে প্রমাণ করে। কবিতায় সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় বিপ্লবর আহবান উচ্চারিত হলেই তাকে আমরা বিপ্লবী কবিতা হিসাবে চিহ্নিত করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। এই ধরনের কবিতা যে বিপ্লবী কবিতা হতে পারে না, তা নয়। হতে যে পারে, পাবলো নেরুদার কবিতাই তার প্রমাণ। কিন্তু বিষয়বস্তুর পাশাপাশি খেয়াল রাখতে হবে, কবিতার এযাবতকালের পথ-পরিক্রমায় এই কবিতা কতখানি নতুনত্বের সঞ্চার করতে সমর্থ হয়েছে। নতুনত্ব সব জায়গাতেই-- গতিতে, বিষয়ে, অঙ্গসৌষ্ঠবে। এইসব শর্তকে পূরণ করতে পেরেছিল বলেই পাবলো নেরুদা, মায়াকোভস্কি, পল এলুয়ারের কবিতা বিপ্লবী কবিতার অভিধা অর্জনে সক্ষম হয়েছে।
কবিতার বিপ্লব কোনো সশব্দে বিস্ফোরিত ঘটনা নয়। এই বিপ্লব ঘটে নিঃশব্দে। কিন্তু তাতে এই বিপ্লবর গুরুত্ব বা গৌরব কমে যায় না। এক মুহূর্তের নৈঃশব্দ যে সহস্র আর্তচিৎকারের সমষ্টি হতে পারে তা কী আমরা কবিতা-কর্মীরা জানি না!
তবে ‘তিরিশের পঞ্চকবি’ বিষয়টিকে একটি প্রজেক্ট বলেছিলেন ওমর আলী। তিরিশের জীবনানন্দকেই কেবল সত্যিকারের কবি বলতে রাজি ছিলেন তিনি। সুইনবার্ন, ইয়েটস, এলিয়টের ভূয়সী প্রশংসা করলেও তাঁদের যান্ত্রিক অনুসরণকারী বুদ্ধদেব বসু বা অমিয় চক্রবর্তীকে খুব একটা পছন্দ করতেন না তিনি।
নিজের কবিতা সম্পর্কে কিছু বলেননি তিনি। প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন-- ওটা আপনারা বলবেন।
আমিই বা কী বলতে পারি!
এইটুকু বুঝি যে ওমর আলী কবিতাকে মিছিল করতে পাঠাননি, রাজপথে স্লোগান দিতে পাঠাননি। তিনি তাঁর কবিতাকে বসতে দিয়েছেন পাঠকের খুব ঘনিষ্ঠ পাশে। এতটাই পাশে, যেন পাঠক ক্লান্তিতে নুয়ে পড়লে কবিতার কাঁধে রাখতে পারেন মাথা।